স্মৃতি
হারিয়ে যাওয়া রুমালের রঙ
সোহানুর রহমান শাহীন
চারভাঁজ করে প্যান্টের পকেটে প্রতিনিয়ত রাখা বস্তুটির নাম রুমাল। অধিকাংশ মানুষের বিভিন্ন কাজে ব্যবহারে আজো নিরলসভাবে চলছে রুমাল। প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে যেমন, সৃষ্টির শুরু থেকে এখন অব্দি আছে। সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ নানাভাবেই ঘটে থাকে। যতদিন মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে ততদিন ভালোবাসাকে প্রকাশ করে। কখনও চোখে চোখ রেখে কখনও বা আড়ালে থেকে। আগের যুগের মানুষ নানা কায়দায় ভালোবাসা প্রকাশ করতো এবং বিভিন্ন ধরনের উপহার দিত। কালের বিবর্তনে জায়গা করে নিয়েছে অনেক অনেক দামী সব উপহার। কিন্তু আগের সেই মিষ্টিমধুর ভালোবাসার ছোট ছোট ভালোলাগার তুলনা কি এই যুগের নোটপ্যাড কিংবা আইফোন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? প্রেমের ক্ষেত্রে প্রায় হারিয়ে যাওয়া রুমাল বিষয়ক চিন্তা করলে বেরিয়ে আসে- ‘রুমাল দিলে ঝগড়া হয়’, এই কথাটি আগে প্রচলন ছিল, তার পরও প্রেমিকারা বিভিন্ন নকশার রুমাল উপহার দিতো, তাতে অল্প কথায় লেখা থাকতো তাদের মনের কথা, ভালোবাসার কথা। বিভিন্ন নকশা কেটে শৈল্পিক রূপদানের মাধ্যমে ফুলের প্রতিচ্ছবি অথবা প্রেমিকের নাম সাদৃশ্য সাদা রুমালের উপর রঙ বে-রঙের সুতায় বুনে দিতো। ভালোবাসার জোড়ালো বন্ধন আরো গাঢ়ো হতে সাথে দিয়ে দিতো লিপস্টিক ঠোঁটে চুম্বনের আলপনা।
বিয়েতে বরের মুখে রুমালঃ আগের বিয়েতে বর কনের বাড়িতে প্রবেশ করার সময়ে মুখে রুমাল ব্যবহার করতেন, কি গ্রাম- কি শহর কোনও ভেদাভেদ ছিল না। বলা যায় যে, আগেকার ছেলেরা বিয়েতে বেশ লজ্জাবোধ করতেন। এছাড়া কনের বাড়িতে শালীরা বিভিন্ন ধরনের ঠাট্টা তামাশা করে বরের লজ্জা ভাঙ্গানোর চেষ্টা করতো। বরের লজ্জাভরা মুখটি যেন শালীরা সহজে দেখতে না পায় সে জন্য মুখে সব সময় রুমাল ব্যবহার করতেন। আবার দেখা যায় যে, বর যদি শালীদের বিভিন্ন ঠাট্টা তামাশায় হেসে ফেলতেন তাহলে তাকে নির্লজ্জ জামাই বলে খেতাব দিতেন সেকেলের নানা-দাদারা। এজন্য বিয়ের আসরে বরকে দীর্ঘ সময় মুখে রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে লজ্জা সামাল দিতে হতো। তবে বরের মুখে রুমাল ব্যবহারের সংস্কৃতি বাঙালি সমাজে লক্ষ্যণীয়, এটি বাঙালি কৃষ্টির মধ্যে পড়েছে। বিভিন্ন দেশে যেমন বিভিন্ন রকম সংস্কৃতি প্রচলিত ঠিক তেমনি নতুন জামাইয়ের মুখে রুমাল দেয়ার বিষয়টি এদেশেরই বলা চলে। এই সংস্কৃতি পাশ্চাত্যে যেমন দেখা যায় না তেমনি আধুনিক কালের বাঙালি সমাজেও লক্ষ্য করা যায় না। তার কারণ হতে পারে, মানুষ অনেক বেশি সভ্য আর সচেতন হয়েছে। যেকোনো ধরনের লজ্জাশীল বিষয়গুলোকে তারা এখন এনজয় করতে শিখেছে।
কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ-এর রুমালঃ প্রয়াত কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ অত্যন্ত বিনয়ী মানুষ ছিলেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবাধ বিচরণ করে কলমের ডগায় তুলে এনেছেন সাবলীল নৈপুন্যতা, বিলিয়ে দিয়েছেন প্রজন্মের হাতে শব্দের ঝুড়ি। কবি হিসেবে উচ্চ আসনে অবস্থান ছিল হরহামেশায়। তাঁর রুমালের ব্যবহার সম্পর্কে আমার দেখা কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সাহিত্যের অনুষ্ঠানগুলোতে যখনই তিনি গিয়েছেন, সঙ্গে নিয়েছেন নিজের বাগান থেকে তুলে আনা বিভিন্ন রকমের তাজা ফুল, আর সেই ফুলগুলো নিতেন রুমালে বেঁধে। মঞ্চ অথবা সাপ্তাহিক সাহিত্য আসরে বসেই তিনি ফুল সম্বলিত রুমাল মেলে দিতেন, ফুলের সুবাস ছড়িয়ে সুবাসিত হতো পুরো সাহিত্য আসর অথবা হলরুম। তিনি আমাদের মাঝে নেই অথচ রুমাল বিষয়ক রচনাটি লিখতে গিয়ে হাজির হলো তাঁর স্মৃতি। আল্লাহ্পাক তাঁকে বেহেস্ত নসীব করুন। আমীন।
