সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৯ অপরাহ্ন

স্মৃতিগদ্য # বাবা, তোমার জন্য-হাস্না ফাহ্মিমা হক

স্মৃতিগদ্য # বাবা, তোমার জন্য-হাস্না ফাহ্মিমা হক

প্রফেসর ড. মুহম্মদ রেজাউল হক, যাঁর নামটা উচ্চারণ করলেই নিজেকে অনেক ভাগ্যবান ও গর্বিত মনে হয়। কারণ তিনি শুধু একজন আদর্শ পিতা ও সফল শিক্ষকই নন, একাধারে তিনি একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, সমাজসেবক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, দক্ষ সংগঠক এবং সর্বোপরি একজন আলোকিত মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাসী এবং মুক্তচিন্তা ও মনণের অধিকারী আমার বাবার জীবনাদর্শই হলো সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও সময়ানুবর্তিতা।
বাবা জন্মেছিলেন ৬ ফালগুন, ১৩৪০ (১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪) সালে চিলমারীর ঐতিহ্যবাহী মিঞাবাড়িতে। তাঁর পারিবারিক পরিমণ্ডলটা ছিল বেশ আলোকিত এবং তাঁদের পরিবারের পরিচিতিটাও ছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অনন্য।
আমার দাদা আলতাফুল হক কোলকাতার ক্যামবেল মেডিকেল স্কুলে পড়েছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং অতঃপর ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলে যোগদান করেন। পরবর্তীতে চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি তিনি আজীবন সমাজসেবায় ব্রতী ছিলেন। আমার দাদি জোবেদা খাতুনও সে সময়ে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন সামাজিক অঙ্গনে। ১৯৫১ সালে চিলমারীতে যখন প্রথম মহিলা সমিতি গঠিত হয়, তিনি ছিলেন তার সভানেত্রী। এমন একটি পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণেই বাবা হয়ত আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছেন।
বাবার স্কুলজীবনটা কেটেছিল চিলমারীতেই। সেখানকার চিলমারী ইংলিশ উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি লেখাপড়া করেছিলেন। ১৯৫০ সালে তিনি মেট্রিকুলেশন স¤পন্ন করেন কৃতিত্বের সাথে। কারণ সে সময় প্রথম বিভাগে লেটারসহ পাস করা ছিল বিরল দৃষ্টান্ত। পড়াশোনার প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহের কারণে চলে আসেন রংপুরে এবং ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজে আইএসসি’র জন্য। কিন্তু ভর্তির পরপর সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা ও শিক্ষক সংকটের কারণে তাঁদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রটা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে যায়। ৫২ এর ভাষা-আন্দোলনের পর পরীক্ষা শুরু হয় কিন্তু এবারে তাঁর পূর্বের মতো আশানুরূপ ফল হলো না। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগে এবং স্নাতকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। সেখানে শিক্ষক হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এবং আহমেদ শরীফের মতো বিখ্যাত শিক্ষাবিদদের। ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন সিলেট শহরের মদনমোহন কলেজ হতে। সেখান থেকে তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন সময় বদলি হন এবং তাঁর কর্মময় জীবনের কিছু না কিছু অবদান রেখে আসেন।
১৯৭১ সাল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বছর, বাঙালির জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। সে সময় বাবা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন এবং কবিতা লিখতেন দেশের জন্য। এর মধ্যে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার একটি কবিতা সংকলনে। তাঁর লেখা সেই কবিতা পাকবাহিনী উর্দুতে অনুবাদ করে পড়ার পর তাঁকে খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। হামলা চালায় গাইবান্ধার একটি গ্রামে যেখানে আমাদের পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল কয়েক মাসের জন্য। কিন্তু হানাদারবাহিনীর শুধুমাত্র একটি কক্ষই বাদ পড়েছিল হামলার সময় আর আমার বাবা ও আমাদের পরিবার বেঁচে যায় ভাগ্যক্রমে। সেইসময় ভারতীয় কিছু পত্রিকায় তাঁর নাম ছাপা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবির তালিকায়।
