চতুর্থ পর্ব
আজ ৩/৫/২৩. গ্যাংটক থেকে বিদায় নিলাম। এখানে কোন অটো বা টেক্সি পাবেন না। ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে কার বা ছোট মাইক্রো পাওয়া যায়। আশেপাশে যেখানে যান না কেন এগুলো ছাড়া চলতে পারবেন না। ভাড়া একই। তবে চারজন এর অতিরিক্ত নয়। আমরা সকালের নাস্তা আলু পরোটা খেয়ে বেরিয়ে পড়ি গ্যাংটক বাস স্টেশন পথে। যাওয়ার আগে ভালো করে দেখে নেই আবারও চারপাশে। আমাদের জিপ এবার ছুটে চলছে দার্জিলিং দিকে। দার্জিলিং কে না জানে। বিশেষ করে বাংগালীদের নিকট দার্জিলিং একটা স্বপ্নের নগরের মতো। পাহাড় ভ্রমণের কথা উঠে যদি তাহলে দার্জিলিং সবার পছন্দের প্রথম তালিকায় থাকে। প্রায় ১০০ কিমি লম্বা পথ। আমাদের ড্রাইভার জানায় যে, ঘন্টা চারেক লাগবে। আমরা যতটা এগুচ্ছি আর ততই বরফের গন্ধ ছাড়িয়ে শান্ত পাহাড়ের পথে ছুটে চলছি। গ্যাংটক টু রংপো প্রায় ৩২ কিমি। এখানে নেমে আমাদের সবার পার্সপোর্ট গুলো তে সিল মেরে চেক আউই করলাম। তার মানে সিকিমের সীমানা ছেড়ে আমরা এবার পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় ঢুকে পড়ি। এই অঞ্চলের সাথে আমাদের দেশের মানুষ আর পরিবেশের খুব একটা তফাৎ নেই। আচার আচরণের বা কৃষ্টি সংস্কৃতির সঙ্গে যথেষ্ট মিল। রাস্তায় হুহু করে ছুটে চলছে গাড়ি। তবে পাহাড় গুলো বিপদজনক । দার্জিলিং থেকে তিস্তা নদীর আরেকটা অংশ চলে এসেছে। গ্যাংটক আর দার্জিলিং আসা মানে তিস্তা নদীর পিছু না ছাড়া। এই দার্জিলিঙে একটা বড় সময় কেটেছে গান্ধী পরিবারের। সোনিয়া গান্ধীর মাতা কমলা যখন নাকি প্রায়শই অসুস্থ হয়ে যায় আর তখনি সোনিয়া গান্ধী তার মা কে এখানে নিয়ে আসতেন শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর বাতাসের জন্য। রাজিব গান্ধীর সাথে সোনিয়া গান্ধীর প্রেমের সম্পর্ক টার ও বড় সাক্ষী এই দার্জিলিং। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে দার্জিলিং চিরকাল ই একটা স্বপ্নের মতো। এই সুন্দর পাহাড়, পাইন আর ঝাউগাছ আর খুব বেশি পাওয়া যায় না অন্য কোথাও। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা তো রয়েছে। খালি চোখে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার মতো সুযোগ আর সহজে অন্য কোথাও মিলবে না হয়তো।
দার্জিলিং (নেপালি: दार्जिलिंङ) হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি শহর ও পুরসভা। এই শহরটি হিমালয়ের শিবালিক পর্বতশ্রেণিতে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬,৭০০ ফু (২,০৪২.২ মি) উচ্চতায় অবস্থিত। শহরটি চা শিল্প, বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য ও ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের জন্য খ্যাত একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র
দার্জিলিংয়ের ইতিহাস সিক্কিম, নেপাল, ভুটান ও ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীন ভাবে জড়িত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্য্যন্ত সিক্কিম রাজ্য দ্বারা দার্জিলিং সংলগ্ন পাহাড়ী অঞ্চল এবং নেপাল রাজ্য দ্বারা শিলিগুড়ি সংলগ্ন তরাই সমতল অঞ্চল শাসিত হত। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নেপালের গুর্খারা সমগ্র পাহাড়ী অঞ্চল অধিকারের চেষ্টা শুরু করলে সিক্কিম রাজ্যের ছোস-র্গ্যাল তাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নেপালীরা তিস্তা নদীর তীর পর্য্যন্ত সিক্কিম সেনাবাহিনীকে হঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই সময় সমগ্র উত্তর সীমান্তে নেপালীদের বিজয়যাত্রা রুখতে ব্রিটিশরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে সংগঠিত ইঙ্গ-গুর্খা যুদ্ধের ফলে গুর্খারা পরাজিত হয়ে পরের বছর সগৌলি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির ফলে সিক্কিম রাজ্য থেকে অধিকৃত মেচী নদী থেকে তিস্তা নদী পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল নেপালীরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিতালিয়া চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চল ছোস-র্গ্যালকে ফিরিয়ে দিয়ে সিক্কিম রাজ্যের সার্বভৌমত্ব সুনিশ্চিত করে।