দিনমজুরের রুমালঃ দিনমজুরের রুমাল ব্যবহার একটি পুরাতন কৌশল। সারাদিন শ্রম দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ যদি চোখ আটকে যায় দরকারি দ্রব্যের দিকে, চটপট তা কিনে রুমালের মধ্যে চার মাথায় গিট দিয়ে রিকসা নয়তো বাইসাইকেল যোগে রওনা দেন গন্তব্যের দিকে। তারা সামান্য সদাইয়ে চটেরব্যাগ অথবা বাতিল হয়ে যাওয়া পলিথিনের দিকে পরওয়া না করে নিজ পকেটে থাকা রুমাল অনায়াসে ব্যবহার করেছেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে।
গ্রামের স্কুল শিক্ষকের রুমালঃ সেদিন গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখ আটকে যায় গ্রাম্য প্রাইমারী স্কুল শিক্ষককে দেখে। পাজামা-পাঞ্জাবী পরিহিত শিক্ষক মহাশয় বাইসাইকেলের টুংটাং শব্দে বেল বাজিয়ে ছুটছেন পাঠদানের জন্য স্কুল অভিমুখে। টুংটাং শব্দে ছুটে আসা বাইসাইকেলকে সাইড দিতে গিয়ে পিছনে ফিরে দেখি বয়স্ক শিক্ষক ভদ্রলোক চেইন কভারহীন বাইসাইকেলে, কালিযুক্ত চেইন প্যডেলের সাহায্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গতি বাড়াচ্ছেন। হায় হায়! ভদ্রলোকের পায়ের দিকে তাকাতেই অবাক। পায়ের গোড়ালী থেকে একটু উপরে পাজামাসহ সুন্দও ভাবে রুমাল দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে গিট দিয়েছেন। চেইনে থাকা মবিল অথবা গ্রীজের কালি যেন পাজামা ছুঁতে না পারে, সেজন্য গ্রামীণ পদ্ধতিতে রুমালের ব্যবহার অনিবার্য হয়েছিল শিক্ষক ভদ্রলোকের জন্য।
নামাজের জন্য রুমালঃ নামাজর জন্য বেশ প্রচলন আছে রুমালের। মসজিদে ওযু শেষ করার পর রুমাল দিয়ে হাত-মুখ মুছবার জন্য রুমাল অত্যন্ত জরুরি হয়। যদিও ওযুর পানি শুকানোর জন্য দু’রাকাত নামাজ আদায়ের বিধান রয়েছে মহাগ্রন্থে। টুপি সঙ্গে নেই! মসজিদ বা নামাজ ঘরে টুপি মিলছে না। এসব ক্ষেত্রে রুমাল সঙ্গে থাকলে তা দিয়ে মাথা ঢেকে নামাজ আদায় করা যায়। অর্থাৎ নামাজের সময় টুপি পড়াকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে ইদানিং খালি মাথা অথবা রুমাল মাথায় নামাজ আদায়ের প্রচলন অনেক বাড়ছে।
ম্যাজিশিয়ানের রুমালঃ ছোটবেলা স্কুলে অথবা রাস্তার পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ম্যাজিক দেখেননি এমন লোক খুব কম খুঁজে পাওয়া যাবে। রাস্তায় চলতে গেলে অনেক সময় মানুষের জটলা দেখে কৌতুহল জাগে- সেখানে কি ঘটনা ঘটছে, কাছে গিয়ে দেখা মেলে ম্যাজিশিয়ানের। তারা একান্ত নিজের মতো করে পরিবেশ বুঝে প্রদর্শন ভঙ্গির মাধ্যমে ম্যাজিক দেখান। উপস্থিত জটলা করা দর্শনার্থীদের চোখে তাক লাগিয়ে দেন ম্যাজিকের কারিশমায়। হাতের রুমালকে কখনো হরিয়ে ফেলেন ম্যােিজকর মাধ্যমে, আবার সেই রুমাল হঠাৎ বেরিয়ে আসে ম্যাজিশিয়ানের হাতে নয়তো দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা তাদের নিয়োগকৃত দর্শকদের পকেট থেকে। আবার চিকন বাঁশের চোঙ্গার এক মাথায় কালো রুমাল প্রবেশ করিয়ে অন্য মাথা দিয়ে বের করে আনেন ফুল তোলা সাদা রুমাল। সরাসরি অথবা টিভি শো’তে আমারা দেখে থাকি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ম্যাজিকে ম্যাজিশিয়ানরা রুমালের উপর অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
