রংপুরে নজরুল
মোস্তফা তোফায়েল
রংপুরের বিখ্যাত কাজী পরিবার। কাজী মহাম্মদ ইলিয়াস, কাজী মহাম্মদ এহিয়া, কাজী মদীনা এই পরিবারের সন্তান। কাজী জুন্নুন, যিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পী হিসেবে পরিচিত, তিনি উক্ত কাজী মহাম্মদ ইলিয়াসের পুত্র। প্রখ্যাত অভিনেতা, আবৃত্তিশিল্পী, নাট্যপরিচালক কাজী মহাম্মদ ইলিয়াস (জন্মসাল 1901; মৃত্যু 1994 এর এপ্রিল) ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । কলকাতা শহরে তাঁরা ছিলেন একই ঘরানার রাজনৈতিক কর্মী।
1927 সালে, কাজী মহাম্মদ ইলিয়াস ও তাঁর অপর দুই বন্ধুর এক আড্ডায় নজরুলকে রংপুরকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। আড্ডার স্থান ছিল রংপুর সদর হাসপাতাল চত্বর, যেখানে 1920-30 এর দশকে ছিল মনোরম পুষ্প উদ্যান। সেদিনের আড্ডার অপর বন্ধুরা ছিলেন কলকাতার ‘অমৃতবাজার ‘ পত্রিকার কলাম লেখক মণীষীমোহন রায় এবং Star of India পত্রিকার তত্কালীন ঢাকা বুরো প্রধান মহমুদ হোসেন । বন্ধুরা সবাই মিলে কাজী মহাম্মদ ইলিয়াসকে দায়িত্ব দিলেন, কলকাতা গিয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে আসার।
তবে, শেষ পর্যন্ত তিনি কলকাতা যাননি। আড্ডার আর এক বন্ধু, দেবেন ঘোষ খুব উত্সাহী ছিলেন কলকাতা যাওয়ার জন্য । কাজী সাহেবের একটি পত্র নিয়ে তিনি চলে গেলেন কলকাতা, কবিকে নিয়ে আসতে ।
কবিকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য মানপত্র তৈরি, তাঁর থাকা র ব্যবস্থা, প্রচার কার্য- ইত্যাদি শুরু হয়ে গেছে । এর মধ্যে ঘটে গেল এক নাটকীয় ঘটনা । কাজী মহাম্মদ ইলিয়াস লিখেছেন, “দেবেন ঘোষ কলকাতা যাওয়ার পঞ্চম দিবসে । সকাল বেলা মুখ ধুয়েছি, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে এলো দেবেন। ওকে দেখে বললাম, ‘কিরে, তুই বাহাদুরি করে গেলি, ফিরে এলি যে!”
দেবেন আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ” শিগগির তৈয়ব সাহেবের বাসা যা, নজরুল এসেছেন- তোকে ডাকছেন ।”
কাজী সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন । বললেন, “আমাদের যে কোনো ব্যবস্থা করাই হয়নি!”
দেবেন বাবু বললেন, “কবি সাহেব শুধু বলতেন, ‘হবে, হবে, যাবো, যাবো । কাল সন্ধ্যায় হঠাত্ করে বললেন, ‘চল, আজই দার্জিলিং মেইলে যাওয়া যাক্ ।’
কাজী সাহেব তখনই ছুটলেন কবির উদ্দেশে । দেবেন বাবু চললেন মণীষী বাবু আর অন্যান্য সকলকে খবর দিতে।
কাজী মহাম্মদ ইলিয়াস সেখানে পৌঁছে দেখেন, কবি খাটের ওপর বসে আছেন । তাঁকে নাস্তা পরিবেশন করা হচ্ছে। বহু লোক তাঁকে বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছে ।
কবি, তাঁর পুরনো বন্ধু কাজী মহাম্মদ ইলিয়াসকে ডাকতেন ‘বাবু’ বলে। কবি তাঁকে ঠেস দিয়ে বললেন, “বাবুর ঘুম ভাঙলো”। কাজীর অগত্যা উত্তর:”আপনি যে আজ এমন করে হঠাত্—” কথা শেষ না-হতেই কবির উত্তর: “পেয়াদা পাঠিয়ে পাকড়াও করে আনলে, আর বলছো হঠাত্ এসেছি ! ফেউয়ের মতো পেছনে লেগে থাকলো, কাল ফাঁক পেয়ে চলে এলাম। এখন বসে পড়। সে ফেউটি গেল কোথায়?”
কাজী বললেন,”এখখনই আসবে, আপনি খাওয়া শুরু করুন ।” বলে, একটু সরার চেষ্টা করতেই কবি খপ্ করে তাঁর হাত ধরে ফেলেন। অসহায় কাজী থেমে গিয়ে বললেন, “আমার হাত এভাবে ধরে থাকলে হাত ধোব কেমন করে?” কবির মন খোলা উত্তর: “এসো তো গুড বয়।”
নাশতা হতে হতেই সেখানে চলে এলেন মণীষী বাবু, মহমুদ হোসেন, দেবেন বাবু- সবাই ।
মণীষী দুঃখ করে বললেন, “একটু আগে জানতে পারা গেল না; কোনো রকম অভ্যর্থনা আয়োজন করারও সুযোগ হলো না !”
কবির তাত্ক্ষণিক উত্তর,”অভ্যর্থনার ত্রুটিটা কোথায় দেখলে? যেরকম উপাদেয় নাশতা; একটু আগে এলে তোমরাও ইলিয়াসের মতো ভাগ বসাতে পারতে। অভ্যর্থনা আবার কী? আমাকে ব্যাণ্ড বাজিয়ে আনতে হবে না কি? আমি কি বর?”
মণীষী উত্তর দেন:”বর না হলেও বরণীয় তো বটেই ! রাইফেল-বন্দুক ছেড়ে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন; একেবারে ভিনি ভিডি ভিসি; সে ছিল অসির জয়। আপনার হলো মসীর জয়।”
ক’ দিন থাকতে পারবেন? – জিজ্ঞেস করতেই কবি, উপস্থিত সবাইকে হতবাক্ করে দিয়ে বললেন,
“ক’দিন মানে! আমাকে আজই সন্ধ্যায় নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেসে নয়তো রাতে দার্জিলিঙ মেইলে যেতে হবে। ট্রেনের সময় সূচি জেনে নিয়েই এসেছি।”
একথা শুনে সবাই হতভম্ব!
মহমুদ হোসেন আগ্রহভরে বললেন, “আমাদের মানপত্র দেওয়ার কথা আছে ।” কবি হাসতে হাসতে ঘর কাঁপিয়ে তুলে বললেন, “মানপত্র? তোমাদের এখানে মানকচুর গাছ নেই? একটা পাতা কেটে আনলেই তো হয়! ওসব সংবর্ধনা সভাটভা হবে না। অনেক লোক জমে গেছে । হারমোনিয়াম নিয়ে এসো, গান শোনাই। আমাকে আজই যেতে হবে ।”
কাজী মহাম্মদ ইলিয়াস লিখেছেন, “কবি হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গান ধরলেন । শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান দিয়ে: ‘মর্মর ধ্বনি কেন জাগিল রে;
পল্লবে পল্লবে, হিল্লোলে হিল্লোলে থরথর কম্পন লাগিল রে।”
কবি মাঝে মাঝে পান খাচ্ছিলেন। পানের বাটা সাজানো ছিল তাঁর বসার আসনের পাশেই। কবি শেষের দিকে তাঁর নিজের রচিত গানই গেয়ে শোনান ।
কবি মাঝে মধ্যেই হাস্যকৌতুকে আসর মাতিয়ে তুলছিলেন। কাজী মহাম্মদ ইলিয়াস লিখেছেন,
“এরই মধ্যে আমাদের পাড়ার এক ভদ্রলোক এলেন। তিনি মৌলভী খেরাজ আলী। খাতুনিয়া সার্কুলেটিং লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা । গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, পরনে খদ্দরের পাজামা, মাথায় খদ্দরের পাগড়ি । তাঁর বেশ সুন্দর, লম্বা দাড়ি। তিনি সাহিত্যামোদী। গানের ফাঁকে কবি নজরুল তাঁকে দেখে ফেলেছেন। কাছে ডেকে, বসতে বলেছেন । তারপর নাম কী, জিজ্ঞেস করেছেন। উনি যেইমাত্র বলেছেন তাঁর নাম খেরাজ আলী, কবি সাথে সাথে বলে উঠলেন, “আপনার নাম স্বরাজ আলী হলেই ভালো মানাতো।” ঘরভর্তি মানুষ হেসে অস্থির । কবি আরও বললেন,
“মৌলভী সা’ব, আপনার মুখমণ্ডলে ভারতবর্ষের আদল পাচ্ছি ।– মাথায় গিরিরাজ হিমালয়; কান দুটোর একদিকে বার্মার উত্তর অংশ অন্যদিকে কচ্ছ; দাড়িতে পূর্ব উপকূল পশ্চিম উপকূল নিয়ে দাক্ষিণাত্য — কিন্তু মানচিত্রের সিলোনের অংশটা পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি এক কাজ করুন– দাড়ির আগায় একটা গিট দেন তো!”
সঙ্গে সঙ্গে হাসির রোল পড়ে গেল ।
সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত গান করেন নজরুল। পরে সিদ্ধান্ত হলো, দুপুরের পর কাচারিবাজার বার লাইব্রেরিতে কবিকে নিয়ে যাওয়া হবে ।
বার লাইব্রেরির হলঘরের ভিতরেবাইরে অনেক লোক। আইনজীবীদের অনেকেই কোর্ট থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু বিচারকগণ আসেননি। স্বাগত বক্তব্য দিয়েছিলেন আইনজীবী প্রফুল্ল ঘটক মহাশয়। কবি নজরুল স্বাগত বক্তব্যের জবাবে বলেন,
“আপনারা আমার প্রশংসাই করলেন, কিন্তু আমার লেখা নিয়ে বিরূপ সমালোচনা হয়, জানেন না? আমি হিন্দু দেব-দেবীর কথা লিখি বলে মুসলমান অনেকেই বিরূপ, আবার উর্দু-ফারসি ভাষা ব্যবহার করে বাংলা ভাষারই জাত মেরে দিচ্ছি। আমার গানের প্যারোডি বের হয়। আপনারা ‘শনিবারেরচিঠি’ নিশ্চয়ই পড়েন। আমি দু তরফ থেকেই গাল খাচ্ছি ।”
এরই মধ্যে হারমোনিয়াম চলে এলো। হারমোনিয়াম আসামাত্র শুরু হলো গানের অনুরোধ । কবি টেবিলের উপর উঠে বসে হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বললেন, “গানই তো গাইব। আপনারা আইনের ঘরের লোক; কিন্তু জানেন তো, আমি লিখেছি, ‘আমি মানি না ক কোনো আইন ।’ বলামাত্র কবি গেয়ে উঠলেন, “কারার ঐ লৌহকপাট! কারার ঐ লৌহকপাট রক্ত জমাট, শিকল পূজার পাষাণ বেদী।” বার লাইব্রেরি চত্বরে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। কবি দ্বিতীয় গান ধরলেন, “দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার!
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার ।”
কাজী মহাম্মদ ইলিয়াস লিখেছেন, ওই অনুষ্ঠানে নজরুল সাত-আটটি গান গেয়েছিলেন ।
সন্ধ্যার পর, টেপা জমিদারের একটি জুড়িগাড়ি এনে কবিকে অগত্যা বিদায় দিতে হয়। ছাত্র-যূবক ছেলেপুলেরা তাঁকে নিয়ে রেলস্টেশন পর্যন্ত গিয়েছিল। বিদায় মুহূর্ত ছিল বেদনা বিধুর । কবি নজরুল, কাজী মহাম্মদ ইলিয়াসের কাঁধে আঙ্গুল চাপা দিয়ে বলেছিলেন, ‘অসন্তুষ্ট হইয়ো না; নিতান্ত বাধ্য না হলে যেতাম না।’
ঠিক এক বছর পরে নজরুল আবারও এসেছিলেন হারাগাছ ও রংপুর কারমাইকেল কলেজ । তিনি কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ ইস্কুল গিয়েছিলেন দু বার: 1928 ও 1934 সালে । কুড়িগ্রামে তাঁর ছিল দুটি দীর্ঘ ভাষণ।