রেজাউল ইসলাম হাসুর গল্প
অতৃপ্তি
ভয় পেলেই ধরা খাবেন। ওরা বুঝে যাবে। আর ওরা বুঝে গেলে কোনো ওঁঝার সাধ্য নেই ওদের অতৃপ্তির বিষ আপনার শরীর থেকে নামায়।
হিরা ভাইয়ের সতর্কবাক্যগুলো তাবিজের মতো আদিফের চোখের সামনে যেন বারবার ঝুলছে। রিক্সা থেকে নেমেই ও আরও সতর্ক হয়ে যায়। ভাড়া মিটিয়ে ডানবাঁম তাকায়। আশপাশের ভিড়ে ওর অশ্বত চোখ পরিচিত মুখমণ্ডল হাস্তায়। কোনো মুখমণ্ডল থেকে পরিচিতের পারফিউম খুঁজে না পাওয়ায় নিজেকে অবমুক্ত পুরুষ শালিকের মতো মনে হয় ওর। অথচ ওর ভেতর-বাহির যেন পুরোদস্তুর কোনো এক সন্ত্রস্ত সন্তের মতো মনে হচ্ছে।
ভয় পেলে চলবে না। না না আমি ভয় পাবো না। ভীত হবো না। কোনো রকমভাবে না। কোনো অবস্থাতেও না। যদি ধরাও পড়ি, তাও না। নিজের ভেতর নিজেকে আরও শক্ত করে তুলতে তুলতে পিচপথে পা বাড়ায় আদিফ। বাসা থেকে বেরোনোর সময় স্ত্রীকে অফিসের কাজের অজুহাত দিয়ে এসেছে। হাফপ্যান্টবেলায় মাতামহি বলতেন, মাইনসের তিনডা হাত। তখন মাতমহির কথার আগামাথা কিছুই বুঝতাম না। বড় হয়ে বুঝলাম—তিন নাম্বার হাতটাই হলো অজহাত।
সামারের দুপুর। মাথার উপর গনগনে আসমান। রোদ যেন গলন্ত শিশার মতো ভূপৃষ্ঠে ঝরছে। দূরে কোনো এক শিমুল ফল ফেটে পেঁজা পেঁজা তুলা আনমনে উড়ে যাচ্ছে হংসরাজের মতো। এক ঝাঁক বাচাল কাক আদিফের মাথা ছুঁয়ে রকেটের মতো শাঁত করে মেঘের ভেতর হাওয়াইমিঠার মতো মিশে যায়।
রকেটের শব্দ হলে আদিফের জন্মতারিখ মনে থাকে না। কোনো এক শীতগ্রস্ত দিনে ওর জন্ম। ভাই-বোনের আধিক্যের ভেতর অবহেলার অতলেই রক্তকরবীর মতোই যেন বেড়ে উঠা ওর জীবন। জীবন আসলে কী চায়—এখনও ও বুঝে উঠতে পারে না। ওর কাছে এই না বোঝার নামই যন্ত্রণা। জন্ম ও জীবনের মধ্যে কোথায় যেন কোনো এক দ্বিধা দাঁড়িয়ে আছে অন্তর্জালের মতো। এই অন্তর্জালের নাম কি দাম্পত্যতা? দাম্পত্য জীবনের কোনো এক অতৃপ্ততা কালো সুতার মতো ওকে টেনে এনেছে এই অচেনা অন্তর্জগতে, এই নরক-দ্রাঘিমায়।
আরেকটু হাঁটলেই স্টেশন। স্টেশন পার হলেই বাজার। বাজারের বুক চিড়ে শঙ্খচূড় সাপের মতো বয়ে যাওয়া গলির গহিন হাঁটলেই সেই অন্তর্জগত, সেই নরক-দ্রাঘিমা। আদিফের ভেতর শয়তানটা তিরতির কাঁপছে। নাভির নিচে জ¦লছে জাহান্নামের জ্বালানি। শয়তানটাকে পুড়তে হবে সেই জাহান্নামের জ্বালানিতে। দ্রæততার ভঙ্গিতে পা চালায় ও।
এই পরিবেশের সঙ্গে ও কখনও না মিশলেও একটা সম্যক ধারণা নিয়েই এসেছে এখানে আসার আগে। এই নরকের নিয়মিত অভিযাত্রী হিরা ভাই ওনার ব্যক্তিগত বিশ^বিদ্যালয়ে ওকে রীতিমতো অভিজ্ঞ অধ্যাপকের মতো লেকচার দিয়েই এখানে পাঠিয়েছে।
এক. এখানকার পরিবেশ কেমন হবে?
