লকডাউন (১-৬ পর্ব)
দিব্যেন্দু নাথ
দুটোর শেষ গাড়িটা সেদিন ধরতে পারেনি বলে, আজ অঞ্জনা মনে মনে খুশি। এখানে দাদা-বৌদি-ই তো খানিকটা কাশি দেখে শুধু তার উপর ঘাবড়ে আছে। শ্বশুর বাড়ির হলে তো! কেউ তার সন্তানেরও খবর নিত না। স্বামীহারা নারীর জীবনে এমন লাঞ্ছনা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এ নতুন কিছু নয়। আজকাল তার কোলের ছাবালকে দাদা এ ঘরে আসতে দেয় না। হয়তো ঠিকই করছে। চীন, ইতালির গণহারে মৃত্যুর মিছিল দেখে দেশের সরকার করোনা নিয়ে যে সব নিয়মনীতি চালু করেছে, শহরের সঙ্গে গ্রাম গুলিও সজাগ। কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া সন্দিহান হয়ে সন্তান ছাড়া করে আলাদা ঘরে, রাখা কি ঠিক হচ্ছে অঞ্জনাকে। কে নিয়ে যাবে তাকে হাসপাতাল? এই রোগ তো অসম্ভব ছোঁয়াচে। গ্রামের ওষুধের দোকান থেকে আনা দাদার গোটা কয়েক প্যারা-চিটো-মল ট্যাবলেট দিয়ে, যা চিকিত্সা হয়, তা চলছে তার। তাও আবার দরজা থেকে ঢিল ছুঁড়ে দেয় দাদা। খাবারটা পর্যন্ত বৌদি বাইরে থেকে দেয়। জ্বরটা আর পুরোদমে নিঃছাড়া হচ্ছে না। বৌদি, তার ও ননদির সন্তানকে দুধের গ্লাস দিয়ে এবার মোবাইলটা হাতে নিয়েছে। কর্তা বাড়িত থাকায় এ কদিন আর ফেবু তে তেমন ঢোকা যাচ্ছে না। স্কিনে চোখ পড়তেই দেখে, একটি আইডিতে লেখা, ‘লকডাউন থাকায় দাদারা বাড়িতে। তাই বৌদিদের তেমন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না’। আঙুলের ঘষায় দ্বিতীয় পোস্ট দেখে – গিন্নিরা ঘরে অযথা অশান্তি ছাড়বেন না, যে কয়দিন লকডাউন চলছে কর্তাকে শান্তিতে বাড়ি থাকতে দিন।” নির্লজ্জের মতো মনে মনে হাসে মালতী। একটু আগেই কাউমাউ করে পতিকে পাঠিয়েছে চরের খেতে। আবার আঙুলের ছোঁয়ায় ভাসে, – ‘মানবতার জয়’ নামে আরেকটি আইডি। স্ট্যাটাসে দেওয়া, – কাঞ্চনপুরবাসি কেউ বাড়িতে অসুস্থ হলে এই *নাম্বারে ফোন করবেন। রোগীকে সুলভ মূল্যে গাড়ি দিয়ে পাঠানো যায় হাসপাতালে। কেউ অসুস্থ হলে করোনার ভয়ে, ঘরে আটকে রাখবেন না তাকে। যথা সময় হাসপাতাল পৌছান, ডাক্তারের পরামর্শে চললে, এই রোগ সেরে উঠে। গাড়ির জন্য অযথা রাস্তায় না বেরিয়ে কল করুন। কোথাও ভীড় বাড়াবেন না। নিজে বাঁচুন। অন্যকে বাঁচান।’
এই মুহূর্তে কমল টুকরী ভর্তি তরতাজা সব্জি নিয়ে আসে বাড়িতে।
: কই বে তোমরা?
: অইত্য ঘরঅ। দেখো, মোবাইলে কিতা লেখছে গো? বারান্দায় টুকরী রেখে কমল দেখে।
: ছোড়দিরে পাঠাই দেও-না হাসপাতালে।
: আমার হাত ‘ভরাইল’ নম্বর অগু লাগাও? কুৎ কুৎ করে রিং হচ্ছে। ক্ষণিকের মধ্যে ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে – হ্যালো।
: টাকা কত লাগব রেবা? আপাতকালীন সময়ে টাকা খরচ করার হিসাব খুব বাঞ্ছনীয় সবার। কমল তো আর সেইমতো টাকা-ওয়ালা – কেউ নয়! চাষাবাদেই জীবন চলে। ও পাশ থেকে কি যেন বলল। কমল বলল,
: নির্ধারিত সাধারণ ভাড়া অইলে আইয়ো। আমার ঠিকানা – কমল নাথ, গ্রাম পোস্টঅফিস – বিলাশপুর। কুড়ি মিনিটের মধ্যে গাড়ি হাজির। এখন তো আর তেমন রাস্তাঘাটের সমস্যা নেই, প্রায় গ্রামের বাড়িতে ছোট গাড়ি যেতে পারে। বাম আমলের মাটি কাটা এই পথে, নতুন সরকার তড়িঘড়ি ইট-সলিং করে দিয়েছে। এখন কমলের উঠোনে গাড়ি আসে। কালীভক্ত কমল অর্ধশিক্ষিত নারী পেয়ে অনেকটা বিজ্ঞান মনোস্ক হয়ে গেছে। ছোঁয়াচের ভয়ে অঞ্জনাকে গাড়িতে তুলতে নারাজ। তাই বোধহয় পিছনেদুয়ারে পলাইছে। মাস্ক ও পলিথিনে পরিহিত ড্রাইভারকে মালতী বলল, ভাই, তুমি ওকে নিয়ে হাসপাতাল যাও। তোমার দাদা এলে, আমরা বাইকে আসছি। এমন সচেতনতা দেখে খুশি ড্রাইভার। কিন্তু সে তো পরিবারটাকে ভালো করে চিনে। যে দাদা বোনের সুখের জন্য ব্যাপারি বর আনল। আজ রোগের সন্দিহানে বোনের প্রতি সেই ভালোবাসা কোথায়? আসলে মানুষ নিজের থেকে কাউকে বেশি ভালোবাসে না। যা কিছু করে আভিজাত্যে ভরা নিজের সম্মান বাঁচানো ছাড়া আর কিছুই নয়! সবাই ভালোবাসার অভিনয় করে। সত্যিকারে কেউ কাউকে ভালোবাসে না। না হলে কি অঞ্জনা তার মনের মানুষ নিশিকে ছেড়ে, দাদার কথায় রাজি হয়ে যেত? গাড়িতে ওঠার পর থেকেই অঞ্জনার নাকে একটি পরিচিত গন্ধ ভাসছে। এ গন্ধ যেন তার খুব কাছের মানুষের। নাহলে কি তার সামনে, এত এত জীবাণু-নাশক স্প্রে করার পরও এই গন্ধ ভাসে? ড্রাইভারকে কিছু বলেবে কি বলবে না, এমন এক ইতস্ততবোধে অঞ্জনা। তার এই হাবভাব দেখে মাস্কটা নামিয়ে ড্রাইভার বলল, – এমন দিনে কেউ বাবার বাড়ি আসে? মধুরিমা ভরা কণ্ঠনালির স্বর শুনে এবং গাড়ির ভেতরের আয়নায় মাস্ক বিহীন ড্রাইভারের মুখাবয়ব দেখে কেঁদে ফেলল অঞ্জনা।
পর্ব – দুই
