সন্ত্রাস
মারুফ হোসেন মাহবুব
এক
ভার্সিটি ছুটি হয়ে গেলে কয়দিন পরই ব্যাগে জামা, বই আর নিউমার্কেট থেকে টুকিটাকি এটাওটা মা আর ছোট বোনের জন্য কিনে বাড়ির উদ্দেশ্য নাইটকোচে চেপে বসে জুয়েল।
বাড়ি ফিরলেই খেলার মাঠ আর সদ্য ছেড়ে যাওয়া কলেজ ক্যাম্পাস জুয়েলকে ডাকে হাতছানি দিয়ে। আর সব বন্ধুরা যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে তারাও ছুটিতে ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফেরে ছুটি কাটাতে।
ছুটিতে সবার সাথে যোগাযোগটা আরো বেশি হয়। কে ফিরলো কে ফিরলো না এখনো, কেন ফিরলো না, সব ক্যাম্পাসেই তো ছুটি চলছে এখন- সবার খোঁজখবর চলতে থাকে।
বিকেল হলেই সব পুরোনো বন্ধুরা একে একে জমা হয় সদ্য পাশ করে যাওয়া কলেজের মাঠে। ফুটবল খেলে দল বেঁধে সকলে। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে যখন ওরা খেলা থামায় ততক্ষণে ঘামে গেঞ্জি ভিজে গায়ের সাথে লেপটে গেছে সবার। যেন এখনি পুকুরে ডুব দিয়ে উঠে এলো একেকজন। খেলা শেষে বন্ধুরা কেউকেউ মাঠে বসে আড্ডা দেয় আরো কিছুক্ষন কেউকেউ বাসায় ফেরে তাড়াতাড়ি।
কলেজ গেট পেরিয়ে মেইনরোড। রোড ধরে এগিয়ে গেলে চারমাথা মোড় পুলিশ চেকপোস্ট। চেকপোস্ট পেরিয়ে সবুজবাগ। সবুজবাগ মসজিদ পার হয়ে ডানদিকের গলি ধরে সামনে এগিয়ে যেতে হয় বেশ খানিকটা। তারপর একটা দোকান গলির মোড়ে। দোকান বামে রেখে মিনিট দুই হাঁটলেই জুয়েলদের বাসা।
সন্ধ্যা নেমে গেছে একেবারে। জোড়ে পা চালায় জুয়েল। আব্বু খুব রেগে গেছেন, দুশ্চিন্তাও করছেন। আম্মু ফোন করে তাড়াতাড়ি বাসা ফিরতে বলেছেন। মসজিদ পেড়িয়ে ডানে গলি ধরে এগিয়ে যায় জুয়েল।
গলির মুখে দুটি ছেলে সিগারেট ফুঁকছে। আম্মুর কাছে শুনেছে গলিতে বখাটেদের উৎপাত বেড়ে গিয়েছে। গলির মুখে ওরা আড্ডা দেয়। আর গলির ভেতরে কয়েকজন বিভিন্ন জায়গায় ওৎপেতে থাকে। মেয়েরা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই ফাঁকা পেয়ে ছিনতাই করে। কোন আত্নীয় আসলে নতুন মানুষ পেয়ে হেনস্তা করে, মোবাইল- টাকা কেড়ে নেয়।
বাসায় ফেরার দিন নাইটকোচ থেকে নেমে ইউনিভার্সিটির বন্ধু রতনের সাথে রিকশায় বাসায় ফিরছিল জুয়েল। রাত তখন দুইটা পার হয়েছে। কোচস্টান্ড থেকে মেইন রোড ধরে বাসার গলি পর্যন্ত আসার পর জুয়েল রতনকে বললো, আমি নামছি। এখান থেকে বাসায় পায়ে হাঁটা পথ। তুই চলে যা এই রিক্সাতেই। রতন রিক্সায় চলে গেলে জুয়েল গলি ধরে এগিয়ে যায় ব্যাগ কাঁধে ফেলে।
গলির ভেতরের মোড়ে আসতেই দেখে পাড়ার বখে যাওয়া এক বড়ভাই দেয়ালে হেলান দিয়ে এতরাতে সিগারেট টানছে। কাছে যেতেই গাঁজার গন্ধ এসে ধাক্কা দেয় জুয়েলের নাকে।
জুয়েল হেঁটে যাচ্ছে কোন পরোয়া না করে। বখাটে থামায় জুয়েলকে। জুয়েল দাঁড়ায়। কাছে আসলে জুয়েল বলে, আরে রকি ভাই কেমন আছেন?