১৯৭৭ সালে তিনি পিএইচডি’র জন্য মনোনীত হন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এবং তাঁর গবেষণার কাজটি তিনি স¤পন্ন করেন ভারতের কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে তাঁর এই গবেষণার কাজটি বই আকারে প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮৯ সালে। এখানে উল্লেখ্য যে, তাঁর আরও একটি কবিতার বই ‘শোকাতুর সংগত’ প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। পিএইচডি শেষে তিনি আবার ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় শহর রংপুরে। এই মোহহীন মানুষটি তাঁর কর্মজীবনে অনেকবার বিভিন্ন লোভনীয় কর্মপ্রস্তাব পেয়েছিলেন, এর মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ পদের কথা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু রংপুরের মায়া তিনি কোনোভাবেই কাটাতে পারেননি। তাঁর কর্মজীবন শেষ করেন রংপুরের কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে।
বর্তমানে রংপুরে হয়ত খুব কম সংখ্যক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে যার সাথে তাঁর স¤পৃক্ততা নেই। এখন তিনি রংপুর ডায়াবেটিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি পরিচালনা কমিটির আজীবন সদস্য। ছিলেন ল কলেজ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সদস্য এবং আরডিআরএস-এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। এসবের বাইরেও এই মানুষটি যে কতটা পরোপকারী, তা বললে হয়ত তাঁর কাজগুলোকে ছোটো করা হবে, তবে না বললে তাঁর প্রতি অন্যায় করা হবে। তিনি তাঁর গরিব ছাত্রছাত্রীদের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা থেকে তাদের স্বনির্ভর হওয়ার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছেন প্রচুর। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী পরিবার, যখনই কেউ কোনো আর্থিক সমস্যায় পড়েছে তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুধুমাত্র সাময়িক উপশমের জন্য না, তাদের পায়ের নিচে শক্ত জায়গাটা তৈরির জন্যও তাঁর অবদান কম না। তাঁর প্রাপ্তির খাতাটাও অবশ্য খুব ছোটো নয়। তিনি ১৯৯০ সালে সরকার কর্তৃক শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পদক পান। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা পেয়েছেন বহুবার।
তাঁর কর্মময় জীবনের কথা আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে বাবা হিসেবে তাঁর কিছু কথা না বললেই নয়। আমার দৃষ্টিতে বাবা হিসেবে এক কথায় তিনি অসাধারণ। আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে আমি সর্বকনিষ্ঠ, তাই তাঁর অপত্য স্নেহের বেশিরভাগটাই ছিল আমার দখলে। একটা ঘটনার কথা সবসময় মনে পড়ে, আমার তখন ৩ অথবা ৪ বছর বয়স, আমরা থাকতাম কারমাইকেল কলেজ ক্যা¤পাসে। আম ছিল আমার ভীষণ প্রিয় ফল, গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন আম আমার চাই। তাই বাবা বাধ্য ছেলের মতো সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁড়িয়ে থাকতেন বাসার সামনে, কখন আমওয়ালা এ পথ দিয়ে যাবে আর তিনি তাঁর মামণির জন্য আম কিনবেন। এই স্নেহে হয়ত শুধুমাত্র বাবা-মার কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব। আর আজ যে আমার এই ডাক্তার হয়ে ওঠা, তারও সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো আমার বাবা-মার ইচ্ছা। প্রথমে মেনে নিতে পারিনি ডাক্তারী পড়ার ব্যাপারটাকে, তবে এখন বুঝি তাঁদের ইচ্ছায় সাড়া দিয়ে ভুল করিনি। আর আজ যে মানসিকতায় আমরা ভাইবোনেরা সমৃদ্ধ হয়েছি, তার জন্য সবচেয়ে বড়ো অবদান এই দুজন মানুষের। আমার বাবা আমাদের জন্মদিনে কখনই বইয়ের বাইরে অন্যকিছুকে উপহার হিসেবে গণ্য করতেন না আর আমরাও তাঁর এই উপহারের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।
বাবা হিসেবে তাঁর আর একটা অনুপ্রেরণার কথা অনস্বীকার্য, তা হলো আমার পরীক্ষার সময়গুলো। তাঁর সে সময়ের কিছু কথা যা তিনি আমাকে পরীক্ষার হলে যাবার সময় বলতেন আর আমি সেগুলো আওড়াতে আওড়াতে ভীরু পায়ে হলে ঢুকতাম। সে সব উক্তি এখনও আমার প্রতিদিনের কঠিন সময়গুলোতে কানে বাজেÑ‘তুমি কারো চেয়ে কম না, কাজেই পারব না, এই কথাটা কখনও বলবে না।’ আর কবিগুরুর এই উক্তিটা মনে করবে যা তোমাকে অনেক সাহস যোগাবেÑ‘আমি ভয় করব না, ভয় করব না। দু-বেলা মরার আগে মরব না, ভাই মরব না।’ যা আমার মেডিকেল জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করেছে। আর এখন বলেনÑ‘পারলে মানুষের জন্য কিছু করো।’
বাবা, তুমি আমার আদর্শ। তুমি যেমন সততা আর নিষ্ঠার ব্যাপারে কখনও আপোষ করোনি, আমিও যেন তেমনই থাকতে পারি, তোমার এই আশীর্বাদ যেন সবসময় থাকে আমার জন্যে। তুমি আরও একশ বছর বেঁচে থাকো আমাদের জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য।

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge