রাত ১০টা।
ঘুম ভাঙ্গল দরজা নক করার শব্দে। এই সময় কে আসল?শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। বৃদ্ধ বয়সে শীতকালে একা একা শরীর আর চলতে চায় না, চালিয়ে নিতে হয়। নরওয়ের ট্রমসোর নৈসর্গিক পাহাড়ের ওপর জীবন যে এত কষ্ট, তা যৌবনে টের পাইনি। ৬২ বছর বয়সে এসে এখন মনে হচ্ছে- কি দরকার ছিল দেশ ছেড়ে এই ধূসর সাদা রসহীন ভূমিতে আশ্রয় নেয়ার! বাংলাদেশেই জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যেত। ২৫ বছর আগে আমার দেশ পরিবর্তন করার যথেষ্ট কারণ অবশ্য ছিল। ভাঙ্গা পরিবার, কর্মহীন এবং শেষে সরকার বিরোধী রাজনীতি করার জন্য কারাবাস। এরপর প্রথম সুযোগেই দেশত্যাগ, সকল সঙ্গত্যাগ। আর ফিরে যাওয়া হয়নি। সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একসময় লেখালেখি শুরু করি। বেকারভাতা পাই আর ঘরে বসে লিখি। মাঝে মধ্যে বারে যাই, বিয়ার খাই, পার্কে হাঁটাহাঁটি করি, ক্যাফেতে বসে কাটাকুটি আঁকি- এভাবেই কেটে যায় দিন, মাস, বছর।
আবার দরজায় টোকা দিচ্ছে কেউ! তাহলে প্রথমে ঘুমের ঘোরে ভুল শুনিনি। আমি দরজা খুলে দেখি সায়মন দাঁড়িয়ে আছে। সায়মন হচ্ছে এখানের একমাত্র বাংলাদেশী ছেলে যার সাথে আমার যোগাযোগ রয়েছে। বয়স ৪০-৪২ হবে। পেশায় একজন প্রকৌশলী ও গবেষক। সামুদ্রিক মাছ নিয়ে গবেষণার কাজে তাকে বছরে ছয় মাসই জাহাজে জাহাজে কাটাতে হয়। ভালো টাকা উপার্জন করে কিন্তু দেখে বোঝা যায় না। সায়মন সুযোগ পেলেই আমার সাথে দেখা করতে আসে। জাহাজে করে বন্দরে, দ্বীপে, সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানোর গল্প করে, গাড়ি চালিয়ে ঘুরতে নিয়ে যায়। ছেলেটা স্বল্পভাষী। সায়মনকে নিয়ে বেশ কয়েকটা লাইন লিখলাম। আসলে ও ছাড়া সামনা সামনি বসে বাংলা কথা বলার আর কোনো মানুষ আমার নেই।
শীতকালে এই অঞ্চলে কয়েক মাস সূর্য ওঠেই না ধরা যায়। এইখানে রাত ১০টা মানে অনেক রাত। বাইরে দেড় ফিট উঁচু তুষারে ঢেকে গিয়েছে সব। সায়মন এরকম সময়ে আসার লোক না, তাও ফোন না দিয়ে। আমি অবাক হয়েই ওকে জিজ্ঞেস করলাম-
– সায়মন এই সময়ে? আসো ভেতরে আসো।
সে তার জ্যাকেট খুলি রেখে ভেতরে এসে বসল।
– কোনো আর্জেন্ট কিছু নাকি? দেশ থেকে কোনো খবর এসেছে?
সায়মন উত্তর দেয়-
– না কাকা। তবে আপনার জন্য একটা অফার নিয়ে এসেছি।
– কি বিষয়?
– আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে। অনেকদিন তো হল ঘরে বসে আছেন। চলেন সমুদ্রে যাই।
– তুমি কি পাগল! মাইনাস বিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আমি যাব সমুদ্র ভ্রমণে! আমার বয়সটা কত চিন্তা করে দেখেছ? দাঁড়াও তোমাকে একটা ড্রিংক দেই। ঠাণ্ডায় তোমার নাক মুখ লাল হয়ে আছে।
– আপনি বসেন কাকা। আমি নিয়ে আসছি।
আমার দুইরুমের কাঠের বাসার কোথায় কি আছে সায়মন সব জানে। ঘরে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই বই ছাড়া। প্রচুর বাংলা বই আমার আমার সংগ্রহে আছে। আসলে বাংলাদেশের কোনো কিছুই আমি ছাড়তে পারিনি, ভূমিটা ছাড়া।
সে দুইটা গ্লাসে ব্র্যান্ডি ঢেলে, গরম পানি আর বাদাম নিয়ে এসে বসল। আমাকে একটা গ্লাস দিল।
– কাকা আমরা রিসার্চের কাজে যাচ্ছি আটলান্টিকের মাঝে ছোট্ট একটা শান্ত দ্বীপে, যেখান থেকে বোটে করে তিমি মাছ দেখা যাবে।
– এই সিজনে তিমি? ওদের উপরে ওঠার বেস্ট সময় কখন? এই ঠাণ্ডায় তো রক্ত জমে নীল হয়ে যাওয়ার কথা।
– ওদের জন্য এত ঠাণ্ডা না। আমরা সম্ভবত স্পার্ম তিমি দেখতে পারব। আপনি শুধু দরকারী জিনিস আর ওষুধ নিয়ে চলুন। জাহাজে বা দ্বীপে কোনো সমস্যা হবে না। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। আপনার থেকে আরো বয়সী লোকরাও যায়। আপনিই একবার বলেছিলেন তিমি দেখার খুব ইচ্ছা আপনার।
আমি ব্র্যান্ডিতে চুমুক দিলাম। একটু চিন্তা করে বললাম-
– হুম। এতগুলো বছর নরওয়েতে থাকার পরেও কখনো তিমি দেখতে যাইনি। কিন্তু শরীর পারমিট করবে না।
– আমি আপনাকে চাপ দিব না। আমাদের ট্যুর মাত্র দুই সপ্তাহের। কাজ খুবই কম। বেসিক্যালি তিমি দেখতে যাওয়াই টার্গেট। আপনার জন্য আলাদা কেবিন থেকে শুরু করে সকল ব্যবস্থা করা থাকবে। আরেকবার ভেবে দেখবেন নাকি?
আমি একটা চুরুট ধরিয়ে পায়চারী করতে থাকলাম। সায়মন বসে বসে ওয়াইল্ড লাইফের একটা বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে, ছবিগুলো দেখছে।
– জাহাজ কখন রওনা দিবে?
– কালকে। আগামীকাল সকাল ৮টায়।
– ঠিক আছে। আমি যাব।
– গ্রেট। আমি এসে আপনাকে গাড়িতে পিক করব সকাল ৬টায়।
– ওকে।
– আপনার জরুরি জিনিসগুলো বলেন। আমি লিস্ট করে গুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। কাল অন্ধকার সকালে আপনি শুধু গাড়িতে উঠে পড়বেন। উইন্ডকাটার, লাইফ জ্যাকেট, বুট, শীতের পোষাক সব জাহাজ থেকে দেয়া হবে, কোনো চিন্তা নেই।
– ঠিক আছে।
– সমুদ্রে ঠাণ্ডা কম্পেয়ারটিভলি কম। আর আমি তো আছিই। আপনার লাগেজ গুছিয়ে দিব?
– দরকার নেই, আমি করে নিব।
– তাহলে কাকা আমি যাই। দেখা হচ্ছে ঠিক সকাল ৬টায়।
– হু ঠিক আছে। গুড নাইট।
– গুড নাইট।
পরদিন ভোরে ওর সাথে গাড়িতে করে চললাম। দুই ঘন্টা ড্রাইভের পর পৌঁছে গেলাম সমুদ্র তীরে। মাঝারি আকারের একটা সাদা জাহাজে আমরা উঠলাম। ও তার সহকর্মীদের কারো কারো সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। ছিমছাম আধুনিক একটা সুন্দর রুম আমার জন্য রেডি ছিল। রুমে ঢোকার পরই সায়মন জানাল ডাইনিং-এ নাস্তা দেয়া আছে।হঠাৎ মনে হল বেশ ক্ষুধা লেগেছে।২।
তিনদিন পর আমরা পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত জায়গায়। শান্ত সমুদ্রে একটা ইঞ্জিন বোটে উঠে আমরা তিমি দেখতে রওনা হলাম। ঠাণ্ডা বেশ কম আর আকাশ পরিষ্কার। তবে রোদের কোনো চিহ্ন নেই। ওদের সিগন্যাল বলছে কাছাকাছির মধ্যেই তিমির ঝাঁক আছে। সকলের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছে। কেউ দূরবীন, কেউ ক্যামেরা হতে অপেক্ষা করছে। বোটে সব মিলিয়ে ১৩ জন বিভিন্ন দেশের মানুষ, বেশির ভাগই বিজ্ঞানী। সায়মনকে বলালাম-
– আমি ভাবতাম তিমি অক্সিজেনের জন্য ওপরে ওঠে আর সেসময় আকাশে রোদ থাকে।
– তিমির তো অক্সিজেন নিতে ওপরে উঠতেই হয়। তবে আমরা যেই ছবিগুলো দেখি তা রোদেই তোলা। এছাড়া কত জাতের তিমি আছে…
– এত বড় একটা প্রাণী, অথচ এই যুগেও টিকে আছে, বেঁচে আছে, ভাবতে অবাক লাগে। ডায়নোসারের থেকেও বেশি অবাক করে বিষয়টা।
– কিন্তু বেশিদিন থাকবে না। তিমির সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। প্লাস্টিকে সমুদ্র নষ্ট হচ্ছে, তিমি শিকারও আটকনো যাচ্ছে না, তাছাড়া সমুদ্রের নীচে বোমা টেস্ট করে রাশিয়া, কোরিয়া, আমেরিকা, চায়না… তিমি হয়ত হারিয়ে যাবে একশ বছরের মধ্যে।
– দুঃখ লাগে ভাবলে। মানুষকেই মেরে শেষ করে দিচ্ছে- নিউক্লিয়ার এফেক্টেড নেশনস যত্তসব।
– জানেন কাকা তিমি নিজেদের মধ্যে সিগন্যাল আদান-প্রদান করে, ওদের লিডার আছে, ফ্যামিলি গঠন করে, এমনকি আত্মহত্যাও করে- ভাবা যায়!