রকি চিনতে পারে। বলে, এত রাতে কোথা থেকে আসছো।
ঢাকা থেকে। এইতো নাইটকোচ থেকে নেমেই রিকশায় আসছি ভাই, জুয়েল বলে।
কী ভেবে রকি বলে, ঠিক আছে, যাও বাসায়।
জুয়েল ইউনিভার্সিটিতে নিয়মিত জিম করে, খেলাধুলা করে। ফলে কাঁধ যেমন চওড়া হয়েছে, হাতে পায়ের মাসল্ যেন সাপের মত ঢেউ খেলায় জুয়েল একটু কায়দা করে শরীরকে মোচড় দিলে।
রকি জুয়েলকে চিনতে পারায় মোবাইল বা মানিব্যাগ নেয়ার চেষ্টা করলো না, নাকি গায়ের জোড়ে পারবে না ভেবে নিষ্ক্রিয় থাকলো বোঝা গেলো না।
লম্বা পা ফেলে জুয়েল বাসায় ফিরেছিলো সে রাতে।
বাসার সবাই উৎকন্ঠিত ছিলোই, রাস্তায় রকির সাথে দেখা হয়েছে শুনে আরো শংকিত হয় বাবা-মা।
গত সপ্তাহেই আম্মু ছোটবোন তাথৈকে স্কুল থেকে নিয়ে দুপুরে বাসায় ফেরার পথে রকি নির্জন গলিতে আম্মুর ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ব্যাগের সবটাকা বের করে নিয়েছে।
বাসার সবাই দুশ্চিন্তায় আর ভয়ে আছে।
বাবা অফিস থেকে ফিরে ঘটনা জানার পর খুব চিল্লাহাল্লা করেছেন। এলাকায় বসবাস করা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইসব ছেলেপেলে নষ্ট হয়ে গেছে।
আব্বুর মাথা গরম হয়ে গেলে তাকে আটকানো দায়। পরদিন তিনি অফিসে না গিয়ে যান রকিদের বাসায়। রকির মায়ের কাছে গিয়ে অভিযোগ করে আসেন। আশেপাশে অনেকের সাথে দেখা হলে এসব নিয়ে নানা হতাশার কথা বলেছেন আব্বু। তার বড় আফসোস, এলাকাটা এরকম ছিলো না। আর আজ চোর-বাটপার, ছিনতাইকারীর আড্ডাখানা এ পাড়ায়।
এলাকার গণ্যমান্যদের সাথে কথা বলে আব্বু সেদিন বাসায় ফিরেছেন গজগজ করতে করতে।
রকির বাবা মারা যাওয়ার পর গত চার বছরে পাড়ায় নানা মারামারি, চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতে থাকে।
ডিশ লাইনের ব্যবসা নিয়ে রকি প্রতিপক্ষ এক ব্যবসায়ীকে ছুরি মেরে জেলে যায়। বছর দেরেক হলো জেল খেটে বের হয়ে এসে আবার এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বেড়াচ্ছে।
পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে ইদানীং রকি আর তার সাঙ্গপাঙ্গকে।
এলাকার মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না এদের ভয়ে।
রকির মাকে অভিযোগ করার পরদিন জুয়েলের আব্বু অফিসে গেলে আম্মু গলির দোকান থেকে চা আর বিস্কুট কিনে বাসায় ঢোকার সময় গেটের পাশে দেয়ালের আড়াল থেকে রকি বের হয়ে এসে আম্মুর পথ আগলে দাঁড়ায়।
খুব ভদ্রভাবে বলে, আন্টি, কয়টা টাকাই না হয় নিয়েছিলাম আপনার ব্যাগ থেকে। তার জন্য বাসা পর্যন্ত নালিশ করলেন। এলাকার সবাইকে জুটিয়ে জানালেন আঙ্কেল। এখনতো কেউ নাই এখানে। এখন যদি এইভাবে একটা পোচ দিয়ে আপনাকে এই ড্রেনে ফেলে দেই কেমন হবে? বলে একটা চাকু আম্মুর গলায় ঠেকিয়েছিলো।
বাসায় ফিরে এইসব জানার পর জুয়েল স্রেফ চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলো।
দুই
ফুটবল খেলার পর সন্ধ্যায় পেরিয়ে