পুলিশের রুমালঃ ‘পুলিশ জনগনের বন্ধু, সেবাই পুলিশের ধর্ম,’ এমন শ্লে¬াগান সম্বলিত প্লেকার্ড পুলিশের বিভিন্ন অনুষ্ঠান অথবা পুলিশ লাইনের বারান্দায় চোখে পড়ে থাকবে অনেকের। দিনরাত পরিশ্রমের মাধ্যমে পুলিশ জনগনের সেবা দিয়েই চলছেন। চোর, গুন্ডা-বদমায়েশ, খুনী ছিনতাইকারীসহ অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের ধরে কোর্টে চালান দেবার মতো কাজে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকেন তারা। বিশেষ করে খুনের কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের সময় অনায়াসে পকেট থেকে নিজের ব্যবহৃত রুমাল বের করে উদ্ধারকৃত অস্ত্র হাত তুলে নেন। রুমাল দিয়ে অস্ত্র ধরার ফলে অস্ত্রে লেগে থাকা আঙ্গুলের ছাপ খুনীর আঙ্গুলর ছাপের সাথে মিলিয়ে সহজেই চিহ্নিত খুনীকে সনাক্ত করে থাকেন পুলিশ। তাই উদ্ধারকৃত অস্ত্রে রুমালের ব্যবহার অতি জরুরি।
রুমাল ফেলে ফাঁসিঃ একটি রুমালের ইশারায় একজন মানুষের জীবনাবসান ঘটে মাত্র কয়েক মিনিটে। কারাগারে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর ক্ষেত্রে- প্রথমে কনডেম সেলে গোসল করে তওবা পড়ানো হয়, এরপর জল্ল¬াদ পেছন দিক থেকে হাত বেঁধে মাথায় কালো রঙের জমটুপি পড়ান। সিঁড়ি বেয়ে মুলমঞ্চে নিয়ে জমকুপ ঢাকা কাঠের পাটাতনে তোলা হয়। সেখানে দাঁড় করিয়ে দুই পা কাপড়ে বেঁধে ফাঁসির দড়ি পড়িয়ে দেন গলায়। কাজগুলো সম্পন্ন করার পর ফাঁসির লিভারের কাছে অবস্থান নেন প্রধান জল¬াদ। তখন সেখান ডাক্তারসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সামনে ম্যাজিষ্ট্রেট একহাত উঁচিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন আর এক হাতে সাদা রুমাল। জল্লাদের দৃষ্টি রুমালের দিকে আর ঘড়ির কাঁটার দিকে দৃষ্টি মেেিষ্ট্রটের। ম্যাজিষ্ট্রেট হাত থেকে রুমাল ফেলে দেবার সাথে সাথে লিভারে টান দিয়ে ফাঁসির আদেশ পালন করা হয়। রুমাল এমন একটি বস্তু যেটা হাত থেকে ফেলে দিলে একজন মানুষের জীবনাবসান ঘটে মুহূর্তের মধ্যে।
ইন্টারনেট তথ্যে রুমালঃ নতুন প্রজন্ম হয়তো জানেই না বৃটিশ মুক্তির আজাদি কতো সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল। ইংরেজ গোয়েন্দা ও শত্রু বাহিনীর কড়া পাহারায়ও তথ্য ফাঁস হবার ভীতি থেকে মাওলানা আমির নসরুল্লাহ খান চুক্তির বিষয় ও তারিখ দক্ষ কারিগর দিয়ে একটি রেশমি রুমালে সুতার সাহায্যে আরবী ভাষায় লিখে দিলেন। শত্রুর চোখ ও তল্লশি নির্বিঘ্ন করার জন্য এই অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণ করে একজন নিষ্ঠাবান ভক্তকে দিয়ে মক্কায় শায়খুল হিন্দ বরাবর পাঠাবার ব্যবস্থাকরা হয়। অনেকগুলো হাত বদল হয়ে রুমালটি শেখ আব্দুর রহিম এর হাতে পৌঁছে। তিনি হজ্জে গিয়ে রুমালটি শাইখুল হিন্দের হাতে দেয়ার কথা।
রুমালের না বলা কথাঃ রুমাল নিয়ে লিখতে গিয়ে নিজের ব্যবহৃত রুমাল ভিজে জবুথবু অবস্থা। এর কারণটা আপাততঃ তাদের তালিকায় রেখে দিতে চাই- যারা হাট-ঘাট বাজার-বন্দর ক্ষেত-খামার এমন কি ঝোপের আড়াল পর্যন্ত প্রকাশ্যে অথবা গোপনে রুমাল ব্যবহার করে স্মৃতির আলনায় সাজিয়ে রেখেছেন। এবার গোপন রহস্য অনুন্মোচিত রাখবার খাতিরে নারীদের রুমাল ব্যবহার অমুদ্রিত রেখে শেষ করা যায় কিনা ভাবছি…।