প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগের কথা যদি আমরা হালকা তালে এড়িয়ে উত্তরাধুনিক সময়ের গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে নান্দনিক বোধের অনুষজ্ঞ ও ব্যঞ্জনকে অধিক শৈল্পিক বলে স্বীকৃতি দেই তবে অতীতের সাথে অবিচার হবে। গ্রন্থ প্রকাশনার ক্ষেত্রে নান্দনিকতাও একটি শিল্প। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির সহজ ও বিশাল ব্যাপ্তির কারণে এখন মুদ্রণশিল্প এক অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করছে। আর তাই প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ায় অলঙ্করণ, গ্রাফিক্স এবং নানাবিধ আকর্ষণীয় কাগজের ব্যবহার বস্তুত একে এক অনন্য উচ্চতা দান করেছে।
যে আনন্দজাত তৃপ্তিই সহজ ভাবে নান্দনিকতা বলে স্বীকৃত সেই তৃপ্তির ঢেকুর আবার সকল ক্ষেত্রে অন্তত গ্রন্থ প্রকাশের দিক থেকে তোলা সম্ভব হয় না। কেননা মুদ্রণ সামগ্রীর উচ্চ মূল্য এবং অপরাপর খরচ যখন একটা বড় গণিত হয়ে আপনার কিংবা প্রকাশকের মস্তিষ্কে অনবরত খোঁচাবে এবং পাঠকের ক্রয় ক্ষমতার স্বাচ্ছন্দ্যতাও যখন ওই শিল্পের আরেক দিক স্মরণ করিয়ে দেয় তখন অনেকের অনেক ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও গ্রন্থের অবয়ব, কাগজ, বাঁধাই এবং অলঙ্করণে আর সৌখিনতা দেখাতে চান না বা পারেন না। অথচ এসব কিছু ছাড়িয়ে কবি বাবলু মওলা অথবা তার প্রকাশক সেই দুঃসাহস দেখিয়েছেন।
হ্যাঁ বলছিলাম আসলে কবি বাবলু মওলার নতুন কাব্যগ্রন্থ -‘ অধর চুঁইয়ে শিশিরের ঘ্রাণ ‘। চমৎকার কাব্যিক নামের এই কাব্যগ্রন্থ নিয়ে দুই একটা কথা তুলে ধরার জন্যেই এই উপস্থাপন। বেশ কিছুদিন আগে নিয়মিত পরিচিত লেখকদের প্রকাশিত গ্রন্থ নিয়ে একটু সংক্ষিপ্ত রিভিউ ফেসবুকে লিখতাম। উদ্দেশ্য এবং আহ্বান ছিল একজন কবি বা লেখক কী আর তেমন পায়। নিজের অর্থ কিংবা প্রকাশকের সাথে চুক্তির মাধ্যমে অনেক আবেগ, আশা নিয়ে যে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন এবং আমরা অনেকেই তা সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে পাই, নেই, চাই। তারপর পড়ি, বুক সেলফে রাখি। আমি বলে থাকি ফেসবুকে তো কোনও খরচ লাগে না, অন্তত গ্রন্থের একটা ছবি দিয়ে দুই চার লাইনে ভালো লাগার, মন্দ লাগার কথা লিখলেও মানুষ সেই গ্রন্থটা সম্পর্কে জানতে পারে।
শিল্পধর্মী প্রকাশও মানববৃত্তির অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী আত্মচেতনার প্রকাশ এবং ভিন্নতর প্রবণতা। শ্রদ্ধেয় আহমদ রফিক কালি কলমে যেমনটা লিখেছেন – শিল্পসাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার – বিবেচনার ধারাটি প্রাচীন। বলাবাহুল্য তা নিয়ে ভিন্নমত ও যুক্তিতর্কের ভিন্নমাত্রিক বয়ান কম নয়। তবে ওই বিতর্কের বিষয়বস্ত্ত শিল্পসাহিত্য সৃষ্টির পেছনের দুটি শক্তি সক্রিয়। মূলত তা মানসিক ও পারিপার্শ্বিক। ক্রিস্টোফার কডওয়েল কবিতার উৎস ও তার নন্দনতাত্ত্বিক বিচার ব্যাখ্যা যেমনটা বলেছেন – মনুষ্যস্বভাব এবং প্রয়োজনের তাগিদ। এদিকে মার্কসবাদীদের একাংশ এর সাথে ‘শ্রম’কে যুক্ত করেছেন বলে জনাব আহমদ রফিক বলছেন।
সাহিত্যের প্রাচীন এক শাখা কবিতা। নিরক্ষর মানুষ যখন পৃথিবীতে ছিল তখনও কবিতা ছিল – মানুষের মুখে, উচ্চারণে। কবিতা অমীমাংসিত সংজ্ঞায়িত একটি শিল্প। অনেক কবি, সমালোচক, বোদ্ধা কবিতার নানান সংজ্ঞা বা অর্থ বলেছেন। আমি কবি মেকলের উদ্ধৃতি বেশি পছন্দ করি। তিনি বলেছেন, ‘কবিতা বলতে আমরা সেই শিল্পকে বুঝি যা শব্দকে ব্যবহার করে এমনভাবে, যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন। ‘ লিরিক, আখ্যান এবং নাটকীয় এই তিন মূল প্রকারের ভেতর আমরা অসংখ্য বিষয়ের অবতারণা কবিতায় দেখতে পেলেও স্বদেশ, আত্মজ, উত্তমচরিত, রোম্যান্টিক, দ্রোহ, পার্থিব এবং অপার্থিব বিষয় কবিদের কবিতায় প্রতিফলিত হতে দেখি। রোম্যান্টিক ঘরানার কবিতা সম্ভবত পৃথিবীর কাব্য ভাণ্ডারের একটি বড় অংশ দখল করে আছে।
রোম্যান্টিকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলন নামে সাহিত্য তথা কবিতার বিষয় ভিন্নতার একটি আন্দোলন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে উদ্ভূত হয়েছিল। এটি ছিল মূলত তৎকালীন প্রচলিত আলোকায়ন ধারণার বিরুদ্ধে। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ- এর যুগ প্রচেষ্টায় “লিরিক্যাল ব্যালাডস” সেই রোম্যান্টিক আন্দোলনের সূচক। এখন কথা থাকে তবে কি এর আগে রোম্যান্টিক কবিতা ছিল না ? অবশ্যই ছিল। কিন্তু একটি সিদ্ধ স্বীকৃত ধারার স্বীকৃত প্রচলন সম্ভবত এভাবেই। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর পরেই নতুন প্রজন্মের কবিতার বিষয়বস্ত্ত,ভাষা ও কাব্যশৈলী ইত্যাদি বিষয়ে মতামত তথা দিক নির্দেশনা উপস্থাপন করেছিলেন।
এতোটা কথার এবং কিছু তথ্য, তত্ত্ব উপস্থাপনের উদ্দেশ্য আসলে আজকের আলোচিত গ্রন্থকে ঘিরেই। বাবলু মওলা কবিতার আলয়েই আছেন। চলাফেরা শব্দের সড়কে, পংক্তির সেতুতে আর ভাবের নাওয়ে। তিনি লেখেন মূলত রোম্যান্টিক ঘরানার কবিতাই বেশি। অন্তত আলোচিত এই গ্রন্থ ‘অধর চুঁইয়ে শিশিরের ঘ্রাণ’- এরকমটাই দেখতে পাই। ১১১ পৃষ্ঠার এই চমৎকার গ্রন্থে মোট ৮৩টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কাব্যগ্রন্থের নামটি যেমন তা পাঠেই পাঠকমাত্রই অনুভব করতে পারেন গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য। হ্যাঁ চমৎকার নামের মতোই একেকটি সুন্দর সুন্দর কবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে গ্রন্থের নান্দনিক অবয়বে। আমি এরকমটাই বলতে চাই গ্রন্থের অবয়ব, অলঙ্করণ, বিন্যাস তথা অঙ্গসজ্জা ভীষণ নান্দনিক। আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করেছে এসব।
মৌমিতা রহমানের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে গ্রন্থটি পেয়েছে এই নান্দনিক রূপ। এবং কবির কবিতার শব্দচয়ন, রূপকল্প, চিত্রকল্প, কাব্যিক প্রকাশ এসব কিছুর জন্যেই এরকমটা সম্ভব হয়েছে। যেহেত ফেসবুকের সীমিত পরিসর এবং এই লেখার পাঠকের অধিকাংশই আলোচ্য গ্রন্থটি পাঠ করেননি সেহেতু কিছু কিছু কবিতা নিয়ে তাই আর আলোচনা নয়। মূলত কবি বাবলু মওলা একজন রোম্যান্টিক কবি। তার কবিতার পরতে কবিতা আছে। তিনি সহজ সরল ভাষাতেই কবিতার পরিস্ফূটন করেছেন। বোধের পরিমিতি কবিতার পরতে ফুটে আছে। অযথা জটিল দৃশ্য, শব্দ উপস্থাপন নেই যেমন তেমনি কবিতাকে প্রলম্বিত করার প্রয়াস দেখা যায়নি। অল্প কয়েকটি কবিতা হয়তো পড়তে গিয়ে এই গ্রন্থের অন্যসব কবিতার মতো ভালো মানের মনে নাও হতে পারে। তবে এ বিষয়ে আমি কবির পক্ষ নেবো। একজন কবির সব কবিতা কিংবা সব পংক্তি সবার ভালো লাগবে এ দিব্যি কারও দেয়া সম্ভব না। আমি কবি বাবলু মওলার আলোচিত এই গ্রন্থ -‘ অধর চুঁইয়ে শিশিরের ঘ্রাণ ‘-এর ব্যাপক প্রচার ও প্রসার তথা সাফল্য কামনা করছি।
কবির মমতাময়ী মা’কে উৎসর্গ করা এই গ্রন্থটি ফেব্রুয়ারি ২০২৩ -এ প্রকাশ করেছে ঢাকার পরিবার পাবলিকেশন্স। বইকিনি ডটকম এর অনলাইন পরিবেশক। গ্রন্থটির মূল্য ৩৬০ টাকা।