দুই. পরিবেশের মানুষগুলো কী ধরনের আচারণ প্রদর্শন করতে পারে?
তিন. কোন বর্ণের বা গন্ধের প্রশ্নসমূহ ছুরির মতো উড়ে আসতে পারে আগুন্তুকের বুকে?
ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া সবচেয়ে যে পয়েন্টটার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বা সজাগ থাকতে হবে তা হলো সংশয়। মানে কোনো রকম ভয় পাওয়া যাবে না। কোনোভাবে ভীত হওয়া যাবে না। ভয় পেলেই ধরা খাবেন। ধরা খেলেই ওরা বুঝে যাবে। আর ওরা বুঝে গেলে কোনো ওঁঝার সাধ্য নেই ওদের অতৃপ্তির বিষ আপনার শরীর থেকে নামায়।
হিরা ভাইয়ের এইসব সতর্কবাক্য যেন রক্ষাকবচের মতোই জড়িয়ে আছে আদিফের আষ্টেপৃষ্ঠে। স্টেশন এসে গেছে। স্টেশন পার হলেই বাজার। বাজারের বুক চিড়ে শঙ্খচূড় সাপের মতো বয়ে যাওয়া গলির গহীন। গহিনে হাঁটলেই সেই নরক-দ্রাঘিমা। আদিফ নিজের সন্ত্রস্ত ভঙ্গিমা শক্ত করে। সংশয়ের পায়ে বেড়ি পড়ায়। লোহার মতো শক্ত হয়ে ওঠে ওর দুঃসাহস। নাভির নিচেও এরকম কিছু একটা অদ্ভুতভাবে বোধ হতে থাকে ওর। ও সেটাও সংযত করে হাঁটে।
হাঁটছে। সামারের দুপুর। মাথার উপর গনগনে আসমান। রোদ যেন গলন্ত শিশার মতো ভূপৃষ্ঠে ঝরছে। দূরে কোনো এক শিমুল ফল ফেটে পেঁজা পেঁজা তুলা উড়ে যাচ্ছে কোনো এক হংসরাজের মতো।
ভয় পেলেই ধরা খাবেন। ধরা খেলেই ওরা বুঝে যাবে। বারবার বাক্যগুলো আদিফের ভেতর মোবাইলের অ্যালার্মের মতো বাজছে। বাজছে আর হাঁটছে। হাঁটছে আর বাজছে। বাজছে আর হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন ফেলে আসে। দেখা হয় বিবিধ সংশয়ের কাঠ ও কংক্রিটের বাজারের সঙ্গে। হাফপ্যান্টবেলায় কোনো একদিন মা বাজারে যেতে যেতে এরকম এক বাজারের গল্প শুনিয়েছিলেন। বাজারে শয়তান থাকে। বাজার একটা নিকৃষ্ট জায়গা। এখানে মানুষ মানুষকে ঠকায় লোভের বশবর্তী হয়ে। এখানে মানুষ মানুষকে ব্যবহার করে ক্রীতদাসের মতো। আদিফের অক্রীতদাসত্ব হৃদয়ে আজো মিথ হয়ে আছে মায়ের সেই গল্পটা।
আদিফকে দেখে ইশারা ছোড়ে নিকোটিনের ধোঁয়ায় ডুবে থাকা মানুষের মুখোশ পড়ে থাকা যদু, মধু, কদুরা। হিরা ভাই বলেছিলেন, বাজার স্পর্শ করার সঙ্গেই এ ধরনের ধুম্রজালের মতো থোকা থোকা ইশারা আসবে। সেসব ধোঁয়াশার ইশারা এড়িয়ে আপনি এগুতে থাকবেন বাজারের বুক চিড়ে শঙ্খচূড় সাপের মতো বয়ে যাওয়া গলির গহিনে। সেখানে নরক ডাকছে শয়তানকে প্রোথিত করার জন্য। অতৃপ্ততার দাহকাল থেকে জীবনকে প্রশমনের জন্য।
আদিফ এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিমা করে বাজারের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া শঙ্খচূড় সাপের মতো গলির গহিনে হাঁটতে থাকে। গলির আশপাশে লাল ট্রাফিক সিগন্যালের মতো দাঁড়িয়ে আছে প্রাশ্নিক প্রহরী। আদিফ এইসব প্রহরীর মুখোমুখী হবে কিনা ভেতরে ভেতরে ভুগতে থাকে অচেনা দ্বিধায়। ওর ভেতর যেন কোনো এক প্রকাণ্ড দ্বিধার গাছ ফুঁড়ে ওঠছে। ও কাউকে বুঝতে দেয় না। ধীরধীর হাঁটে। আশপাশ তাকায়। তাকাতে তাকাতে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে তাকায়। এগুতে থাকে বেগানা গলির গহিনে।
