কবি নিমগ্ন ভাবনায় আত্মগত কথনের যে বুনন জন্মান বাহ্যিকগত উচ্চারনে তারই প্রতিফলন ব্যক্তি ও সমাজে বর্হিপ্রকাশ ঘটে। যতনা আত্মগত বাহিরে তা বিশাল মহীরুহ এ ভাবনার ডালে পল্লবে আলোড়ন তোলে। তাইতো কখনও সুখে, কখনো দুঃখে একান্ত আপনার কথা আপন মনে বেজে ওঠে।
আত্মাকে প্রজ্বলিত করে যে অগ্নি উত্থিত হন, তার নাম কবি। কবি আসলে একটা আগুনে নাম।
সমসাময়িক সময়ের এক কবি এম এ শোয়েব দুলাল। তার সৃষ্টি কর্ম কবিতা, ছড়া, গল্পে, প্রবন্ধে বিশাল ভান্ডার হলেও তাকে নিয়ে কেউ লেখার তেমন উৎসাহ নেননি। অথচ প্রতিভা নয় কঠোর অধ্যায়নের মধ্যে তার সৃষ্টি। সীমাহীন কষ্টেও তার কলম এখনো সচল। অজ¯্র কবিতা, গল্পে, ছড়ায় প্রবন্ধে যার সৃষ্টিময় লেখার জগৎ।
এম এ শোয়েব দুলাল, পিতাঃ মৃত: আব্দুল বারী, মাতাঃ মৃত: রমিছা বেগম, তিনি ০১/০১/১৯৬৭ইং সনে হারাগাছ পৌরসভাধীন সারাই হকবাজার দোয়ানীটারীতে জন্মগ্রহন করেন। সাহিত্যের সব শাখাতেই অবাধ বিচরণ তাঁর। লিখছেন দীর্ঘদিন থেকে দেশ ও দেশের বাহিরে। লেখা লেখির স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন বেশ কিছু সম্মাননা। সম্পাদনা করছেন কালি কলম, অক্ষর, শব্দ সহ বেশ কিছু লিটলম্যাগ। যা সাহিত্যাঙ্গনের ব্যাপক সমাদৃত। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহ: বেদনার অশ্রæ (কবিতা- ১৯৮৭), মহাপ্লাবন (কবিতা-১৯৮৮) শিরোনাম নেই তবুও আমরা (যৌথ কবিতা-১৯৯০), তুমি যদি কথা দাও (কবিতা-১৯৯২), হৃদয়ে ক্যাক্টাস বোধ (যৌথ কবিতা-১৯৯৪), ফেরাও আমাকে (প্রবন্ধ-১৯৯৭), কি যে ভালোবাসি (কবিতা-১৯৯৪), হারাগাছ ধুমনদী ধুমগড় (প্রবন্ধ-২০১৪) এই সব মানুষের গল্প (যৌথ গল্প-২০১৬), স্মৃতির উঠনে তোফাজ্জল হোসেন (প্রবন্ধ-২০১৬), দ্বিধাহীন একদিন (যৌথ কবিতা-২০১৬), তুমি আসবে বলে (কবিতা-২০২১), শারদ প্রভাতে(যৌথ কবিতা-২০২২), উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
তার প্রথম দিকের কাব্য গ্রন্থঃ তুমি যদি কথা দাও’ ‘কি যে ভালোবাসি’ ‘মহাপ্লাবন’ ‘বেদনার অশ্রæ তে যার স্ফুরণ। সাম্প্রতিক প্রকাশিত কাব্য ‘তুমি আসবে বলে’ মহীরুহ এক সৃষ্টি। একশত আট পৃষ্ঠা জুড়ে এমন সব কবিতা, যার প্রতিটি কবিতা অনন্য সাক্ষরে উজ্জলতায় নক্ষত্র নয়, প্লাবিত জোৎ¯œায় উদ্ভাসিত। তার ‘তুমি আসবে বলে’ কবিতায় কবির ভালোবাসা চিত্রিত হয়েছে শুধু ভালোবাসায়।
