ফ্লাশব্যাক-৬ঃ Mr.Allen এবং আমি -২
মো. শওকত আলী
Trafalgar sqaure দর্শন শেষে পরিমিত মধ্যাহ্নভোজ সেরে Allen সাহেব আমাকে একটা স্যুভেনীর শপে নিয়ে গেলেন।সন্ধ্যায় ছিল অফিসিয়াল ডিনার। হাতে তখনও ঢের সময়। কেনাকাটার তেমন কোন ইচ্ছে ছিল না।কারণ ইতোমধ্যে একটা লিষ্ট করে রেখেছিলাম যেগুলো সফরসঙ্গীদের ক’জন আমরা একসঙ্গে শপিং করবো বলে কথা ছিল । তাকে নিয়ে সেগুলো কেনাকাটা করতে মোটেও ইচ্ছে করছিল না। তবুও Allen সাহেবের পীড়াপীড়ি আর কিছুটা অভিজ্ঞতা লাভের মানসে তার সংগে একটা স্যুভেনীর শপে ঢুকলাম।
শপে ঢুকে মুশকিলে পড়লাম, সেলসম্যান যা বলে আমি কম বুঝি আর আমি যা বলি সেলসম্যান সে বিষয়ে আবার জিজ্ঞেস করে। মূলতঃ একসেন্টগত সমস্যা ছিল। একবার তো সেলসম্যানকে এ্যালেন সাহেব বলেই বসলেন, শুনো, ও(আমি) হচ্ছে বিদেশি। ইংরেজি ওর মাতৃভাষা নয়। তবে তার মানে এই নয় যে ও ইংরেজি বুঝে না। তুমি উচ্চস্বরে কথা বললেই ও বুঝবে না। বরং তুমি ধীরে ধীরে ওকে বলো।আর আমি যাতে বিব্রতবোধ না করি সেজন্য আমাকে বললো, শুনো, বৃটিশদের মধ্যে তিনধরনের ইংরেজি আছে যেমন, ইংল্যান্ড, স্কটিশ আর আইরিশ। আইরিশরা যখন তাদের লোকাল একসেন্টে তাড়াতাড়ি কথা বলে তখন আমাদেরও অনেকসময় বুঝতে অসুবিধা হয়।আর ওদের আচরণও অতোটা মোলায়েম নয়।এই সেলসম্যান জাতিতে আইরিশ।
যাহোক, এবার এ্যালেন সাহেব আমাকে একটা প্রোটোটাইপ মটরগাড়ির দাম করতে দেখে সেটি নেবার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করালেন। তিনি বলতে শুরু করলেন, খেলনা গাড়ির মতো দেখতে হলেও ওটি আসলে British Royal Mail এর একটা Branded Mailvan এর স্মারক।কিন্তু আমার কাছে মূল্যটা কিছুটা বেশি মনে হচ্ছিল- ২০ স্টার্লিং পাউন্ড। ২০০১ সালে একটা ছোট্ট গাড়ির পিছনে ২০ পাউন্ড ব্যয় করা আমার মত বাংলাদেশের একজন তরুণ সরকারি কর্মকর্তার জন্য বেশ চড়া মনে হচ্ছিল । আমার কিছুটা ইতস্ততভাব দেখে তিনি ওটি আমার সংগ্রহে রাখার পক্ষে আরও যুক্তি দাঁড় করালেন বেশ জোড়ালোভাবে।বললেন,দেখো, আজকে দুনিয়াজোড়া যে আধুনিক পোস্টাল সার্ভিস চালু আছে সেটির পিছনে বৃটিশদের একটি বড় অবদান আছে । বর্তমান বিশ্বে প্রথম ডাকটিকেট প্রচলন করে এই বৃটিশরা। এটি বৃটিশদের জন্য গৌরবের বিষয়। তাই আজও তারা অহংকার করে তাদের ডাকটিকেটে নিজ দেশের নাম লিখে না। (আমার কাছে মনে হলো অনেকটা ‘চেনা বামনের পইতা লাগে না’ ধরনের চিন্তা।) যদিও অন্যসব দেশকেই তাদের ডাকটিকেটে নিজ নিজ দেশের নাম লিখতে হয়।গোটা বিশ্বের জন্য পোস্টাল সংস্থা Universal Postal Union গ্রেট বৃটেনকে সম্মানসূচক হিসেবে এ সুযোগটুকু দিয়েছে।
আবার British Posal Department তাদের Mail Carier (Royal Mail) হিসেবে যে আকৃতির গাড়ি ব্যবহার করে সেটিও তারা তাদের ঐতিহ্য হিসেবে মানে। তাই এটি তুমি স্মারক হিসেবে তুমি নিতে পারো। তাকে আশ্বস্ত করে গাড়িটি আমি নিয়ে নেই।
তবে ডাকটিকেট প্রর্বতনের পূর্বেও পৃথিবীতে ডাকব্যবস্হা বহু আগে থেকেই চালু ছিল। আসলে মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে এবং তার সভ্যতা যখন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটা পর্যাযে পৌঁছায় তখন তাদের ভাব আর সংবাদ আদান-প্রদানের প্রয়োজন দেখা দেয়। মানুষ তখন আগুন জ্বালিয়ে, ঢোল বা ড্রাম পিটিয়ে, সিংগা ফুঁকিয়ে বা অন্য কোনভাবে শব্দ সৃষ্টি করে কিম্বা বিভিন্নভাবে পতাকা উড়িয়ে, পায়রা পাঠিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা গোত্রের মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদান করতো।