দর্পণ থেকে আপাতদৃষ্টি সরিয়ে, এই সঙ্কটময় সময়ে নিশি সামনের দিকে তাকায়। মাঝে মাঝে পুলিশ টহলদারি ছাড়া রাস্তা মোটামুটি শুনশান। গাড়ি একটা নির্দিষ্ট গতি নিয়ে চলছে। শেষ বসন্তর গন্ধমাখা বাতাস ফনফন করে জানালায় আঁচড় কাটে। অঞ্জনাকে তেমন কাহিল মনে হচ্ছে না। বরং দু দিনের ঘরবন্দি কাটিয়ে আজ তার মন বেশ ফুরফুরে। যদিও মনে আশঙ্কা বাড়ির সকলের তৎপরতায়, তার করোনা হয়য়েছে। তবুও পুরানো মানুষ পেয়ে অতীত স্মৃতি আওড়াচ্ছে পুলকে। মাঝে মাঝে কাশি দেয়, দীর্ঘ নিঃশ্বাসও ছাড়ে। সটান বুকের দুর্বিনীত স্তনযুগলের ওঠানামা দেখে, নিশির আতঙ্ক! সে কি, সত্যি সত্যি করোনা আক্রান্ত? কিন্তু তার দীর্ঘদিন Ambulance এ রোগী নেওয়ার অভিজ্ঞতায় দেখা; – অঞ্জনা করোনা আক্রান্ত নয়, সাধারণ সর্দিকাশি জ্বর। তবে সার্টিফিকেট দেবে না সে। সে তো আর ডাক্তার নয়। দুজনের আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তার মাঝেও আবার হারানো কিছু রঙ ঠোঁটের কোণে। এবার ভিতর দর্পণে চোখ পড়তেই; আঁতকে উঠে অঞ্জনা, এ কি! তুমি কাঁদছ যে? একহাতে স্ট্যায়ারিং ধরে টপ করে পড়া দু ফোঁটা জল মুছে নেয় নিশি। বলে,
কই? না না। চলন্ত গাড়ির ধমকা হাওয়া বোধহয় চোখে ঝাপটা মেরেছে। অঞ্জনা কোন উত্তর দেয় না। মনে মনে বলে, – ছেলেরা চোখের জল বের হলে, নিজেকে ছোট ভাবে। নিশি তো নিশিই রয়ে গেল! একটুও বদলালো না। কষ্ট চেপে রাখার অভ্যাসটা আজও ছাড়তে পারল না। আমাকে কি আগের মতোই ভালোবাসে?
তার এই হৃদয় বিদ্ধ প্রশ্নের উত্তর কোনওদিনও নিশি মুখে দেয় নি! আজও দেবে না। এই মূহুর্তে নিশি দেখল পুলিশ একটি বাইক আটকে; দুজনের মধ্যে একজনকে নামিয়ে দিল। ওরা কোনও তর্কে জড়ালো না। যে ভাবে সবদিক লাঠির প্রতাপ চলছে। খানিকটা এগোতে দেখে এক বাইসাইকেল আরোহী সাইকেলে সাইনবোর্ড লাগিয়ে চলছে। ”মারবেন না। ঘরে সব্জি নেই, আনতে যাচ্ছি।” পেছনে ফেলে আসা পুলিশ এই বাইসাইকেল আরোহীকে কি করে, লুকিং গ্লাসে দেখছে নিশি। নাঃ। কিছু হাসাহাসি করে ছেড়ে দিয়েছে।
গাড়ি ততক্ষণে কাঞ্চনপুর সাব ডিভিশন হাসপাতালের সামনে। প্লাস্টিক ড্রেস পরিহিত নিশি তাকে ধরে নামাতে গেলে,
আমি একা নামতে পারবো। কথাটা কেমন জানি গোলাপ কাঁটার মতো বিঁধল নিশির অন্তরে। বিষন্ন মনে সরে দাঁড়াল। অঞ্জনা ব্যাপারখানা বুঝতে পারলেও মনে মনে বলল, – আমার কিছু করার নেই নিশি। যদি করোনা আক্রান্ত হয়ে থাকি…..? নিশির ধারণা হয়তো অন্য কিছু।
ডাক্তার এলেন, প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, অভিভাবক খুঁজলেন। দাদারা কেউ এখনও আসে-নি তার। নিশিকে ডাকল। মনে মনে খুশি অঞ্জনা। যা আর কোনওদিন হওয়ার কথা ছিল না, আজ তা…। হোক-না এক মুহূর্তের। তাতে কী! আমার হারিয়ে যাওয়া আপন মানুষটা আজ আমার অভিভাবক….। ডাক্তার বললেন,
আশঙ্কাজনক তেমন কিছু বলে আমার মনে হচ্ছে না। আর যা জানলাম, মহোদয়ার কথায়, বাইরে কোথাও ছিলেন না তিনি। দীর্ঘদিন ধরে ত্রিপুরায় আছেন। তবুও বর্তমান আবহাওয়ায়, আমাদের সকলেরই আশঙ্কা, – করোনা ছড়ানো। সুতরাং বিষয়টাকে মোটেই হাল্কা ভাবে নেওয়া যায় না। আপনি রোগীকে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে রক্ত দিয়ে যান। এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট এসে যাবে। এখন রোগীকে বাড়িতে রাখুন, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে মাস্ক পরিয়ে, দিনে দু চারবার গরম জলে নুন কুলকুচি করান, প্রোটিন যুক্ত সবুজ শাকসবজি খাওয়ান, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান। যেহেতু এই রোগের কোনও ভেক্সিন এখনও বের হয় নি। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের শরীরে, প্রতিটি রোগের এনজাইম তৈরি করার ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। সুতরাং আমরা সচেতন ভাবে স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রাকঃপ্রনালী মেনে চললে এই রোগ আটকাতে পারি। যদি রোগী করোনা আক্রান্ত নাই-বা হন, তাতেও ক্ষতি নেই। স্বাস্থ্যবিধান মানলে তো আমরা যেকোনো রোগমুক্ত থাকতে পারি। তাই আর চৌদ্দদিনের ডাক্তারি নজরদারিতে পাঠাচ্ছি না ওনাকে।
আচ্ছা স্যার। বলে তারা পা বাড়ায় ল্যাবরেটরির দিকে। ভারপ্রাপ্ত ল্যাবরেটরিশিয়ান রক্ত নিয়ে বললেন,
সাড়ে চার হাজার টাকা ক্যাশিয়ারের কাছে জমা করে রসিদ দিয়ে যাবেন। আধ ঘন্টার মধ্যে হলে আজই পাঠিয়ে দেবো। না হলে কাল আবার রক্ত দিতে হবে।
টাকা কেন? এটা সরকারি হাসপাতাল না! – নিশি বলল।
ভাই আমরা কর্মচারী, সরকার যা বলে তা-ই করতে হয়? অঞ্জনা বুঝতে পারল খামখা তর্ক করে লাভ নেই।
আচ্ছা দাদা, আমার বড়ভাই আসছে! টাকা জমা হয়ে যাবে। চল নিশি! ভীড় এড়িয়ে কোথাও গিয়ে বসি। নিশি সরকারের এই অমানবিক সিদ্ধান্ত মন থেকে মেনে নিতে পারল না। তবে, এই লকডাউনে ঝগড়াঝাটি করা ঠিক নয়। কিন্তু আক্ষেপ রয়ে গেল তার। যে মানুষগুলো ‘নিত আনে নিত খায়’ তারা কীভাবে এই টেস্ট করাবে। ল্যাবরেটরি ত্যাগ করে দুজন। তখনই নিশির মোবাইলটা বেজে উঠে। লাইনে কমল। হাঁটতে হাঁটতে লাউডস্পিকার অন করে অঞ্জনাকে দেয়।
হ্যালো।
অঞ্জনা?
