মাসুদ বশীর এর গল্প অসম্পূর্ণ অয়ন
দরজা টা ভেতর থেকে আটকানো। দিনমান আটকানোই থাকে এমন। ভেতর থেকে মাঝে মাঝে হালকা পড়াশুনার আওয়াজ শোনা যায়। কি হয় ভেতরে? কে থাকেন? কি-ই বা করেন সারাদিন ঘরের ভেতর তিনি? যা করার তাইতো করেন। হ্যাঁ, তিনি অধ্যয়ন করেন সেখানে। নেশার মতোন পাঠ করে চলেন বই, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। খাওয়া-দাওয়া, নিত্যকর্ম, ঘুম আর শুধুই পাঠ্যবই পাঠ। আত্মীয়স্বজন কেউ তাদের বাসায় বেড়াতে এলেও তার সাক্ষাৎ পাওয়া বড়োই দুষ্কর। আর বন্ধুবান্ধব তো বলতে গেলে নেই-ই তার। জীবনে- স্কুল, কলেজ আর মেডিকেল কলেজ বাদে, তার কাছে সবকিছুই অচেনা অজানা ছিল। ছিলোনা খেলাধুলা, ছিলোনা তার জীবনে কোন গল্প-বিনোদনের ছোঁয়ামাত্র! মানুষের সমাজে থেকেও তিনি একজন রোবটিক অসামাজিক মানুষ, আবার এই মানুষটিই এভাবেই এস.এস.সি, এইচ.এস.সি, ডাক্তারি পাশ করে ফেলেন এবং যথারীতি প্রতি স্তরে অনেক ভালো রেজাল্টসহ। তারপর ইন্টার্নি, প্রেম-ভালোবাসা, অতঃপর বিবাহ। প্রেম-ভালোবাসাটা যে তার জীবনে কিভাবে হলো, ভাবতেও অবাক লাগে! হয়তো ওখানেও পাঠ্য-বইয়ের কোন একটা পাতা জুড়ানো ছিলো বুঝি! কি এক অদ্ভুত ছকবাঁধা জীবনের ছবি। তবে, তিনিও মানুষ, এক্কেবারে পাঠ্য-বইপোকা মার্কা বিচিত্র রকমের অদ্ভুত অসামাজিক মানুষ।
মেডিকেল ডিউটি। নিত্যদিনের মতো ওয়ার্ড ভিজিট চলছে। রোগীদের পরীক্ষা করছেন ডাক্তার সাহেব, রোগীর সঙ্গে কথা বলছেন, ইন্টার্নি শিক্ষার্থীদের গম্ভীরভাবে হাতেকলমে শেখাচ্ছেন, কিন্তুু তার মুখে যেন সর্বদা অমাবস্যা লেগেই আছে! তখনও যেন ডাক্তার সাহেব সেই পড়ার ভেতরেই ডুবে থাকেন আপাদমস্তক। কি মানুষ রে ভাই! পৃথিবীতে কত মেধাবী মানুষই তো আছেন- কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ সায়েন্টিস্ট, কেউ বা বড় ব্যবসায়ী, কেউ অনেক বড় সরকারি অথবা বেসরকারি কর্মকর্তা, আরো কতো কি। তারাও তো হাসিখুশিভাবে সমাজ সংসার নিয়েই জীবন যাপন করেন নাকি। কিন্তু ইনি কেমন মানুষ যার মুখে বিন্দুমাত্র কোন হাসি নেই, খুশি নেই, একদম ভাবলেশহীন থাকেন সর্বদা। জীবনে বড় কোন ধরনের আঘাত পেয়েছেন তেমনও কিন্তু নয়, তবুও তিনি এমনই, জন্মগতভাবেই বুঝি এমনই তার স্বভাব।
ওয়ার্ড ভিজিট শেষে নিত্যদিনের মতো আজও তিনি তার রুমে এসে বসলেন। আজ এই গম্ভীর আত্ম-অহংকারি বইপোকা মানুষটির মন হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেলো নিমিষে, অবাক হওয়ার মতোই একটি ঘটনা বটে! রিটায়ারমেন্ট সামনে চলে এসেছে হয়তোবা তাই মনে পড়ে গেলো তার সেই ফেলে আসা অতীতদিনের কথা, তার প্রেয়সীর কথা, যেন তার কানে ভাসছে তার স্ত্রী ডাঃ ছন্দার বলা সেই দূর অতীতের কিছু অমলিন বাক্যবান-
“তুমি কি পড়া ছাড়া আর কিছুই বোঝনা, শুধু পড়া-বই-নোট এগুলোই যদি তোমার জীবনের সবকিছু হয়, তবে আমাকে আর তোমার প্রয়োজন কি?, তাহলে তুমি থাকো তোমার শুধু ওই পড়া আর বই নিয়েই”।