খ্রীষ্টের জন্মের ৩৫০০ বছর আগে সুমেরীয় অঞ্চলে (প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ার অঞ্চল -বর্তমান ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চল) রাজকার্যের প্রয়োজনে মাটির পাতলা পাত তৈরি করে কাঁচা অবস্থায় তার উপর সংবাদ, আদেশ -নির্দেশ ইত্যাদি খোদাই করে লিখে আগুনে পুড়িয়ে ইটের মতো শক্ত করে নিতো। এরপর চিঠির ঐ মাটির পাতটির নিরাপত্তা আর গোপনীয়তা রক্ষার জন্য খাম আকৃতির কোনকিছুর মধ্যে পুরে মুখ বন্ধ করে দিতো।
কোরআন শরিফের সুরা’ হুদ এ উল্লেখ আছে হজরত সুলায়মান (আঃ) রানী বিলকিসকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে হুদ পাখির মাধ্যমে চিঠি পাঠান। অনেকেই মনে করেন প্রাচীন লিখিত তথ্য অনুযায়ী এটিই ডাক যোগাযোগ ব্যবস্হার সর্বপ্রথম উৎস।
আবার খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে সম্রাট সাইরাসের তৎকালীন বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যে সংবাদ আর আদেশ-নির্দেশ আদান-প্রদানের জন্য তিনি সুশৃঙ্খল পায়ে হাঁটা এবং অশ্বারোহী বিশাল বাহক বাহিনী গড়ে তুলেন। তার এই ব্যবস্হা দেখে গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস মন্তব্য করেছিলেন-‘Neither snow,nor rain, nor heat, /Nor gloom of night Stays these couriers from swift completion of thier appointed rounds.’
কিন্তু ডাকটিকেটের প্রচলন হয় আরও অনেক পরে।পৃথিবীর প্রথম ডাকটিকেট প্রচলন হয় ইংল্যান্ডে ১৮৪০ সালে। ডাকটিকেট প্রবর্তনের পিছনে একটি কাহিনী আছে। সেটিকে কেউ কেউ বলেন করুণ কাহিনী আবার কেউ কেউ বলেন রাজস্ব ফাঁকি দেবার কাহিনী। তবে ঐ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোল্যান্ড হিল নামক একজন স্কুল শিক্ষক ডাক মাশুল পরিশোধের ব্যবস্হা হিসেবে ডাক টিকেট প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন।
ঘটনাটা ছিল এরকম, এক বৃদ্ধার পুত্র দূরে কোথাও স্বল্প বেতনে চাকরি করতো। তখন যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল চিঠি।ডাকমাশুল পরিশোধ করতে হতো প্রাপককে। কিন্তু ডাকমাশুল ছিল বেশ চড়া। তাই তাদের জন্য ডাকমাশুল পরিশোধ করা কষ্টকর ছিল। মা আর ছেলে তখন পরামর্শ করে ঠিক করেছিল ছেলে যখন চিঠি পাঠাবে তখন চিঠির খামের উপরে সে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন একেঁ দিবে যাতে মা বুঝতে পারে ছেলে ভালো আছে। সেমতো ছেলে মাকে চিঠি পাঠাতো। ডাকপিয়ন চিঠি নিয়ে এলে মা চিঠি নেড়েচেড়ে সংকেত দেখে ডাকপিয়নকে চিঠি ফেরত দিয়ে দিতো। রোল্যান্ড হিলও ঐ সময়ে তার প্রেমিকার চিঠির জন্য অপেক্ষা করতো।তিনি বিষয়টা বার কয়েক লক্ষ করার পর বৃদ্ধাকে চিঠি গ্রহণ না করার কারন জিজ্ঞেস করেন। বৃদ্ধা জানায় যে অত পয়সা দিয়ে চিঠি নেবার সামর্থ্য তার নেই।সে কারনে সংকেত দেখে যখন সে বুঝে যে ছেলে ভালো আছে তখন সে চিঠি আর নেয় না।
শুধুমাত্র বেশি ডাকমাশুলের জন্য মা তার পুত্রের মনের কথা জানতে পারছে না! এ বিষয়টা রোল্যান্ড হিলকে ভাবিয়ে তুলে।
অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করেন, রোল্যান্ড হিল ভেবেছিলেন যে বৃদ্ধা এধরনের চতুরতা অবলম্বন করায় ডাক প্রশাসন তাদের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
রোল্যান্ড হিলের মনে কি ছিল কিম্বা বৃটিশ পার্লামেন্টে প্রস্তাব পেশ করার সময় তিনি কি প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছিলেন তার সঠিকতা যাচাই করার সুযোগ হয়নি। তবে বৃটিশ পার্লামেন্ট তার প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং বৃটিশ ডাক বিভাগ এক পেনি মূল্যমানের পেনি ব্লাক নামে বিশ্বের প্রথম ডাকটিকেট প্রকাশ করে। এ ডাকটিকেট এর উপর সেসময় দেশের নাম লেখা ছিল না এবং তার কোন প্রয়োজনও হয়তো ছিল না।কারণ ঐ সময় আর কোন দেশেই ডাকটিকেটের প্রচলন হয়নি। পরবর্তীতে এ বিষয়টির প্রতি সম্মান দেখিয়ে এখনও ব্রিটিশ ডাকপ্রশাসনের ডাকটিকেটে দেশের নাম লেখা হয় না।তার পরিবর্তে টিকেটের এক কোনায় তাদের রানীর প্রতিকৃতির ছাপ দেয়া হয়।