শ্রেষ্ঠ মানুষ
(A Gateway of Realization)
মনজুরুল ইসলাম
একথা আজ সর্বজন স্বীকৃত যে,একমাত্র প্রকৃত শিক্ষাই জাতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে। প্রকৃত শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমেই কেবল সমাজকে তমসাচ্ছন্ন প্রতিবেশের পরিধি থেকে মুক্ত করে উন্নয়নের চূড়ান্ত শিখরে উন্নীত করা সম্ভব। জাতি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করবারমহান এইদায়িত্ব পালন করেন পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ। বটবৃক্ষ যেমন সুশীতল ছায়ায় ধরিত্রীকে শান্ত করে রাখে তেমনি পিতৃ অথবা মাতৃতুল্য একজন শিক্ষক আজীবন শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষার ছায়া প্রদান করে নিজের সর্বশেষ নির্যাসটুকুও উৎসর্গ করেন। সন্তানতুল্য শিক্ষার্থী মনুষ্যত্ব অর্জনে প্রবৃত্ত হয়ে নৌকোর মাঝির মতো শক্ত করে হাল ধরে সমাজ পরিবর্তনের ভার গ্রহণ করবে; এটিই একজন শিক্ষকের নিবেদিত কর্তব্য এবং আজীবনের লালিত স্বপ্ন। পৃথিবীর সকল শিক্ষকেরই অন্তরাত্মায় স্বর্গীয় শান্তি অনুভূত হবে তখনই, যখন শিক্ষার্থী সেই কাক্সিক্ষত স্বপ্ন পূরণে সমর্থ হবে। কিন্তু, স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিবর্তে যখন কোনো শিক্ষার্থী বিপথে পরিচালিত হবে, শিক্ষক যখন চোখের সামনেই কোমলমতি শিক্ষার্থীকে ঠিকানাবিহীন পথের অকূল পাথারের প্রচ্ছন্ন ভেলায় ভাসতে দেখবেন তখন তাঁর অন্তরে যে কষ্ট অনুভূত হবে, ভাষার বৃত্তাবদ্ধ আবর্তের ভেতর দিয়ে তার প্রকাশ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শিক্ষকের লক্ষ্যকে যখন কোনো শিক্ষার্থী নিজ জীবনের লক্ষ্য ও স্বপ্ন হিসেবে অন্তরে গ্রন্থিত করবে তখন শিক্ষক তঁাঁর শিক্ষা প্রদানকে সার্থক বলে বিবেচনা করতে পারবেন।
তাই বলতে দ্বিধা নেই, শিক্ষকের এই অনন্ত স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। ইদানীং কোনো শিক্ষার্থীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার স্বপ্ন কী? উত্তরে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেই সে বলবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা প্রশাসক। কিন্তু, প্রথমে কখনোই সে বলবার তাড়না বোধ করবে না যে, আমি একজন আদর্শ মানুষ হতে চাই। বস্তুত, একজন শিক্ষার্থীর যথার্থ লক্ষ্য হওয়া উচিত সুশিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে সৎ এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। দ্বিতীয়ত, পেশাগত উন্নয়নের জন্য কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং প্রশাসক হওয়ার ঈপ্সিত স্বপ্ন পূরণ করা। কিন্তু, পেশাগত উন্নয়নকেই যদি কোনো শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণের মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে লক্ষ্য স্থির করে, তবে সেই শিক্ষা দিয়ে প্রত্যাশিত সামাজিক কল্যাণ কখনোই সম্ভব নয়। এমনকি, ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার পরও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাকে সুখী মনে হলেও প্রকৃত প্রেক্ষিতে সে সুখী নয়, সুখী হতে পারে না।
বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ব্যতীত ভিন্ন কোনো শিক্ষককে সম্মান প্রদানের ক্ষেত্রে কৃপণতার পরিচয় দেয়। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি আমার স্কুল, কলেজ অথবা বিভাগের শিক্ষক নয় বলে একটি অদৃশ্য যুক্তি দাঁড় করায়।কিন্তু, হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করতে হবে শিক্ষক শিক্ষকই, তিনি নিজ বিদ্যায়তন বা অন্য কোনো বিদ্যায়তনের হোক, বরং অতিথি কোনো শিক্ষকের পরিচয় জানবার পরেও যদি কোনো শিক্ষার্থী তাঁকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করে তবে তার প্রতি ওই শিক্ষক সন্তুষ্ট থাকবার পাশাপাশি তার নিজ শিক্ষকের প্রতিও উচ্চ ধারণা পোষণ করবেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএস এবং স্কুল শিক্ষকের ওপর ভিত্তি করে সম্মানকে কখনোই বিভক্ত করা যাবে না। একজন শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ বিকাশে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানরত শিক্ষকবৃন্দের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। বরং, উন্নত চরিত্র গঠন ও নৈতিক শিক্ষার বীজ বপনে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাই, সমাজের সকল শিক্ষকবৃন্দের প্রতি সমভাবে সম্মান প্রদর্শন একজন প্রকৃত শিক্ষার্থীর নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য হওয়া উচিত নয় কি? সেই চিরন্তন দায়বদ্ধতা পালনের অমোঘ আকর্ষণ যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অন্তর্জগতে চিরকালের জন্য উদ্ভাসিত হয়, সেটি আমাদের সকলেরই অকৃত্রিম অভিপ্রায়। সেই অভিপ্রায়কে সামনে রেখেই হৃদয়ের গহীন কোণ থেকে উৎকলিত ভাবনার প্রতিটি পালক তুলে দিলাম তোমার মতো একজন শিক্ষার্থীর হাতে-
