সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:২৯ অপরাহ্ন

ফ্লাশব্যাক এবং একটি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা-মো. শওকত আলী

ফ্লাশব্যাক এবং একটি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা-মো. শওকত আলী

ফ্লাশব্যাক এবং একটি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা
মো. শওকত আলী

ছবি দুটো পুরনো। করোনা ভাইরাসের কারনে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী গৃহকোণে বসে আছি। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী হাত ধুচ্ছি,লেবু পানি খাচ্ছি। মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ মতো মনকে ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করছি।তারই অংশ হিসেবে আজ পুরনো এ্যালবামে চোখ বুঝাচ্ছিলাম।হঠাৎ চোখ আটকে গেল এ ছবিগুলোতে।দারুণ ভয়ংকর একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল।সময়টা২০০১ সাল।প্রশিক্ষণে গিয়েছিলাম বিদেশে। আট সপ্তাহ ব্যাংকক এবং স্টাডি ট্যুর ১০ দিন লন্ডন এবং আশেপাশে ।বিদেশ যাত্রা বলতে সেটাই প্রথম।অগাস্ট মাসে ব্যাংকক গেলাম। সেপ্টেম্বরে লন্ডন যাবো।ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যের ভিসাও নিয়ে গেলাম।জীবনের প্রথম বিদেশ যাত্রা।শিহরণ তো ছিল, কিছুটা টেনশনও ছিল। লন্ডন যাত্রার পূর্ব নির্ধারিত সময় ছিল সম্ভবত সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ।ক’জন বিদেশি প্রশিক্ষনার্থী ইউ কে এর ভিসা না নেয়ায় তাদের ভিসা প্রসেসিং এর ব্যবস্হা গ্রহণ করে ব্যাংককের কর্তৃপক্ষ।ব্যাংককে বসে জানতে পারলাম ব্যাংকক থেকে লন্ডন যাবে হেলসিংকিতে ট্রানজিট নিয়ে। ট্রাভেল টাইম বাড়বে তবে খরচ অনেকটা কম পড়বে।এর মধ্যে ঘটে গেল টুইনটাওয়ারে হামলার ঘটনা। আমি তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বললাম অন্যান্যরা তো ব্যাংকক থেকে হেলসিংকির ট্রানজিটসহ ট্রাভেল করবে। আমিতো ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যের ভিসা নিয়ে এসেছি। সুতরাং আমার বিষয়টা তুমি খোঁজ নিও। প্রয়োজনে আমার ট্রানজিট ভিসার ব্যবস্হা করো।ভদ্রলোক বিষয়টাকে খুব একটা পাত্তা দিতে চাইলেন না।বললেন মাত্র দেড়-দুই ঘন্টার ট্রানজিট হবে, ভিসার প্রয়োজন হবে না।তারপরও পীড়াপীড়িতে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ভিসা অফিসে গেলেন কিন্তু সেদিন অফিস বন্ধ। এদিকে পরদিনই লন্ডনের যাত্রাকাল।আমার মন কেন বলছিল কিছু একটা ঝামেলা হতে পারে। তাই একটু রাগ করে বললাম যে সময়মত তো গেলে না।এখন এক কাজ করো মেইল করো সংশ্লিষ্ট সকলকে আমাদের লিস্টসহ।ভদ্রলোক কথাটা রাখলেন। পরদিন সন্ধ্যায় ব্যাংকক এয়ারপোর্টে রওনা হলাম সবাই মিলে।দারুণ একটা উত্তেজনা কাজ করছে ভিতরে। প্রথম ইউরোপ যাত্রা। গাড়িতে অনেক মজা করলাম। বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তা -থাইল্যান্ড, চীন,মালয়েশিয়া,ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, জাপান,দক্ষিন কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, শ্রীলন্কা,নেপাল সবাই মিলে হৈচৈ করতে করতে এয়ারলাইন্সের কাউন্টারের লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম বোর্ডিংপাস নেয়ার জন্য। আমার সময় আসতেই কাউন্টার থেকে জিজ্ঞেস করলো তোমার আর লাগেজ কোথায়?আমি বললাম আমার লাগেজ একটাই।তারপর জানতে চাইলো ট্রানজিট ভিসা কোথায়? আমি বললাম সর্ট ট্রানজিট, ভিসা নেয়া হয়নি।সে ট্রানজিট ভিসা ছাড়া বোর্ডিংপাস দিবে না জানিয়ে দিলো।