সিয়াম বা রোজা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি। যুগে যুগে প্রত্যেক নবী রাসূলগনের উম্মতের উপর সিয়াম পালন বাধ্যতামূলক ছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের উপরও সিয়াম পালনকে ফরজ করা হয়েছে যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার। (সূরাহ আল বাকারা, আয়াত-১৮৩)।
রাসূলের হাদিস থেকেও অন্যান্য নবীগণের উম্মতের উপর সিয়াম আদায় করা যে ফরজ ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন-
হযরত ইব্নু ‘উমার (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা:) আশূরার দিন সিয়াম পালন করেছেন এবং এই সিয়ামের জন্য আদেশও করেছেন। পরে যখন রমযানের সিয়াম ফরয হল তখন তা ছেড়ে দেওয়া হয়। (সহিহ বুখারী)।
আম্মাজান হযরত আয়িশাহ্ (রা:) থেকে বর্ণিত। জাহিলী যুগে কুরাইশগণ আশূরার দিন সওম পালন করত। আল্লাহ্র রাসূল (সা:) পরে এই সওম পালনের নির্দেশ দেন। অবশেষে রমযানের সিয়াম ফরয হলে আল্লাহ্র রাসূল (সা:) বললেন, যার ইচ্ছা ‘আশূরার সিয়াম পালন করবে এবং যার ইচ্ছা সে সওম পালন করবে না। (সহিহ বুখারী)।
আলোচ্য হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, সকল নবী রাসূলগনের উম্মতের উপর সিয়াম বাধ্যতামূলক ছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের উপরও সিয়াম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সিয়াম পালনে অনেক ফজিলত রয়েছে। রাসূলের হাদিস থেকে সে বিষয়ে কিছু জেনে নেয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
রোজার মাসে আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে শিকলবন্দী করেন। জাহান্নামের দরজাও বন্ধ করে দেন এবং খুলে দেন জান্নাতের দরজাসমূহ। এছাড়াও সৎ বান্দাদেরকে সামনে অগ্রসর হতে উৎসাহিত করা হয় এবং অসৎ লোকদেরকে থেমে যেতে নির্দেশ করা হয়। যেমন রাসুল (সা:) বলেছেন-
হযরত আবূ হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত।
আল্লাহ্র রাসূল (সা:) বলেছেন, যখন রমযান আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। (সহিহ বুখারী)।
অপর আরেকটি হাদিসে এসেছে-
হযরত আবূ হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত।
রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, যখন রমজান মাসের প্রথম রাত আসে, তখন শয়তান ও অভিশপ্ত জিনদের শৃংখলিত করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, তার একটি দরজাও খোলা হয় না, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, এর একটি দরজাও বন্ধ হয় না এবং একজন ঘোষক ডেকে বলেন, হে সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি! অগ্রসর হও, হে অসৎকর্মপরায়ণ! থেমে যাও। আল্লাহ্ (রমযানের) প্রতিটি রাতে অসংখ্য লোককে জাহান্নাম থেকে নাজাত দেন। (সহীহুল বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, সুনানে ইবনে মাজাহ)।
এছাড়াও আরেকটি হাদিসে এসেছে-
হযরত আবূ হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলতেন, আল্লাহ্র রাসূল (সা:) বলেছেন, রমযান আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানগুলোকে শিকলবন্দী করে দেয়া হয়। (সহিহ বুখারী, সুনানে আন-নাসায়ী)।
রাসূল (সা:) সিয়ামকে ঢাল স্বরূপ উল্লেখ করেছেন। জিহাদের ময়দানে সৈনিকেরা যেমন নিজেকে রক্ষার জন্য শত্রুদের মোকাবেলায় ঢাল ব্যবহার করে থাকেন, ঠিক তেমনি নিজেদের ঈমান আমল রক্ষা করে জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য মুমিনগণের জীবনে রোজা হচ্ছে ঢাল স্বরূপ। যেমন আল্লাহ্র রাসূল (সা:) বলেছেন-
হযরত উসমান (রা:) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে বলতে শুনেছি, যুদ্ধের মাঠে ঢাল যেমন তোমাদের রক্ষাকারী, সিয়ামও তদ্রূপ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার ঢাল। (আন নাসায়ী, সুনানে ইবনে মাজাহ)।
এছাড়াও আরেকটি হাদিসে এসেছে-
হযরত আবূ হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা:) বলেছেন, সিয়াম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মত কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুই বার বলে, আমি সওম পালন করছি। ওই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই সওম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ্র নিকট মিসকের সুগন্ধির চাইতেও উৎকৃষ্ট, সে আমার জন্য আহার, পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে। সিয়াম আমারই জন্য। তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশ গুণ। (সহিহ বুখারী)।