টাইটফিট ব্লাউজ ফেটে যেন আদিফের হাতে আসতে চাইছে মিম্বারের গম্বুজের মতো স্তনগুলো। কিসমিসের মতো লিপলগুলো যেন ঠোঁটের ভেতর মিশে যেতে চাইছে ক্যান্ডির মতো। লাল লাল লিপিস্টিকের মদ মেশানো হাসিগুলোর উদাসীনতা যেন ঝুঁকে পড়তে চাইছে ওর ত্রিশোর্ধ্ব শরীর-শকোটে।
এ যেন বাজারের ভেতর আরেক বাজার। ছোট ছোট ঘরগুলোকে মনে হয়ে একেকটি মাছের দোকান। খদ্দের আসছে। দাম হাঁকাচ্ছে। আর সাঁটার নামানো দোকানের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে শুঁড়ীখানার মাতালের মতো। তারাও কি আদিফের মতো কোনো এক অতৃপ্ততাকে ঘুচাতে ঝাঁপ দিচ্ছে জাহান্নামের জ্বালানিতে। অতৃপ্ত আদিফ হিসাব মেলাতে পারে না। কেবল কোনো এক ঘোরের মেঘে আচ্ছন্ন হতে থাকে।
একটু এগুতেই কিছু অগোছালো স্বরগ্রাম। খানকির পোলা। তোর মায়েরে চুদি। পারোস না তয় আইছোস ক্যান।
এইসব কুয়াশা ছেদ করে কোনো এক অতৃপ্ততাকে দেখা যায় লাফ দিয়ে এইসব প্রাচীন প্রাচীর টপকে দৌড়ে পলায়ন করতে। তখনও অন্ধকার গহন থেকে কেবল ভেসে আসছে মেয়েলি গলায় পুরুষালির অসভ্য স্বরগ্রামসমূহ। খানকির পোলা। তোর মায়েরে চুদি। পারোস না তয় আইছোস ক্যান।
আদিফের লোমশ শরীর-শকট শিউরে ফুঁড়ে উঠে সন্ত্রস্ততার কণ্টক। কোনো এক বেগানা প্রবীণ মহিলা ভিখারির মতো এসে পথ আগলে দাঁড়ায়। হিরা ভাইয়ের লেকচারের কোথাও তো এই ভিখারি ছিলো না। তাহলে ইনি কে? কোত্থেকে এলো? তাহলে কী ভিখারি ওদেরই ছায়া। আদিফ ফুলপ্যান্টেরে ডান পকেট থেকে একটি ১০০ টাকার নোট বের করে ছায়াকে শান্ত করে এগুতে থাকে।
সামনে গহিন অন্ধকার। অন্ধকারে মন্দিরার ঢেউ। হার্টথ্রুব হিন্দি গানের পাখায় উড়ে বেড়াচ্ছে পাপ ও প্রদাহ। অযাচিত খিস্তি খেউর শিশ্ন। গোঙানির আবর্জনা। এইসব আদিফকে ভাসিয়ে নিতে চায় কোনো এক জাহান্নামে। সংশয়হীন-দ্বিধাহীনভাবে নিজেকে শক্ত করে ধরে ও।
বাবু, চল ভেতরে যাই। বাসায় পোষা বেড়ালের মতো কোনো এক মসৃণ হাত এসে আদিফকে হ্যাচকা টান মেরে ঘরে নিয়ে যায়। ওর কাছে ঘরটাকে মনে হয় কোনো কবুতর খুঁপড়ি। দরজা বন্ধ করে দেয়। আদিফের দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। নাভির নিচে শয়তানটা আরও শক্ত হয়ে ওঠে। যেন লোহাকেও হারা মানা সমূহ শক্তি এসে ভর করেছে ওতে। জাহান্নামের জ্বালানি জ¦লছে। গনগনে সে উত্তাপ। সেখানে পুড়ছে আদিফের অতৃপ্ত শয়তান। গোঙানির গাঙে বেড়ালটা অজ্ঞান হয়ে যায়। তখনও ওর অতৃপ্ততা ঘুচেনি। তখনও ওর নাভির নিচে জাহান্নাম জ¦লছে। তখনও ওর শয়তানটা লোহার মতো অদ্ভুত শক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে ওর অতৃপ্ত মুখের দিকে।
কোনো এক অনাথ অতৃপ্ততা নিয়েই নরকের অর্গল ভেঙে আবার হাঁটতে থাকে আদিফের অতৃপ্ত পৃথিবী…