বলো দাদা?
তোর যা অবস্থা! ডাক্তার নিশ্চয়ই ভর্তি করেছে?
না দাদা। অঞ্জনার উত্তরটা চেপে বিজ্ঞান মনোষ্ক দাদা একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে
তালইমশাই এসেছেন, আমরা এ বেলা আসতে পারছি না। তিনি এ বেলায় নাকি! অর্পিকে নিয়ে চলে যাবেন। তুই চিন্তা করিস্ না, আমি ওদেরকে পাঠিয়ে, সন্ধ্যায় আসবো খাবার নিয়ে। তুই তো আবার হাসপাতালের খাবার খেতে পারিস্ না।
লাইনটা কেটে গেল। অঞ্জনা আর কিছু বলা হল না। কি-বাই আর বলত এমন সচেতন দাদাকে। তার রোগের আতঙ্ক কেটে গেছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে হৃদয়। চৈত্রের শিমুলের মতো বিষাদ ফুটে আছে দুর্বিনীত ভাবে চোখেমুখে। বাষ্প জমাট বেঁধে কয়েক ফোঁটা টপ টপ করে পড়ল চোখের পাতা থেকে। হাসপাতালের চকচকে শ্বেতপাথর সিক্ত হল। ভুলে গেল এই মুহূর্তে তার হাতে নিশির ফোন বিদ্যমান। ধীর লয়ে ল্যাবরেটরির দিকে যায়।
দাদা, কাল এসে আমি আবার রক্ত দিয়ে যাবো।
না দিদি আর দেওয়া লাগবে না। এক সপ্তাহ পরে এসে রিপোর্ট নিয়ে যাবেন।
টাকা? জমার রসিদ দেখালো ল্যাবরেটরিশিয়ান। রসিদের কোণায় কমলের নকল সই। মুখে একটা অজানা ভ্রান্ত হাসি, আবারও দু ফোঁটা জল গড়ালো টানা টানা চোখের কোণে। এই দু ফোঁটা, খুশির না দুঃখের বুঝতে পারল না অঞ্জনা। বরং দুষ্টটাকে খুঁজতে গেল, দাঁড় করানো গাড়ির দিকে।
পর্ব তিন
দাদার বাড়ি ছাড়া যদি আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকত! বলে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে অঞ্জনা। চলন্ত গাড়ির সুঁ সুঁ বাতাসে কথাটা পরিস্কার বুঝতে পারেনি নিশি।
কিছু বললে?
তোমাকে নয়?
থাকার জায়গা, থাকলে কি করতে?
চলে যেতাম। যে দাদা আমার…..। চোখ দুটি ঢলমল করে অঞ্জনার। মুখাবয়ব ফ্যাকাসে। আরো কত কিছু যেন বলতে চায় তার অবহেলায় ভরা জীবনের পথ, বেদনা ভরা মন। কি করে বলবে বুঝে উঠতে পারে না। নিশির সঙ্গে এত কিছু হওয়ার পরও সে আজ তার এত খেয়াল নিচ্ছে? কাউন্টারে টাকা জমি দিল, মরণব্যাধির আশঙ্কা তো এখনও আছে আমার! এই ছোঁয়াচে রোগে সে আক্রান্ত হতে পারে জেনেও সে ই একমাত্র ছেড়ে গেল না বা যাওয়ার নাম গন্ধ নেই। আমাকে আগের মতোই ভালোবাসে? যদি একবার বলত?
দাদা কি এমনি এমনি যেতে দিতো, তোমাকে? নিশির কথাটা শুনে সম্বিত আসে অঞ্জনার,
দাদাকে সত্যি জানালে তো?
কি মিথ্যে বলে যেতে?