রোজার মাসে রাসূল (সা:) সবচেয়ে বেশি দান সদকা করতেন। এই মাসের একটা ফরজ ইবাদত সত্তরটা ফরজ ইবাদতের সমান এবং একটা নফল আমল একটা ফরজ আমলের সমান মর্যাদাপূর্ণ। তাই এই মাসে বেশি বেশি দান সদকা করা উচিত। যেমন রাসূল (সা:) বলেন-
হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ্ (সা:) অন্যান্য লোকদের তূলনায় অত্যধিক দানশীল ব্যাক্তি ছিলেন। রমযান মাসে যখন জিবরাঈল (আ:) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি অত্যধিক দানশীল হয়ে যেতেন। আর জিবরাঈল (আ:) রমযানের প্রত্যেক রাত্রে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁকে কুরআন শিক্ষা দিতেন। আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা:) বলেন, যখন জিবরাঈল (আ:) রাসুলুল্লাহ্ (সা:)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি প্রবাহমান বায়ু অপেক্ষাও অত্যধিক দানশীল হতেন। (সুনানে আন-নাসায়ী)।
প্রত্যিটি রোজার সময় মুসলমানদের জন্য দুটি খুশির খবর দেয়া হয়। একটি ইফতারের সময় আরেকটি আনন্দ রয়েছে তার প্রভু আল্লাহ্র সাথে তার সাক্ষাতের সময়। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা নিজেই তার নিজের হাতে রোজাদারকে পুরস্কার দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন রাসুল (সা:) বলেছেন-
হযরত আবূ হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত।
রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, আল্লাহ্র মর্জি হলে আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকাজের প্রতিদান দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আল্লাহ্ বলেন, তবে সিয়াম ব্যতীত, তা আমার জন্যই (রাখা হয়) এবং আমিই তার প্রতিদান দিবো। সে তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই ত্যাগ করে। রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ! একটি আনন্দ তার ইফতারের সময় এবং আরেকটি আনন্দ রয়েছে তার প্রভু আল্লাহ্র সাথে তার সাক্ষাতের সময়। রোযাদার ব্যক্তির মুখের গন্ধ আল্লাহ্র নিকট কস্তুরীর ঘ্রাণের চেয়েও অধিক সুগন্ধময়। (সহীহুল বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, সুনানে ইবনে মাজাহ)।
কেবলমাত্র রোজাদার ব্যক্তিরাই রাইয়্যান নামক জান্নাতের দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেন। এছাড়া এই বিশেষ দরজা দিয়ে আর কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না। যেমন আল্লাহ্র রাসূল (সা:) বলেছেন-
হযরত আবূ হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত।
আল্লাহ্র রাসূল (সা:) বলেছেন, যে কেউ আল্লাহ্র পথে জোড়া জোড়া ব্যয় করবে তাকে জান্নাতের দরজাসমূহ হতে ডাকা হবে, হে আল্লাহ্র বান্দা! এটাই উত্তম। অতএব যে সালাত আদায়কারী, তাকে সলাতের দরজা হতে ডাকা হবে। যে মুজাহিদ, তাকে জিহাদের দরজা হতে ডাকা হবে। যে সিয়াম পালনকারী, তাকে রাইয়্যান দরজা হতে ডাকা হবে। যে সদাকাহ দানকারী, তাকে সদাকাহ্র দরজা হতে ডাকা হবে। এরপর আবূ বকর (রা:) বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক, সকল দরজা হতে কাউকে ডাকার কোন প্রয়োজন নেই, তবে কি কাউকে সব দরজা হতে ডাকা হবে? আল্লাহ্র রাসূল (সা:) বললেন, হ্যাঁ। আমি আশা করি তুমি তাদের মধ্যে হবে। (সহিহ বুখারী)।
এছাড়াও আরেকটি হাদিসে এসেছে-
হযরত সাহল (রা:) থেকে বর্ণিত। নবী (সা:) বলেন, জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন সওম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবে, সওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে করে এই দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে। (সহিহ বুখারী)।
হযরত সাহ্ল বিন সা’দ (রা:) থেকে বর্ণিত। নবী (সা:) বলেন, জান্নাতের একটি দরজার নাম ‘রাইয়্যান’। কিয়ামাতের দিন সেখান থেকে আহ্বান করা হবে, রোযাদারগণ কোথায়? যে ব্যক্তি রোযাদার হবে, সে উক্ত দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে এবং যে উক্ত দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, সে কখনও পিপাসার্ত হবে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ)।
রোজার যেহেতু এতো মর্যাদা সেহেতু গুরুত্বের সাথে সিয়াম পালনে যত্নশীল হতে হবে। যেমন রাসূল (সা:) বলেছেন-
হযরত আবূ হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এই পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই। (সহিহ বুখারী)।
আলোচ্য হাদিস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা নিজেদের সিয়াম পালনে যত্নশীল হব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সিয়ামের গুরুত্ব বুঝে তার আলোকে সিয়াম পালনের তাওফিক দিন। আমিন।