তুমি আসবে বলে
তিস্তার চরে ঘর বেঁধেছি
দখিনা দুয়ার খুলে রেখেছি।
তুমি আসবে বলে
কুমড়ো শাক, লাউ পাতা
লাল আলুর ফসল বুনেছি।
তুমি আসবে বলে
আমার পোষা পাখিটি
ছেড়ে দিয়েছি।
তুমি আসবে বলে
আমাদের বড় মাঠটায়
কবিতা পাঠের আসর ডেকেছি।
তুমি আসবে বলে
হক বাজারে
কত্তো বাজার করেছি।
তুমি আসবে বলে
আমি সেজেগুজে
বসে আছি।
তুমি আসবে বলে
শুকনো কলাপাতায় লেখা হবে
তোমার জন্য একটি প্রেমের কবিতা
শব্দচয়ন, উপমা-বিশাল ক্যানভাস ছুঁয়ে তার কবিতা যেন এক একটি আয়নায় মুখোমুখি করে আমাদের দিন-কাল। ধরে নেই একটি ছোট্ট কবিতা: (কষ্টের ট্রেন)।
শেষ ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে গতকাল
পুষ্প বৃষ্টি রোদ্দুরে উত্তপ্ত ঝিলিক
এক বিন্দু কষ্ট
সাথি করে নিয়ে গেছে
তুমি যদি ট্রেনে থাকতে
বুঝতে আমার কষ্টের কাল।
কতনা কিছু ভাবায়; এই ভাবনায়ত কবিকে উঠে নে পাঠক প্রিয়তা। আবার ‘সমকালীন কবি’ কবিতায় ইচ্ছের যে বর্হিপ্রকাশ তা কালিক স্পর্শ ছুয়ে যায়ঃ
ভালোবাসায় ভালোছিলাম
তোমার আমি সুজন
সংসার করছো অন্যের ঘরে
আমি এখন কুজন।
আশা করি ভালো থেকে
দু’জনে মিলি সবি
তোমার জন্য হয়ে গেছি
সমকালীন কবি।
অপ্রাপ্তির ধুসরতা কবিকে করে দ্রোহী। অথচ কবি কবিই হয়ে যান। তার দুঃখ নেই। সুখে থাকার এই অনাবিল উজ্জ্বলতা আমাদেরকে জাগ্রত করে। অকৃত্রিম ভালোবাসার এমন মুগ্ধতা কোথায় মিলে।
প্রেম আর ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে আমাদের বাঁচবার আকুতি নিরন্তর পথচলা। মাঝে কিছুটা হলেও অপূর্ণতার আহাজারি কখনো দূরত্ব বাড়িয়ে কষ্টের এক সীমাহীন নরক দেয়াল তোলে। এখানে দুঃখ তেমন আপেক্ষিক নয়। পথ চলতেই হয়। অন্য এক কবিতা ‘প্রেম’ যেখানেঃ
প্রেম বাজারে সব হারালম
এখনো তোমাকে খুঁজি
‘নিশি’ তুমি সুখেই
আছো বুঝি।
তবে তুমি জানলে না
আমি কেমন আছি।
তোমার প্রেমে জীবন হলো মাটি
অথচ আমার প্রেম ছিল খাঁটি
এখনো প্রেম বাজারে হাঁটি।
কবিকে বাঁচতে হয়। বাঁচার প্রেরনা জাগাতে হয়। সময় সময় দ্রোহী হতে হয়? হতে হয় কোমল অথচ অধরা সুখ সময়ের গন্ডি পেরিয়ে আলো-আঁধার মুখ লুকিয়ে রাখে।
