সিদ্ধার্থ সিংহ’র বৃষ্টি বিষয়ক গদ্য কথা রিমঝিম ঝিম বৃষ্টি
বৃষ্টি শুরু হয়েছে কি হয়নি, শুধু আকাশে মেঘ করেছে দেখেই, অনেকে আছেন যাঁরা ছাতা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। যে সব মেয়েরা জলের ছাঁট থেকে বাঁচার জন্য সামান্য কোনও শেডের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন বা বড় বড় ফোঁটা পড়ার আগেই বাস স্টপেজে পৌঁছে যাওয়ার জন্য ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রায় ছুটছেন কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই অল্প বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যাঁরা রাস্তায় নেমে পড়েছেন, তাঁদের মাথায় একটু ছাতা ধরার সুযোগ পাওয়ার জন্য।
না, পুরুষ হলে হবে না। বাচ্চা হলেও নয়। মেয়েই হতে হবে এবং বয়স হতে হবে ষোলো থেকে ছত্রিশের মধ্যে। না হলে ছাতা ধরে কী লাভ! কারও কারও ক্ষেত্রে এই বয়সের গণ্ডিটা অবশ্য একটু কম বেশি হয়।
আর এই সব পুরুষরা বেরোবার সময় মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেন, হে মা কালী, ও বাবা লোকনাথ, হে জগধাত্রী, আজ যেন কোনও মেয়েই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে না থাকে। বেরোলেও সেই সব ছাতা যেন দরকারের সময় না খোলে কিংবা হ্যান্ডেল ভাঙা থাকে। হে মা, হে বাবা, এই অভাগাকে একটু দেখো!
এই সব পুরুষরা সারা বছর ধরে অপেক্ষা করেন, কবে আসবে আষাঢ় এবং শ্রাবণ মাস! কারণ, এই দু’মাসই হল বর্ষাকাল।
বৃষ্টির সঙ্গে আমাদের প্রেম সেই আদিকাল থেকেই। বৃষ্টি আমাদের প্রথম প্রেমিক, আমাদের প্রথম প্রেমিকা। তাই বর্ষায় জমে ওঠে অনন্য প্রেম। বর্ষা নিয়ে কত যে গল্প, ছড়া, কবিতা, গান লেখা হয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। সেই জন্যই হয়তো বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবিতা বর্ষার কাব্য; বর্ষাকে অবলম্বন করেই বাঙালির প্রেমের কবিতা।’ এটা আসলে কবিদের ঋতু। রবীন্দ্র-নজরুলের ঋতু।
রবীন্দ্রনাথের কাছে সব ঋতু প্রিয় হলেও বর্ষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল নিঃসন্দেহে একটু বেশি। তাই বারবার তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে বর্ষার আগমন, সৌন্দর্য আর প্রস্থান। বর্ষা নিয়ে তিনি লিখেছেন গান, কবিতা, ছড়া, গল্প এমনকি জীবনস্মৃতিও। তাঁর বর্ষাবন্দনা এতই সমৃদ্ধ যে, বাংলা সাহিত্যে এমন বর্ষাবন্দনা সত্যিই মেলা ভার।
তিনি নিজেই বলেছেন, তাঁর সব কবিতা বিষয়বস্তু অনুসারে সাজানো হলে দেখা যাবে বর্ষার কবিতাই সবচেয়ে বেশি। গানের ক্ষেত্রেও তাই। গীতবিতানে প্রকৃতি পর্যায়ের গানের সংখ্যা ২৮৩টি। তার মধ্যে বর্ষা পর্যায়ের গানের সংখ্যাই ১২০টির মতো। তিনি লিখেছেন, আজি ঝর ঝর মুখর বাদলদিনে / জানি নে, জানি নে কিছুতেই / কেন মন লাগে না… কিংবা এমন দিনে তারে বলা যায় / এমন ঘনঘোর বরিষায়, / এমন মেঘস্বর বাদল-ঝরঝরে / তপনহীন ঘন তমসায়…
‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল’ হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন কবি। বলতেন, ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী, / উড়ে চলে দিগ-দিগন্তের পানে…’ কিংবা বৃষ্টির ছোঁয়ায় যখন আনন্দে নেচে উঠত মন, তিনি গেয়ে উঠতেন- হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে / ময়ূরের মতো নাচে রে…
বর্ষার মধ্যে রয়েছে এমনই সুর, ল’য়ের মাদকতা যে, বসন্তকালকে বাদ দিলে দেখা যাবে ছয় ঋতুর মধ্যে কেবল বর্ষাকালই দখল করে আছে রাগ-রাগিণীর বেশির ভাগ জায়গা। সংগীতশাস্ত্রে বর্ষার জন্য আলাদা ভাবে বরাদ্দ হয়েছে- মেঘ, মল্লার।