না, ছন্দার তাকে ছাড়া আর থাকা হয়ে ওঠেনি, সে-ও যথারীতি ডাক্তারী পাশ করেছে এবং এই বইপোকা ডাক্তারের সাথেই ঘর বেধেছে এবং পুত্রকন্যা দু’সন্তানের জননীও হয়েছে সে।
প্রাইভেট প্রাকটিস। ডাক্তার সাহেবের বাড়ির ফটকে এবং চেম্বারের সামনে তার নামের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে, সেখানে সবশেষে লেখা রয়েছে এমন-“বিঃদ্রঃ ডাক্তার সাহেব বাইরে কলে যান না এবং চেম্বার ব্যতিরেক বাসায় কোনপ্রকার রোগী দেখেন না”(সকল ডাক্তারের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, ইনি একদম অত্যধিক অন্যরকম সেলফসেন্টার সর্বস্ব মানুষ কিনা)। মানে, আত্মীয়-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী, এমনকি বিশেষ পরিস্থিতি পরিবেশ হলেও- ‘নট এ্যালাওড’! একদিন রাতে পাড়ার একজন মরণাপন্ন রোগীর স্বজন তার শরণাপন্ন হয় তাকে নিতে কিন্তু তিনি স্রেফ জানিয়ে দেন যেতে পারবেন না মেডিকেলে নিন, এমনি তার আত্মীয়স্বজনরাও অনেকবার তার কাছে এসে বিমুখ হয়েছেন। তাহলে বুঝুন এখন, কতটা আত্মকেন্দ্রিক মানুষ তিনি! একজন ডাক্তার রোগীর কাছে পরম ভরসাতুল্ল আপনজন। একজন সত্যিকারের মানুষ কখনোই মানুষের বিপদে পিছপা হননা তার উপরে সেই মানুষ যদি হন ডাক্তার। সেবাই একজন ডাক্তারের পরম ধর্ম। (এই করোনাকালে জাতীয় দুর্যোগে যে সমস্ত ডাক্তার জীবন বাজি রেখে মানবসেবায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন তাঁদের প্রতি রইলো হৃদয় নিংড়ান বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শুভকামনা।)
অফিস টাইম শেষে প্রতিদিন চেম্বারে ডাক্তার সাহেব রোগী দেখেন। যথেষ্ট নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে তার, সিরিয়ালের পর সিরিয়াল, গভীর রাত পর্যন্ত রোগী দেখেন তিনি। যথারীতি তার বাড়ি-গাড়ি, অর্থ, সম্পদ, সম্মান, প্রতিপত্তি সব হয়েছে, সন্তান দু’টিও ডাক্তারী পাশ করেছে তার, পুত্রসন্তানের বিয়েও দিয়েছেন তিনি ইতোমধ্যে। সবকিছুই কেমন করে যেন সরল অংকের মতো সুন্দর সমাধান হয়ে গেছে তার জীবনের পরীক্ষার খাতায়। এখানে অবশ্য তার স্ত্রী ডাঃ ছন্দার একটা বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। এমন কাটখোট্টা একরৈখিক চিন্তা-সর্বস্ব মানুষের সাথে কিভাবে যে ছন্দা বত্রিশটা বছর কাটিয়ে দিলেন, তা ছন্দা নিজেও জানেন না। মাঝে মাঝে তিনিও অবাক হন কি করে এমন অদ্ভুত মানুষের সাথে তিনি প্রেমে জড়িয়েছিলেন! কি দেখেই বা প্রেমে পড়েছিলেন, তার স্বামীর বইপোকা স্বভাবটিই কি তাহলে তাকে তার প্রতি দূর্বল করেছিল? তা নাহলে, স্বভাবে সেতো তার স্বামীর একদম বিপরীত মানুষ। ডাঃ ছন্দা হাসিখুশি-মিশুক, সংসারে-অফিসে, মোটকথা ঘরে বাইরে তিনি সকলের পছন্দের মানুষ, পছন্দের ডাক্তার ম্যাডাম। স্বামীর অসামাজিক স্বভাব মানে, মানুষের সাথে মিশতে না পারার স্বভাব, শুধু পাঠ্যবই এবং পেশা-রিলেটেড কাজ ও বইয়ের মধ্যেই সর্বদা পড়ে থাকা বিচিত্ররকম স্বভাবের মানুষটির বদনাম সে-ই একরকম পুষিয়ে দিয়েছে তার সহজাত সুন্দর মনমানসিকতা আর বোধ দিয়ে। তাইতো সে আত্মীয়স্বজনসহ সকলের কাছে একদম আপনজন কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন, শুধু তার স্বামীর স্বভাবগত কারণেই তার স্বামীই যেন তার কাছে অনেক দূরের একজন অন্যকেউ। সেজন্য ডাঃ ছন্দার বুকে বড়োই কষ্ট! ছন্দা রবিঠাকুরের গানের কলিতেই খুঁজে নেন তার একরকম নিঃসীম একাকী পথচলা-“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে…”
সকালের মিষ্টি রোদ জানালার শার্সি ভেদ করে ঘরে এসে প্রবেশ করছে। ডাক্তার সাহেব দোতলার বেলকনিতে এসে দাঁড়ালেন। সামনের মাঠে ছোট ছোট বাচ্চারা হৈ-হুল্লোড় করছে, খেলাধুলা করছে, পাশে কয়েকজন মানুষ গল্পগুজব করছে, হাসাহাসি করছে, তাদের মাঝে ডাক্তারের পরিচিতও একজন কে দেখা যাচ্ছে তিনি ডাক্তারের সমবয়সী এবং তিনিও ভালো ছাত্র ছিলেন, বিসিএস ক্যাডারে বড় চাকুরী করেছেন এখন এলপিআর এ আছেন, এলাকায় তিনি সকলের সম্মানীয় প্রিয় মানুষ, পাড়াপ্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন সকলের সুখেদুখে তিনি সর্বদা পাশে থাকেন একদম নিরহংকার মানুষ তিনি। এই লোকটিই সুদীর্ঘ অতীতে একদিন তাকে বলেছিলেন-“জীবনে বড় হতে হলে পড়ালেখার বিকল্প নেই ঠিক আছে, কিন্তু তার মানে এই না যে বন্ধু, তুমি একদম সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, শুধু পড়তেই থাকবে, অনেক বড় হতে চাইবে, কিন্তু আদতে একদিন দেখো কিছুই হতে পারবে না, মানে এতো পড়ালেখা করে যদি একজন সত্যিকারের মানুষই হতে না পারলে, সবাই তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তাহলে এমন অর্জনকৃত আড়ষ্ট জীবনের মানে কি?” একথাগুলো ডাক্তারের মনে এতদিন পরে আবারও রেখাপাত করলো, ডাক্তারের চোখ থেকে অজান্তেই দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো! দীর্ঘজীবন পাড়ি দিয়ে এসে আজ নিজেকে তার এখন বড়বেশি অসহায় লাগছে, মনে পড়ছে তার রংহীন নষ্ট করে ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর এবং পড়া-সর্বস্ব জড় যৌবনের কথা, মাটি-মানুষ সকলের ভালোবাসা একদম হারিয়ে ফেলার কথা। তার জীবনের অংক গোলকধাঁধায় আজ যেন শুধুই ভুল-সর্বস্ব শূন্য উত্তর। তার সব অর্জন আজ ফিকে হয়ে মিশে আছে শুধু পাঠ্য বইগুলোর পাতায় পাতায়…
ডাক্তার আজ হারিয়ে ফেলেছেন সকলের সকল রকম ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। তার পরিবার, ছেলে-মেয়েও এখন তাকে ছেড়ে একরকম আলাদাই থাকে, আলাদাই চলে। এখন সে নিজেকে মন থেকে তাই ভীষণরকম ছোট অনুভব করে, প্রচন্ড ঘৃণা করে নিজেকে, সে ভাবে এতো যে পড়লাম, এখনো পড়ি, পড়ছি, কি লাভ হলো তাতে? আমার জানাটুকু শুধু যে ঐ পাঠ্য বইয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকে গেলো! আজ তো আমার আশপাশে সত্যিকার অর্থে কেউ নেই, কিছুই নেই! কি লাভ হলো আমার, কি-ই এমন অর্জন করলাম আমি, শুধু এই জীবনে আমার এতো পড়া-পড়ে? শুধুই পড়ে…