ভবিষ্যতের জ্ঞানী হিসেবে তোমার আচার-আচরণ, চিন্তন ক্ষেত্র, দৃষ্টিভঙ্গি হবে একজন প্রকৃত জ্ঞানী মানুষের মতোই যাতে নিরক্ষর কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তোমার পার্থক্য স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। পেশাগতভাবে রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, রাজমিস্ত্রি অথবা কাঠমিস্ত্রিজাতীয় মানুষজন এবং এ জাতীয় মানুষের ঊর্ধ্বে অবস্থানকারী কোনো শ্রেণি নির্বিশেষে যে কোনো মানুষের সঙ্গে উদ্ধত আচরণ কখনোই তোমার ব্যক্তিত্বের শোভনতাকে উজ্জ্বল করবে না। বরং, সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে শ্রমিক অথবা তাদের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো ব্যক্তির প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের হাড়ভাঙা শ্রমকে যদি তুমি শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করে নাও তবেই তোমার জীবন হবে পূর্ণ মহিমান্বিত। কুলি, দিনমজুর, ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির সঙ্গে তোমার আচরণ সব সময়ই হবে মানবোচিত। কিন্তু, অর্থনৈতিক অপ্রতুলতা, সামাজিক মর্যাদা এবং দারিদ্র্যের ওপর ভিত্তি করে যদি তুমি মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রদর্শন করো তবে বুঝতে হবে, তোমার ভেতরে প্রকৃত শিক্ষার আলো প্রজ্বলিত হতে পারেনি। সেক্ষেত্রে স্বার্থ সিদ্ধ করণের পথ অন্বেষণই যে তোমার শিক্ষা গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য ছিল তা জলের মতো স্পষ্ট হবে। সুতরাং, শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান এবং মানব সম্মান প্রদর্শনে যাতে কোনো ধরনের বৈষম্য পরিলক্ষিত না হয়, সর্বাগ্রে সেদিকে সচেতন হওয়াই তোমার উচিত। জাপানি এবং চীনারা খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে বর্তমানের যে অবস্থানে উঠে এসেছে সেই অবস্থানে উন্নীত হবার গূঢ় রহস্যই হচ্ছে- কাজকে কাজ হিসেবে বিবেচনা করা এবং মানুষকে মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়া। কাজের ধরন এবং বিনিময়ের ওপর ভিত্তি করে মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। মানতে হবে, পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষেরই সম্মান পাবার ন্যূনতম অধিকার রয়েছে। একমাত্র প্রকৃত শিক্ষাই তোমার মধ্যে সেই মূল্যবোধ সৃষ্টি করবে, যার মাধ্যমে তুমি মানুষকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করতে শিখবে।
ফার্স্টবয় অথবা প্রথম সারির শিক্ষার্থী হিসেবে তুমি হয়ত গর্ব অনুভব করতে পারো, কিন্তু কোনোভাবেই সে কারণে অহংকারী হতে পারো না। বরং, তোমার পদভারে যেন অহংকারের পাহাড় কেঁপে ওঠে, সে লক্ষ্যেই তোমাকে এগুতে হবে। ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি কীভাবে ভালো ভালো মানবিক গুণাবলি অর্জন করা যায় তার জন্য নিরলস চেষ্টা করে যেতে হবে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অবহেলা না করে বরং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। তুমি কোনো একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছো, শুধু এ কারণে দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন কখনই তোমার চরিত্রের উজ্জ্বলতাকে দীপ্ত করবে না। তাদের এড়িয়ে না চলে বরং তোমার প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা তাদের সঙ্গে বিনিময় করলে অন্তিমে তুমিই লাভবান হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে তোমার মানসিকতাকে যে তুমি বিশ্বমানে উন্নীত করেছ সেটিই তোমাকে প্রমাণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে শিক্ষা শব্দটিকে উপভোগ্য এবং প্রাণবন্ত করে তোলাই হবে তোমার মূল লক্ষ্য। অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে তোমাকে ছোটো ভাই, বোন, বন্ধু, প্রতিবেশী শিক্ষার্থীদের উৎসাহ জুগিয়ে যেতে হবে। দেখবে, তোমার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি আপনা আপনি জন্ম