তখন ইন্সটিটিউটের কর্মকর্তাকে ডাকলাম।যাকে আগে ট্রানজিট ভিসা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম।সেও অনুরোধ করলো।কাউন্টার থেকে জানানো হলো যে অপেক্ষা করতে হবে। তারা হেলসিঙ্কিতে কথা বলবে।কিছু সময় পরে জানালো, হেলসিংকি থেকে জানানো হয়েছে ট্রানজিট ভিসা ছাড়া বোর্ডিংপাস দেয়া যাবে না।এর মধ্যে এক ভদ্রলোক আমার কাছে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলো কি সমস্যা। উনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা।পৃথিবীর বড় বড় এয়ারপোর্টে সাহায্য করার জন্য এরকম কর্মকর্তা থাকেন।উনি বললেন তোমার এটা কোন সমস্যা নয়, এতো সর্ট ট্রানজিটে ভিসার প্রয়োজন হয় না।তোমাদের মেইল আমি পেয়েছি। তোমার নাম তো প্রথমেই আছে। সেও অনুরোধ করলো। কিন্তু কাজ হলো না।ইতোমধ্যে অন্যরা বোর্ডিংপাস পেয়ে গেছে, ফ্লাইটের সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। আমি থাই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে আমি কি করবো?ভদ্রলোক আমাকে আশ্বস্ত করলো যে থাই এয়ারওয়েজের একটা টিকেট সে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। ওটা সরাসরি লন্ডন যাবে। দাম বেশি। তবে কোন সমস্যা হবে না।একটু পরে আমাকে থাই এয়ারওয়েজের কাউন্টারে দাঁড় করিয়ে ওনারা বিদায় নিলেন। কাউন্টারে কোন ভীড় নেই।পাসপোর্ট, টিকেট দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।একটা মেয়ে কাজ করছে কাউন্টারে।দেখি সে সময় নিচ্ছে। একটু পরপর আমাকে জাস্ট অ্যা মিনিট স্যার বলছে আর থাই ভাষায় ফোনে কোথায় যেন কথা বলছে।হঠাৎ দেখি থাই ইমিগ্রেশন পুলিশের দুজন কর্মকর্তা এসে হাজির।সম্ভবত পরিদর্শক পর্য্যায়ের হবে।এসেই আক্রমণাত্বকভাবে প্রশ্ন করা শুরু করলো।নাম কি,দেশ কোথায়, কোথায় যাবো,কেন যাবো, শুধু হ্যান্ড লাগেজ কেন, ন্যাশনাল আইডি কোথায়, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি সব বলছি। কিন্তু তারা কোনকিছু শুনতে রাজি নয়।দুটো বিষয়ে তারা সিরিয়াস হয়ে গেল, কেন আমি শুধু হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে যাচ্ছি?আর কেন আমার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই?আমি জানালাম যে আমাদের দেশে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হয় না(তখনও আমাদের দেশে জাতীয় পরিচয়পত্র চালু হয়নি)।সর্ট ট্রিপে যাচ্ছি, তাই বড় লাগেজ নেইনি।আমার পরিচয়পত্র,ইন্সটিটিউটের পরিচয় পত্র, সরকারি আদেশ নানান জিনিস দেখালাম।কোনকিছুতেই তারা মানছে না। মাঝে মাঝে ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তারা আমাকে কাস্টোডিতে নিবেই।মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করে লাগেজে কি আছে? দেখাতে চাইলে লাগেজের কাছে যেতে দিচ্ছিল না।এমন ভাব করছে যেন ওটার ভিতর বোমা আছে, কাছে গিয়ে আমি ফাটিয়ে দিবো।মনে হচ্ছিল যে আমি টুইনটাওয়ারে বোমা মেরে ব্যাংকক হয়ে লন্ডন পালিয়ে যাচ্ছিলাম।তাদের মারমুখী আচরণে নিজের নার্ভ ঠিক রাখা তখন কত যে কঠিন ছিল সে কথা এখনো মনে পড়লে শরীরে কাঁটা দেয়। মনে মনে নিজেকে বলছিলাম যে নার্ভাস হওয়া যাবে না।নার্ভাস হলেই শেষ। সারা পৃথিবীর বিখ্যাত এয়ারপোর্টগুলোতে তখন রেডএলার্ট চলছিল। আমি মুসলিম, ইয়াং, হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে লন্ডন যাচ্ছি। সবকিছু দুয়ে দুয়ে চার মিলাচ্ছিলো ওরা। মাঝে মাঝে একজন কাছে ডাকে, আর একজন বলে দূরে দাঁড়াও।