রংপুর দখিগঞ্জ ট্র্যাজেডি ও একজন মন্টু ডাক্তার
আবিদ করিম মুন্না
৩ এপ্রিল ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে সাতদিনে গড়িয়েছে। পাকিস্তানি খানসেনারা শুরু থেকে ব্যাপকভাবে শুধু মানুষকে হত্যাই নয়; আগুনে জ্বালিয়ে দিতে থাকে ঘরবাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি প্রতিদিনই হত্যা করতে থাকে জাতির মেধাবী সন্তানদের। সেদিন বাদ গেলেন না রংপুর শহরের বিশিষ্টজনেরা। রাত আনুমানিক আড়াইটায় তৎকালীন রংপুরের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, সমাজসেবকসহ অনেককে পাকসেনারা ধরে নিয়ে আসে শ্মশানে।
পুরাতন রংপুরখ্যাত মাহিগঞ্জের রয়েছে সাতমাথা বলে একটি জায়গা। এমন নামের কারণ সাতটি রাস্তা সাতদিকে চলে গেছে। যে রাস্তাটি প্রবেশ করেছে শহরের জনারণ্যে সেই রাস্তার অল্প কিছুদূর যেতেই চোখে পড়বে দুটো প্রতিষ্ঠান। একটি বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয় এবং তার বিপরীতে অবস্থান বাংলাদেশ রেশম বোর্ড অর্থাৎ সেরিকালচার অফিসের। এই অফিসের লাগো রংপুরের বৃহত্তম হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্মশান- যা দখিগঞ্জ শ্মশান নামে অধিক পরিচিত। শ্মশানের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য পুরাতন গাছগাছালি। এর মধ্যে পুরনো মহীরুহ পাঁচটি বটগাছ সাক্ষী হয়ে আছে সেই কালরাত্রির। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এই শিমুল গাছগুলোর নিচেই একাত্তরে সেই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় যা আজো বৃহত্তর রংপুরের মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
সেই ভয়াল রাতে অনেকের মতো জীবনের ওপারে যাবার কথা ছিল দীনেশ চন্দ্র ভৌমিকের যিনি মন্টু ডাক্তার নামে রংপুরবাসীর কাছে পরিচিত ছিলেন। ১ জানুয়ারি ১৯৩০ সালে জন্ম নেয়া মন্টু ডাক্তার ১৯৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন। পেশাগত জীবনে ছিলেন সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ম্যানেজার। একটা হোনডা ফিফটি চালিয়ে সেন্ট্রাল রোডস্থ চৌধুরী ভবন রংপুরের অফিসে আসতেন। মঞ্চে অভিনয়েও দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। তাঁর সন্তানেরা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত- ডা. অসীমা ভৌমিক বাবলী, বিভাগীয় প্রধান, গাইনি বিভাগ, নর্দান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর; বুলা ভৌমিক টাবলী, অধ্যক্ষ, লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রংপুর; অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টি এবং রংপুর আইনজীবী সমিতির সহসম্পাদক; কৃষ্ণা ভৌমিক, প্রধান শিক্ষক, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়, রংপুর; সাংবাদিক সুশান্ত ভৌমিক সুবল, রংপুর প্রেসক্লাবের কোষাধ্যক্ষ এবং দৈনিক খোলা কাগজের বিভাগীয় অফিস প্রধান এবং ডা. বিশ্বজিৎ ভৌমিক বিপ্লব, কো-অর্ডিনেটর, সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি, ঢাকা।
না, মন্টু ডাক্তার সেই কালরাত্রিতে মরেননি, বেঁচে গিয়েছিলেন। সেই রাতে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা হলেন ওয়াই এ মাহফুজ আলী জররেজ, দুর্গাদাস অধিকারী, ক্ষিতীশ হালদার, গোপাল চন্দ্র, এহসানুল হক দুলাল, তোফাজ্জল হোসেন মহরম, রফিকুল ইসলাম রফিক, উত্তম কুমার অধিকারী (গোপাল) ছাড়াও অজ্ঞাত আরো ২ জন।
সবার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা এবং চোখ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল। পাকিস্তানি খানসেনারা গুলি করার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মন্টু ডাক্তার। সবার মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে কিনা সেটিও পরীক্ষা করতে এসেছিল ওরা। বুটের লাথি এবং বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরীক্ষা করেছিল সবক’টি মৃতদেহ। কিন্তু মন্টু ডাক্তার সে সময় দম বন্ধ করে মরার মতো পড়েছিলেন। মন্টু ডাক্তারের উচ্চতা ছিল শহীদ জররেজের বুকসম। অলৌকিকভাবে তাই বেঁচে যান তিনি। ভোররাতে ক্রল করে দু’পায়ে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ নিয়ে দখিগঞ্জ শ্মশানের মূল পাকাসড়কে উঠে আসেন। একজন পথচারী তাঁকে চিনতে পারেন। মন্টু ডাক্তার তৃষ্ণা মেটানোর জন্য আর্তি জানিয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। তাঁকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য একটি রিকশার হুড তুলে শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে মাহিগঞ্জ এলাকা পাড় করানো হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের সহযোগিতায় বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী থানার আলেফের চৌপথী মোড় থেকে পশ্চিমে রামখানায় প্রয়াত ডাক্তার শচীন বাবুর চিকিৎসা নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। শোনা যায়, কুচবিহার এবং কলকাতায় উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ দেশ স্বাধীন হলো। সবাই ধরেই নিয়েছিল মন্টু ডাক্তার আর বেঁচে নেই। কিন্তু আচমকা একদিন হাজির হলেন পরিবার-পরিজনের কাছে। সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল তাঁর অলৌকিকভাবে ফিরে আসা দেখে।
মাহিগঞ্জ এলাকায় বসবাসরত পুরনো মানুষেরা আজও শিউরে ওঠেন যখন মনে পড়ে ৪৬ বছর আগে ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিলের সেই লোমহর্ষক ঘটনার কথা। রংপুরের সচেতনমহল এবং স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের অনেকের উদ্যোগে সেই হত্যাযজ্ঞস্থলে নির্মাণ করা হয়েছে দখিগঞ্জ বধ্যভূমি ’৭১ স্মৃতিফলক। স্মৃতিফলকটি ’৭১ এর ভয়াবহ দিনগুলোর কথাই বারবার মনে করিয়ে দেয়।
শহীদরা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যে আত্মত্যাগ করে গেছেন তাদের ঋণ আমরা কি কোনোদিন শোধ করতে পারবো?