শুক্রবার, ১৩ Jun ২০২৫, ০৭:২৪ অপরাহ্ন

রবীন্দ্রনাথের আনন্দ-বেদনার গান : প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ আলম

রবীন্দ্রনাথের আনন্দ-বেদনার গান : প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ আলম

*রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই শুরু করি- ‘বেদনা থেকে যে আনন্দের উৎপত্তি, সে আনন্দের তুলনা নেই।’ রবীন্দ্রনাথের অনেক গানই প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা। তাঁর জীবন জুড়ে  বেদনার  গভীর স্পর্শ। কিন্তু ম্রিয়মানতা গ্রাস করেনি তাঁকে। তরুণ সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর যাবতীয় আবেগ, মাধুর্য, আনন্দ, প্রাচুর্য নিয়ে গানের পশরা সাজিয়েছেন।  কোনো কোনো আলোচকের মত- রবীন্দ্রনাথের গানের প্রাচুর্যের ব্যাপারটিকে, আবেগ ও মাধুর্য ব্যাপারটিকে সংগীত রচনার মাধুর্যের  সঙ্গে মিলিয়ে ভাবা যেতে পারে। সে সাথে ব্যাপারটিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা ভালো। দুঃখ নয়, সৃষ্টি সুখের আনন্দ নিয়ে কবির প্রথম দিকের কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। কবির উচ্ছ¦াস-
‘আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান!
না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।’
আনন্দঘেরা চিত্তের এমন  উল্লাস গানেও বহুবিস্তৃত। পূজা পর্যায়ের কিছু গানসহ অনেক গানেই অনাবিল আনন্দ সুবাস ছড়িয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের আনন্দ ভুবনে বিচরণ করবো তারপর যাবো দুঃখের অঙ্গনে।
সৃষ্টির মূল প্রেরণা যে আনন্দ এমন উপলব্ধি গভীরভাবে লালন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আনন্দ প্রসঙ্গে উপনিষদে বলা হয়েছে- ‘ঈশ্বর আনন্দ থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন এবং আনন্দ দ্বারাই একে সঞ্জীবিত রেখেছেন।’ আনন্দই বিশ্বজগতের চালিকাশক্তি, যা কিছু দৃশ্যমান সবই মূলত আনন্দরূপ। এমন বিশ্বাস নিয়েই রবীন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছিলেন তার আনন্দভাবনা। জগতে নেতিবাচক দিক নেই তা নয়, অশেষ দুঃখ যন্ত্রণার ভার নিয়ে অগ্রসর হতে হয় মানুষকে। কিন্তু চরম বাস্তবতা হলো দুঃখই জীবনের শেষ কথা নয়, আনন্দের রেশও জীবনকে দেয় স্বস্তির ঠিকানা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই উপলব্ধি করেছেন আনন্দেশ্বর মুছিয়ে দেবেন সব অশ্রু, পরিণামে দুঃখ নয় বয়ে যাবে আনন্দের সুবাতাস। এজন্যই মানব জীবন ধন্য, কারণ মানুষ জগতের আনন্দমঞ্চে যোগ দিতে এসেছে। এমন বোধেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ
ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন’-
এ গানে জগতের রূপময়তায় সাধ মিটিয়ে বেড়াবার আনন্দকথা বলেছেন কবি। গানটির রাগ-সরফর্দা-বিলাবল, তাল- একতাল, রচনাকাল ৩০ আশ্বিন ১৩১৬ বঙ্গাব্দ, স্বরলিপিকার-  সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভীমরাও শাস্ত্রী।
ব্যথার বাঁশিতে আনন্দগান বেজে ওঠে এমন কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। কবি জানেন দুঃখের সুরে বাঁধা বাঁশি, কিন্তু তবু আনন্দ গানেই বাজতে হয়।  তিনি লিখেছেন-
‘আনন্দ গান উঠুক তবে বাজি
এবার আমার ব্যথার বঁশিতে
অশ্রুজলে ঢেউয়ের ‘পরে আজি
পারের তরী থাকুক  ভাসিতে’
 রবীন্দ্রনাথ আলোয় আলোয় মুক্তির আনন্দ প্রত্যাশা করেছেন। ধর্মেরও অন্যতম প্রধান বিবেচ্য বিষয় মুক্তি। ধর্মে বহুভাবের মুক্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে মুক্তির প্রত্যাশা করেছেন তা ভিন্ন আর বিস্ময়কর। গানে ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে যুক্ত হতে চেয়েছেন কবি। সকল মানুষের মনের মধ্যেই তিনি খুঁজেছেন মুক্তি। আনন্দময় যেখানে বিশ্বসাথে যুক্ত হচ্ছেন সেখানেই তাঁর সাথে কবির যোগাযোগ, তুমি-আমির সে এক আশ্চর্য মিলন, অনন্ত আনন্দ। রবীন্দ্রনাথ এ ভাবনাকে সাথী করে লিখেছেন-
‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে
আমার মুক্তি ধূলায় ঘাসে ঘাসে-এ গানটি।
পূজা পর্যায়ের এ গানটির রাগ মিশ্র কেদারা, তাল তেওরা, রচনাকাল  ২রা আশ্বিন ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ, স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ গানটি লেখেন ন্যুর্নবর্গ, জার্মানীতে।  এ গানে কবির সর্বজনীন বোধের প্রকাশ ঘটেছে। কবির বোধ-
‘আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে
দুঃখ-বিপদ-তুচ্ছ করা কঠিন কাজে।’
মুক্তির আশায় জীবন আহুতি দেবার কথাও বলেছেন এ গানে।
 বিশ্বেশ্বরের সাথে মিলনের আকাক্সক্ষা প্রবল কবির। একার নয় সবার আনন্দধর্মের সাথে মিলিত হবার প্রবল  বাসনার কথা ব্যক্ত করেছেন গানে। তিনি সূর্য, চন্দ্র থেকে অক্ষয় জ্যোতি পান করতে চেয়েছেন অঞ্জলি ভরে। কবির বোধ স্বার্থমগ্নতা নয়, চারদিকে হৃদয় প্রসারিত করে সবার সাথে মিশতে হবে। দুঃখ যন্ত্রণায় কাতর হলে চলবে না, সব বেদনাময়তাকে উপেক্ষা করে, তুচ্ছ ভেবে প্রেমের ধারা প্রবাহিত করতে হবে শূন্য জীবনে। কারণ পৃথিবী তো খুবই সুন্দর, জগৎজুড়ে তো আনন্দধারা বহমান, অমৃত রসে জগৎ ভরপুর। এ বোধ নিয়েই রবীন্দ্রনাথ যে গান রচনা করেছেন তা হলো-
‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে
দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগণে’
জগৎজুড়ে যখন আনন্দধারা প্রবহমান তখন বেদনার ঠাঁই কেন অন্তরে। যে জন্য কবি দুঃখকে তুচ্ছ মানতে বলেছেনÑ ‘চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচছ মানি,
প্রেম ভরিয়া লহ শূন্য জীবনে।’
কবির বিশ্বাস শূন্য জীবন প্রেমে ভরে উঠলেই বইবে আনন্দবাতাস।   এ গানটির রাগ মিশ্র মালকোষ, তাল ত্রিতাল, রচনাকাল-১৩০০ বঙ্গাব্দ, স্বরলিপিার- ইন্দিরা দেবী।