আমাকে আগরতলায় নেওয়া হয়েছে চৌদ্দদিনের পরীক্ষায় রাখতে। কোনও উত্তর দেয় না নিশি। মনে মনে বলে, বুদ্ধির বালাইছুট।
ফিরার গাড়ি বাজার ছুঁই ছুঁই। দুয়েকটা মুদি দোকান ছাড়া সব বন্ধ। পুলিশের টহলদারি। এক সব্জিওয়ালা কিছু বালুজুরি মরিচ আর গোটা কয়েক আলু বাঁধাকপি নিয়ে বসেছে একটি বন্ধ দরজার বারান্দায়। দু তিনজন খরিদ্দার। আচমকা লাঠি হাতে দুজন পুলিশ।
স্যার মারবেন না? ঘরে কোন সব্জি….। কথাটা শেষ করার আগেই দু ঘা বসিয়ে দিল এক খরিদ্দারের পিঠে। থলে ফেলে বাকিরা পালালো। এবার তেড়ে যায়, ভয়ে মাল গোছানো মধ্যবয়েসি সব্জি বিক্রেতার দিকে।
বাবু, বাড়িত পোয়াপুড়ি উপাস। তারার ক্ষুধার জ্বালা দেইখ্যা ঝারতা পারছি না, আই গেছি। মাইরেন না। আমি সব আটাই যাইয়ার গিয়া। কার কথা কে শুনে, ধেড়াম ধুড়ুম লাথি, সরঞ্জাম সব রাস্তায়।
ভাষণ দেওয়া শিখিলাই ছো! বলে হাত টানে লাঠি তুলে।
দাঁড়ান, বলে গাড়ি থেকে গর্জে ওঠে নিশি। দ্বিতীয় পুলিশ লাঠি তুলে আসে তার দিকে। ততক্ষণে আরেক পুলিশ লাথি দিয়ে বালিজুরি মরিচ ছড়িয়ে দেয় রাস্তায়।
খবরদার সাচিরাম? এটা এম্বুলেনস। ঘুরে দাঁড়ায় কনসেটবল। সঙ্গে সঙ্গে স্যালুট। প্রথম জন – রিপোটিং করে,
স্যার, শালারা লাঠির ভাষা ছাড়া কিছুই বুঝে না।
কথায় লাগাম দাও মুকুন্দ? তোমার অভাব্য আচরণ আর কথায় এক্ষুনি সাসপেন্ড করতাম! করলাম না, কিছু ঘুষ-খোর ক্যামেরাধারির যন্ত্রণায়। এই লক-ডাউনে তারা আবার…..।
সরি স্যার।
ওর মালগুলো ঠিক করে দোকান সাজিয়ে দাও? সব্জি মুদির দোকান খোলা থাকবে, জানো না তোমরা? ধমকে বললেন আগন্তুক অফিসার।
ইয়েস স্যার।
আপনি গাড়ি এগোন? নিশিকে বলে, তার ড্রাইভারকে ইঙ্গিত করলেন জীপসি নিয়ে আসতে। – চল মাছ বাজার যেতে হবে, এখানেও নাকি বিশৃঙ্খলা চলছে। বাজার সেক্রেটারি কখন ফোন করে ছিলেন, হয়তো তিনি ক্ষেপে আছেন। বাজার ছেড়ে এম্বুলেনস নতুন রাস্তা ধরে।
অ্যা-এ-ই কোথায় যাচ্ছো?
আমার বাড়ির যাওয়ার নতুন পথ এটা।
তোমার বাড়ি! …. অর্ধ সমাপ্ত বাক্য রেখে, অঞ্জনা মনে মনে হাসে।
ফোনে করে দাদাকে জানিয়ে যাই? আমি আগরতলায় যাচ্ছি। কিছু না বলে, নিশি চ্যাপ্টা মোবাইলটা পেছনে দেয়। মোবাইল হাতে আবার চিন্তিত হয়ে অঞ্জনা ভাবে, সম্পর্ক ছিঁড়ে গেছে সেই কবে, তার সঙ্গে। এমন বিভীষিকাময় সময়ে, এই মানুষটার উপর এত দায়িত্ব চাপানো কি উচিত হবে?
পর্ব চার
মোবাইলের লাইন কেটে কমলকে খুঁজে মালতী। ফোনের হতাশ ব্যঞ্জনায় ভুলে গেছে, স্বামী যে তাকে বলে, জনশূন্য চরমাঠে গেছে কাজে। সুজনকে ডাকে। পাত্তা নেই। হঠাৎ দেখে উত্রবাড়ির কাঁঠাল গাছের তলায় মাস্টার কাকির সঙ্গে। অবশ্য ভয় নেই, দুজন দূরত্ব বজায় করে বসে আছে শেকড়ে। মালতী এগিয়ে আসে।দিদি, অঞ্জনার খবর কি?
সন্দেহবশে আগরতলায় পাঠাইছে।
ভালো করেছে। দেখো অনিকেত মৃণালকান্তি কি শেয়ার করছে পোস্টে।
মালতী পড়তে লাগে মোবাইলের স্কিনে,
‘করোনাভাইরাসসত্যিসত্যি_চীন-এর ল্যাবরেটরি’তে তৈরি ???।।।।
নিউক্লিওপ্রোটিন দ্বারা গঠিত, অ-কোশীয়, রোগ সৃষ্টিকারী, সূক্ষাতিসূক্ষ(কেবলমাত্র ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা যায়), জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ের একপ্রকার বস্তুকে ভাইরাস বলে। মাধ্যমিকের জীবন বিজ্ঞানের খাতাতে ভাইরাসের সংজ্ঞা কাকে বলে’র উত্তরে এটুকু লিখে দিয়ে আসলে মাস্টারমশাইরা ভালোবেসে আমাদের কে ২ নম্বর দিতেন। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী জেনার’-এর সর্বপ্রথম ভাইরাস আক্রান্ত বসন্ত রোগের উল্লেখের কথা হোক বা বিজ্ঞানী ‘আইভানওস্কি’- এর তামাক গাছের ভাইরাস সংক্রান্ত সংক্রমণকারী তরলকে বা বিষকে সনাক্তকরণ হোক কিম্বা জাপানের বিজ্ঞানী টাকাহাসি-মার্কিন বিজ্ঞানী স্ট্যানলি -ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী ব্যডেন ও পিরী ভাইরাস নিয়ে এনাদের গবেষণার কথা একটা সময় জীবন বিজ্ঞান বইয়ে ছেলে-মেয়েরা পড়তো।
এরপর ২০১৪- এ দেশে পালাবদল হলো, আচ্ছে দিনের বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা যুক্ত সরকার এলো, মানুষ বুক ছেড়ে ফেস-বুকে’র তথ্যে বেশি বিশ্বাস করতে শুরু করলো, দেশ জুড়ে সব ইউনিভার্সিটি’তে কম সময় দিয়ে মানুষজন হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটি-তে বেশি পড়াশোনা করতে শুরু করে দিলেন। চিকিৎসক-বিজ্ঞানী-ডাক্তার সকলের গবেষণা পেপার, তথ্য সব হারিয়ে যেতে বসলো আর বদলে জায়গা করে নিলো ভক্তদের হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির পিএইচডি’র থিসিস গুলো। ভক্তদের সেই থিসিস গুলো কিরকম!’
পালা বদল পড়ে, ভালো লাগে না শক্তিকমিটির সদস্যা মালতীর। লক-ডাউনে রাজনৈতিক শব্দটা ব্যবহার করা উচিত নয় ভেবে বলে, – লেখাটা বেশ লম্বা। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আর পারছি না। দাও, আমি পড়ি। মোবাইল ছোট জা’য়ের হাতে দিয়ে মালতী, খিটখিটে মন নিয়ে বলে, – তুমি তো পড়বে! রিক্শা-ওয়ালা, ঠেলা-ওয়ালা-রাও তোমরারে অযোগ্য কয়, চীনের দালাল হক্কল। সুজনের মাস্টার-কাকি পড়েই যাচ্ছে,
” এই ধরুন করোনার থেকে বাঁচতে সেই দেশের মানুষ যাতে রাস্তাতে বেরোতে না পারে তার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন পুরো দেশ জুড়ে ৮০০ সিংহ ছেড়ে দিয়েছেন বা দিব্বি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট কে ইতালির প্রেসিডেন্ট বলে চালিয়ে দেওয়া বা করোনা ভাইরাস চীন-এর ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে সেই দেশের ৬৫+ বয়স্ক মানুষদের মেরে দিয়ে চীন-এর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা মোটামুটি হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটি জুড়ে ৩৬৫*২৪ ঘন্টা ধরে ভক্তরা নিরলস ও ক্লান্তিহীন ভাবে এভাবেই একের পর এক তাদের পিএইচডি এর থিসিস গুলো লিখে যাচ্ছে। আর তার থেকেও দ্বিগুণ উৎসাহে কমিউনিজমের বিরোধী, সমাজতন্ত্রের বিরোধী কিছু অতি-উৎসাহী ভক্তগণ তা আলোর গতিবেগ এর থেকেও বেশি গতিবেগে শেয়ার করে, কপি-পেস্ট করে অদ্ভুত এক অর্গাজম-‘র সুখে ভেসে গিয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে পাশ ফিরিয়ে শুয়ে আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখছে। ভাবখানা এমন যেন দেখ রে সমাজতান্ত্রিক চীন কে বেশ কষিয়ে বাঁশ দেওয়া গেছে !
করোনা ভাইরাস চিনের তৈরি করা একটি বায়োলজিকাল অস্ত্র এই মর্মে সকাল বিকেল ১৩৩ বার নিউজ ফরওয়ার্ড করলেও ভক্তরা কোনোদিন ভুলেও ফোর্বস, বুলেটিন অরগ, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ‘দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’ এর ওয়েবসাইট ভুলেও খুলে দেখবেনা। দেখে ফেললেই যে ফেক প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর পুরো রান্নাটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
ভক্তরা আসলে জানেনা করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়। [লিঙ্ক ১]
এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে এসএআরএস-সিওভি-২’ পাওয়া যায়(যা বর্তমানে সাধারণত নোভেল করোনাভাইরাস নামেই পরিচিত। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়। [লিঙ্ক ২]
মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১শে ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এর পর ১১ই জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। [লিঙ্ক 3]
ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসন নামক এক গবেষক বিজ্ঞান জার্নাল নেচার ম্যাগাজিনে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য শেয়ার করেছেন। তিনি সাফ জানাচ্ছেন কোভিড-১৯ একটি প্রাকৃতিক ভাইরাস। কোনও রসায়নাগারে একে তৈরি করা হয়নি। [লিঙ্ক 4]
১৭ই মার্চ নেচার মেডিসিনে প্রকাশিত ‘দা প্রক্সিমাল অরিজিন অভ SARS-CoV-2’ নামক আর্টিকেলে ক্রিস্টিয়ান জি অ্যান্ডারসন, অ্যান্ড্রু র্যামবাউট, ডব্লু ইয়ান লিপকিন, এডওয়ার্ড সি হোমস এবং রবার্ট এফ গ্যারি নামক এই ৫ গবেষকরা দেখান, এই ভাইরাসের জিনের প্রোটিনে যে ছয় ধরণের এ্যামিনো এ্যাসিড সম্বলিত ‘রিসেপটর বাইন্ডিং ডোমেইন’ বা RBD পাওয়া যায়, তা এই ভাইরাসের বাহক। এইক্ষেত্রে মানুষের ACE2 রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হইলে মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এই ACE2 রিসেপ্টরের সাথে SARS-CoV-2-র স্পাইক প্রোটিনের যুক্ত হওয়ার প্রবণতা সম্পূর্ণ ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’এর কারণে হয় বলে ওই ৫ গবেষকরা প্রমান করে দিয়েছেন। [লিঙ্ক 5]
নিউ অরল্যন্সের তুলান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট রবার্ট এফ গ্যারি’র বক্তব্য উহানের ভাইরাস গবেষণাগারের লাগোয়াই মাছবাজার। তাই এই তত্ত্ব খুব সহজে ছড়ায় যে চিন এই ভাইরাসকে তৈরি করেছে। সরাসরি এই তত্ত্বকে খারিজ করেছেন রবার্ট গ্যারি ও ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসন। বিজ্ঞানীদ্বয় বলেছেন, একটি ভাইরাসকে কৃত্তিমভাবে প্রস্তুত করলে তা পূর্ববর্তী কোনও ভাইরাসের চরিত্র লক্ষণ অনুযায়ীই তৈরি করতে হয়। এমনও হতে পারে একাধিক ভাইরাসের গুণাগুণ মিশিয়ে একটি ভাইরাস তৈরি করেন। সেক্ষেত্রে নতুন ভাইরাসটির মৌলিক কোনও চরিত্র থাকে্ না। কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে হয়েছ ঠিক এর উল্টো। তার নিজস্বতা রয়েছে। এই নিজস্বতা সে অর্জন করেছে প্রকৃতি থেকেই। এই ভাইরাসের জিনের গঠন দেখেও বোঝা যায় অন্য কোনও ভাইরাসকে ভিত্তি করে তাকে তৈরি করা হয়নি।
এখানেই থেমে যাননি বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দেখাচ্ছেন প্যাঙ্গোলিন ভাইরাস বা ব্যাট ভাইরাসের সঙ্গে মিলও রয়েছে এই করোনা ভাইরাসের। এই ভাইরাসগুলির গঠন সম্পর্কেও জানা গিয়েছে সম্প্রতি। কাজেই রাতারাতি কৃত্তিম ভাইরাস তৈরি করাও সম্ভব নয়। [লিঙ্ক 4,5 & 6 ]
আপনাদের যদি কারুর পৃথিবীজুড়ে গবেষকদের গবেষণাপত্র পড়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে আপনারা নিশ্চয়ই জানবেন যে শুধুমাত্র রবার্ট গ্যারি ও ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসন না ইতিমধ্যেই পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের ভিন্ন ভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞানী গবেষক উনাদের ভিন্ন ভিন্ন গবেষণাপত্রে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে এই ভাইরাস মনুষ্যনির্মিত কোনো জীবাণু বা অস্ত্র না।
করোনা ভাইরাসের বৈজ্ঞানিক নাম কিন্তু COVID-19 না, এই ভাইরাসের বৈজ্ঞানিক নাম SARS-CoV-2 (বা HCoV-19); COVID-19 শুধুমাত্র এই ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়া শ্বাসযন্ত্রের একটা রোগবিশেষ। যেমন HIV ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়া রোগের নাম AIDS। [লিঙ্ক 7]
পৃথিবী জুড়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই এই ভাইরাসের দুই প্রকার জেনেটিক বৈশিষ্ট্য আলফা ও বিটা করোনা ভাইরাসের জেনেটিক তথ্যের তুলনামূলক কাঠামোগত বিশ্লেষণ এবং জৈব-রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে এই ভাইরাস মানুষের দ্বারা তৈরি করা কোনো কৃত্রিম জীবাণু না।
সারা দুনিয়াতেই মানুষ গুজবে একটু বেশিই আস্থা রাখে। রীতিমতো এসব নিয়ে চর্চাও হয়। কন্সপিরেসি থিওরি বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নামে সারা দুনিয়াতে চলে। সুতরাং আপনারা যারা কন্সপিরেসি থিওরি ভালোবাসেন, তারা এইসব বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত বিষয় নিয়ে বেশি আলাপ-আলোচনা না করে হোয়াটস্যাআপ ইউনিভার্সিটি’তে ফেক নিউজ এর প্রপাগান্ডাবাজি চালাতে থাকুন। সাথে ওই প্রতিটি ফেক পোস্ট এর একদম নিচে এই কথাটি লিখতে ভুলবেন না যে,
“এই মেসেজ টি আপনি যদি আরো ১৫ জন কে শেয়ার করেন দেখবেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে আপনার জীবনে একটা ভালো সংবাদ আসবে।”
কিন্তু যারা কুসংস্কারে না, অসভ্যতামিতে না, উল্লাসে না, গুজবে না, বিজ্ঞানে-সভ্যতাতে-সংস্কারে-শিষ্টাচারে-শালীনতাতে-মস্তিষ্কের যুক্তি তর্কের লড়াইয়ে বাঁচতে চান তারা একটু বামদিক ঘেঁষে হাঁটুন।”
©সৌ তি ক(লেখক)’
হাঁটুটান করে মালতী দাঁড়ায়। কর্কশ সুরে ছেলেকে বলে,তোর বাপ রে ডাকিয়া আন? রাগের মানে বুঝেন অযোগ্য দিদিমণি। – এই রে, গায়ে লেগেছে! কথাটা ভেতরে সংযত করে নেয়। মৃদু হেসে বলে,একি বলছো দিদি! ত্রি-সন্ধ্যায়, এইটুকু ছেলেরে নদীর পারে পাঠাবে! তুমি কি ভুলে গেলে? লক-ডাউন চলছে।
পর্ব পাঁচ
এই কদিন শুধু প্রাক-সন্ধ্যায় ডাকতেন অঞ্জনাকে, তুলসীতলার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে। নিজে কি না কষে শঙ্খ বাজাবেন, কাঁসর বাজাবেন উঠোনে দাঁড়িয়ে। নগরকীর্তনে অংশগ্রহণ করার পক্ষে ছিলেন না মাধুরীদেবী। আজ সকালে তিনটি তুলসী পাতা নিজের হাতে দিয়েছেন তাকে। ত্রাসের মধ্য দিয়ে এই পাঁচদিন অতিবাহিত করে, আজ সন্ধ্যায় ডেকেছেন বসার ঘরে। এ বাড়ির সঙ্গে পূর্ব পরিচিত অনেক আছে অঞ্জনার। কিন্তু এই ঘরগুলোর সঙ্গে নেই। ভাইয়ালি সম্পত্তি বাটোয়ারার পর দু ভাই পুরানো ঘর ভেঙে নতুন ঘর করেছে। বড়ো ছেলে নিদু সরকারি স্কুলের শিক্ষক। তাদের ছোট্ট একটি সন্তান আছে। নাতিকে নিয়ে অনেক সময় কাটত বুড়ির। কিন্তু এই কদিন কাছে আসে কম। হয়তো বৌমা মানা করেছে। করুক, তাতে দুঃখ নেই তাঁর। দিন দিন যেভাবে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে। সময় স্বাভাবিক হলে নাতি-সোহাগের অনেক সময় পাওয়া যাবে। এছাড়া লম্বাটে বাড়ির দক্ষিণ অংশে দেওর বাস করে, তার সন্তানসন্ততি নিয়ে। আজকাল সবাই দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে চলে। জমজমাট হইহল্লার বাড়ি এই কয়েকদিন ধরে নীরব। সবাই কেমন যেন শহুরে শহুরে ভাবে চলে। বুড়ির মনে হয় এসব। কিন্তু রাগ আসে না। দূরত্ব বজায় রেখেও সকলের মধ্যে গ্রামের আন্তরিকতা এখনও বিদ্যমান সাধের বাড়িতে। লক-ডাউনের বাজার সমস্যা, অনেকটা কেটে উঠেছে, পরস্পরের ভোগ্যপণ্য আদানপ্রদানে।
আজ বসার ঘরে আসার অনুমতি পেয়ে অঞ্জনার মন কেমন আনমনা হয়ে গেছে। নিশির সহপাঠী হয়ে যখন এ বাড়িতে আসতো সে, বাড়িটাকে মাথায় তুলে রাখত উল্লাসে। মাধুরীদেবী প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন তাকে। মা হারা মেয়েটাও যেন এ বাড়িতে এলে প্রাণে স্পন্দন পেত, বুঝতেন তিনি। ঘুরঘুর করে ঘুরত বাড়ির আনাচেকানাচে। কখনও কখনও ঘরের কাজে হাত লাগাত, স্নেহাবশে মাধুরীদেবীর কত মানা, মেয়েটা শুনলে তো! উল্টো শাসন করে দিত তাঁকে। অনেক সময় তাক্ লেগে যেতেন তিনি। – দেখো পাগলি মেয়ের কাণ্ড! আমার বাড়িতে আমাকে শাসন করে! এই দুঃখ কই কারে? মনের কথা মনে রেখে, উৎফুল্লিত হাসির ছোঁয়া থাকত মাধুরী মুখে।
সব নষ্ট করে দিয়েছিল কমল। পরিবারের আভিজাত্য বাঁচাতে নাকি বোনকে দূরে বিয়ে দেয়। ভেঙে দেয় মা মেয়ের নিবিড় সম্পর্ক। মেয়েটাও যে, কেমন করে ভুলে রইল মাকে এতদিন। দিনে দিনে মায়ের মনে অভিমান পুঞ্জীভূত হয়েছে। মেঘ আকারে বুকে চেপে রেখেছেন। দীর্ঘদিন পরস্পর দুরত্ব থাকলেও আজ পাঁচদিন ধরে এক বাড়িতে থেকে বুড়ির পুঞ্জিভূত অভিমান গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মতো ঝরে যাচ্ছে। সন্তানের প্রতি মায়েরা কি অভিমান বেশিদিন ধরে রাখতে পারে? হোক না সন্তানের যত বড় অসুখ, সে যতই খারাপ! মা জাগবেই সারা রাত। তেমন কথাবার্তা না বললেও অঞ্জনা বুঝতে পারে মায়ের হৃদয় ধীরে ধীরে তাকে ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখছে। সইচ্ছায় বন্দি ঘরে থেকে তার বারবার মনে পড়ে, হারানো দিনগুলোর কথা। মাতৃ স্পর্শে মাধুরী দেবী তার দীঘল কালো চুলগুলো আচড়ে দিতেন। বিলি কেটে রঙিন পিতে দিয়ে বেণীবন্ধন করে দুটি খোঁপা বানিয়ে দিতেন। নিশি হলুদ পলাশ গোঁজে দেওয়ার ভান করে বেণী খুলে দিত। মা তাকে বকে বকে আবার বেঁধে দিতেন। এসব ভাবতে ভাবতে কত কাঁদে অঞ্জনা মন। এবার নিশির কথায় এ বাড়িতে আসার পর থেকেই কেন যেন এই কথাগুলো তার আরও বেশি বেশি মনে পড়ে। বন্দিঘরে ফুঁপিয়ে কাঁদে। নিশি সবসময় কাছে থাকতে পারে না, এম্বুলেন্স নিয়ে মানুষের ডাকে সাড়া দিতে হয়। এছাড়া মা-ছেলের সংসারে এখন একজন নতুন অসুস্থ অতিথি। ভাই সরকারি চাকুরে হলেও তো খাবার আলাদা। অতিথির ওষুধপত্র সহ সকলের খাবার তাকে-ই ব্যবস্থা করতে হয়। তবে দাদা (নিদু) খবর নেয়। কিন্তু নিশি পারতে কারো কাছে হাত পাতে না। এম্বুলেন্সের গুরুদায়িত্ব না থাকলে, অবশ্য লক-ডাউন মেনেই চলত। সে কোনোদিনই অবাধ্য ছেলে নয়, এ কথা অঞ্জনার চেয়ে কেউ ভালো জানে না।
গ্যারেজে গাড়ি রেখে জীবাণুনাশক স্প্রে করে স্নান সেরে নিশির আসতে একটু দেরি হচ্ছে। অঞ্জনার মনের জগতের মা বা প্রাক্তন শাশুড়িই তো বলা যায় মাধুরীদেবীকে। বসার ঘরে দুজন দুই সোফায়। টেলিভিশনে চোখ। করোনা নিয়ে জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। ‘মেরে প্যায়ারে দেশবাসীও, আভি ভারত যো স্থিতিমে চল রা হেঁ।’ বাংলায় অনুবাদ করে বল-না মা? এতদিন পর তাঁর মুখে অধিকারে কথা শুনে, চোখ দুটি ভরে ওঠে অঞ্জনার। তা সুখাশ্রু জেনে এক ফোঁটাও মাটিতে পড়তে দেয় না। আপ্লুত হয়ে শাড়ির আঁচলে বেঁধে নেয়। বাংলা অনুবাদ করে বলতে লাগল,
আমার প্রিয় দেশবাসী। ভয়ঙ্কর স্থিতির মধ্য দিয়ে আজ আমাদের ভারত ভূমি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকেও এ যুদ্ধ আরো ভয়াবহ। কৌরব-পাণ্ডবদের তুমুল যুদ্ধ আঠারো দিনে শেষ হয়েছিল কত তাবড় তাবড় ধনুর্দ্ধরের হাতে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে। কিন্তু আমাদের এই যুদ্ধ একুশ দিনের, খালি হাতে। নিরস্ত্র হয়ে ঘরে বন্দি থেকে। চাইলে আমার সকল মহান ভারতবাসী এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে জয়লাভ আনতে পারে……।
নিশি কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, ওরা বলতে পারেনি। অঞ্জনার নিরলস অনুবাদ শুনে, মনে মনে সুখের হাসি। – সব খারাপের একটি ভালো দিক থাকে, গুণীরা বলে। না হলে কি আমার মা, আবার তাঁর হারানো মেয়েকে ফিরে পেতো! এই ভয়ঙ্কর সময়ে মায়ের সঙ্গে অঞ্জনাকে আগের মতো একাত্মবোধ দেখে, চিত্ত বেশিক্ষণ বিচলিত থাকতে দেয় না নিশি। চোখকান খোলা রেখে নিবিড় ভাবে মন নিবেশ করে টেলিভিশনের পর্দায়। স্কিনে ভেসে উঠে, প্রাণবন্তকর প্রধানমন্ত্রীর প্রণয়মাখা মুখাবয়ব। আজ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জীব, এক অদৃশ্য প্রাণীর কাছে কত অসহায়। – আহা রে! প্রধানমন্ত্রীর কাতর কণ্ঠ, বারবার কেঁপে উঠে। দেশবাসীর জন্য তাঁর আকুল আর্তনাদ। নিশির ভেতরটাও বেজে উঠল, – পৃথিবীব্যাপি মানুষ যখন করোনা মহামারীর আতংকে আতংকিত তখন আমাদের দেশে, কিছু লোক এই মহামারীকে নিয়ে রাজনীতিতে ব্যস্ত। কেন এখনও মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না, ঘর থেকে বের হচ্ছে? এই রোগের পাদুর্ভাব কতটা ভয়াবহ, একশো ত্রিশ কোটির ভারতে। চুটকিতে চীন, ইতালি টপকে যেতে পারে কোভিড 19…..।
পর্ব- ছয়