ভাব এমন করে যেন আমার কাছে বোমা-টোমা কিছু থাকতে পারে।এরকম ঝাঁকাঝাঁকি করতে করতেই প্রায় আধাঘন্টা পেরিয়ে গেছে। এয়ারপোর্টের এসির মধ্যেও ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছছিলাম।তারা নিজেদের মধ্যে কিছু একটা শলাপরামর্শ করে। আবার নতুন করে জিজ্ঞেস করা শুরু করে।এর মধ্যে একজন গিয়ে আর একজন যোগ দেয়। সময় চলে যাচ্ছিল। মনে মনে ভাবছি এদের হাত থেকে নিস্তার পেলেও ফ্লাইট মিস করলে ফিরে যাবার বিড়ম্বনাও কম নয়।কারন সবই আমার কাছে নতুন। কি করবো কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না।শুধু মনে মনে বলছিলাম কিছুতেই ওদের সঙ্গে যাওয়া যাবে না। ঐ সময় হঠাৎ মনে হলো সেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার কথা।তৎক্ষনাৎ ওদেরকে বললাম যে তোমরা যদি আমার কথা বিশ্বাস না করো তাহলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে ডাকো।উনি আমাকে জানেন।সাদা চামড়ার কথা বলায় দুজন নিজেদের মধ্যে কিছুটা আলাপ করে নিলো।তারপর একজন আমার পাহারায় থেকে অন্যজন চলে গেলো।কিছু সময় পরে দেখি সেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা সঙ্গে আর একজন ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে এলেন।এসে সঙ্গের ভদ্রলোককে আমার সংগে পরিচয় করে দিলেন। সংগের সেই ভদ্রলোক সিনিয়র থাই ইমিগ্রেশন অফিসার।তিনি তখন ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করা শুরু করলেন। সমস্যা কোথায়?পাসপোর্টে কোন সমস্যা আছে? ওরা বললো নেই।তাহলে আটকিয়েছো কেন?তাদেরকে দিলেন ধমক-জানো উনি কে?উনি বাংলাদেশ গভর্মেন্টের হাই অফিসিয়াল। উনি বাংলাদেশ গভর্মেন্টকে রিপ্রেজেন্ট করছেন।উনি যদি কমপ্লেইন করেন তাহলে কি অবস্থা হবে জানো?আমি হাই অফিসিয়াল নই।আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ইটস ওকে।ভদ্রলোকের ধমকের চোটে একজন পুলিশ ইতোমধ্যে সরে পড়েছে।আর একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্যরি স্যার,স্যরি স্যার বলছে।উনি আবার ধমকের সুরে পাসপোর্ট ভালো করে চেক করার কথা বললেন। সঙ্গে সঙ্গে ইমিগ্রেশন ইনস্পেক্টর বলে উঠলো,স্যার, পাসপোর্ট ঠিক আছে স্যার।তাহলে বোর্ডিং এর ব্যবস্হা করো।তখন সময় মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে।সিনিয়র অফিসার আর সেই ইউরোপিয়ান কর্মকর্তাআমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেলেন।আমি তখন ইন্সপেক্টরকে বললাম দেখো, আমি তোমাদের এয়ারপোর্টের কিছু চিনি না,তুমি আমাকে সাহায্য করো।ভদ্রলোক আমার লাগেজ নিজে হাতে নিয়ে,স্যার, আমাকে ফলো করেন বলে প্রায় দৌড় শুরু করলেন।তখন এয়ারপোর্টে একটা ফি দিতে হতো।পন্চাশ বাথ পকেট থেকে বের টেলর মেশিনে দিয়ে টিকেট নিয়ে আবার প্রায় দৌড় শুরু করলো।আমাকে টাকা দেয়ার সুযোগই দিলো না।এয়ারক্রাফটের কাছে গিয়ে দেখি দুজনের আর একজন সেখানে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। মনে হয় অনুরোধ করে এয়ারক্রাফটের দরজা খোলা রেখেছিল।আমি পৌঁছামাত্র দরজা লেগে গেল।উঠে দারুণ একটা সিট পেলাম। ত্রিসিটারে আমি একা।টেনশনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিলো। ডিনার সেরে লম্বা হয়ে দিলাম ঘুম।হঠাৎ খোঁচা খেয়ে ঘুম ভেংগে গেল। দেখি সকাল হয়ে গেছে। পিছনের সিটের এক বাচ্চা আমার পিছন দিকে খোঁচা মারছিল আর ড্যাড,ড্যাড বলছিলো। উঠে পিছন ফিরে তাকাতেই বাচ্চার মা একটু সলাজ হাসি দিয়ে বাচ্চাটিকে বসিয়ে দিয়েছিল।

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge