সেই রাতের কথা বলছি
অসীমা ভৌমিক
২৭ মার্চ ১৯৭১। বিকেল ৪টা। হঠাৎ গাড়ির শব্দ। উঁকি মেরে দেখলাম বাড়ির সামনে পাক আর্মির গাড়ি। মুহূর্তেই আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেললো ওরা। দরজা ধাক্কা দিয়ে বললো মন্টু ঘরে আছে কিনা। দরজা খুলতে মুহূর্তেই ঘরে প্রবেশ করে তারা বাবাকে বলেÑক্যান্টনমেন্টে যেতে হবে। এই কথা বলে বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও বাবার খোঁজ মেলেনি।
এরপর ৩ এপ্রিল দিবাগত ভোরবেলা অনেক গুলির শব্দ। আতঙ্কে বাড়িতে মা, ভাই-বোনেরা বসে কাঁদছি। পরে জানতে পারি, শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সেখানে বাবার লাশও নাকি আছে।
১৯৭১ সালে রংপুর শহরের দখিগঞ্জে গণহত্যার সময়কার স্মৃতি মনে পড়লে আজো শিউরে উঠি। আমার বাবা রংপুর শহরের তাজহাট বাবুপাড়ার দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক ওরফে ডা. মন্টু ভৌমিককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী।
পরদিন ৪ এপ্রিল লোকজন দখিগঞ্জ শ্মশানে গিয়ে লাশের স্তুপে বাবার লাশ পাননি। গণহত্যার হাত থেকে ভাগ্যচক্রে বেঁচে গিয়েছিলেন বাবা। পরে বাবার মুখে ওই দিনের লোমহর্ষক ঘটনা শুনেছিলাম।
ওই দিন বাবাসহ ১১ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দখিগঞ্জ শ্মশানে চোখ-হাত বেঁধে তাঁদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে পাকিস্তানি বাহিনী। মুহূর্তেই সবাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ১০ জন মারা যান। বাবার পায়ে ১১টি গুলি লেগেছিল। পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে ভোরের সূর্য ওঠার আগেই হামাগুড়ি দিয়ে দখিগঞ্জ শশ্মানের পাশের আরডিসিসিএস লিমিটেড এর চিফ ক্যামিস্ট জাফর চাচার বাড়িতে আশ্রয় নেন।
পরে বাবার মুখে জানতে পারি জাফর চাচা লোকজনের সহায়তায় বাবাকে রিকশা দিয়ে লালমনিরহাট জেলার কাকিনা দিয়ে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। কাকিনায় গেলে সেদিন ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গাড়ি যোগে দেশে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার নিয়ে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন।
পরে ঘটনাটি শুনে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের গাড়িতে করে বাবাকে ভারতের কুচবিহারের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। সেখানে বাবার চিকিৎসা করায় ভারতে অবস্থানরত আমার বড়োমামা। পত্রিকা মারফতে আমার বাবার ঘটনাটি শুনে তারা হাসপাতালে যোগাযোগ করে বাবাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। আমরা তখন বাবার এসব কোনো কথাই জানতে পারিনি।
বাবার মুখে আরও শুনেছি বাবাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের একটি সেলে আটক রেখে আওয়ামী লীগের নেতাদের নাম বের করার জন্য অনেক টর্চার করা হয়। তাকে এসময় কোনো খাবারই দেয়া হতো না। তবে ক্যান্টনমেন্টে সেসময় বাঙালি অফিসার ও জোয়ান যারা পাক আর্মির ভয়ে মুখ খুলতে পারতেন না তারা তাদের খাবার চুপ করে বাবাকে খাওয়ার জন্য দিয়ে যেত। এছাড়া পাক আর্মিরা এত টর্চার করেছিল যে বাবা উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারতেন না এবং নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়লেও সেদিকে তারা কোনো ভ্রুক্ষেপই করতো না। চালিয়ে যেত নির্যাতন।
একদিন পাক আর্মিরা শ্যামপুর থেকে এক দরবেশকে ধরে নিয়ে বাবাকে ক্যান্টনমেন্টের যে সেলে রাখা হয়েছিল সেই সেলে নিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যায়। এরপর ওই দরবেশ বাবাকে তার কাছে ডাকেন এবং মাথায় হাত দিয়ে অনেকক্ষণ বিড়বিড় করে কী যেন বলে জোরে একটি থাপ্পড় মারেন। এতে বাবা মারের চোটে ছিটকে দূরে পড়ে যান। এসময় ওই দরবেশ বাবাকে বলেন, যা তোকে কেউ মেরে ফেলতে পারবে না।
