সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৮ অপরাহ্ন

সিকিম, দার্জিলিং : বরফ, নদী আর পাহাড়ের দেশে-লতিফুর রহমান প্রামাণিক

সিকিম, দার্জিলিং : বরফ, নদী আর পাহাড়ের দেশে-লতিফুর রহমান প্রামাণিক

দ্বিতীয় পর্ব
সারা রাত ভালো ঘুম হয়। ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সাথে যুদ্ধ করছিলাম গতকাল অব্দি। সারা বাংলাদেশের মানুষ যখন রোদের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে ডাবল প্যান্ট পরে আর মোটা দুটো কম্বল জড়িয়ে আজ রাতে ঘুমাতে হয়েছিল আমাদের। তবুও যেন শীত যাচ্ছিল না। সকালে ব্রাশ করে পানি মুখে ভরে কুলি করতে গিয়ে টের পেয়েছি, মনে হয় পানির সাথে দাত উপরে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাংটকের বাসিন্দারা ভীষণ পানীয় জলের কস্টে আছে পত্রিকার খবর তাই ছিলো। আর তা টের পেলাম যখন হোটেলের ম্যানেজার এসে বারবার সতর্ক করে বলছিল, জলের ভীষণ সমস্যা হচ্ছে, সেই ভাবে ব্যবহার করুন। শেষ হয়ে গেছে তো আর উপায় থাকছে না। গ্যাংটক নিয়ে গত একমাস ঘাটাঘাটি করেছি গুগলে। গ্যাংটক (নেপালি: गान्तोक, /ˈɡæŋtɒk ; নেপালি উচ্চারণ: [ˈɡantok]) হচ্ছে ভারতের একটি শহর, পৌরসভা, রাজধানী এবং ভারতের সিকিম রাজ্যের বৃহত্তম জনবহুল স্থান। এটি একই সাথে সিকিম রাজ্যের পূর্ব সিকিম জেলা সদর দপ্তর। গ্যাংটক শহরটি পূর্ব হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১,৬৫০ মিটার (৫,৪১০ ফুট)। শহরটির জনসংখ্যা প্রায় ১,০০,০০০ জন। তাদের মধ্যে রয়েছে ভুটিয়া, লেপচা, কিরাটি এবং গোর্খাদের মতো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী। হিমালয়ের উচ্চ শিখরের মধ্যে অবস্থিত হওয়ার পাশাপাশি সারা বছর ধরে মৃদু নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু থাকায় গ্যাংটক সিকিমের পর্যটন শিল্পের কেন্দ্রে রয়েছে।
১৮৯৪ সালে, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে সিকিমের চোগিয়াল বা রাজা থুটোব নামগিয়াল তুমলং থেকে গ্যাংটকে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এর ফলে শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। নতুন রাজধানীতে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ভবনের সাথে একটি নতুন গ্র্যান্ড প্যালেস তৈরি করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর, সিকিম একটি জাতি-রাষ্ট্রে পরিণত হয় যার রাজধানী ছিল গ্যাংটক। চোগিয়াল এবং তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে সিকিম ভারতের আধিপত্যের অধীনে আসে এই শর্তে যে, এটি তার স্বাধীনতা বজায় রাখবে।[৯] এই চুক্তিটি সিকিমের পক্ষে ভারতীয়দের পররাষ্ট্রীয় বিষয়গুলির নিয়ন্ত্রণ দেয়। নাথুলা এবং জেলেপলা পাস দিয়ে ভারত ও তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। এর ফলে গ্যাংটক শহর উপকৃত হয়। ১৯৫৯ সালে তিব্বতে চীনা ক্র্যাকডাউনের ফলে বাণিজ্য হ্রাস পায় এবং ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর পাসগুলি সিল করে দেওয়া হয়।[১০] নাথুলা পাস অবশেষে ২০০৬ সালে সীমিত বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করা হয়, যা সিকিমের অর্থনৈতিক উত্থানের আশা জাগিয়ে তোলে।


সিকিমের ইতিহাস সমৃদ্ধ। যুদ্ধ, স্বাধীনতা আর দাসত্ব যেন পিষ্ট করে দিয়েছে এই সুন্দর জনপদ।
স্থানীয় মানুষদের অধিকাংশ পাহাড়ের নিচে সুন্দর ছবি মতো রঙিন বাড়িতে থাকে। তবে এখন যে আধুনিকতার অহং তাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে তা সত্যিই অকল্পনীয়। পাহাড়ের বুকে সাত আট তলা দালানের অন্ত নেই। শহরে এথচ কোন কোলাহল নেই, নেই আমাদের মতো শহরের দোকানে দোকানে হিন্দি বা বাংলা গানের শব্দের প্রতিযোগিতা। আমরা হাটছিলাম এম জি মার্গ ধরে। ইউরোপের কোন দেশের রাজধানী এত সুন্দর আছে কি না সন্দেহ করছি। রাস্তার মাঝ দিয়ে ফুলের গাছ আর টবে উথলে পড়ছে ফুল। মাহাত্মা গান্ধীর নাম করনে এই এম জি মার্গ। বিশাল মুর্তির সামনে দাঁড়িয়ে প্রচুর মানুষ ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়েছে। অথচ কোলাহল নেই। দূরের পাহাড়ের বুকে জমে আছে মেঘ আর কুয়াশার চাদরে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। এখানে রেডিমেড খাবার তেমন পাওয়া যায় না, অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে কুড়ি মিনিট, সহাস্যে হোটেলের মহিলা কর্মট ম্যানেজার আমাদের বসতে বললেন সোফাতে। পাশে আঠারো উনিশের সুন্দরী একলা বালিকা তটস্থ ভঙ্গিতে নির্বাক তখনও। কাকে যেন বলেছিলাম বাংগালী হবে, তা পরীক্ষা করতে গল্প জুড়িয়ে দিলাম। বাড়ি বহরমপুর। মানে জিয়াগঞ্জ এর কাছে?
হ্যাঁ গিয়েছেন কখনো?
না। তবে যাব। আমার বন্ধু কবির বাড়ি। খুশি হলো আমাদের বাংলাদেশ থেকে আসার কথা শুনে।
নাস্তা সারতে প্রায় দশ টার মতো।