আমি-তুমি বা সীমা-অসীমের সম্পর্ক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যত গান লিখেছেন বা যা কিছু বলেছেন, সবক্ষেত্রেই তুমি বা অসীমকে গৌরবান্বিত করেছেন। সাথে মানুষকেও বড় করার প্রয়াসী কবি। তাঁর উপলব্ধিÑ অসীম তার সুর বাজাচ্ছেন সীমায়, তাই সে সুর মধুর হয়ে উঠেছে। যদি সীমা না-ই থাকত তাহলে তো সুরই বাজাতে পারতেন না। অসীম, তো কায়াহীন, আমির মধ্যেই কায়া গ্রহণ করে আমির সৌন্দর্যে অসীম সুন্দর হয়ে ওঠেন। আমি-তুমির এ পরস্পর পরিপূরক সম্পর্ক রবীন্দ্রভাবনায় একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে, যাতে মানবজীবনের গৌরবময় দিকটিও বিশেষভাবে প্রষ্ফুট। অসীমের কাছে নিজেকে নিবেদনে মেলে বিপুল আনন্দ। অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ড পরম শক্তির বিকাশ লক্ষ্যযোগ্য, এখানে শতকোটি ভক্তহৃদয় বিশ্বচরণে নিবেদিত। যে জন্য জগতে নিরন্তর বয়ে যায় আনন্দধারা। এমন চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ —
‘বহে নিরন্তর আনন্দধারা\
বাজে অসীম নভো মাঝে অনাদি রব
জাগে অগণ্য রবচন্দ্রতারা’-গানটি।
এ গানের রাগ লচ্ছাসার বিলাবল, তাল ঝাঁপতাল, রচনাকাল ভাদ্র ১৩০৪ বঙ্গাব্দ, স্বরলিপিকার- কাঙ্গালীচরণ সেন।
** ‘সদা থাকো আনন্দে, সংসারে নির্ভয়ে নির্মলপ্রাণে\
জাগো প্রাতে আনন্দে, করো কর্ম আনন্দে
সন্ধ্যায় গৃহে চলো হে আনন্দগানে\’
*‘গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর-
হৃদয় মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখির ডোর?’
*‘আজি এ আনন্দ সন্ধ্যা সুন্দর বিকাশে, আহা\
মন্দ পবনে আজি ভাসে আকাশে
বিধুর ব্যাকুল মধুমাধুরী, আহা’
*এত আনন্দধ্বনি উঠিল কোথায়,
জগতপুরবাসী সবে কোথায় \
কোন্ অমৃতধনের পেয়েছে সন্ধান,
কোন্ সুধা করে পান!’
এমন অনেক গানেই আনন্দধারা বইয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সংসার ধূলি মাঝে আনন্দগীতির সুরাবেশ ছড়িয়ে জীবনকে মুখর করার যে প্রয়াস তাতে তার সাফল্য স্বস্তির।
আনন্দ সংগীতের পর এবার সন্ধান দুঃখের বাণী। রবীন্দ্র জীবন আলোচনায় স্পষ্ট যে তাঁর  জীবনে দুঃখের স্রোত বয়ে গেছে নানা ভাবে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে দুঃখ, লেখক রবীন্দ্রনাথকে ব্যক্তিগত আক্রমণ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য আক্রমণ- তাঁকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়েছে। স্বজন হারানোর বেদনায় অনেক সময়ই বিমর্ষ থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে দুঃখ-কষ্টকে মেনে নিয়েই সমুখপানে যাত্রা এবং সৃষ্টির জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন কবি। তাঁর মননে জাগ্রত-
‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে
তুবও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’
  ব্যক্তি জীবনের দুঃখবোধ রবীন্দ্রনাথের গানেও নিবিড় ছায়া ফেলেছে, আধ্যাত্মিক ভাবনায় আরও গভীর করে আছে দুঃখবোধ। পূজা পর্যায়ের গানে একটি উপবিভাগ আছে যার নামই ‘দুঃখ’। ৪৯ গান আছে এ বিভাগে। গীতবিতানের দুঃখ উপবিভাগের গানগুলোর বিষয়বস্তু যে অভিন্ন তা নয়, তবে একটা সাধারণ মিলিত বোধ প্রায় সব গানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। সে বোধ হচ্ছে  দুঃখের অপর পারে দুঃখহীনতা বিরাজিত, সেখানে যাবতীয় দ্ব›দ্ব ও বৈপরীত্যের অবসান। দুঃখের ভেতর দিয়েই তাকে তীব্রভাবে পাওয়া যায়।
