বিভৎস ভয়ংকর
মিম্ মি
আমি বিরক্ত। অসহ্য লাগছে অধরাকে। অধরা আমার মেয়ে। দ্বিতীয় সন্তান। বয়স সাত মাস।
অথচ যেদিন কনফার্ম হলাম আমি প্রেগন্যান্ট কি খুশিই না হয়েছিলাম সেদিন। অয়ন আমি দুজনে মিলে সারা রাত জেগেছিলাম আনন্দে।
আমার আব্বু আম্মু,শ্বশুরবাড়ির সবাই খুশিতে অস্হির। অধরা দুই পরিবারের প্রথম নাতনী। সবার অনেক আদরের।
অয়ন তো একটা ঘর রেডি করে ফেলল। পুরো রুমে পিঙ্ক কালারের ডেকোরেশন । গোলাপি রঙের ছোট্ট বেবী কড, পর্দা, পুতুলে ভর্তি এক ঘর।
তখন আমার একটু হিংসা হল ! এই ঘরটা আমার কাজের জন্য ব্যবহার করতাম। অয়ন বলল তুমি আমাদের বেডরুমেই কাজ কর। তোমার ল্যাপটপের ডেষ্কসহ সবকিছু এই রুমে সেট করে দিচ্ছি আমি।
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল আমার। নুপুর, আমার ছোটবোন জন্মের সময় আব্বু আম্মুও এরকম করেছিল। আমাকে অন্য রুমে দিয়ে বলল– এখন থেকে নুপুর আব্বু আম্মুর সাথে ঘুমোবে। আমি বড়। তাই নিজের রুমে ঘুমোতে হবে আমাকে। আচ্ছা ক্লাশ থ্রি’তে পড়লে কি আর বেবী থাকে না কেউ ?
বোন আসার পর সবাই আমার কথা ভুলেই গেল। সবার মনোযোগ হলো নুপুরকে নিয়ে। আমাকে কেউ ভালবাসছিল না। আমি লক্ষ্মী হয়ে থাকব কেন ?
আব্বু আম্মু তখন ডিনারে ছিল। নুপুর তাদের বিছানাতে ঘুমে। রুমে ঢুকে আমি ওলক্লথ সহ নুপুরকে জোরে টান দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিলাম এক দৌড়।
নুপুর মারা যাবার তিন বছর পর আমার ভাই নিশাতের জন্ম। তখন আমি ক্যাডেট কলেজে ভর্তি কোচিং করছিলাম শহীদ একাডেমীর হোস্টেলে থেকে। এরপর চলে গেলাম ক্যাডেট কলেজে। তারপর ভার্সিটির হলে। এরপর বিয়ে করে অয়নের সাথে ভার্সিটির কোয়ার্টারে।
বিয়ের প্রথম বছর ঘুরতে প্রেগন্যান্ট হয়েছিলাম আমি। তখন আমরা কানাডাতে। অয়নের পিএইচডি চলছে।
সেবার একটা ছেলে বাবু হলো। প্রচন্ড ডিপ্রেশন আকড়ে ধরল । এত বাজে দেখত আমাকে। বেঢপ মোটা। স্কীন কুঁচকে গিয়েছিল। গলাতে ছোপ ছোপ দাগ। রাত জেগে থাকতে থাকতে চোখের নীচে কালি। চুল পরে যাচ্ছে তুলোর মতো।
সবার মনোযোগ ছিল ছেলে বাবুটার দিকে। দেশ থেকে সবাই ভিডিও কল করে দেখতে চাইতো বেবীকে। আমার জন্য কেউ ছিল না। অয়নও না।
ব্রেষ্ট ফিডিং করানোর নিয়ম নার্স আমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিল। কতখানি গ্যাপ রাখতে হবে বেবি আর মায়ের স্কিনে বলেছিল। নাহলে কি কি মারাত্বক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে সেটাও জানাল।
রাতে কান্নাকাটি করে খুব বিরক্ত করতো বেবীটা। বারবার ডায়াপার চেইন্জ করতে হতো। অয়ন এসব পারতো না। কানাডাতে কোন আত্মীয় ছিল না আমাদের।একা আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম বেবীটাকে সামলাতে।
প্রচন্ড রকম পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনে চলে যাই। ডাক্তারের কাছে পর্যন্ত যেতে হতো।
তারপর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বেবীটাকে বেবি কডে পাওয়া গেল না। দেখা গেল সে শুয়ে আছে আমার আর অয়নের মাঝের জায়গাটাতে। শ্বাস নিচ্ছে না সে। ছোট্ট ঠোঁটের কোনাতে সাদা দাগ লেগে আছে। সাদা ফর্সা পুরো শরীরটা কেমন নীল হয়ে আছে।
বেবীটাকে কানাডাতেই দাফন করা হয়।
অয়নের কোর্স শেষ হলে দেশে ফিরে আসি আমরা। ও ভার্সিটিতে জয়েন করে। আমি বাসাতেই ফ্রিল্যান্সিং করতে থাকি। এর মধ্যে বাচ্চার কথা আমরা আর ভাবিনি। অয়ন তো ভুলেও বলত না। তিন বছর পর অধরা পেটে এল।
অধরাকে কোলে নিয়ে বললাম — এই শোন আমি তোমার মা হই। তুমি এ রকম বিরক্ত কর কেন আমাকে ? রাত জেগে থাক। একটু পর পর পটি কর। এত ক্ষুধা কেন লাগে তোমার ? মায়ের কষ্ট হয় বোঝ না ?
অধরা পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার শুরু করে কান্না। এত কাঁদতে পারে বাচ্চারা ! বিরক্তিকর !
শোন অধরা মায়ের না বেবী একদম পছন্দ না। তোমার একটা ভাই ছিল। সেও এ রকম বিরক্ত করত। মায়ের চেহারা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বাবা ভালো করে কথা বলতো না তখন। সবাই শুধু বেবীদের জন্য ভাবে। মায়ের জন্য কারো সময় নেই। এটা কি ঠিক বল ? তুমি কাঁদবে না। তাহলে কিন্তু ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিব তোমাকেও। সেখানে নুপুর আন্টিও আছে কিন্তু।
কাঁদতে কাঁদতে অধরা ঘুমিয়ে গেল। ওকে বেবী কডে রেখে ওষুধের কৌটা থেকে দুটো ট্যাবলেট বাথরুমে ফ্লাশ করে দিলাম কমোডে। সাইক্রিয়াটিষ্ট দিয়েছে খেতে। দুবার সুইসাইডিয়াল এটেম্প নেবার পরে ডাক্তার এই ওষুধ দিয়েছে। পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের জন্য। ময়লার ঝুড়ি অয়ন চেক করে। তাই ফ্লাশ আউট করতে হয়। আমি কি পাগল যে প্রতিদিন ওষুধ খাব ? নিজের বাচ্চার জন্য এত মায়া। অথচ আমার জন্য শুধু ডাক্তার দেখিয়েই দায়িত্ব শেষ। এক সময়ে অয়ন শুধু আমাকেই ভালোবাসতো।