ঘামে ভেজা গায়ে জুয়েল বাসার গলি দিয়ে ফিরছিলো। গলির ভেতর সামনে এগিয়ে যেখানটায় বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় বেশ অন্ধকার সেখানে একটি মেয়েকে কে একজন টানাহেঁচড়া করছে দেখে জুয়েলের মাথায় রক্ত উঠে যায়। কাছে এগিয়ে যায় সে। দেখে পাড়ার রিক্তা আপুকে রকি টেনে নিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে। রিক্তা আপুর অসহায় কান্না শোনে জুয়েল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। রিক্তা আপুর মুখ চেপে ধরে রকি গাছের আড়ালে দেয়ালের একটা ফোঁকড় দিয়ে ওপাশের ঝোঁপের দিকে নিতে থাকে।
জুয়েলের ঘামে ভেজা শরীরের লেপ্টে থাকা পেশীগুলো অজগরের মত মোচড় দিয়ে টানটান জেগে ওঠে।
জুয়েল এগিয়ে যায় কাছে। চিতাবাঘের মত লাফিয়ে পড়ে রকিকে তুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় গলির রাস্তায়।
ছাড়া পেয়ে রিক্তা আপু ছুটে চলে যায় বাসার দিকে।
রকি পকেট থেকে চাকুটা বের করে জুয়েলের ওপর বারদুয়েক হাত চালায় অন্ধকারে। জুয়ল কয় পা পেছনে সরে এসে এক লাফে দেয়ালের ওপরের দিকে ডানপা দিয়ে বেশ খানিকটা বাতাসে ভেসে রকির পেছেনে কয়েক গজ দূরে চলে আসে।
রকি ঘুরে দাঁড়াবার আগেই কলেজের লং জাম্পে আর একহাজার মিটার দৌড়ে সেরা এ্যাথলেট জুয়েল উড়ে এসে রকির কোমর বরাবর এক কিক বসিয়ে দেয়। কোমড় ভাঁজ হয়ে ছিটকে দূরে গিয়ে কুকুরের মত কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে রকি।
এদিক ওদিক চারপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। জুয়েল একদৌড়ে গলি পেড়িয়ে গেট গলিয়ে বাসায় ঢুকে পড়ে। তারপর থেমে লম্বা দম নেয় কয়েকটা। উত্তেজনা আর বুকের ওটানামা কন্ট্রোল হয়ে এলে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায়। বাথরুমে ঢুকে সাওয়ার ছেড়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করে জুয়েল।
যেন কিছুই হয় নি এমন গম্ভীর আর চুপচাপ জুয়েল বাসার সবার সাথে রাতের খাবার খায়।
তিন
পরদিন ছুটির সকালে আব্বু চা খেতে খেতে খবরের কাগজ দেখছিলেন বেলকনিতে বসে। হঠাৎ একটা খবর দেখে উচ্চস্বরে জুয়েলের আব্বু আলতাফ সাহেব বলতে থাকেন, এই তাথৈয়ের মা, শুনেছো ঘটনা? গতরাতে নিজেদের ভেতর দ্বন্দ্বের ফলে মারামারি করে কোমড় ভেঙে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে রকি। পুলিশ হাসপাতালে নিলে হাসপাতাল থেকে বলেছে, ভাঙা মেরুদন্ড নিয়ে রকিকে নাকি বাকী জীবন হুইলচেয়ারে কাটাতে হবে।
জুয়েল ফ্রেশ হচ্ছিলো ওয়াশরুমে। আব্বুর কথা শুনে বুঝতে পারে ঘটনা কোনদিকে মোড় নিয়েছে।
সে চুপচাপ ছাদে উঠে আসে। ওদের বাসার বিল্ডিং ওপরে আরো উঠবে কয়েকতলা। রডসহ পিলার দাঁড়িয়ে আছে। কলেজে পড়াকালীন পাশাপাশি দুটি পিলারে একতাল ওপরে আড়াআড়ি বাঁশ বেঁধে বক্সিং ব্যাগ ঝুলিয়ে প্রাকটিস করতো জুয়েল। চুপচাপ কালো ব্যাগটা ঝুলছে বাঁশ থেকে। এগিয়ে গিয়ে ঝুলে থাকা ব্যাগের সামনে পেশী টান করে দাঁড়ায় জুয়েল। দুইহাতের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে আপনা আপনি। হাতের পেশিতে যেন সকালের রোদ ঠিকড়ে পড়ে। একটানা পাঞ্চ চালাতে থাকে জুয়েল নানা এঙ্গেল থেকে। ব্যাগের চারপাশে ঘুরে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুষি মারতে থাকে সে । উপর্যুপরি ঘুষির তীব্রতা তার বাড়তে থাকে ক্রমশ।