ভাবের মন মুগ্ধতা হারিয়ে কখনো ভাবের আকুলতা এক চিলতে উঠোনে বসে। আর তখুনি কবি খুঁজে নেন; অজানা সুখের নীল খামে ভরা একগুচ্ছ শব্দের অমীয় ধারা।
ঠিক একটি কবিতা দু’লাইনে লেখাঃ
দিলরুবা তুই আয়
আমার ভালোবাসার গায়।
‘তোমাকে ও যাচ্ছি ছাড়ি’-সুন্দর স্বপ্নময় ভাবাবেগ কবিতায় শুরুটা এমনইঃ
দুঃখের কালো মেঘ যাচ্ছে উড়ে
আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসায়।
আপনার মানুষ দুরে চলে গেছে
মৃত্যুর বাহারি আয়োজন দেখে
আমি লুকাতে চাই নীলাকাশে।
অথবা ধরে নেয়া যাক আরেক কবিতা ‘ভালোবাসার আলোপনে’
আমার একটি জলাশয় ছিল, জলাশয়ে
হরিৎবর্ণের কচুরি পানা, পদ্মপাতা, শাপলা
সাঁঝের বেলা পদ্ম পুকুর বনে যেতো সুখের লালিত্যে
নজর কাটতো একার এবং আমার
আমরা হারিয়ে ফেলতাম জলাশয়ের পথ। ভালোবাসার আলাপনে।
যেন ভালোবাসার আলাপনে মাহাকাল থেমে গেছে।
প্রেমিক প্রেমিকার পথ স্বপ্ন রচনার
এক মহাকাব্যিক লগ্ন আর ফুরাবার মতো নয়।
সহজ উপমার এমন শব্দময় চিত্র চোখের ভিতরে বসে খুঁজে ফিরে হারানো দিনের সেই সব মধুরতম স্মৃতি। যা আমার আপনার কাছে জলমগ্ন সুখের লালিত্যে শাপলার মতো পুর্ণিমা চাঁদ জলে ফোঁটে। প্রতীক্ষার অবসনে একদিন তো হবে তখনও থাকবে প্রতিশ্রæতির দীপ্তময় উচ্চারণঃ
তুমি মধ্যরাতে এসো
তোমাকে সোনালি সকাল দেবো।
তুমি সকালে এলে
তোমাকে সোনা ঝরা রোদে
এক মুঠো ভালোবাসা দেবো।
তুমি বিকালে এলে
তোমাকে ধুমনদে
ভালোবেসে সাঁতার শেখাবো
তুমি না এলেও
তোমাকেই ভালোবেসে যাবো।
অধরা সুখই বড় সুখ। এ সুখ কখনো ফুরায় না। সাময়িক সুখ আমাদের বড় স্বপ্ন সাজাবার পথে রাক্ষুসী ক্ষুধায় গিলে। কথায় বলে সস্তায় সুখ, বাড়ায় দুঃখ। নইলে হাসন-লালন কবেই মন থেকে মুছে যেতো। সৃষ্টিময় মরমী উত্তাপ জলে নির্জন হয়ে যেতো। তাই তো-‘কতো ভালোবাসি’ কবিতায় দেখিঃ
আমরা এক সঙ্গে
রিকশায় ঘুরছি-ফিরছি
কিন্তু কোন কথা হলো না
বলতে পাললাম না
তোমাকে
কতো ভালোবাসি।
এই না বলা কথাই তো জাগ্রত চেতনায় চির জাগরূপ।
আগুনের ফুলকি তোলে মনের গহীনে। এই আগুন আসে বলেই কবি জেগে ওঠেন ক্রোধে ভালোবাসায় আমাদের মনন মননে। কবি এম এ শোয়েব দুলাল এর কবিতা আমাদের মনন চেতনায় মর্মরে ঝড় তোলে। এখানেই কবির পরম উষ্ণতা। যা ধরা যায় না’ অনুভবের স্পর্শে নিরন্তর ভালো লাগা।(লেখকঃ কবি শিকড় সম্পাদক)