আজ থেকে শুরু হলো আমাদের প্রথম ট্যুর। এবার গন্তব্য লাচুং এর পথে। এখান থেকে প্রায় ১১৭/১১৮ কিমি পথ। রাস্তা খুব ভালো নয়। রাস্তার উপর দিয়ে ঝর্নার পানি গড়িয়ে পড়ে অনেক জায়গায়। যেমন দুর্গম আর সুন্দর। রায়হান বমি করার অযুহাত তুলে পুরো ট্যুরে জানালার পাশের সীট দখলে রাখে। আমি সিনিয়র হওয়ায় তাদের বিরোধিতা করতে আর পারিনি। সবাই বাংলাদেশ থেকে এসেছি, দুজন কাপল আর আমাদের সাথে আরও দুজন ঢাকার এই মিলে মোট নয় জন গাড়ির ভিতর। ভীষণ মদ্যপ ড্রাইভার। তবে মাতাল নয়। যেখানে গাড় থামে সেখানেই এক বোতল খেয়ে নেয়। মদ খাওয়ার এই উৎসব দুনিয়ায় হয়তো কম পাবেন। বলা যায় মদ খোরদের সর্গরাজ্য যেন এই সিকিম। দুদিন ধরে শুধু ডিম আর সবজি ছাড়া পেটে আর কিছু পড়েনি। চিকেনের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে মুলত জবাই করার নিয়মের কারণে। পাহাড়ি আঁকাও বাকা এবং মাঝে মাঝে কুয়াশার ভিতর দিয়ে গাড়ির চলাচল এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দেয় আমাদের। যতই এগুচ্ছি ততই আমরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যাচ্ছি।
লাচুং শব্দের অর্থ ‘ছোট গমনোপযোগী অঞ্চল’। রয়েছে একটি মনাস্ট্রি। কয়েক জন লামা থাকেন এখানে। লাচুং-এ আছে একটি কার্পেট বুনন কেন্দ্র। সারা বিশ্বের পর্যটকরা অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত এখানে ঘুরতে আসেন। এই সময়টুকুই লাচুং ভ্রমণের পিক টাইম। মূলত ইয়ামথাং ভ্যালি, লাচুং মনাস্টেরি দেখার পথেই তারা লাচুং আসেন। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীই লেপচা এবং তিব্বতীয়।


লাচুং হল ভারতের সিকিম প্রদেশে অবস্থিত একটি ছোট শহর এবং পাহাড়ি স্টেশন। তিব্বতের সীমান্তঘেরা এই স্থানটি উত্তর সিকিম জেলার মধ্যে অবস্থানরত।লাচুং লাচেন নদী এবং লাচুং নদী থেকে প্রায় ৯,৬০০ ফুট (২,৯০০ মি) উচ্চতায় অবস্থিত। লাচেন ও লাচুং উভয় নদীই তিস্তা নদীতে গিয়ে পড়েছে। রাজধানী গ্যাংটক থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১২৫ কিলোমিটার । লাচুং যেতে প্রথম চোখে পড়ে পাহাড়ের চূড়ায় চকচক করছে বরফের স্তুপ। আর আগ্নেয়গিরির লাভার মতো রুপার প্রলেপ মতো বরফ বেয়ে পড়ছে নিচের দিকে। ইতোমধ্যেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারদিকে ঘন্ধ আঁধার আর গা ছমছম পাহাড়ি আঁকা বাকা রাস্তার ভিতর দিয়ে ছুটে চলছি আমরা। যতই পথ কমে আসছে আর ততই হাত পায়ে কাটার মতো খোচা দিয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা। রাত প্রায় নয় টা তখন। লাচুং এ এসেছি তা হোটেলের নাম ফলক দেখে বুঝতে পারি। গাড়ি থেকে নেমেই বুঝতে পারি বাহিরের অবস্থা। এত শীত আর জনমে দেখিনি সম্ভবত ৫/৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর কম নয়। বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকার কোন উপায় ছিলো না। দ্রুত রুমের দিকে চলে যাই। রাতে গরম ভাত, জংগী সবজি আর চিকেন। মুখে তুলে বুঝতে পারি এই চিকেন খাওয়া সম্ভব নয়। না ঝাল আছে, না স্বাধ। বাধ্য হয়ে ডিম ভাজি আর ডাল সব্জির উপর ভরসা করি। ঝর্নার পানি অনবরত শব্দ করে ছুটে চলছে তিস্তা নদীর বুকে। বুঝতে পারি হোটেলের পিছনে সেই ঝর্না। তার কাছের পাহাড়ের বুকে জোনাকির মতো জ্বল জ্বল করছিল ঘরের লাল নীল বাতিগুলো। (ক্রমশ)

সূত্র : উইকিপিডিয়া, পত্রিকা ও জার্নাল।
লেখক: লতিফুর রহমান প্রামাণিক, লেখক ও আইনজীবী

প্রথম পর্বে লিংক:

সিকিম, দার্জিলিং : বরফ, নদী আর পাহাড়ের দেশে-লতিফুর রহমান প্রামাণিক

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge