পাতা প্রকাশ : কেমন আছেন
হেলেন আরা সিডনী : আলহামদুলিল্লাহ্ । মহান করুনাময় যখন যেভাবে রাখেন সেটাকেই তার অপার দান বলে মনে করে শুকরিয়া জানাতে পেরেই আমি ভালো আছি বা ভালো থাকার চেষ্টা করি।
পাতা প্রকাশ : আপনার লেখালেখি শুরুর গল্পটা শুনতে চাই
হেলেন আরা সিডনী : আসলে গল্প বলার মতো তেমন কিছু নেই। আব্বাকে খুব একটা মনে পড়ে না কারন আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠেছি তখন আব্বা ঢাকায় মামার বাড়ীতে মাসহ বেরাতে গিয়ে হঠাৎ ক্রনিক ডায়রিয়াতে ঢাকা মির্জাপুর হাসপাতালে মারা গেছেন। মামা ঐ হাসপাতালের চোখের ডাক্তার ছিলেন । নাম-ডাক্তার ফজলুল হক। তার বাড়ী ধাপে। তিনি মারা গেছেন। আমাদের শান্তিময় সুখ সংসারে হঠাৎ ছন্দ পতন। চারবোনের ছোট আমি, আমার প্রায় ৬/৭ বছরের ছোট ভাইয়া। কিন্তু চাল-চলন, জেদ-আব্দারে আমি যেনো ছোট ছিলাম। বাবা ছিল না, কেনো নেই এই প্রশ্নটা মনে হয় ইন্টার পর্যন্ত আমায় কুড়ে কুড়ে খেতো, আমি গোপনে খুব কাঁদতাম। রংপুর গোমাস্তাপাড়ায় আমার বাবার বাড়ী ছিল। সেখানেই মা আমাদের নিয়ে থাকতেন। আর্থিক স্বচ্ছলতা আল্লাহ যথেষ্ট দিয়েছিলেন। একটি বাসায় আমরা থাকতাম আর অন্য দুটি ভাড়া চলতো, গ্রাম থেকে আবাদী সবকিছু আসতো শুধু মাছ-মাংসা ছাড়া। আসলে এতো কথা বলার পেছনে কারন যেটা , সেটা হলো কষ্ট-দু:খ কেনো আমায় ছোট থেকে ঘিরে থাকতো। উত্তর একটাই আমার বাবা নেই কেনো? বাবা-বাবা করে আমি পড়তে বসে খাতার পাতায় কাটিকুটি কি সব লিখতাম-
বাবা.. ও বাবা..তুমি কেনো নেই
তুমি নেই তাই আমি ভালো নেই
সকলে যখন বাবা ডাকে
তখন আমি পারি না কেনো বাবা ডাকতে।
এমন হিজিবিজি কি সব লিখতে লিখতে ছোট্ট ছোট্ট লেখা জমে উঠতো। চাঁদের হাটে লান্চুমামা আমায় নিয়ে গেলেন একদিন সেখানে কি যে সব লিখতাম মনে পড়ে না। মনে পড়ে আগে মেলা হলে মাঠের এক পাশে নাটক মন্চস্ত
হতো, সেখানে আমি একটা ছোট নাটক লিখে দিয়ে ছিলাম যেটা চাঁদের হাট থেকে ওখানে অভিনয় করানো হয়ে ছিল। খুব আনন্দ পেয়ে ছিলাম। ছোট বেলা থেকে আমি রংপুর বেতারে হাঁটাচলা করতাম কারন আমার উপরে যে বোন সে সেই সময় রংপুর বেতারে মোটামুটি ভালো গানের শিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিল, নাম জেসমিন আরা ম্যানিলা। যতো সম্ভব দশম শ্রেণী থেকেই কবিতা পাঠ করতাম রংপুর বেতারে। ঢাকায় ইত্তেফাক , জোনাকি , ঝিনুক, বেগম, ব্যাপক পরিচিত পত্রিকা ছিল। শখ করে সেখানে লেখা পাঠাতাম আর অপেক্ষায় থেকে থেকে খুব আল্লাহ আল্লাহ করতাম-ইস্ যদি আল্লাহর রহমতে লেখাটা ছাঁপা হয়। তারপর সব প্রতীক্ষা শেষে দেখতাম কখনো লেখা ইত্তেফাক পেপারে, কখনো জোনাকি, কখনো ঝিনুক, কখনো বা বেগম পত্রিকাগুলোতে আমার লেখা। বলতে দোষ নেই, সে যে কি আনন্দ যেনো লাখ লাখ টাকা হাতে পাওয়ার চেয়েও বেশি কিছু। স্থানীয় পত্রিকা দাবানলে বেশি লেখা প্রকাশ পেতো। সবকিছু ছিল আমার একার চেষ্টা। তখনকার সময় চেনা-জানা, পরিচিত মুখ এগুলো ছিল না। বলতে দোষ নেই, আমার বাবা ঘরে গান গাইতেন, মা কিছুটা। যে হারমোনিয়ামটা আজো আমার কাছে আছে। বড় বোন দিলরুবা বুবু লিখতেন, মেজবোন লাহোর গীটার বাজাতেন, ডা: তানভীর ভাইয়া ছবি আঁকতেন। মোটামুটি সাংস্কৃতিমনা পরিবার ছিল আমাদের। আমি বা যে বোন গান গাইতো আমরা পরিবার থেকে কোনো বাঁধা পাইনি বরং মা কখনো আমায় নিয়ে কবিতার অনুষ্ঠানে যেতেন, কখনো ম্যানিলা আপাকে নিয়ে গানের অনুষ্ঠানে যেতেন। লেখাটা আসলে কষ্টবোধ, না পাওয়ার অতৃপ্তবোধের অনুভূতি থেকেই শুরু বলে মনে হয় আর সেটা অবচেতন মনেই হয়তো হয়েছিল। তবে ঐ সময় আমি ছোট গল্প অনেক লিখে ছিলাম।আগে তো রংপুরের সব স্কুল আবার সব কলেজ মিলে রচনা প্রতিযোগিতা হতো খুব । আমি বাসায় এসব ব্যাপারে কিছু বলতাম না কাউকেই, নিজে নিজে অংশ নিতাম। বিশ্বাস হবে কিনা জানি না, তিনটি পুরস্কারের মধ্যে একটিতে থাকতাম আল্লাহর করুনায়।/ লেখনীর সহযোগিতায় মা ছিল আমার মাষ্টার/শ্রোতা।
পাতা প্রকাশ : ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য কী ছিল? তা কি হতে পেরেছেন?
হেলেন আরা সিডনী : আসলে লক্ষ্য কি ছিল সেটাই বড় বিষয় ছিল। যাদের ভালো লাগতো বা পছন্দ করতাম তখন তারা যা ছিল সেটা হবার কথা ভাবতাম। আবার বাবা ছিল না বলে মা যখন প্রতিটি পদক্ষেপে কষ্ট পেতেন, স্বার্থের হানাহানি (পারিবারিক বৈষয়িক বিষয়ে) আঘাত পেতেন শ্বশুর বাড়ীর লোকদের কাছে তখন খুব রেগে যেতাম আমি। ক্ষেপে উঠতাম, দেখতাম মা কাঁদতো, তখন মনে করতাম-আমি বড় হলে স্বার্থপর বেঈমান মানুষ হবো না, খুব ভালো মনের মানুষ হবো একটা। নিজে দু:খ নেবো তবু কাউকে দু:খ দেবো না। দু:খী মানুষদের পাশে থাকবো।
সত্যি বলতে কি হয়তো ইচ্ছের তরীটা সঠিক ভাবে এখনো সেদিকে নিতে পারি নি তবে যার সঙ্গে সারা জীবন এক সঙ্গে থাকার অঙ্গীকারে সংসার জীবন বেঁধে ছিলাম দয়াময়ের ইচ্ছেতে সে ছিল এমন একজন মনের মানুষ। বিয়ের পর যখন তার কর্মস্থলে ঢাকা ডেমরা শীতালক্ষী নদী পার হয়ে টিলার উপরে নবারুন জুটমিল কান্চন জায়গাটির নাম, সেখানে যখন পৌঁছালাম তখন দেখলাম ৪/৫ জন অফিসার-অফিসার বৌ আর পুরো মাঠ জুড়ে লেবার। প্রত্যেকের হাতে ফুল/ফুলের মালা। আমার বরটি ছিল সেই জুটমিলের জুট পারচেজ অফিসার (সেকেন্ড ম্যান)। সেদিন বুঝলাম মানুষের ভালোবাসা কি? তারপর দেখতাম প্রতি শুক্রবার সে আমাকে সঙ্গে নিয়ে (যাবার আগে বলে দিত-ওরা যা খেতে দেবে একটু হলে মুখে দেবে, ঘৃণা করবে না।) লেবারদের ঘরে ঘরে ঢুকে খোঁজ খবর নিত, যতোটুকু পারতো টাকা দিয়ে সাহায্য করতো। হঠাৎ কখনো দেখতাম বেতন আনে না। ব্যাপার খোঁজ করতে গিয়ে দেখতাম কোনো লেবারের চিকিৎসা বাবদ টাকা দিয়ে ঢাকা পাঠিয়েছে। সে যে কি কষ্ট হতো সে মাসে। আবার বিকেল হলে ব্যাডমিন্টন এবং ক্লাবে ক্যারাম-তাস খেলতো সঙ্গে সঙ্গে তার কলিগ/বন্ধুরা আমাকেও সঙ্গে নিত। মানে তার স্বভাবটা ছিল সে যেখানে আমিও সেখানে। স্বাধীনচেতা মানুষ ছিল, বেড়ানোটাও তার একটা নেশা ছিল। ছুটি পেতো না। ডিসেম্বর এলে সে ঘুরে বেরাবে। একবার ছুটি মিলছিল না। ব্যস রাগারাগি চাকুরী করবো না বলে বিদায় নিল চাকুরী থেকে। ১৯৯১ তে আমায় নিয়ে এসে রংপুর পালপাড়া ভাড়া বাসায় উঠলো। যদিও তার বাবার বাড়ী ছিল মুন্সিপাড়া। রংপুর সুপার মার্কেট যখন শুরু হচ্ছিল তখন লটারী দিয়ে নীচ তলার ১০৫ নং দোকানটি আমাদের হলো, যা সানী ইলেকট্রনিক্স নামে বিশেষ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, তারপর দু’ জনের চেষ্টায় নেওয়া হলো রংপুর রামমোহনে ২১০ নং দোকান দোতলায়। শুরু হলো নতুন জীবনযাত্রা। আমার ইচ্ছেগুলো আমার স্বামীর মধ্যে দিয়ে পূরণ হয়ে যেতো। রংপুরে এসেও সে সামাজিক জন কল্যাণমূলক কাজগুলো করতো নির্দ্ধিধায় তবে একা নয় দুইবন্ধু (কাজী জুন্নুন জিতু ভাই) মিলে। আমার মধ্যে এমন স্বপ্নের বসবাস আছে তবে পারি না। খুব ক্ষুদ্র চেষ্টায়, মানুষের যে কোনো সমস্যায় ডাকলে, কোনো ভালো কাজের পাশে থাকতে পারলেই অজানা একটা তৃপ্ত বোধ বুকের ভেতরে অনুভব করি। আর তাই আমার পরিবার, প্রাইমের দু’জন ডাক্তার, কিছু ফেসবুক বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন সর্বসার্কুল্যে ১০/১২ জন সদস্যের আন্তরিক সহযোগিতা নিয়ে সেই ইচ্ছেতে “ পাশে আছি “- মানবিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে দিয়ে কিছু করার চেষ্টা রাখি কারন একার পক্ষে সম্ভব নয়। যার বয়স মাত্র দেড় বছর। সাধ আছে যতো মোর সাধ্য নেই ততো। “ পাশে আছি “-মানবিক সংগঠন থেকে (সহযোগিতার টাকায়) একটি মেয়েকে হাত সেলাই মেশিন, ৬ জন অসুস্হ মানুষকে হুইল চেয়ার এবং বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে শীতবস্ত্র , ঈদ পোষাক , ইফতারী দেওয়া হয়। জানি না এই প্রশান্তিময় কাজ দয়াময় কতোদিন করার তৌফিক দেবেন। হয়তো বলবেন যা দেওয়া হয় বা পরের জন্য করা হয় তা কেনো বলছেন, তা তো বলতে নেই। হ্যা বলতে নেই সত্যি তবে আমি মনে করি যেটা দশ জনের আর্থিক সহযোগিতায় কাজ হয় সেটা প্রকাশের প্রয়োজন আছে স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসের কারনে আর ঐ একজনের দেওয়া দেখে হয়তো আরো দু’জনের ইচ্ছে হতে পারে। আপনার একার নিজস্ব অর্থায়নে আপনি যেটা করতে পারছেন সেটা জানানোর বা দেখানোর প্রয়োজন নেই বলেই মনে করি। খুব সাধারণ ভালো মনের মানুষ ও মানুষের পাশে থেকে কিছু করে যেতে পারি যেনো মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত, এটাই ইচ্ছে। সাধ্য নেই বলে পারছি না ভালো কিছু করতে তবে চেষ্টার ত্রুটি নেই।
পাতা প্রকাশ : আপনি নিজেকে কি কবি ভাবেন? নাকি অন্যকিছু?
হেলেন আরা সিডনী : প্রশ্নটা অনেক বড় মাপের হয়ে গেলো না? লিখে সকলেই, অন্তত মনের সঙ্গে যারা কথা বলতে পারে আমার মনে হয় তারাই কিছু না কিছু লিখে বা লিখতে পারে। সেটা গদ্যে-পদ্যে-ছন্দে যেভাবেই হোক। প্রেরণা বা উৎসাহের দিক থেকে বললে বলবো-লিখো গো তোমরা লিখে যাও। লিখতে লিখতে লেখিকা, গাইতে গাইতে গায়িকা। কি তাই না? সকলে কবি নয়, কেউ কেউ কবি। আমি ভাবি না, পাঠক/শ্রোতাদের বিচারধীন এ ব্যাপারটা।
প্রসঙ্গে আসি, আমি কবি নিজেকে ভাবি না। যদি লেখার মতো লিখতে সত্যি পারতাম তাহলে কিছু সঙ্গতিপূর্ণ পরিচিতি আমার থাকতো। জীবনের নিরপেক্ষ রায়গুলোকে আমি সব সময় অগ্রাধিকার দেই এবং ভালোবাসি। তাই নিজেকে কবি বলার দু: সাহস ব্যক্তিগতভাবে আমার নেই। জীবন পরিক্রমার প্রতিটি পদক্ষেপে সমাজ-মানুষ, সুখ-দু:খ, ঘাত-প্রতিঘাত, এগুলোই আমার কলম বন্ধু। জীবন অভিজ্ঞতার উপাখ্যান থেকে আমি নিজেকে যেমন দেখি, তেমনি মানুষকে। সব মিলিয়ে স্বপ্ন গড়ে ওঠা আর ভেঙ্গে যাওয়ার ভালোবাসায় ঋদ্ধ হয়ে বাহ্যিক কিছু না থাকলেও প্রাণ প্রাচুরর্য্যের উদ্দীপ্ত ও প্রত্যয়ী একটা মন নিয়ে সুস্থ জীবনকে লালন করার চেষ্টা করে লিখে যাই। জীবনের গল্প ভাগে ভাগে লেখা যায় কিন্তু গল্পকে জীবন করা কঠিন। আসলে কবি তো তিনি, যিনি খুব স্বাভাবিক সহজবোধ্যতার মধ্যে দিয়ে জগত-জীবনের চিত্রপটকে তুলে এনে স্নিগ্ধতার অনুভূতিতে সাজিয়ে প্রকাশ করতে পারে। হোক না তা গদ্যে কিংবা পদ্যের আঙ্গিকে।
পাতা প্রকাশ : নিজের বই নিয়ে উপলদ্ধি-
হেলেন আরা সিডনী : সন্তান প্রসব করার উপলদ্ধির মতোই মনে হয় এক একটি বই-প্রকাশ এর পেছনে সেই উপলদ্ধি কাজ করে। বই যখন হাতে আসে তখন খুব ভালো লাগে, আবার সেই বই যদি অপরিচিত মানুষেরা বইমেলায় কিছুক্ষণ হাতে নিয়ে ওলোট-পালোট করে দেখে একবার মুখের দিকে তাকিয়ে পাঠক বলে-আন্টি বা আপা বইটি দিন তখন সত্যি বুকটা সুখানন্দে ভরে যায়। কারো সুপারিশে বা পরিচিতদের মধ্যে হলে অতটা ভালোলাগা উপলদ্ধি হয় না। তবে যতোটা আমি এ পর্যন্ত দেখলাম-পাঠকেরা সামাজিক বাস্তবতার আঙ্গিকে লেখা সহজ-সরল শব্দ চয়নের বই হাতে নিয়ে স্বস্তি পায় বা পছন্দ করে। আমার বেশি বই নেই । একক ২ টি এবং যৌথ ৬ টি। বইগুলো যখন নিজে প্রথমে আবার পড়ি তখন মনে হয়-ইস্ এখানে এমন করে লিখলে আরো ভালো লাগতো। আসলে এখনো অনেক পড়া এবং জানার দরকার আছে।
পাতা প্রকাশ : আপনার কাছে কবিতা কি?
হেলেন আরা সিডনী : আমি মনে করি যে, আমি যদি কোনো ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে চাই তাহলে সেই দক্ষতা অর্জন করার জন্য প্রথমে কবিতার দিকে ঝোঁকটা বেশি দিতে হয় বা কবিতা পড়তে হবে। কবিতা আসলে সুস্পষ্ট জীবনালেখ্য। শৈল্পিক সৌন্দর্যবোধ বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হতে হবে। হতে হবে গভীর চিন্তনের অর্থপূর্ণ ছবি। গদ্য কবিতাকে অনেকে নাক সিটকান আসলে আমি বলবো গদ্য কবিতায় কিন্তু ছন্দবদ্ধতার ছোঁয়া না থাকলে আপনার নিজের কবিতাটি আপনি নিজে পড়েও আনন্দ পাবেন না কারন এটা অন্তরস্থ প্রদেশ থেকে উদিত হয় তখুনি সেটা আকর্ষিত আর ভালোলাগার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছাবে। কবিতা লেখাটিকে যে যেমন ভাবে উপলদ্ধি করে সে সেভাবে লিখে। প্রেম-ভালোবাসার কবিতা হয়তো আপনি লিখছেন, আমিও লিখছি। এই যে লেখা, লেখার আগে কবি মনের সুকুমার চিন্তা-চেতনা, সভ্যতা এবং নৈতিকতার মানদন্ডে বা মাপকাঠিতে লিখবে যা দিকদর্শনের কাজে লাগবে, বিকশিত হবে মনের উদারতা এবং স্বচ্ছ সুন্দর চৌতন্যবোধের। আবার অপর দিকে লাম্পট্য ও অশ্লীলতা, ব্যঙ্গাত্মক, কটুক্তিমূলক ভাবে একটি কবিতা সুন্দর ভাবে লিখে প্রশংসিত হয় বা হচ্ছে। এক কথায় আমি যেটা বলতে চাই সেটা হলো, উলঙ্গ নৈতিকতা বিবর্জিত কবিতা লিখে সমাজকে, আগামীর প্রজন্মকেই নষ্ট করা হয়। কবির সুষ্ঠ সুন্দর রুচিসম্পন্ন মনোভাবের উপরেই কবিতার সৌন্দর্য। শিশু মায়ের বুকের দুধ খায় স্বাভাবিক একটি প্রথা। মা এমন এক জায়গায় যে চারপাশে মানুষের ভীড় , শিশু কাঁদছে। মা তার লজ্জা-সম্মান ঠিক রেখে শিশুকে দুধ পান করাচ্ছেন। আমরা সকলে জানছি কিন্তু কেউ দেখছি না। কবিতা মনে হয় এটাই, আপনার বিবেকবোধের সৌকর্ষ সাধনে ভাষার সৌন্দর্যে পরিস্ফূটিত জানা-অজানা দিকগুলোকে তুলে ধরা।
পাতা প্রকাশ : আপনার মাথায় লেখার ইমেজ কিভাবে আসে ?
হেলেন আরা সিডনী : সত্যি বলতে কখোন কিভাবে এসেছে এটা আমি নিজেও জানি না। ছোট্ট বেলা থেকেই আমার বই-এর প্রতি খুব ঝোঁক। কোথাও গেলে সকলে গল্প করে আর আমি যদি কোনো বই পাই কাছে, ওটাই আমার বন্ধু হয়ে যেতো। তবে মনে পড়ে-যতো সম্ভব প্রাইমারীতে পড়ি। আমি যাচ্ছিলাম কাউনিয়া খালার বাসায় তো আমি জানালার কাছে বসে ছিলাম। আমি দেখছিলাম ট্রেনটি এক লাইন থেকে আর এক লাইনে ঘুরছে মানে ওর ইন্জিনটা দেখতে পাচ্ছিলাম, ধোঁয়া উড়ছেৃ মনে মনে অনেক কিছুই ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল-পু..রেলগাড়ি ঝিকঝিক ঝিক/আমায় নিয়ে চলো ঠিকঠিক ঠিক/আমি যাবো খালাবাড়ী/নিয়ে চলো তাড়াতাড়ি… (মনে পড়ে না..) এভাবে এগুতে থাকি। অভিযাত্রিক সাহিত্য সংগঠনকে আমি অস্বীকার করলে অকৃতজ্ঞ হবো। মূলত: সেখানে ছিল সুফী স্যার, বিশুদা, সব্রতদা, কালীরন্জন, শিকদার, হাসনাত লাভলু (আমার ফুপুতো ভাই) মাহবুবুল ইসলাম-এতোসব ভালো মনের মানুষদের মাঝে বসে বসেই লেখার ভাবনা আমার মনে দৃঢ় হয়ে গেঁথে বসে। আমাদের ঐ সময়ে আমরা জিলা স্কুলের বট গাছ তলায় বেশি অনুষ্ঠান করতাম। মনে পড়ে, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দুগুন, দাদুভাই (রফিকুল ইসলাম) র সাথে কতো প্রোগ্রাম করেছি। এভাবেই মনে হয় লেখার এই যে সুন্দর ইমেজ এটা আমার মনে তখন থেকেই বাসা বেঁধেছে। ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল আমি বেঁচে ছিলাম জিন্দা লাশের মতো। এই মধ্যে খানের সময় আমার যতো লেখা পত্রিকায় বেড় হয়েছিল মানে জমাতাম সব… সব পুড়িয়ে শেষ করে দিয়ে ছিলাম, এমনকি নিজের শাড়ী/কাপর পর্যন্ত। মানসিক অসুস্থ হয়ে পরে ছিলাম কারন আমার জীবনের প্রাণপ্রিয় ভালোবাসার মানুষটি ২০০৩ সালে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিল।। টাকা/খাবার/থাকা কোনো কিছুর নিশ্চয়তা ছিল না আমার। অষ্টম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর দুটো বাচ্চা নিয়ে দিশেহারা আমি। শ্বশুর বাড়ী থেকে দুটো ঝুরঝুরে ভাঙ্গা ঘর নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া। দোকানে কিছু নেই। সেই দিনগুলো এখন ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে। তারপর ২০০৮ থেকে রংপুর সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদে আসার পর আস্তে আস্তে মানসিক ভাবে সুস্হ হয়ে উঠি এবং লিখতে শুরু করি যদিও যখন আমার বোন-দুলাভাই ঐ সংগঠনে নিয়ে যায় তখন ও আমি চিৎকার করতাম আমি তো কিছু পারি না, জানি না। আমি কখনো লিখিনি বোন- দুলাভাইর কাছে কৃতজ্ঞ এবং পরম করুনাময়ের অশেষ দয়ায় আমি আজ এখানে সুস্হ জীবন যাপন করছি। এরপরেও কথা থাকে-মফিজুল ইসলাম মান্টু, স্বাত্তিক শাহ আল মারুফ, শাহ্ আলম, জাকির আহমদ , রেজাউল করিম জীবন এরাই আমাকে লেখার জগতে এখনোৃ এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। কারন ২০০৩ সালেই হয়তো আমার মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল মনে মনে। লেখার জগত শুধু নয়, সংসার, সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক সব দিক দিয়ে আমি জিরো হয়ে গিয়ে ছিলাম। মহান করুনাময়ের অপার করুনা, আমার চেষ্টা, নিরলস পরিশ্রম, মা, ভাই-বোনদের কিছু সহযোগিতায় আমি ২০০৩-এর পর থেকে অনেক অনেক সাহস নিয়ে প্রতিটি মুহুর্ত লড়াই করে একদম শূণ্য থেকে এখানে এসেছি, আজো সুস্হ মানসিকতায় বেঁচে আছি। আমি আমার ভাঙ্গা সংসারটিকে বাঁচাবার জন্য ন্যাশনাল লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে এজেন্ট পদে চাকুরীতে ঢুকে কাজ করতে শুরু করেছি। অনেকে বলেছে এম, এ পাশ করে এজেন্ট হয়। আমি কোনো কাজকে ছোট করে দেখি না। ৮ দিনে এস- ও , ২০ দিনে ম্যানেজার, ৫/৬ মাসে ডিভিশনাল ম্যানেজার। এখান থেকে যে টাকা পেতাম তা দিয়ে শেয়ার ব্যবসা করেছি। দুটো ভাঙ্গা ঘর থেকে আল্লাহর রহমতে টিন শেড তিনটি বাসা করেছি, ছেলেরা পড়ালেখা করেছে। বুটিকস বেডকভার, থ্রী পিছ কাপরের ব্যবসা করেছি। এভাবে আমি এক এক করে দিন পার করে চলেছি শুধু আমার স্বামীর ভালোবাসাকে বুকে নিয়ে দয়াময়ের দয়ায়। আমি বুঝেছি সত্যিকারের জীবন মানেই পরিশ্রম , চেষ্টা আর সততা। জীবনকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে যে পড়তে পারে সেই জীবনের কথা সুন্দর ভাবে তুলে ধরতে পারে। হোক নিজের , হোক অন্যের। কবিতা সত্যনিষ্ঠ ও সুসামন্জস্য হয়ে ওঠে জীবনবোধ থেকে। কবিতা নিয়ে রাসুল (সা:) এর এমন মনোভাবো পাওয়া বই-এ। -তিনি বলেছেন-“তোমাদের কারো পেটে দুর্গন্ধময় মন্দ কবিতা থাকার চেয়ে সে পেটে পুঁজ জমে তা পঁচে যাওয়া অনেক উত্তম।”
পাতা প্রকাশ : আপনি কার লেখা বেশি পড়েন? বিশেষ কারো লেখা কি আপনাকে প্রভাবিত করে?
হেলেন আরা সিডনী : ম্যাক্সিম গোর্কির মা প্রথম পড়ছি, যা আমাকে ভাবায়, মোহমুগ্ধ করে রাখে। এছাড়া ডেল কার্ণেগী, রেনে ডেকার্ত, ফ্রেডারিক নীটশে এদের বই বেশি পড়তে ভালোলাগে। আসলে রচনামূলক বইগুলো পড়তে আমার বেশি পছন্দ। দর্শন/জীবনমুখী বইগুলো আমায় টানে বেশি। ইসলামিক অর্থমূলক বই পড়ি। প্রভাবিত করে কিনা জানি না তবে ছোট বেলা থেকেই আমি জীবনানন্দ দাশ ও সুকান্তের বই-এর প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলাম। পরবর্তীতে নির্মলেন্দুগুণ, সামসুর রহমান, সুনীলগঙ্গোপাধ্যায় এবং অসীম সাহার বই পড়ি।
পাতা প্রকাশ : আপনার সমকালীন লেখকদের লেখা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি? কার লেখা বেশি ভালো লাগে?
হেলেন আরা সিডনী : সমকালীন লেখকদের লেখা নিয়ে কিছু বলার নেই। সকলে ভালো লিখি বা লেখার চেষ্টা করি। তবে দু:খ পাই যখন নিজের লেখা কবিতাটিকে কাউকে ব্যঙ্গ বা কটাক্ষ করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। আমরা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কবিতা পড়ে/গান শুনে উদ্ভুদ্ধ হয়ে ছিলাম, আগ্রহ ও প্রেরণা পেয়েছিলাম। তাই লেখা যেনো মানুষকে বদলাতে সাহায্য করে, মনকে অনুপ্রাণিত করে, সর্বোপরি দেশকে ভালোবাসতে শেখায় অর্থাৎ আমাদের অর্ন্তচক্ষু খুলে দেয়।
পাতা প্রকাশ : সবশেষে লেখক হিসেবে চূড়ান্ত লক্ষ্য কি?
হেলেন আরা সিডনী : আসলে চূড়ান্ত বলে কোনো শেষ কথা নেই। মানুষ যতো পায়, ততোই চায়। চড়ান্ত মানেই জীবনের শেষ রেখা টেনে দেওয়া। তাই আমি বেঁচে থাকা অব্দি আল্লাহ যদি মানসিক ও শারিরীক সুস্হ রাখেন, কিছু লেখার তৌফিক দেন তাহলে আমি যেনো জীবনের যে দর্শন তা নিয়ে মানুষের মানবিক চৈতন্যবোধে বিবেকের মর্যাদা, শ্রদ্ধা আর ইসলামিক আলোকে লেখার মধ্যে দিয়ে কিছু ম্যাসেজ লিখে যেতে পারি আর সম্মানিত পাঠক সমাজে বই ভালোবেসে বই কিনুক, বই পড়ুক তা দেখে যেতে পারি। আমি মনে করি লেখকের হাজার লেখার ভিতরে একটি লেখাও যদি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে, অন্য এক জীবনের সঙ্গে বিদগ্ধ শব্দচয়ন কিংবা বাক্যবিন্যাসের একটি লাইন মিলে গিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখ রুমালে লুকোয় সেটাই লেখকের সার্থকতা। লেখকের জীবদ্দশায় সেটাই চূড়ান্ত প্রাপ্তি। সকলের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।