প্রথমেই আকর্ষণ করলো এর নামকরণ। ‘মাদুলা’। লোক ঐতিহ্যের আকর থেকে তুলে আনা শব্দের মাধ্যমে নামকরণ এবং এই অঞ্চল তথা রংপুরের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প শতরঞ্জি থেকে করা প্রচ্ছদ দেখেই আলোচিত স্মরণিকাটি পাঠে আগ্রহ তীব্র হয়ে ওঠে। কিছু কিছু পত্রিকা বা স্মরণিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেকেরই একটা দায়সারা যেরকম ভাব থাকে আলোচিত ‘মাদুলা’ প্রথমেই সেই বোধ থেকে পরিপূর্ণ উৎরে গিয়ে পাঠক মনকে আকর্ষিত করে মোটা কলেবরের এই পত্রিকাটির ভেতরে পাঠ প্রবেশে। পত্রিকাটি দেখা মাত্রই তা পাঠের জন্য পাঠকমন যেন আকুল হয়ে ওঠে। এরকমটা সম্ভব হয়েছে একটি যোগ্য দিক নির্দেশনা, সম্পাদনা ও টিম ওয়ার্কের জন্য।
বলছিলাম রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ৫ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বিশেষ স্মরণিকা ‘মাদুলা’ প্রসঙ্গে। ২৮৮ পৃষ্ঠার এই বিশাল কলেবরের পত্রিকাটিতে দেশের স্বনামধন্য ও স্থানীয় প্রতিথযশা লেখকদের এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের লেখা শুধু কলেবর বৃদ্ধি কিংবা আকর্ষণীয়ই করে তোলেনি বরং এটিকে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণযোগ্য একটি কাজ হিসেবে পরিগণিত করেছে। এ কারণেই এই প্রশংসনীয় কাজের জন্য পত্রিকাটি নিয়ে একটু আলোকপাত করবার প্রয়াস। এখানে উল্লেখ্য যে ইতোপূর্বেও রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে আকর্ষণীয় ও ঐতিহাসিক তথ্য সম্বলিত স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ফলে তাদের পত্রিকা সম্পর্কে অনেকেরই আগ্রহটা তাই যথেষ্ট।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে তাঁর একটি ভাষণের কিছু অংশ উদ্ধৃত করে স্মরণিকার পৃষ্ঠার এগিয়ে চলা। এ ধরনের প্রকাশনার রীতি অনুযায়ী যথারীতি পরবর্তী অংশে বিশিষ্টজনদের বাণী। মাননীয় রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্পীকার, সর্ব শ্রদ্ধেয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, ডিআইজি রংপুর রেঞ্জ, পুলিশ কমিশনার,রংপুর এঁর বাণীতে উঠে এসেছে শুভেচ্ছা, প্রত্যাশা আর সফলতার কথা। সম্পাদকীয়তে বর্ণিত হয়েছে সংকলনটির প্রেক্ষাপট।
বিভিন্ন নিবন্ধ, প্রবন্ধ, তথ্য ও তাত্ত্বিক সমারোহ এরপর থেকেই। শ্রদ্ধেয় বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব টিপু মুনশি, এমপি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ, অবদান এবং বর্তমান অবস্থান উঠে এসেছে।
অধ্যাপক ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন ‘অপরাধ ও শাস্তি ‘।
জনপ্রিয় লেখক ও কলামিস্ট মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন, ‘তোমরা যারা জঙ্গী হতে চাও’। শিরোনাম দেখে আঁৎকে উঠলেও লেখায় উঠে এসেছে চমৎকার ম্যাসেজ।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট, গবেষক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসাইন সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর-‘ বঙ্গবন্ধুর নারীনীতি ও পদক্ষেপসমূহ, ১৯৭২-১৯৭৫’ শীর্ষক গবেষণাধর্মী লেখায়।তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘৭২ -এর সংবিধানে নারী -উন্নয়ন সংক্রান্ত ধারা অনুযায়ী আজও বাংলাদেশের নারী -উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণীত হয়। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশে নারী – উন্নয়নের পথিকৃৎ।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নাই। বাংলা সাহিত্যে তাঁর যেমন অবদান অনস্বীকার্য তেমনি এই পত্রিকায় তাঁর লেখা – ‘জেলখানার লুদু’ শুধু পত্রিকার মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে তা নয় বরং এটি একটি ঐতিহাসিক উপস্থাপন।
শোলাকিয়া ঈদগাহ-এর প্রধান ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ লিখেছেন -‘ স্বাধীনতা কী?’। তিনি বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা ও জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের সভাপতি।
বলা হয়ে থাকে তিনি বাংলাদেশের কবিদের কবি। ষাটের দশক থেকে তিনি বাংলা কবিতার ভুবনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি আর কেউ না, তিনি আমাদের অতি প্রিয়, শ্রদ্ধেয় নির্মলেন্দু গুণ। ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলন -সংগ্রাম যাঁর কবিতাকে সমূলে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ; স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় চেতনা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক কবি নির্মলেন্দু গুণ এঁর কবিতা ‘শিয়রে বাংলাদেশ’ আলোচ্য পত্রিকার শুধু শ্রী বৃদ্ধি করে নাই বরং এর মানকে করেছে উজ্জ্বল।
‘বাংলাদেশ পুলিশ – মুক্তিযুদ্ধের একটু ঝলক ‘ লিখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম। তার লেখায় উঠে এসেছে যে তথ্য তাতে আমরা জানতে পারি -” ৩ মার্চ রংপুরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহিদ কিশোর শঙ্কু সমজদার। ওই দিনে তিনি প্রথম শহিদ হিসাবে রাস্ট্রীয় স্বীকৃত প্রাপ্ত কিশোর। ” যদিও আলোচ্য এই লেখাটির এই অংশ নিয়েই আরেকটা নিবন্ধের আক্ষেপ মনে থাকে।
আনিসুল হক। আমাদের রংপুরের সন্তান। তিনি আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তাঁর লেখালিখির অসাধারণ প্রতিভার জন্য জনপ্রিয় একজন কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ‘বুকে গুলি নিয়ে প্রিয় বঙ্গবন্ধু আপনি কী ভাবছিলেন’ শীর্ষক শিরোনামে একটি সমৃদ্ধ লেখা স্থান পেয়েছে এই পত্রিকাটির ৭২ পৃষ্ঠায়।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রথম কমিশনার মোহাঃ আবদুল আলীম মাহমুদ, বিপিএম লিখেছেন ‘রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠনের ইতিহাস ‘। বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের ইতিহাস লেখকদের অনেকেই তাঁর এই লেখা থেকে রেফারেন্স হিসেবে তথ্য গ্রহণ করবে এরকম তথ্যপূর্ণ লেখা।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের বর্তমান পুলিশ কমিশনার লিখেছেন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : স্মার্ট পুলিশিং; সম্ভাবনা ও বাস্তবতা ‘ শীর্ষক একটি সময়োপযোগী, তথ্য ও তত্ত্ব নির্ভর লেখা। কেন দরকার স্মার্ট বাংলাদেশ জন্য স্মার্ট পুলিশ কিংবা জনজীবন, নাগরিক মান উন্নয়নে কেন দরকার স্মার্ট পুলিশ এ লেখা পাঠে সেসব তথ্য পরিস্কার চিত্রিত হয় পাঠক মনে। তাঁর দ্বিতীয় লেখা ‘ আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ ‘ একটি জীবন ঘনিষ্ঠ, স্মৃতিচারণমূলক ও উদাহরণ যোগ্য উপস্থাপন।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের আরেক সাবেক কমিশনার বর্তমানে চট্টগ্রামের ডিআইজি জনাব নুরেআলম মিনা,বিপিএম-বার পিপিএম। খুব অল্পদিন তিনি ছিলেন রংপুরে। সংক্ষিপ্ত সময়ে তাঁর কর্মপরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিধৃত হয়েছে তাঁর লেখায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু লিখেছেন, ‘ মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু’ । জনাব বাবলু রংপুর জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং রংপুর মেট্রোপলিটন কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সভাপতি। একজন যোগ্য সংগঠক ও রাজনীতিবিদ। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে স্মৃতিচারণ।
আরপিএমপি’র ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা লিখেছেন অতিরিক্ত পুলিশ মোঃ সায়ফুজ্জামান ফারুকী। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার উত্তম কুমার পাল পিপিএম লিখেছেন ‘অধরা স্বপ্নের বাস্তবায়ন আরপিএমপি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ ‘। উপ-পুলিশ কমিশনার -ক্রাইম মোঃ আবু মারুফ হোসেন লিখেছেন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট পুলিশিং : চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা’। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর একটি তাত্ত্বিক ও তথ্য নির্ভর উপস্থাপন। ডিবির উপ-পুলিশ কমিশনার কাজী মুত্তাকী ইবনু মিনান লিখেছেন, ‘ রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা সাফল্য ‘। রংপুর মেট্রোপলিটন এলাকার ট্রাফিক পরিস্থিতি তথা যানজট নিরসনে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ নিয়েছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা। সেসব নিয়ে লিখেছেন উপ-পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক মোঃ মেনহাজুল আলম -‘রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা: বর্তমান কার্যক্রম ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা’।
রংপুরের যেসব গুণীজন লেখালিখির জগতে ইতোমধ্যেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, করছেন রংপুরকে বিভিন্ন অঙ্গনে উপস্থাপন, কুড়াচ্ছেন রংপুরের জন্য সুনাম এরকম কয়েকজন সু-লিখিয়ের লেখা এতে প্রকাশিত হয়েছে। লেখক ও বেরোবির সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা’। লেখক ও সাহিত্যিক প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ আলম লিখেছেন, ‘ আমরা তোমাদের ভুলবো না’। শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রফেসর মোঃ মোজাম্মেল হক লিখেছেন, ‘ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’। কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোঃ মতিয়ার রহমান লিখেছেন, ‘দমদমা গণহত্যা’। ঢাবির অধ্যাপক ড. কাজী মোস্তাক গাউসুল হক লিখেছেন, ‘যখন পুলিশ ছিলাম ‘: অপূর্ণ স্বপ্নের পদাবলী’। সাংবাদিক আরিফুল হক রুজু লিখেছেন,’ প্রত্যাশা, সুন্দর শহরের মডেল হয়ে উঠুক মেট্রোপলিটন পুলিশ ‘। আলেম মাওলানা মিরাজ রহমান লিখেছেন,’রিজিক নির্ধারিত ; লোভীরা বঞ্চিত ‘। রংপুর মেট্রোপলিটন কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আরিফ হোসেন টিটো লিখেছেন, ‘ কমিউনিটি পুলিশিং রংপুর মেট্রোপলিটন কমিটি: অগ্রযাত্রার নানা কথা’। কবি, গল্পকার এ,এস,এম,হাবিবুর রহমান লিখেছেন, ‘ তিস্তা রেলওয়ে ব্রীজ মুক্তিযুদ্ধের মাইলফলক ‘। সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের অনুপ্রেরণা প্রশিক্ষণ ও সম্মুখযুদ্ধ’। এছাড়াও আরও কিছু লেখা আছে। আছে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন কার্যক্রমের আলোকচিত্র। এসব আলোকচিত্রে এই ইউনিটের বর্তমান ও অতীত অনেক ইতিহাস ও তথ্য উঠে এসেছে।
এবার যে লেখাটির একটি শব্দ তথা তথ্য থেকে এই স্মরণিকাটির নামকরণ পুলিশ কমিশনার মহোদয় ও সম্পাদক নির্বাচিত করেছেন তা হচ্ছে ‘ শতরঞ্জির ইতিকথা’। রানা মাসুদ মানে আমার লেখা রংপুরের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জির ইতিকথা সম্পাদনা পরিষদ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ এবং পরিবেশন করেছেন। এই লেখা থেকে পত্রিকার নামকরণ এবং প্রচ্ছদ পরিকল্পনার জন্য আমি সম্মানিত পুলিশ কমিশনার জনাব মোঃ মনিরুজ্জামান বিপিএম বার পিপিএম বার, সম্পাদক ও পরিষদের প্রতি জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো.মনিরুজ্জামান বিপিএম বার পিপিএম বার এঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষকতায় পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ‘মাদুলা’ শিরোনামের এই পত্রিকার উপদেষ্টা হলেন, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোঃ সায়ফুজ্জামান ফারুকী, উত্তম কুমার পাল। সম্পাদক হলেন উপ-পুলিশ কমিশনার সিটিএসবি মোঃ আবু বকর সিদ্দীক। এটি প্রকাশ করেছে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। চমৎকার ঝকঝকে গ্রাফিক্স ও মুদ্রণ উপহার দিয়েছে ইউনাইটেড প্রিন্টার্স।
আমি সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এবং আশাবাদ ব্যক্ত করি ভবিষ্যতে তাঁরা এরকম আরও মানসম্পন্ন প্রকাশনা আমাদের উপহার দেবেন। ধন্যবাদ।