*র‌্যথার পূজার অবসান ঘটবে তখন যখন পরম আরধ্যকে উজাড় করে সব নিবেদন করা যাবে। তা না হলে বয়ে বেড়াতে হবে অসীম যাতনাময় জীবন। অস্তরবির সাথে পূজার সব আয়োজনের মাধ্যমে সমর্পনের রঙে শেষ হবে ব্যথার পূজা। এ বোধ নিয়ে গান-
‘আমার সকল দুখের প্রদীপ জে¦লে দিবস গেলে করব নিবেদন
আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন
গানটির রাগ মিশ্র ভীমপলশ্রী, তাল কাহারবা, রচনাকাল -আশ্বিন-১৩২৫ বঙ্গাব্দ। অন্তরের দহন থেকেই সাধন সিদ্ধির সুবাতাস বয়ে যায়। মনের দহন না থাকলে ধুপের মতো সাধন সুগন্ধি উত্থিত হয় না, মনের দীপ না জ্বালালে সবকিছুই থাকে আঁধারে ঢাকা। সাধকের চিত্ত অসচেতন থাকলে পরম অসীমের সাথে মিলবার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই দরকার দহন, না পাবার দৈন্য ঘোচাতে পরমাত্মার দহন একান্ত কাম্য হয়ে ওঠে। সেজন্যই রবীন্দ্রনাথের গানে তেমন আকুতি ঝরেছে-
‘এই করেছ ভালো নিঠুর হে, এই করেছো ভালো,
এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো/
..যখন থাকে অচেতনে/
এ চিত্ত আমার/
আঘাত সে যে পরশ তব/
সেই তো পুরস্কার।’
 গানটি লেখা ইমন কল্যাণ রাগে, তাল- একতাল, রচনাকাল- ৪ঠা আষাঢ় ১৩১৭বঙ্গাব্দ ।
দুঃখ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আনন্দের মতো দুঃখ সম্বন্ধেও পূর্বসুরীদের মতবাদ নিয়ে ভেবেছেন। কৈশর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত পারিবারিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে নানা দুঃখ পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। চিত্তময় বেদনা ও দুঃখের  অভিজ্ঞতার সাথে মিশেছে  পূর্ববর্তীদের দুঃখভাবনা। এদের সমন্বয়েই রচিত হয়েছে রাবীন্দ্রিক দুঃখবোধ, যার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে গানে। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি-পৃথিবীতে দুঃখ, মৃত্যু, বিরহবেদনা সবই আছে। তবুও জাগে শান্তি, অফুরান আনন্দ প্রণ-মন ছুঁয়ে যায়। তাইতো কবি লিখেছেন-
‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক /
তবে তাই হোক/
মৃত্যু যদি কাছে আসে তোমিার অমৃতময় লোক/
তবে তাই হোক।’
 কারণ সৃষ্টির নিয়মে মৃত্যুতে সব লয় হয় না, নতুন জন্ম নবজীবনের স্পন্দন আনে, ফুল ঝরলেও, নতুন পাঁপড়ি বিকশিত করে নতুন ফুল। তাই পৃথিবীতে কোন কিছুর ক্ষয় নেই, শেষ নেই, দৈন্যলেশও নেই। সেজন্য দুঃখ-মৃত্যু, বেদনাকে নিয়ে শংকিত না  হয়ে আনন্দের ভুবন রচনা করতে আগ্রহী রবীন্দ্রনাথ। এমন কথাই ধ্বনিত-
‘ আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে/
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে-’ গানটিতে।
 গানটি যোগিয়া রাগের, তাল – একতাল, রচনা কাল-১৩০৯ বঙ্গব্দ।
* রবীন্দ্রনাথ দুঃখ সম্পর্কে বলেছেন- ‘দুঃখ আছে , সংসারে দুঃখের শেষ নাই। সেই দুঃখের আঘাতে, সেই দুঃখের বেগে সংসারে প্রকাণ্ড ভাঙন-গড়ন চলিতেছে। ইহাতে অহরহ যে তরঙ্গ উঠিতেছে তাহার কতই ধ্বনি, কতই বর্ণ, কতই গতি ভঙ্গিমা। মানুষ যদি ক্ষুদ্র হইত এবং ক্ষুদ্রতাতেই মানুষের যদি শেষ হইত, তবে দুঃখের মতো অসংগত কিছুই হইতে পারিত না।’- সে জন্য রবীন্দ্রনাথের বোধ- ‘সংশায়াকুল হবার প্রয়োজন নেই, যিনি পরম আশ্বাস, পরম আশ্রয় তিনি রুদ্র, তবে আঘাত দিলেও তিনি অবহেলা করেন  না।’ এমন বেধ থেকেই রবীন্দ্রনাথের চাওয়া-
‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি
তোমার সেবার মহান দুঃখ সাহিবারে দাও ভকতি।’
গানটি কাহারবা তালের। নানা গানে দুঃখবোধের অনুভবের প্রকাশ থেকে স্পষ্ট হয় দুঃখকে রবীন্দ্রনাথ কতটা গভীরভাবে নিয়েছিলেন।
দুঃখ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কিছু গান-
*‘এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল যে, পার হল
তোমার পায়ে এসে ঠেকল শেষে, সকল দুঃখের সার হল।’
* তোমার কাছে শান্তি চাব না,
 থাক্না আমার দুঃখ ভাবনা\
*‘আর রেখো না আঁধারে, আমায় দেখতে দাও।..
কাঁদাও কাঁদাও এবার, সুখের গ্লানি সয় না যে আর,
নয়ন আমার যাক-না ধুয়ে অশ্রুধারে-
আমায় দেখতে দাও\
*‘ দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক
তবে তাই হোক।..’
  *দু:খের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে।
যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় ক‘রে ধরিব হে\
**যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে
   জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে\
সব যে হয়ে গেল কালো, নিবে গেল দীপের আলো,
আকাশ পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে?
      ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোকে/ তবে তাই হোক।
দুঃখের কাছে সমর্পণ করেননি রবীন্দ্রনাথ, বরং দুঃখের মধ্য দিয়ে মঙ্গলের আলো জ্বালাতে চেয়েছেন। বিপদে বিচলিত না হয়ে, স্রষ্টার কাছে চেয়েছেন শক্তি ও সাহস। কবিতায় তাঁর  চাওয়া-
‘ বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা-
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখ-তাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত¡না,
দুঃখে যেন করিতে পরি জয়\
রবীন্দ্রনাথ জীবনে সুখ-দুঃখ যা পেয়েছেন তাতেই তাঁর তুপ্তি ও স্বস্তি।  সে স্বস্তি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কবিতায় বলেন-
‘যেখানে এসেছি আমি, আমি সেথাকার,
দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর।
জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখ দুঃখভার
বহুভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির।’
অনেকেই বলেন দার্শানিকগণের কাছে দুঃখ সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রবল। দুঃখ কী, দুঃখ কেন, দুঃখ থেকে নির্বাণ এমন বিষয়গুলো ভবিত করেছে তাঁদের। রবীন্দ্রনাথও বহুমুখী ভাবনায় দুঃখকে ধারণ, লালন ও প্রকাশ করেছেন গানে। নান্দনিক গভীরতায় বিষয়গুলো উপস্থাপনে রবীন্দ্র প্রয়াস হতাশার মাঝেও জাগিয়ে রেখেছে আশা। যা বেদনার মধ্যেও স্বস্তি ও প্রত্যয়ের জন্ম দেয়।-
‘ দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে
দহন করে মারতে হবে।’’
[লেখক: বিশিষ্ট সাহিত্যিক, ভূতপূর্ব অধ্যাপক, বাংলা, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর]

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge