মোশফিকুর রহমান এর ছোটগল্প তবুও বলা হয়নি ভালবাসি তোমায়
হঠাৎ ইমোতে তার ছবিটা দেখে বড় বেশী অবাক হয়েছি! আমার ইমোতে তাকে এভাবে খুঁজে পাবো ভাবিনি। যদিও আমার ইমো আইডিটা অপরচিত নামে খোলা,আমার সাথে সে কেমনে এ্যাড হয়েছে আমি নিজেও জানিনা ;তার কাছ থেকেও জানা সম্ভব হয়নি। বিধাতা মনে হয় শূণ্য আকাশ হতে কালো মেঘমালা দূর করতে চাচ্ছেন! মেয়েটার সাথে দীর্ঘ দিনের জানাশোনা অথচ কখনো কুশলাদিটা পযন্ত জানা হয়নি । আমি ছোট বেলা হতে একটু লাজুক স্বভাবের,তাই যেকোন মেয়ের থেকে শতহাত দূরে থাকাটাই শ্রেয়তর মনে করতাম। তাই কোন মেয়ের সাথেই আমার তেমন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনা। যদিও পরে জানতে পারি ,আমার সম্পর্কে অনেক মেয়ের মনেই বদ্ধমূল ধারণা এই যে,আমি অনেক অহংকারী! এটাই অবশ্য মেয়েদের স্বভাব ,গায়ে পরে কথা বলতে যাবেন তো আপনাকে পরশ্রীকাতর বলবে ; আর তাদের থেকে দূরে থাকলে ভাবে অহংকারী ।
ছোটবেলা থেকেই কবিতা লেখার প্রতি আলাদা একটা ঝোঁক ছিল ; তাই কবিতা লিখে মনের গহিণের অব্যক্ত কথাগুলো প্রকাশ করতাম। আর একটা বিষয় আপনারা নিশ্চয় জানেন,কবিরা কখনো একত্বে বিশ্বাসী হয়না;তারা বহুত্বে বিশ্বাসী। তাই কবিরা সব সময় সুন্দরের পূজারী,তাই কখন কার প্রেমে পড়েন স্রষ্ঠাও বুঝতে পারেন না ।আমার এক বান্ধবী তো প্রায় বলত ,আর যাই করি কখনো , কোন কবির প্রেমে ডুব দিবনা! তো যাইহোক আমার অবস্থাও সচরাচর অন্য কবিদের মতই । যদিও আমি জানিনা আমার লেখা কবিতাগুলো সাহিত্যের কোন শাখায় পরার যোগ্যতা আদৌ রাখে কিনা? আমারও যখন যে মেয়েকে ভাললাগে,তখনই তার প্রেমে পরে যাই ।যদিও তাদের কাউকেই আর সাহস করে বলা হয়নি ভালবাসি তোমায় । কিন্তু তাদের অনেককে নিয়েই কবিতা লিখেছি , তাদের পছন্দ ; অপছন্দ ,সবকিছু কবিতায় তুলে ধরেছি ।
দিনাজপুর সরকারি কলেজে পড়াশোনার কারণে , দীর্ঘদিন আমাকে দিনাজপুর শহরে থাকতে হয় ।কলেজের বিভিন্ন দিবস ও নানা আয়োজনে আমাকে বাধ্যতা মূলকভাবে থাকতে হয় । কেননা কলেজের রোভার স্কাউট কার্যক্রমের সাথে সক্রিয় ভাবে জরিয়ে ছিলাম , এ জন্য আমার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উপস্থিত থাকা নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে ছিল ।ঠিক তেমনি কোন এক অনুষ্ঠাণে তার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল, যতদূর মনেপড়ে, কোন পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠাণ ছিল । আমাদের কলেজের মুক্ত মঞ্চের সামনে দ্বিতীয় সারিতে চেয়ারে বসে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করছি , হঠাৎ চোখটা আমার পাশের চেয়ারে বসা মেয়েটার দিকে চলে গেল । পড়নে তার বৈশাখী সাজ , চুলগুলো ছড়ানো ; যেন মধূসুদনের বনলতা আমার পাশে বসে আছে । আমার হৃদয় মাঝে এ কোন ঝড় শুরু হলো , ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা । আমার হৃদয়ে নব ঢেউ খেলা করতে লাগল ।আমি অনেক বারই শুনেছি , একবারের দেখায় অনেকের জীবনে প্রেম এসেছে । কিন্তু আমিও যে কোন মেয়ের প্রেমে এভাবে পরবো , কারও প্রতি আসক্ত হব ভাবিনি ।সে রাতে মেসে এসে আর ঘুমানো গেলনা , রাতটা যে কিভাবে কাটলো; কখন ভোর হল জানিনা ।এরপর কতরাত তাকে স্বপ্নে দেখেছি,তার কোন হিসেব নেই ।কমবেশী প্রতিদিন তার সাথে ক্যাম্পাসে দেখা হয় , শুধু কথাটাই আর হয়না ।
এর বছর দু‘য়েক পরে, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে কম্পিউটার ক্লাস করতে গিয়ে আমি পুরাই অবাক ! এখানে আমার বনলতা আসলো কিভাবে , আমি স্বপ্ন দেখছিনা তো ! ইদানিং আমার কি হয়েছে বুঝিনা , যে কোন মেয়েকে দেখলে ; আমার তার কথা মনেপড়ে যায় ।আজও এমনটা হচ্ছেনা তো ; না সবি তো ঠিকই আছে! সেই গোলগাল মুখ , সেই ভুবন ভোলানো হাসি , সেই ঘনকাল চুল ; তবে কি এবার আমার হৃদয় আকাশ খুলে যাচ্ছে ? এবার আমার শূন্য হৃদয়, পূর্ণ হবে।রোজ ক্লাসে যাই , তাকে মুগ্ধ হয়ে দুচোখ ভরে দেখি; কিন্তু তবুও বলা হয়নি ‘ ভালবাসি তোমায় ‘। প্রতিদিন ভাবি আজই মনের কথাটা বলে ফেলবো ,কিন্তু বলতে আর পারিনা ।কেন বলতে পারিনা , আমার পঞ্চইন্দ্রিয় আজও সে রহস্য ভেদ করতে পারেনি । আমার ট্রেডের সকল ছাত্রছাত্রীর সাথেই আমার অসাধারণ ভাব জমলেও তার সাথে কখনো কথাও হয়না । তার সামনে গেলেই যেন আমার হার্ডবিট বেড়ে যায় , তখন আর কিছুই বলা হয়না ।আমি কেন যেন তাকে দেখলেই এলোমেলো হয়ে যাই ।
দেখতে দেখতে ডায়রীর পাতা হতে ছয়টি মাস কেটে গেল , তাকে এত কাছে পেয়েও আর বলা হলোনা ‘ ভালবাসি তোমায় ‘ । অবশেষে কোর্স সমাপ্ত হলো, যে যার মত সনদ নিয়ে চলে এলাম । অথচ যাকে প্রতিদিন স্বপ্নে দেখি , যার ছবি হৃদয়ে আঁকি তাকে এতটা কাছে পেয়েও বুঝি হারালাম । এদিকে আমার অনার্স কোর্সও শেষ ,বাসা থেকে জোর চাপ ; অনেক হয়েছে , আর দিনাজপুরে নয় । এবার মাস্টার্সটা অন্তত, কারমাইকেলে কর , কি আর করা , বাধ্য ছেলের মত সবকিছু নিয়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজ । যদিও রংপুরে পরে থাকলাম ,তবুও হৃদয়টা থাকল দিনাজপুরে । এরপর বিভিন্ন বাহানায় দিনাজপুরে যাই , কিন্তু তার সাথে আর দেখা হয়না । আমি ধরেই নিলাম , সে নিশ্চিত কারও হাত ধরে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়ে সুখেই আছে।আমিও তার চিন্তা মাথা হতে ঝেড়ে ফেলি এবং আমার মাস্টর্সের পড়াশোনায় মনোযোগী হই।
মাস্টার্স শেষে আমি কোম্পানির জবের সুবাদে ঝিনাইদহে , কাজের এমন চাপ যে তেমন করে অনলাইনে আসা হয়না ।একদিন আমার ইমোটা চালু করতেই, তার ছবি ভেসে উঠল । আমি যেন হাতে আকাশের চাঁদ ফিরে পেলাম ।তার সাথে ইমোতে চ্যাটিং শুরু হল , প্রথমে হাই , হ্যালো , কেমন আছে এই যা । দিন দিন আমাদের চ্যাটিং বাড়তে থাকল । আমি তার পছন্দ ,অপছন্দ জানার চেষ্ঠা করি , সে আমার ।তার সাথে ইমোতে ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাটিং হয় , কিন্তু তাকে আর মনের কথাটা বলা হয়ে ওঠেনা ।অবশেষে সে নিজেই বলে ফেলে , তাকে আমার কিছু বলার আছে কিনা ? আমি নিশ্চিত প্রেমের আভাস পেয়েও এগুতে পারিনি ,মনে কি যেন একটা ভয় সারাক্ষণ ঝড় তোলে ।আমি তাকে বোকার মত বলে বসলাম , আমার কিছুই বলার নেই । সে এর মধ্যে আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে , কি করি , কোথায় থাকি সবকিছু । সে রোজ আমার কবিতা পড়ার জন্য , ব্যকুল হয়ে থাকে । আমি বুঝিনা , সে আমার কবিতার মাঝে কি পায় ।একদিন সে আমার কাছে বায়ণা ধরল , কবি ‘ আমাকে নিয়ে কি একটা কবিতা লেখার সময় আপনার হবে ‘ ? আমি সাহস করে বললাম ,তাহলে আমি কি পাব বনলতা ? এর মধ্যে সে আমাকে কবি বলে ডাকে আর আমি তাকে বনলতা বলে ডাকি ।সে মুচকি হেসে বলল , কবিরা কি কবিতার বিনিময়ে কিছু চায় ? আমি বললাম অন্য কবি কি করে জানিনা , তবে আমি অবশ্যই চাই ! আর বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর ও তো বলেছেন “ কিছু পেতে হলে , কিছু দিতে হয় ।“ আমার চাইলে দোষ কি ? সে মুচকি হাসলো !
যাইহোক তাকে নিয়ে একদিনের মধ্যে ৪৮ লাইণের একটা কবিতা লিখে সেন্ড করলাম । সে আমার কবিতাটা এতো বেশী পছন্দ করবে ভাবতেও পারিনি ।সে সরাসরি বলেই ফেলল , আজ কবি আমার কাছে যা চাও , তাই পাবে ? কিন্তু তবুও আমার বলা হয়না ‘ তোমাকে চাই “। বনলতা রাগান্নিত হয়ে বলে বসল , আপনি কবিতার মাঝে এত কথা বলেন অথচ; মাত্র তিনটি শব্দ বলতে আপনার এত জড়তা কেন ? তবুও তাকে বলা হয়না ,ভালবাসি ,ভালবাসি ,ভালবাসি । প্রতিদিন নানা বিষয়ে তার সাথে কথা হয়,তবুও আর তাকে সাহস করে বলা হয়ে ওঠেনা,ভালবাসি তোমায় ।