তাত্ক্ষণিক স্ট্রে অর্ডার করল রেল কর্তৃপক্ষ। পঁচিশ মার্চ লামডিং স্টেশনে জয়েন্ট করার সিদ্ধান্ত রেখেছিলেন দীননাথ তরফদার। লক-ডাউনের চতুর্থ দিনে যাত্রী আগমনের টহল দেখে ভীমরতি খেয়ে যান, আনন্দ-বিহার রেল স্টেশনে পুনর্বার আটকে রাখা স্টেশন মাস্টার। দেশের এই দুর্যোগে সবাই মিলে মোকাবিলা করতে হবে একসাথে। প্রতিটি নির্দেশ মেনে চলতে হবে সুনাগরিকের মতো। কিন্তু এরা কারা? সরকারের ঘোষণাকে অমান্য করছে। তরফদার মহাশয় সঙ্গে সঙ্গে, সব যাত্রীবাহী ট্রেন বতিল, আজ আবার বরাবার ঘোষণা করার কথা বললেন, ঘোষণাকারিকে। আর একটা কাগজে লিখে দিলেন, আর কি সব ঘোষণা করতে হবে। – চলুন, আগে দেশ, দেশবাসী ও নিজেকে রক্ষা করি। মাইকের শেষ বুলেটিং আজ বড় বেমানান লাগে ভবঘুর কৈলাশের। দু বছর আগে আমদানি হয়ে ছিল, তরফদারবাবু আসার সঙ্গে সঙ্গে। মাঝে মাঝে কোথায় হারিয়ে যায়। এমন করে কত পাগলের আমদানি হয় সমাজে, তার খোঁজ কে রাখে? কিন্তু কৈলাশ স্টেশন মাস্টার দীননাথ তরফদারের টানে আবার চলে আসে। তিনি গৌহাটি স্টেশনে থাকাকালীন সময়ে কৈলাশ পাগলার সঙ্গে পরিচয়। তার আসল নাম কেউ জানে না। কৈলাশ নাম, তরফদারের দেওয়া। বছর দুয়েক আগে তিনি যখন বদলি হয়ে এখানে এসেছিলেন, তার দু চার দিন পর দেখেন, কৈলাশ পাগলা এখানকার প্লেটফর্মে। তিনি জানেন, অন্য দশ পাগলের মতো নয় সে। তাই আবার তাকে এই স্টেশনের একটি কোণে থাকার ব্যাবস্থা করে দেন। এখানেও তার দুবেলা খোঁজ নেন। এই দুদিন একটু বেশিই নিলেন। মহামারীর কারণে সরকার আপাতকালীন রেলের যাত্রী পরিষেবা বন্ধ রেখেছে। সারাদিনে যে কটা মালবোঝাই ওয়াগন আসে, বাদবাকি পুরোটা সময় অবসর। কিন্তু গত দুদিন ধরে ভিন্ন রাজ্যের মাইগ্রেন্ড লেবারদের হিড়িক। বাড়ি ফিরতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে সবাই। হয়তো পেছনে কিছু রাজনৈতিক দালালের চক্রান্ত আছে। প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন, যে যেখানে আছে, সেখানেই থাকতে হবে। সরকার তাদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে যাচ্ছে। গোটা বিশ্ব জুড়ে যে অদৃশ্য ঘাতকের তাণ্ডব। তাদেরকে আটকানোর একমাত্র পথ, মানুষ পরস্পরের মধ্যে ব্যবধানে তৈরি করে, ঘাতকের যুদ্ধ ব্যূহচক্র ভেঙে দেওয়া। অদৃশ্য-খুনিদের চলার অবলম্বন একমাত্র মানুষের শরীর। যদি আমরা একে অপরকে না ছুঁয়ে চলতে পারি, তাহলে ঘাতক নিরুপায়। আক্রমণের দুন্দুভি ভেরি আর বাজাতে পারে না তারা। মানব শরীর পরস্পরের বিচ্ছিন্নতার জন্যই এই লক-ডাউন। তাই এখনও ভারতবর্ষ দ্বিতীয় স্টেজে। কে বা কারা এই অসংগঠিত পরিযায়ী শ্রমিকদের ফুসলিয়ে দিয়েছে? যাত্রীবাহী কোনও ট্রেন নেই। স্টেশনগুলিতে খামখা ভীড়। এই ভীড়, এই অসাবধানতাই তো শত্রুকে বিজয় এনে দেবে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মানুষের খামখেয়ালিপনা থেকে বিশ্বে। কী অসহায় পৃথিবীর মানুষ। একটা অদৃশ্য পোকা তছনছ করে দিচ্ছে আধুনিক সভ্যতা, শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে। গোটা বিশ্বটাকে দ্রুত গিলে ফেলছে। কিসের দলাদলি, জাতপাত বর্ণবাদ, রাজনৈতিক সমীকরণ। কি হবে এসব দিয়ে। যদি না বেঁচে থাকে মানুষ! কিসের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নিয়ে ভেদাভেদ। মিছে জাত ধর্ম পরিচয়। আজ মুখ তুবড়ে কল্পিত ঈশ্বর অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। আমাদের প্রতিপালক একমাত্র, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। তাতেই রক্ষা। চাতকের মতো মানুষ আজ বসে আছে বিজ্ঞানীদের দিকে। এক ফোঁটা প্রতিষেধকের অপেক্ষায়। সবাই ঘরমুখী হয়েছে। জীবনের প্রতি মানুষের বড় মায়া, তার আত্মীয়স্বজন। পরিযায়ী শ্রমিকেরাও আজ ঘর-মুখো হয়েছে। বাড়ির দূরত্ব কত, ভাবছে না। দু তিনশো কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যাওয়ার সংকল্প। পায়ে পায়ে সবাই এত পথ যেতে পারবে? কেন এই সহজ সরল মানুষকে নিয়ে এত রাজনীতি? কেউ কেউ অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে, বাড়ি ঢোকার আগে মারা যাচ্ছে। সব খবর দ্রুত ইন্টারনেটের মাধ্যমে চাউর হচ্ছে। দীননাথবাবু বধির নয়, পাথরও নয়! বারবার মাইকে ঘোষণা দেওয়াচ্ছেন।ছোটাছুটি করছেন, স্বাস্থ্য দপ্তরের বিধিসম্মত ভাবে। এই অসহায়, ব্যতিব্যস্ত দিনে কৈলাসকে ভুলে রইলেন তিনি। তার খাওয়া হল, সে কি এই ভীড়ে সংক্রমিত হচ্ছে? তার গায়ে তো স্বাস্থ্য দপ্তরের পোশাক নেই।
অঞ্জনা করোনা সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে নাতনিকে বাড়িতে নিয়ে এলেও বুড়ার শান্তি নেই। বছর পাঁচেক আগে ছেলে নিরুদ্দেশ! পুত্রশোকে উদ্বিগ্ন মা! সময়ের দাপটে খানিকটা সুস্থ হলেও এই মহামারীর কথা শুনে আবার গৌতম গৌতম করে কাঁদছেন। এই লক-ডাউনে বুড়ার বাকি ছেলেদের রোজগার বন্ধ। ভাগ্যিস্ একুশ তারিখ গরুর-গাই কিনে নিয়ে ছিল বিল্লাল। না হলে যে…..।