নেবে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য যেমন তোমাকে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে, ঠিক তেমনি মানসিক উন্নয়ন সাধনের ক্ষেত্রে প্রকৃত প্রতিযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। নিজের মধ্যে নিহিত লোভ, লালসা, হিংসা, ক্রোধ, কাম এবং অসংযমী মনোভাব নির্মূলের জন্য সবসময়ই যুদ্ধ করে যেতে হবে নিজের সঙ্গে। পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার চেয়ে বরং দ্বিতীয়, তৃতীয় এমনকি দশমও হও সমস্যা নেই, কিন্তু উপর্যুক্ত নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো পরিত্যাগ করে যদি নিজেকে একজন সৎ এবং যোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত করতে পারো তবেই তোমার শিক্ষা হবে সার্থক। দেখবে, তুমি হয়ে উঠছো সকলের অনুকরণীয়, সকলের ভালোবাসায় তুমি হচ্ছো সিক্ত। তোমার জীবন এবং জগৎ হবে উন্নততর এবং ঐশ্বর্যমÐিত।
ইন্টারনেট, ফেসবুক অথবা মুঠোফোনের অপ্রয়োজনীয় নেতিবাচক ব্যবহারে মূল্যবান সময় নষ্ট না করে বরং বিকেলে মাঠে গিয়ে ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলায় অংশগ্রহণ করো, তাহলে শারীরিক এবং মানসিক, উভয় দিক থেকেই তুমি লাভবান হবে। তারুণ্যকে কাজে না লাগিয়ে উলটো বৃদ্ধ মানুষের মতো হাত পা গুটিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু উপভোগের লক্ষ্যে ফুটবল, ক্রিকেট অথবা অন্য কোনো খেলা দেখে সময় অপচয় করা কোনোভাবেই তারুণ্যের প্রতীক হতে পারে না। সর্বোচ্চ মাত্রার অলসরাই এই কাজটি করে তারুণ্যের মৌলিক অগ্রগামীতাকে বিনষ্ট করে দেয়। বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি অতিমাত্রায় অনুরক্ত না হয়ে দেশীয় সংস্কৃতি ধারণ ও গভীরতা অন্বেষণে অগ্রগামী হবার চেষ্টা করতে হবে। অশ্লীল পত্রিকা এবং বই পড়ে নিজের নিষ্পাপ মনকে কোনোক্রমেইকলুষিত করা যাবে না। দুষ্ট বন্ধুর প্ররোচনায় ধূমপান অথবা ঐ জাতীয় কোনো আসক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়লে নিজেকে ধ্বংসকরণের কাজটি প্রশস্ত হবে। শখের বশবর্তী হয়ে সিগারেটের একটি টান হয়ত ক্রমান্বয়িকভাবে তোমাকে এক পর্যায়ে নিয়মিত ধূমপায়ীতে পরিণত করবে, যা থেকে হাজার চেষ্টা করেও তুমি ফিরে আসতে পারবে না। বন্ধু অথবা বন্ধুস্থানীয় কোনো ব্যক্তির অসৎ পরামর্শে প্রলুব্ধ হয়ে নিজের চরিত্রের স্খলন ঘটানো যাবে না। আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন অবৈধ সম্পর্কে নিজেকে না জড়িয়ে যতটা দূরত্ব বজায় রাখা যায় ততটাই রাখতে হবে। ক্ষণিকের স্বল্প সুখের আশায় চিরস্থায়ী দুঃখ বরণ করা কখনোই কোনো বুদ্ধিমানের পরিচয় হতে পারে না। যত কষ্টই হোক চরিত্র সমুন্নত রাখার চেষ্টা করতে হবে। গোলাপের পাপড়ি ঝরে গেলে যেমন শুধুই কাঁটা থেকে যায় তেমনি মানুষের চরিত্র একবার নষ্ট হয়ে গেলে সমস্ত জীবনটাই কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ে, যা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে অনুশোচনার যন্ত্রণায় দগ্ধ করবে। শুধু সততা এবং মনুষ্যত্বের বীজ তুমি একবার তোমার চরিত্রে বুনতে পারলে ছাত্রাবস্থায় যতই দুর্বল অবস্থানে থাকো না কেন ব্যবহারিক জীবনে অবশ্যই সফল হবে।
সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে খুব কম লোকই আছেন যারা বইকে নির্বাচন করেন। আমরা সহজেই ভুলে যাই, বই পাঠের ওপর আগ্রহ সৃষ্টি এবং সে সৃষ্টির প্রতি অবিচল আস্থা রেখে সৃষ্টিটিকে যদি যে কোনো দুর্বল জাতির ওপর প্রক্ষিপ্ত করা যায় তাহলে সে জাতি সময়ের পরিক্রমায় একদিন অনিবার্যভাবে সবল হয়ে উঠবে। বইয়ের প্রতি আমাদের চরম উদাসীনতা আমাদের জাতিসত্তার দুর্বলতাকেই উন্মোচন করে। সাধারণভাবে লক্ষ করা যায়, আমাদের শিক্ষার্থীরা ভিন্ন দেশের আড়ম্বরপূর্ণ পোশাক, মুঠোফোন অথবা এ ধরনের কোনো কিছু কিনবার বেলায় যতটা উদগ্রীব, মানসিক শ্রী বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উদ্দীপনা প্রদানের একমাত্র বাহন বই কিনবার ক্ষেত্রে ততটাই কৃপণ। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই ক্রয়ের প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অনেকেই স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্য অধিক হারে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে নোট এবং গাইড জাতীয় বইয়ের ওপর যেটি মানসিক উন্নয়ন সাধনের ক্ষেত্রে চরমভাবে অন্তরায়। হয়ত কোনো শিক্ষার্থী তার পুরো শিক্ষাজীবনে একটি মূল বই ক্রয় না করে কিংবা চোখে না দেখেও উচ্চশিক্ষার সনদ অর্জন করছে। সবচাইতে দুর্ভাগ্যের বিষয় যেটি, সেটি হলো; বিশ^বিদ্যালয় এবং কলেজ লাইব্রেরিগুলিতে প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীরা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে পড়াশুনা করছে এবং তাদের এই নেতিবাচক দৃশ্যটি অবলোকন করতে করতে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে লাইব্রেরির তাকে সাজানো হাজার হাজার ধ্রæপদী গ্রন্থ। এমন অবস্থা চলতে থাকলে জাতি যে ধীরে ধীরে মেধাশূণ্য হয়ে পড়বে তা সহজেই অনুমেয়।