– হু তাই তো শুনেছি। সবই পশ্চিমাদের রিসার্চ তো… কোনটা সত্য, কোনটাকে সত্য হিসেবে দেখানো হয় সন্দেহ আছে।
– তা ঠিক। ১৯৬৯ সালে চাঁদে যাওয়া নিয়েও…
হঠাৎ বোটের সামনে নীলচে একটা পাহাড় লাফ দিয়ে পানিতে ডুব দিল। তিমি লাফিয়ে উঠেছে! ডুব দেয়ার সময় তিমির লেজটা স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম। সবাই খুশিতে চিৎকার করছে। আমাদের বোটটা দুলছে পানির ঢেউয়ের কারণে। কি অসম্ভব ভারী একটা প্রাণী!
এরপর একটু দূরে তিমিটাকে আবার দেখা গেল। সবাই প্রস্তুত ছিল দেখে এইবার সকলে দেখতে পেল। উল্লাসে ফেটে পড়ার অবস্থা। আমারো খুব অবাক লাগছে। জীবনে প্রথমবার একটা জীবন্ত তিমির সামনাসামনি হতে পেরেছি। ৩০ ফিট লম্বা তো হবেই। ওজন কত টন কে জানে!
তিমিটা সরে গেল। আমরা আরো দুই ঘন্টা ছিলাম কিন্তু আর দেখা গেল না। শুনলাম আমাদের বোটের কাছাকাছি অনেকগুলো তিমি ছিল, তারা আর ওপরে ওঠেনি। হয়ত আরো দূরে গিয়ে শ্বাস নিবে, খেলবে। যান্ত্রিক বোট আর মানুষের উপস্থিতি ওদের ভালো লাগার কথা না। আমার অল্প জ্ঞান থেকে এরকমটাই ভেবে নিলাম।৩।
জাহাজে ফিরেই লিখতে বসলাম। সাধারণত আমি নোট করে রেখে পরে গুছিয়ে লিখি। এইবার সরাসরি ভ্রমণ কাহিনি লেখা শুরু করলাম। দুই পাতা লেখার পর মনে হল ভ্রমণ কাহিনি নতুন করে লেখার কিছু নেই। হাজারো মানুষের আমার থেকে বেশি অভিজ্ঞতা নিয়ে ভ্রমণ কাহিনি লিখে গেছেন। ঠিক করলাম যা সত্য ঘটেছে তাই লিখব, সুতরাং ডায়েরিই লেখা উচিৎ। পরে যদি কখনো ইচ্ছা করে তো ফিকশন লিখব। জীবনের শেষ সময় এসেও ফিকশন লেখার শখ আমার রয়ে গেছে। এখনো মনে পড়ে ছোটবেলায় পড়া তিমি ও সমুদ্র কাহিনি- হারমেন মেলভিলের ‘মবি ডিক’ বা হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’। গুলিস্তান হলে সিনেমা দুটো দেখেছিলাম কলেজে পড়ার সময়। তখন পর্যন্ত আমি কোনো সমুদ্র দেখিনি, তিমি তো অনেক দূরের কথা। গল্প দুইটি অদম্য গভীর কল্পনায় ডুবিয়ে দিয়েছিল।জাহাজের জানলা দিয়ে তাকালাম। আকাশটা একটু লাল লাল দেখা যাচ্ছে। মনে হয় আজকে সূর্যের দেখা পাওয়া যাবে। কেন যেন চোখ ঝাপসা হয়ে আসল। মায়ের কথা মনে হল যিনি অনেক আগেই পৃথিবীর ছেড়ে চলে গেছেন। মেঘ-সূর্যের ছায়া থেকে যেন তিনি তাকিয়ে আছেন। আর আমি দেখছি নীলচে পানি আর কমলা আকাশ, যেন কোনো দেশের পতাকা। বহু বছর পর আমি কিছু সময় কাঁদলাম। আবেগটাকে অবহেলা করলাম না। তারপর দরজা খুলে বের হয়ে জাহাজের খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে মনে হল- জীবন আসলে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকৃতির একটা সমগ্র।