শুধু গান বা কবিতা নয়, কত গল্প উপন্যাসে যে রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে ধরেছেন! বর্ষার প্রেমে পড়ে ১৩২১ সালের আষাঢ় মাসে ‘আষাঢ়’ নামে একটি প্রবন্ধও লিখেছেন তিনি।
বর্ষায় যে কত লোক প্রেমে পড়েছেন! এক সময় তো বাংলা সিনেমায় আকছারই দেথা যেত, আচমকা বর্যার কবলে পড়ে কোনও গাড়িবারান্দার নীচে কিংবা ঝাঁকড়া মাথাওয়ালা কোনও গাছের তলায় অথবা কোনও পরিত্যক্ত নির্জন ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে নায়ক-নায়িকা। হঠাৎ আকাশ বিদীর্ণ করে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বাজ পড়ল কোথাও, আর সেই বিকট শব্দে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে নায়িকা সপাটে জাপটে ধরল নায়ককে। শুরু হল প্রনয়’পর্ব।
বর্ষায় সব কিছু কি শুধু বড়দেরই হয়! ছোটদের কিছুই হয় না! অবশ্যই হয়।
বৃষ্টির দিনে অন্ধকার নামলেই বাচ্চারা এক জায়গায় জড়ো হয়ে এখনও ঠাকুমা-দিদিমাকে ধরে ভূতের গল্প শোনার জন্য। কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হলেই টপাটপ পড়তে থাকা আম কুড়োনোর জন্য ছুটে যায় কিংবা শিলাবৃষ্টির সময় শিল কুড়োনোর জন্য সটান নেমে পড়ে ঝড়-জলের মধ্যেই। খোলা আকাশের নীচে। বড় হয়ে গেলে ফের এই স্বাদ পাওয়ার জন্য বড়দের মন বড় ছটফট করে।
একটু বড় বয়সে বৃষ্টিতে ভিজে এসে চা চাননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তেলেভাজা গিয়ে মুড়ি খাওয়াও বর্ষার একটা অঙ্গ। আর সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হলে? খিচুড়ি অবধারিত। সঙ্গে বেগুন ভাজা।
গভীর রাতে টিনের চালে একটানা পড়া বর্ষার বড় বড় ফোঁটার শব্দ যাঁরা শোনেননি, তাঁরা বড়ই অভাগা। সেই শব্দ শুনে এক কবি বলেছিলেন, বর্ষাকন্যার উদ্দাম নৃত্য।
বহুকাল আগে আর এক কবি, কালিদাস এ ভাবেই মুগ্ধ হয়েছিলেন আষাঢ়ের রূপে। ‘আষাঢ়’ শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা গুরুগম্ভীর ভাব আছে। আছে স্বপ্নাবিষ্ট এক মোহময়তা। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে অতিষ্ঠ প্রাণকে ঠান্ডা করার জন্য বর্ষাকালের কোনও জুড়ি নেই।
প্রতি বছর আটই জুন বর্ষা আসার কথা থাকলেও সব সময় যে তিনি একেবারে ঠিক সময় মতো আসেন, তা কিন্তু নয়। তবে আষাঢ় মাসেই আসেন। থাকেন একটানা ভাদ্র মাস অবধি।
আর বর্ষা এলেই সব খাল, বিল, পুকুর, নদী, নালা জলে ভরে ওঠে। এর পুকুর মিশে যায় ওর পুকুরের সঙ্গে। এ পুকুরের মাছ চলে যায় তার পুকুরে। তখন শুধু বড়রাই নয়, কচিকাঁচারাও গামছা নিয়ে নেমে পড়ে মাছ ধরতে। মাছ খাওয়ার চেয়েও মাছ ধরার যে কী মজা, তা একমাত্র তাঁরাই জানেন, যাঁরা বর্ষাকালে জমা জলে শখ করে মাছ ধরেন।
এই সময় চারিদিকে শুরু হয়ে যায় ইলিশ উৎসব। গঙ্গার ইলিশ। পদ্মার ইলিশ। তার কত রকম রান্নার গাল ভরা নাম- ইলিশ কোপতা কারি, লেবু ইলিশ, ইলিশ কাসুন্দি, আস্ত বেকড ইলিশ, কাঁটা গলানো ইলিশ, টক মিষ্টি ইলিশ, ইলিশ কোরমা, নোনা ইলিশ ভুনা, আনারস ইলিশ, ইলিশ মালাইকারি, আস্ত ইলিশ রোস্ট, ইলিশ ভিন্দালু, লবনে বেকড ইলিশ, অরেঞ্জ ইলিশ, ইলিশ কোপতা, ইলিশ পোলাও- বলে শেষ করা যাবে না। তবে ও সব নয়, বাঙালির পাত মূলত ভরে ওঠে ইলিশ মাছের পাতুরি, ইলিশ ভাপা, সরষে ইলিশ, ইলিশের টক আর খুব বেশি হলে- দই ইলিশে। এমনি ছোট ছোট বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের পাতলা ঝোলও যেন বাঙালির কাছে অমৃতের সমান। কোনও অংশে কম যায় না, মচমচে ই