তাই, ধ্রæপদী হিসেবে পরিচিত বইকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে নির্বাচনের পাশাপাশি বিদ্যালয়, পাঠাগার এবং শিক্ষকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা মূল বিষয় উত্তীর্ণ হবার একটি অবশ্য পূরণীয় শর্ত। বই পড়া এবং ক্রয় করাকে যদি যে কোনো নেশার পরিপূরক হিসেবে গ্রহণ করা যায় তাহলে নিজের জ্ঞানকে যতটা সমৃদ্ধ করা যাবে, একই সঙ্গে ঠিক ততটাই জাতীয় জ্ঞানও সমৃদ্ধ হতে পারবে। সে প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সামাজিক অথবা সমমানের অন্য কোনো অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে সবার আগে বইকে নির্বাচন করা হবে বাঞ্ছনীয়। প্রতি মাসে ছোটো খাটো টুকিটাকি ব্যয়ের মধ্য থেকে যেমন বাদাম, আইসক্রিম ও মোবাইল খরচের জন্য নির্ধারিত অর্থ থেকে অন্তত কিছু টাকা বাঁচিয়ে হলেও বই কেনবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এটি করলে দেখবে- শিক্ষাজীবন শেষে তুমি একটি ছোট্টলাইব্রেরির অধিকারী হয়ে গেছ যা তোমার মানসিক সমৃদ্ধিকে স্ফীতির দিকে নিয়ে যাবে।এ প্রেক্ষিতে অভিভাবকবৃন্দ যদি সামর্থ্য অনুযায়ী সৃজনশীল পুস্তক ক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তাদের সন্তানদের জন্য সঞ্চয় করতে পারেন সেক্ষেত্রে জাতীয় জ্ঞানের উৎকর্ষ অর্জনে সেটি বিবেচিত হবে একটি অনবদ্য অবদান হিসেবে। দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক সর্বশেষ বাৎসরিক ভিত্তিতে হলেও যদি একটি বই পঠন সম্ভব হয় দেখবে সারাজীবনে অনেক বই পাঠ করে তুমি তোমার অভিজ্ঞানের সড়কটিকে তোমার অজান্তেই অনেক দীর্ঘ করে ফেলেছ।যে সাহিত্য তোমার চেতনার জগৎকে প্রসারিত করবে, ব্যক্তিত্বকে উন্নত করবে, মানব কল্যাণে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করবে সে জাতীয় বই পাঠ করাই হবে তোমার জন্য সবচাইতে উপযোগী।
ধনসম্পদ ভিত্তিক পরিবার অথবা দারিদ্র্য, নির্বিশেষে যে কোনো পরিবারের সন্তান হলেও গ্রন্থ পাঠ আত্মনির্মাণের ক্ষেত্রে যে অনিবার্য উপাদান এই ধারণা থেকে কোনোভাবেই বিচ্যুত হওয়া যাবে না। একমাত্র নির্বোধরাই জ্ঞানার্জনের চেয়ে ধন অর্জনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অভিজাত ও অর্থভিত্তিক সম্পদশালী পরিবারের সন্তান হয়েও ধন-সম্পদ, ভোগ-বিলাস, প্রাচুর্যের মোহ দার্শনিক ইবনে সিনা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ইংরেজ প্রাবন্ধিক জন লককে অধ্যয়ন থেকে কোনোভাবেই নিবৃত্ত রাখতে পারেনি। জ্ঞান অন্বেষণ ও অর্জন সাধনায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঋণী করে গেছেন তাঁরা।
কখনো কি ভেবে দেখেছ তোমার কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক অথবা ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত তোমার পিতা অথবা বিধবা মাতা কী পরিমাণ কষ্ট করে তোমাকে গড়ে তুলবার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ তোমাকে প্রদান করছেন? প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্ব-স্ব নিয়ম অনুযায়ী ফরম পূরণ, ভর্তি ফি, গ্রন্থ ক্রয় ও শিক্ষা ভ্রমণের জন্য যে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন তা যোগান দিতে তাদেরকে কী পরিমাণ কষ্টের ঘাম ঝরাতে হয়েছে, এমনকি তাঁরা ঋণ পর্যন্তও গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই, তাঁদের কষ্ট ও যন্ত্রণাকে তাদের চাইতে দ্বিগুণ মাত্রায় উপলব্ধি করবার দক্ষতা অর্জনে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছ বলে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সাথে তাল মিলিয়ে চলবার চেষ্টা করলে আত্মসর্বনাশকেই যেমন আহŸান জানানো হবে তেমনি পরিবারকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার কাজটি সম্পন্ন হবে। এই ধরনের প্রতিযোগিতা ও প্রবণতা থেকে প্রতি মুহূর্তে দূরে থাকতে হবে। বাস্তব অবস্থার ভিতটিকে তাদের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরবার চেষ্টা করলে দেখবে একদিন তারাই তোমার সততাকে শ্রদ্ধা করছে। পক্ষান্তরে, প্রাইভেট, পাবলিক অথবা জাতীয়সহ যে কোনো প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী হিসেবে কোনো যৌক্তিক কারণ ব্যতীত অর্থের অপচয় করলে অর্থের অপচয়টি হবে তোমার অভিভাবকের ওপর একটি বাড়তি চাপের সমান।
মেডিক্যাল কলেজের একজন গর্বিত শিক্ষার্থী হিসেবে যেদিনই প্রথম কলেজে পা রাখবে সেদিনই তোমাকে প্রতিশ্রæত হতে হবে- স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিগ্রি অর্জন করবার পর নিজেকে নিয়ত দুস্থ অথবা মানবতার সেবায় উৎসর্গ করবার। অসহায়দের কথা ভেবে চোখ বন্ধ করে ভাবনার জগতে প্রবেশ করো, দেখবে, চরাঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চল, উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্তনাদ তোমাকে কতটা সমব্যথী করে তুলছে। তোমাকে মনে রাখতে হবে, তোমার সেবা প্রাপ্তির আকাক্সক্ষায় কত অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন গোটা দেশের মানুষ। প্রতিদিন রাস্তার পাশে, নদীর তীরে, বালুরচরে, পাহাড়ের পাদদেশে এবং বস্তিতে বসবাসরত অসংখ্য আর্তপীড়িত মানুষ দূরদূরান্তর থেকে বুকভরা আশা নিয়ে সঠিক চিকিৎসা পেতে ছুটে আসছেন তোমার হাসপাতালেই, তোমার কাছেই। শুধু প্রকৃত সেবার মাধ্যমে তুমিই পারবে তাদের বিষাদপূর্ণ বিষণœ মুখমÐলে বিষণœতার ছায়াটিকে লুপ্ত করে তোমার অনাবিল হাসিটুকু প্রতিষ্ঠা করতে। তোমাকে দ্বিতীয়বার মনে রাখতে হবে, তোমার যা কিছু অর্জন তার নেপথ্যে শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে সংগৃহীত জাতীয় রাজস্বের কথা। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক চ্যানেলসমূহে পরিবেশিত তথ্যবহুল, সেবামূলক এবং অভিযানভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলো দেখলে বুঝতে পারবে, বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রসমূহে একটি পশু পর্যন্ত অসুস্থ হলে কতটা নিবিড় পরিচর্যায় চিকিৎসকবৃন্দ সেটিকে সুস্থ করে তুলবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করে চলেছেন। আর মানুষ হলে তো কোনও কথাই নেই। এক এক জন দুঃস্থ রোগীকে তোমাকে গ্রহণ করতে হবে ভবিষ্যতের এক একটি মহৎ কাজের দৃষ্টান্ত হিসেবে। আর দুঃস্থ রোগীদের হাস্যোজ্জ্বল মুখের প্রতিচ্ছবিগুলো যখন তোমার মানসপটে ভেসে উঠবে তখন হৃদয়ে যে প্রশান্তি অনুভব করবে তা যে কোনো পরিমাণ অর্থের বিনিময়েও কখনোই কিনতে পারবে না।
ডাক্তার হলে হতে হবে এডওয়ার্ড জেনারের মতো, যিনি গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনবার পরেও ইংল্যান্ডের একটি অঞ্চল বার্কলের সেই দুঃখিনী মায়ের পঞ্চম সন্তানকে বাঁচাতে না পারার গøানিমিশ্রিত যন্ত্রণা এবং অনুশোচনায় জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দগ্ধ হয়েছেন। জীবনের শেষ দিকে এসেও তিনি বহুবার বহুভাবে সেই দুঃখিনী মায়ের অনুসন্ধান করেছিলেন, যার সন্তানটিকে তিনি বাঁচাতে পারেন নি। এ ধরনের অন্তহীন ভালোবাসাই ছিল এডওয়ার্ড জেনারের, দরিদ্র রোগীদেরকে আপন করে নেবার মূল আত্মিক শক্তির ভিত্তি। ইচ্ছে করলে এবং সে ইচ্ছের প্রতি সর্বশেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবিচল থাকলে কোনো একদিন হয়ত তোমাকেও ডাক্তার এডওয়ার্ডের কাছাকাছি খুঁজে পাওয়া যাবে। এতটুকুু ভালোবাসা, এতটুকুু মমতা, এতটুকুু দায়িত্বশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন শুধু রোগীদেরকেই নয়, তোমারো মানসিক স্বাস্থ্যকে উচ্চ মাত্রায় উন্নীত করবে। তখন লক্ষ করলে বুঝতে পারবে, মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যায় কীভাবে; যে অর্জনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অন্য কোনো অর্জনে সারা পৃথিবীতে নেই।
একইভাবে যদি নিজেকে প্রকৌশলী হিসেবে গড়ে তুলে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার সাথে তোমার নির্ধারিত কর্মটি সম্পন্ন করতে পারো তাহলে কর্মটি সম্পন্ন হবার পরমুহূর্তেই দেখতে পাবে, তোমার মতো সুখী আর কেউ নেই। কারণ, তুমি তোমার সৃজনশীলতার সৃষ্টিটিকে কাজে লাগিয়ে একটি সৃজনশীল সৃষ্টিকে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছ। কিন্তু, উৎকোচ গ্রহণের বিনিময়ে আত্মসিদ্ধির জন্যে দায়িত্ববোধে অবহেলা করে মা, মাটি ও মাতৃভূমির সাথে প্রতারণার চেষ্টা করলে কখনোই সেই অমিয় সুখ সৃষ্টি করতে পারবে না।
অর্থের প্রয়োজন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে, তোমারো থাকবে-এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু, নিজের আপেক্ষিক মেকি সুখ সৃষ্টির লক্ষ্যে অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জনের প্রবণতা অবশ্যই তোমাকে পরিত্যাগ করতে হবে-যদিও এ অর্থ অর্জনের উপায় অনায়াসেই বহুভাবে তোমার সম্মুখে উন্মোচিত হতে থাকবে। মনে রাখতে হবে, যে কোনো সাময়িক বিষয় সময়ের পরিক্রমায় সাময়িকই থেকে যাবে- স্থায়িত্ব লাভ করতে পারবে না। সেদিক থেকে যে মুুুুুুুুুুুুহূর্তেই তোমার ভিন্ন পথে উপার্জিত অর্থের প্রাচুর্য শেষ হয়ে যাবে তখন সবার কাছে তোমার মূল্যায়ন হবে নিকৃষ্টতম, অবলীলায় মুখ ফিরিয়ে নেবে সবাই তোমার কাছ থেকে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পরিবারের কেউই তোমার পাশে এসে দাঁড়াবে না। তুমি হবে প্রকৃত অর্থেই নিঃস্ব। শেকসপিয়রের বিখ্যাত সৃষ্টি “টাইমন অব এথেন্স” পড়বার সুযোগ হলে দেখতে পাবে নায়ক “টাইমনের” পরিণতি কতটা ভয়াবহ ও মর্মান্তিক হয়েছিল। অথচ এই টাইমানই যখন সম্পদশালী ছিলেন তখন সবার মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে উদার হস্তে অর্থ ব্যয় করেছিলেন। টাইমানের মতো করুণ পরিণতির পুনরাবৃত্তি কখনোই যেন তোমার জীবনে না ঘটে সেদিকটির দিকে তোমাকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো লক্ষ রাখতে হবে। নইলে সময় আসবে যখন তুমি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের প্রতিই হয়ে পড়বে বীতশ্রদ্ধ।
মূল কথাটি হচ্ছে- শিক্ষক, সাংবাদিক, জজ, ব্যারিস্টার, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, মন্ত্রী, এম.পি সহ নিজেকে যে পেশাতেই নিয়োজিত করো না কেন, তোমার ওপর অর্পিত দায়িত্বটিকে যদি একশত ভাগ সততার সাথে নির্বাহ করতে ব্যর্থ হও তবে এ ব্যর্থতার গøানি তোমার মানসিক প্রসারতাকে এতটাই সংকুচিত করে ফেলবে যে, তুমি নিজেকেই নিজে ঘৃণা করতে শুরু করবে। এবং এমনও সময় আসবে যখন তুমি নিজেকে নিজেই ক্ষমা করতে পারবে না। একজন দক্ষ শাসক কিংবা প্রশাসক হিসেবে সমগ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে নিরপেক্ষ হবার চেষ্টা করাটা বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়বে। কিন্তু, এটি করতে গেলে প্রতি মুহূর্তে তোমাকে একাধারে নিজের সঙ্গে এবং বহিরাগত প্রলোভনের সঙ্গে নিরলস যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এখানে কারো কিছু বলবার অথবা সে উপহাসসূচক মন্তব্যকে যদি সঙ্গত মনে না হয় তাহলে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে তাৎক্ষণিকভাবে সে প্রলোভনকে অগ্রাহ্য করতে হবে। তোমার ন্যায়ভিত্তিক সিদ্ধান্তের প্রতি যদি তুমি প্রতি মুহূর্তে অটল থাকতে পারো তাহলে স্রষ্টার অনুগ্রহ প্রাপ্তিও তোমার জন্য কঠিন হবে না। কিন্তু, দুর্নীতির কাছে মাথা নত করাই হবে তোমার আত্মহননের মূল উপাদান। আর, এ জন্য সততার চর্চা শুরু করতে হবে শিক্ষাজীবনের প্রারম্ভেই এবং সেই অর্জিত সততা অনুশীলন করে যেতে হবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে নিজ ব্যক্তিত্বকে কখনোই বিসর্জন দেয়া যাবে না। মানুষের জীবনের কর্মক্ষেত্র ব্যাপক এবং বিস্তৃত-এটি সর্বজন স্বীকৃত। জীবনে সফল হতে চাইলে ধৈর্যশীল এবং আত্মত্যাগী হবার আগ্রহ ধারণ করতে হবে প্রথম থেকেই। দেখবে, সাফল্যের নক্ষত্র ঠিকই একদিন না একদিন মধ্যগগনে এসে তোমার জীবনকে প্রবল আলোক রশ্মির উজ্জ্বলতায় সমুজ্জ্বল করে তুলবে। আনন্দের স্রোতধারায় তুমি হয়ে উঠবে উদ্বেলিত, উদ্ভাসিত এবং অনন্য। সাফল্যের আবেগঘন মুহূর্তে অতীতকে স্মরণ করবে শ্রদ্ধাভরে। যে শিক্ষক অথবা সমমানের স্বজনের উপদেশ এবং অনুপ্রেরণাকে লালন করে বাস্তব জীবনে তুমি সফল হয়েছ তাদের প্রতি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কৃতজ্ঞতাবোধে আবদ্ধ থাকতে হবে। তোমার কোনো ধরনের আচরণে তারা যেন আহত না হন সে দিকটির প্রতি তোসতর্ক দৃষ্টি রাখবেই, পাশাপাশি তোমার ব্যবহার ও আনুগত্যবোধে যেন তারা গর্ববোধ করতে পারেন সেজন্যও প্রাণপণ চেষ্টা করতে পিছপা হবে না। মনে রাখতে হবে, সাফল্যের সময় যে অতীতকে স্মরণ করে সেই মহান। কারণ, অতীতই ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ করে দেয়। বস্তুত সেই স্বর্ণালি অতীত যত কষ্টের গ্রন্থিতে গ্রন্থিত হোক না কেন, সেই গ্রন্থি তোমার সফল জীবনের অন্তর্জ্যােতিকে দ্বিগুণ মাত্রায় আলোকিত করবে।
শুধুই অর্থ উপার্জনে বিশেষ কোনো কৃতিত্ব নেই। একজন ভিক্ষুক থেকে শুরু করে কোটিপতি পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকেই অর্থ উপার্জন করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এটিই মনুষ্য সমাজের একটি চিরন্তন রীতি। কিন্তু, সুখ অন্বেষণের একমাত্র অবলম্বিত উপায় হিসেবে যদি অর্থ প্রাপ্তিকে মূল হিসেবে ধরা হয় এবং পাহাড় পরিমাণ সম্পদ অর্জন করবার পরেও যদি কেউ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্লান্তিহীনভাবে রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয় সৃজিত“হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ এ ম্যান নিড?’’ গল্পের চিরায়ত চরিত্র ‘পাখোম’ এর মতো সম্পত্তির লোভে নিরন্তর ছুটতে চান তাহলে সেখানেই সবচাইতে বড় ভুলের বীজটি রোপিত হবে। অতিরিক্ত সম্পত্তি অর্জনের ইচ্ছে যে একজন মানুষের জীবনে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে সেটিই গল্পকার গল্পের মূল চরিত্র ‘পাখোম’ এর শোচনীয় পরিণতি ফুটিয়ে তুলবার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। ভুলে গেলে চলবে না যে “সুখ” শুধুই একটি আপেক্ষিক বিষয়। অন্তর স্বচ্ছ থাকলে একটি ক্ষুদ্র বস্তুর মাধ্যমেও তা উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু, অন্তর অস্বচ্ছ অথবা আলোকিত না হলে বড় কিছু প্রাপ্তির যোগ ঘটলেও সুখের আস্বাদন অধরাই থেকে যায়। এখানে মনে রাখতে হবে, সুখ যে ধরনের অনুভূতি ধারণ করে সে ধরনের অনুভূতির উপলব্ধি সৎকর্ম এবং সৎকর্মের জন্য আত্মত্যাগের অঙ্গীকার যার অনুভবে সক্রিয় থাকবে সেখান থেকেই সুখ উপলব্ধ হবে। এবং পাশাপাশি এই সুখ উপলব্ধ হবার পর অবশ্যই মনে হবে, অর্থগত সম্পদের পরিমাণ অথবা অন্য কোনো সমমানের প্রাচুর্য উপলব্ধ সুখকে কোনোভাবেই প্রতিহত ও ম্রিয়মাণ করতে পারবে না। এর সঙ্গে যদি সততা, চারিত্রিক উৎকর্ষ, নির্লোভ, নিরহংকার এবং অহিংসার মত অসাধারণ গুণাবলিকে ধারণ করা যায় তাহলে অর্থগত সম্পদ অর্জনের প্রবণতা আপনা আপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। দেখবে, জীবনের চলার পথ হবে স্বচ্ছ এবং মসৃণ।
প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে তোমার নিজ প্রয়োজনেই। মৌহূর্তিকভাবে স্মরণ করতে হবে- তোমার শৈশব, তোমার কৈশোর- এই সময়গুলিতে তোমার হাঁটতে চলা, অসুস্থতায় তোমার প্রয়োজনীয় শুশ্রƒষা, বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় পরিচর্যা এবং বিদ্যালয় ছুটির পর বাড়িতে ফিরে আসলে তোমার কাক্সিক্ষত মমতা, তুমি কাদের কাছ থেকে পেয়েছিলে? নিশ্চয়ই এখন তুমি বলবে অথবা প্রশ্নটির উত্তর দেবে এভাবেই- অবশ্যই আমার মা এবং বাবা। এরা দু’জনেই আমার শৈশব, কৈশোর এমনকি তারুণ্যেও আমার কাজের উৎসাহদাতা, শিক্ষার উৎসাহদাতা এবং মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবার মূল অনুপ্রেরণা। আমি যখন ভালো রেজাল্ট করে বাসায় ফিরতাম সবার আগে তারাই আমাকে তাঁদের বুকে জড়িয়ে নিতেন। শুধু তাই নয়, চাকরির জন্য যখনহন্যে হয়ে ছুটতাম, হতাশা আমায় আঁকড়ে ধরতো তখন তারাই আমার ইচ্ছাশক্তিকে জাগিয়ে তুলতেন প্রবলভাবে। এবং আমার সুখের জন্য, আমার উন্নত ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করবার জন্য তাঁদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আমি যেন হাসিমুখে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারি, জীবনের সকল গøানি মুছে সফলতার শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছতে পারি, এটুকুর জন্যই জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন তাঁরা।
তুমি কি কোনো মায়ের সন্তান প্রসবের কষ্ট বিজড়িত মুহূর্ত অনুভব করতে পারো? একজন প্রসূতিই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারেন সন্তান প্রসবের বিরতিহীন অব্যক্ত যন্ত্রণা। অবিশ্রান্তভাবে অসীম ধৈর্যের সাথে ৩১০ দিন সীমাহীন কষ্ট সয়ে সয়ে প্রহর গুনবার পর যখন একজন মা শিশুটিকে প্রসব করে সূর্যের আলোর মুখোমুখি করান, তখন তাঁর গগনবিদারী আর্তনাদে পুরো পৃথিবী প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। অতঃপর, সেই আলোতে যখন গর্ভিণী মা শিশুটির কচি মুখটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর দীর্ঘদিনের যন্ত্রণা, কষ্ট, ক্লান্তি সবই তিরোহিত হয়ে যায়। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে যে জীবনটিকে একজন চিরস্বার্থহীন মা পৃথিবীতে আনয়ন করেছিলেন তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এক মুহূর্তের জন্যে কি তিনি ভুলে থাকতে পেরেছিলেন? নিশ্চয়ই তুমি বলবে- একি ভোলা সম্ভব!
সেই প্রিয়মুখ গর্ভিণী মা আর বাবা আজ বয়সের ভারে ক্লান্ত। তাঁরা আজ বড় নিঃস্ব, বড় অসহায়। তবু, জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে অস্তাচলগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও হাসির রেখাটি তাঁদের ঠোঁটে অবশ্যই ফুটে উঠবে এই ভেবে যে- আমরা আমাদের সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। এই উপলব্ধির বিপরীতে তোমার অহংকার এবং আত্মতৃপ্তি কতখানি বেড়ে যাবে। একটু ভালো করে ভেবে দেখবার চেষ্টা তোমাকে অবশ্যই করতে হবে। এটি শুধু তোমার নৈতিক দায়িত্ব নয় বরং তাঁদের প্রতি তোমার অনিবার্য কর্তব্যও বটে। পাশাপাশি একটি দিকের প্রতি তোমার দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে, বাবা-মায়ের মুখের হাসি কেড়ে নিয়ে পৃথিবীতে কোনো সন্তানই “সুখ” নামের অনুভবটিকে উপলব্ধি করতে পারবে না, কোনোভাবেই পারা সম্ভবও নয়। এবং অন্য কারো মুখে প্রকৃত হাসি ফুটিয়ে তোলাও হবে অসম্ভব। এই মূল্যবোধের দীক্ষায় তুমিসহ আমরা সবাই যদি দীক্ষিত হয়ে উঠতে পারি তাহলে শুধু আমি অথবা আমার বাবা-মা নন, প্রকারান্তরে গোটা সমাজই সুখের আলোতে আলোকিত হবে। এবং তখনই বাবা-মা সহ সমাজের প্রতিটি মানুষ বেঁচে থাকার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করবে। চূড়ান্ত অর্থে মানবকুলে জন্ম নেয়া সফল বলে প্রতীত হবে অসীম অমৃত তৃপ্তিতে। কিন্তু, আমরা সবাই যদি তাঁদের সেবা করবার দুর্লভ সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করি তবে ক্রমান্বয়িকভাবে পৃথিবীর সব মায়া, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা ফিকে হয়ে আসবে।
একজন মানুষের জীবনে তারুণ্য হচ্ছে মধ্যগগনে উদীত সূর্যের অবারিত প্রভা। কেন এটি বারবার মনে করবার চেষ্টা করো না? তারুণ্যের ধর্মটিই হচ্ছে- ভালো কাজের লক্ষ্য স্থির করে সেই লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগামী হওয়া। যে মুহূর্তে তুমি সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে, সেই মুহূর্ত থেকে তোমার সমাজ, সমাজের উন্নয়নের গতি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই অবধারিতভাবে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকবে; কতকটা সমুদ্রের দিকে স্রোতস্বিনী নদীর নিরন্তর ছুটে চলবার মতো। কিন্তু, কোনোভাবেই যদি তুমি সেই উন্নয়নের গতির সঙ্গে নিজের গতিকে একত্রিত করতে না পারো তবে সেটি হবে তোমার জন্য চরম হতাশার। সুতরাং, জীবনের প্রকৃত অর্থ উদ্ধারে উদ্যমী হবার চেষ্টা করে তারুণ্যের সুবর্ণ সময়কে নিজের করে নেবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা তারুণ্যের প্রকৃত সংজ্ঞাকেই পুনরায় প্রমাণ করবে। দায়িত্ববোধের নিবিড় ভাবনা আপনা আপনি এসে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষকে আন্দোলিত করবে। নিজের ভেতর অদম্য কর্মস্পৃহা জেগে উঠবার পাশাপাশি আলোকিত হবার নি®প্রভ ইচ্ছেগুলোও উদ্দাম গতিতে উদ্দীপিত হয়ে উঠবে।
এখন উদ্ধৃত সমগ্র বিষয়গুলোকে একীভূত করে এবং একই মাত্রায় স্থাপন করে সেই একীভূত বিষয়গুলিকে যদি আত্মস্থ করবার প্রশ্ন এসে সম্মুখে দাঁড়ায়, সেই প্রেক্ষিত বিবেচনায় তোমার দৃষ্টিতে আসবে- তোমার আত্মোৎসর্গ, আত্মোৎকর্ষ এবং প্রীতির পদ্ম প্রস্ফুটিত কররার মাধ্যমে গোটা সমাজের মানুষকেই তোমার অজান্তেই তুমি জয় করে নিয়েছ। এখানেই মূল শর্তটি অন্তরিত। যেহেতু এটিকে বিবেচনায় নেয়ার মাধ্যমেই তুমি সমগ্র বিষয়গুলোকে একটি একক হিসেবে একক মাত্রায় আত্মস্থ করেছ সেহেতু তোমার কাছে অবশ্যই পৃথিবী সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়েছে। তুমি হয়েছ পৃথিবীর কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ।
প্রবন্ধটির রচনাকাল এবং স্থান: ১০/০৯/২০১২খ্রিষ্টাব্দ, লালমনিরহাট
তথ্যসূত্র:
১। উইলিয়াম শেকসপিয়র রচনাসমগ্র, ডিসেম্বর, ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ, টাইমন অব এথেন্স, লিপিকা প্রকাশন।। ঢাকা। পৃষ্ঠা নং ৭১-৭৫।
২। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী, একুশে বইমেলা, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ, এডওয়ার্ড জেনার, সুলেখা প্রকাশনী।। ঢাকা। পৃষ্ঠা নং ২৩২।
৩। শ্রেষ্ঠ গল্প, লিয়েফ তলস্তয়, সম্পাদনা হায়াৎ মামুদ, জুন, ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা। পৃষ্ঠা নং-৮৮।
লেখক পরিচিতি: জন্ম ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৮১ কুড়িগ্রাম। কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি পড়াশুনা করছেন নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়াতে। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পরিচালনা করে আসছেন ‘প্রতীতি’ নামে একটি অবৈতনিক বিদ্যানিকেতন। ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ’ লেখকের প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থ এবং ‘কাঠের শহর’ দ্বিতীয় এবং প্রথম গল্প গ্রন্থ। এছাড়াও লেখক কর্তৃক অনূদিত বিশ^সাহিত্যের ধ্রপদী কিছু প্রবন্ধ, গল্প এবং কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন অনলাইন সাহিত্য সাময়িকীতে।