সেই কথাটিই সত্য হয়েছিল। ৩ এপ্রিল মধ্যরাতে বাবাসহ যখন ১১ জনকে গাড়িতে তুলে রংপুরের দখিগঞ্জ শশ্মানে নিয়ে যাওয়া হয়। সবাইকে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি চালালেও অন্য সবাই মারা গেলেও বাবা তখনই গুলি বিদ্ধ হননি। পরে পাক আর্মিরা দখিগঞ্জ শশ্মান থেকে মূল রাস্তায় উঠে আবার ফিরে আসেন এবং বলতে থাকে গুলি খেয়েও যদি কেউ বেঁচে থাকে তাহলে পাক আর্মির দুর্নাম হবে। এই বলে তারা আবারও মুহুর্মুহু গুলি চালাতে থাকলে বাবা পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। এরপর পাক আর্মিরা সেখান থেকে চলে গেলে বাবা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলে মাটিতে পড়ে যান। তখন বুঝতে পারেন, তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এরপর উপলব্ধি করেন কে যেন তার হাতের বাঁধন খুলে দিচ্ছে। তার হাতের বাঁধন মুক্ত হলে সকলের নাম ধরে ডাকতে থাকেন আর বলেন কেউ বেঁচে থাকলে চলো একসাথে পালিয়ে যাই। একথা বলে তিনি অনেকের শরীরে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলে দেখতে পান তাদের শরীর একবারেই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। এরপরও বাবা অনেককে ডাকলেও কেউ উত্তর না দিলে তিনি হামাগুড়ি দিয়ে তার বন্ধু জাফর চাচার বাসায় গিয়ে উঠেন এবং সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে জাফর চাচা ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ভারতে চলে যান।
ওদিনের সেই রাতে যাঁদের নির্মমভাবে ওই বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়েছিল, তাঁরা হলেন জররেজ আলী, মোহাম্মদ মহরম, গোপাল চন্দ্র, দুর্গাদাস অধিকারী, উত্তম কুমার অধিকারী, দুলাল মিয়া, রফিক আলী, ক্ষীতিশ হাওলাদার, শান্তি চাকী ও পাগলা দরবেশ।
এ ঘটনার পরপরই লোকজনের সহায়তায় রিকশাযোগে পালিয়ে যাই। প্রথমে আমরা সবাই (চাচারাসহ) রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বড়োবিল ইউনিয়নে বাবার এক রোগীর বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই আমাদের পরিবারের সবাই।
এদিকে, আমরা ৬ ভাইবোন আমি ডা. অসীমা ভৌমিক, বর্তমানে রংপুর নর্দান মেডিকেল কলেজে গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজ করছি; মেজোবোন রংপুর লায়ন্স স্কুলের প্রিন্সিপাল বুলা ভৌমিক, ভাই অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা, বোন রংপুর প্রতিবন্ধী স্কুলের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণা ভৌমিক, ভাই রংপুরের বিশিষ্ট সাংবাদিক বর্তমানে দৈনিক খোলাকাগজের রংপুর বিভাগীয় অফিস প্রধান সুশান্ত ভৌমিক সুবল এবং ছোটোভাই ডা. বিশ্বজিত ভৌমিক বিপ্লব বর্তমানে বারডেম হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত।
আমরা আমাদের মা কমলা ভৌমিক (বর্তমানে স্বর্গীয়) সহ ভাইবোন মিলে না খেয়ে না গোসল করে সে কি কষ্ট ভাষায় বলা যাবে না। অনেক কষ্টে গঙ্গাচড়ার বড়োবিল গ্রামের লোকজনের সহায়তায় আমাদেরকে ভারতে পৌঁছে দেয়া হয়। আমরা ভারতে গিয়ে ভারতের রেলে চাকুরিরত ছোটোমামার বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই। পরবর্তীতে আমরা অনেকদিন পর আমাদের বাবা বেঁচে থাকার খবর জানতে পারি। এরপর আমাদের বাবা ভারতের জলপাইগুড়িতে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরে তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের হয়ে হোমিও চিকিৎসক হিসেবে কাজে যোগ দেন। তিনি সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
পরবর্তীতে আমাদের বাবা ডা. দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক চাকুরি করার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবা কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি রংপুর লায়ন্স ক্লাবের হয়ে ভারতের লায়ন্স ক্লাবের ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দিয়ে দেশে ফেরার পথে কলকাতার দমদম এয়ারপোর্টে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে সেখান থেকে কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ দুতাবাসের কর্মকর্তা এবং রংপুর লায়ন্স ক্লাবের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় মরদেহ দেশে নিয়ে আসা হয়।