১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সিক্কিম রাজ্য আর্থার ক্যাম্পবেল নামক কোম্পানির একজন আধিকারিক এবং জোসেফ ডাল্টন হুকার নামক একজন উদ্ভিদবিদ ও অভিযাত্রীকে গ্রেপ্তার করলে কোম্পানি তাদের মুক্ত করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠায়, যার ফলে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোম্পানি ৬৪০ বর্গমাইল (১,৭০০ কিমি২) এলাকা অধিকার করে নেয়। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ভূ্টান ও ব্রিটিশরা সিঞ্চুলা চুক্তি স্বাক্ষর করলে কালিম্পং ও পাহাড়ের গিরিপথগুলির ওপর ব্রিটিশ রাজের অধিকার হয়। ব্রিটিশ ও সিক্কিমের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিবাদের ফলে ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা নদীর পূর্ব তীরের অঞ্চলগুলি ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ১,২৩৪ বর্গমাইল (৩,২০০ কিমি২) ক্ষেত্রফল এলাকা নিয়ে দার্জিলিং জেলা গঠিত হয়, যা বর্তমানে একই আকারের রয়ে গেছে।
দার্জিলিং ভ্রমণের আগেই সেই সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছি, এটা বরাবরই সব জায়গায় যাওয়ার আগেই সেরে নেই। তাই দার্জিলিঙে কোথায় কি আছে নাই তা আমার কাছে মুখস্ত মতো ছিলো। শহরে প্রবেশের আগেই তিস্তা নদীর উপর একটা ব্রিজ পেরুতে হয়। আর এরপর যে সর্পিল, ভয়ংকর আর সুন্দর একটা রাস্তা দিয়ে উপরে উঠার যে চিত্র কল্পনায় আসে। কিভাবে সম্ভব। খুব খাড়া আর বাকানো পথ। পাহাড়ের এই রাস্তার নিচে চোখ দিলেই মাথা ঘুরে যাবে। এত গভীর আর ভয়ংকর। দার্জিলিঙে এসে বৃষ্টি না পেলে নাকি দার্জিলিং দেখা হয় না। মুহূর্তে এক বিশাল মেঘের দল পাহাড় থেকে উঠে এসে আমাদের ঘিরে দাড়ালো। ঝরঝর করে বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা গাড়ির ভিতর আছি। পাহাড়ের বৃষ্টি দেখা ভীষণ মনোরম আর সৌল্পিক। শহরের ভিতর আমরা ঢুকে পড়েছি। পরিস্কার আর সুন্দর রাস্তা। নেপালী মহিলারা কাচা সবজি, ফল বিক্রি করছে রাস্তার পাশে। প্রথমেই দেখা হলো সেই প্রাচীন ঘুম স্টেশন এর সাথে। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের ঘুম রেল স্টেশন ভারতের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন। এটি ২,২৫৮ মিটার (৭,৪০৭ ফুট) এর উচ্চতায় অবস্থিত। তারমানে আমরা আরেকটি মেইল ফলক ছুয়ে ফেললাম। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের নির্মাণ ১৮৭৯ সালে শুরু হয় এবং রেলপথটি ৪ এপ্রিল ১৮৮১ সালে ঘুমে পৌঁছে।১৮৭৮ সাল পর্যন্ত, কোলকাতা থেকে দার্জিলিং যাত্রায় ৫ থেকে ৬ দিন সময় লাগত বাষ্প-ইঞ্জিন-চালিত ট্রেন ব্যবহার করে, সাহেবগঞ্জে বাষ্প ফেরি দিয়ে গঙ্গা পার করা, এবং তারপর গরুর গাড়ি এবং পালকি ব্যবহার করা। ১৮৭৮ সালে, শিলিগুড়িকে ভারতের রেলওয়ে মানচিত্রে স্থান দেওয়া হয়েছিল, যা দুদিনের যাত্রা কমিয়ে দেয়। কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত ট্রেন যাত্রা (একটি নতুন রেলওয়ে স্টেশন ৬ কিমি, ৩.৭ মাশিলিগুড়ি থেকে ) প্রায় ১০ ঘন্টা লাগে।
বাতাসিয়া লুপ পেরিয়ে আমাদের গাড়ি ঠিক দার্জিলিং স্টেশন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায়। মানে আমরা হোটেলের কাছে এসে গেছি। তখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। সাথেই সার্কিট হাউস। এখান থেকে প্রায় দুই বাশ পাহাড়ের চূড়ায় আমাদের হোটেল। ক্ষুধায় শরীরে আর জোর থাকার কথা নয়। ভারী ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়া আমাদের জন্য হিমালয় অভিযানের মতো। যাইহোক হোটেলে ব্যাগ রেখে সোজা চললাম মুসলিম হোটেল খুঁজে খুঁজে দেখতে। আবারও বৃষ্টি। প্রায় ভিজে গেছি। বাধ্য হয়ে ছাতা কিনতে হলো। মিঠুন অন্য হোটেলে খেতে যাওয়ায় আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলেও সে খানিকটা দেরি করে। রায়হান, ফাহিম আর তারেক বউ বাচ্ছাদের জন্য কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি মিঠুনের জন্য খুব কেচো গতিতে হাটছি। এক সময় রায়হান দের থেকে আমি হারিয়ে যাই। কোথায় যে গেছে আর খুঁজে পাচ্ছি না তাই বাধ্য হয়ে হোটেলের সামনে দার্জিলিং স্টেশনের দিকে হাটতে থাকি মল এর ভিতর দিয়ে। আহা সত্যিই কি অপরুপ দৃশ্য। দার্জিলিং রেলওয়ে স্টেশন হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলার একটি প্রধান রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশনটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েতে অবস্থিত। দার্জিলিং রেলওয়ে স্টেশনটি ২,০৭৩ মিটার (৬,৮০১ ফু) ) উচ্চতায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে অবস্থিত। এটি কাটিহার রেলওয়ে বিভাগের এখতিয়ারের অধীনে DJ এর রেলওয়ে কোড বরাদ্দ করা হয়।
১৮৭৮ সালে স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলের মাধ্যমে কলকাতা ও শিলিগুড়ি যুক্ত হয়। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত শিলিগুড়ি থেকে একটি কার্ট রোডের (অধুনা হিল কার্ট রোড) মাধ্যমে দার্জিলিং যুক্ত হয়। এই রাস্তায় টাঙা পরিষেবা চালু ছিল। ফ্র্যাঙ্কলিন প্রিস্টেজ নামে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির জনৈক এজেন্ট সরকারের কাছে বাষ্পচালিত ট্রামওয়ের মাধ্যমে শিলিগুড়িকে দার্জিলিঙের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব রাখেন।বাংলার লেফটানেন্ট গভর্নর স্যার অ্যাশলে ইডেন এই প্রস্তাবে ইতিবাচক মনে করলে এটি গৃহীত হয়।নির্মাণকাজ শুরু হয় সেই বছরই।
গিলেন্ডারস আরবাথনট অ্যান্ড কোম্পানি এই রেলপথ নির্মাণ করে। ১৮৮০ সালের ২৩ অগস্ট শিলিগুড়ি-কার্শিয়াং অংশটি চালু হয়। দার্জিলিং পর্যন্ত লাইনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৮৮১ সালের ৪ জুলাই। পরবর্তীকালে রেলের নতিমাত্রা কমানোর জন্য একাধিকবার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কাজকর্ম করা হয়।১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প ও ১৮৯৯ সালের একটি বড়ো ঘূর্ণিঝড় সত্ত্বেও যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রসারণের কাজ চলতে থাকে। যদিও কম সময়ের বাস পরিষেবা চালু হলে এই রেল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দার্জিলিং ও ঘুমের একাধিক সেনা ক্যাম্পে রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে এই রেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। আজও এটি বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে চলে। দার্জিলিঙের মেল ট্রেনের জন্য ডিজেল চালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। স্টেশনের প্লাটফর্ম ও তার আধুনিকতার সাথে অনেক বড় বড় প্লাটফর্ম পাল্লা দিতে অক্ষম। কাচে ঘেরা আর বাহারী সাজে সজ্জিত পুরো প্লাটফর্ম। যাত্রীদের বসার জায়গা, ছিমছাম আর পরিপাটি। আর সবচেয়ে যেটা অবিশ্বাস্য তা হলো এর সামনের অসীম ফাকা জায়গা আর পাহাড়ের সারি। কিছুক্ষণ পর পর এখানকার রূপ বদলায়। এই মেঘ এই বৃষ্টি র খেলা। দার্জিলিংএর সবচেয়ে সুন্দর আর বহুরূপী জায়গা এটাই মনে হয়েছে আমার কাছে। সূর্য অস্ত নামে এখানে। দার্জিলিং এর পুরো রূপ টা উপভোগ করতে থাকি প্লাটফর্ম এ দাঁড়িয়ে। রায়হান দের যোগাযোগ করার উপায় ছিলো না, নেটওয়ার্ক এত বাজে পুরো ভারত জুড়ে এটা কল্পনায় আসে না। যাইহোক খানিকটা বাদ মিঠুন চলে আসে। আর দুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে থাকি দার্জিলিঙের প্রথম সূর্য ডুবি। রাত নয়টা নাগাদ রায়হান রা হোটেলে চলে আসে। আর তাদের নিয়ে আসা মূড়ি, মরিচ, চানাচুর দিয়ে মজা করে খাওয়া দাওয়া। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে। আগামীকাল ভোর চার টায় জেগে উঠে পড়ার তাগাদা তো আছেই। (ক্রমশ)
সূত্র : উইকিপিডিয়া, পত্রিকা, জার্নাল।
লেখক: লতিফুর রহমান প্রামাণিক। লেখক ও আইনজীবী।
৩য় পর্বে লিংক:
সিকিম, দার্জিলিং : বরফ, নদী আর পাহাড়ের দেশে-লতিফুর রহমান প্রামাণিক