প্রথম প্রেমের গল্প
নূর হোসেন
তৃতীয় শ্রেনীর বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট হবে আজ।সবাই যাচ্ছে রেজাল্ট আনতে,তুষার খেলছে ফুফাতো ভাই হাফিজুরের সাথে।কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তার সেদিকে। সহপাঠিরা জিজ্ঞেস করে কিরে রেজাল্ট আনতে যাবি না ?
তুষার বলে নাহ্ ,যাবো না।আমি তো ফার্স্ট হবো। তুষারের জবাবে সবাই তা ইয়ার্কী মনে করলেও তুষারের মনে ইতমধ্যেই আত্মবিশ্বাস জন্মেছে যে, তার ক্লাসে তারচেয়ে ভাল ছাত্র আর নাই,এবং তা এতটাই সিরিয়াস ভাবে ভেবেছে যে,স্কুল থেকে ফেরার পথে সবাই তাকে প্রথম হওয়ার সংবাদ জানালেও বরাবরের মতো তার কোনো অনুভূতি পরিলক্ষিত হয়না। এভাবে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যšত তুষার একটানা ফার্স্ট হয়েই যায়।
তুষারকে আজ বেশ উৎফুল মনে হচ্ছে। হাইস্কুলে ভর্তি হবে। নেভী ব্লু কালারের নতুন প্যান্ট আর সাদা শার্ট ইন করে পরেছে। মাথায় মা এমন ভাবে শরিষার তেল দিয়ে দিয়েছে যা প্রায় দুই চিবুক দিয়ে বেয়ে বেয়ে পড়ছে।
বেশ ক’দিন থেকে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে তুষার। প্রধান সড়কের কাছে তার হাইস্কুলটি হওয়ায় ভালই হয়েছে। সব সময় চলাচলকারী বাস গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে সে। কারণ,এর আগে যে স্কুলে পড়েছে সেখানে বাস চলাচলের কোন রা¯তা ছিল না। ওদের ক‘জনের দুষ্টমি ছিল,লোকাল বাস গুলো এসে সেই স্টেশনে থামলে তারা বাসের পিছনে উঠে বসে থাকতো,্যখন বাসটি ছেড়ে দেয়ার সময় হতো তখন লাফিয়ে নেমে যেতো। একদিন তাদের নামতে একটু দেরী হওয়ায় গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পরে লাফ দেওয়ার ফলে হাঁটুর চামড়া উঠে যায়,যার জন্য বেশ ক’দিন স্কুল যেতে পারেনি সে। এজন্য স্কুলের ম্যাডামের বেত্রাঘাতও খেতে হয়েছিল। এমনিভাবে দুই বছর ভালই কেটে যায়। এরই মধ্যে সংসারে অনটন শুরু হলে বড় ভাই তুষারকে হাল চাষ করতে বলে।
তুষার প্রথমে আপত্তি জানায় কিšতু কোন কাজ হয় না। পরে অনেকভাবে অনেক জনকে দিয়ে বড়ভাইকে বুঝানোর পরেও কোন কাজ না হওয়ায় বাধ্য হয়েই কৃষিকাজে মনোনিবেশ করতে হয়। দিনে দিনে তার কাজে সন্তুষ্ট হতে থাকে বড় ভাই। একটানা কাজের মধ্যেও পড়ার ইচ্ছাটা একটুও নষ্ট হয়নি তুষারের। একটু সুযোগ পেলেই সে বই পড়া অব্যাহত রাখে। বড়ভাই চায় যে তুষার পুরোদমে কৃষক হয়ে যাক।উপায়াšতর না পেয়ে সে প্রকৃত কৃষকের মতই কাজ করতে থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলে একাধারে কাজ আর কাজ। মহিষ দিয়ে হাল চাষ করা,মহিষকে ঘাস খাওয়ানো,জমিতে ধান লাগানো,ধান কাটা,পাটের জাগ দেওয়া,পাট ধোয়া। আর এর সবগুলো কাজেই তুষার ছিল বিশেষ পটু।
দিনে দিনে একাজগুলো তুষারের ভাল লাগতে শুরু করে। তবে তার খুব খারাপ লাগতো তখন, যখন সে কাজ করতো আর তার সামনে দিয়ে সহপাঠিরা স্কুলে যেতো।
শীতের সকাল,তুষার উঠোনে বসে রোদে শরীরটাকে গরম করছিলো। গ্রাম সম্পর্কের চাচা বেলাল এসে বলল, ভাতিজা কি ভর্তি হয়েছো ?
না চাচা, আমার আর পড়াশোনা করা হবে না।
কেন চাচা ?
আমার বই খাতা বড়ভাই তুলে রেখেছে চাচা। আমাকে হাল চাষ করতে বলে তাই আমি হাল চাষ করা শুরু করেছি।
কী কও বাপ ?পড়া বন্ধ করলে হবে ?
এ ছাড়া আর উপায় কী বাপ ? গরিবের আবার পড়াশোনা !
না চাচা,তোমাকে আজকেই আমার সাথে যেতে হবে,আমি তোমার জন্য লজিং ঠিক করে রেখেছি।তোমার পড়াশোনা বাদ দেয়া হবেনা।
রাজী হয়ে যায় তুষার। কারণ পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তার এতটুকুও কমেনি। আর এজন্য সে খরচের টাকা বাচিয়ে একটা ছাগল কিনে রেখেছে।
পরদিন সে তার সেজোভাই এর সাথে পরার্মশ করে ছাগলটি বিক্রি করে বেলালের সাথে চলে যায় লজিং বাড়ি।দুটো বাচ্চাকে পড়ানো,সকাল বিকাল ইরিক্ষেতে পানি দেয়া সহ অনেক কাজ করা লাগলেও পড়াশোনার জন্য এর সবকিছু মেনে নেয় তুষার।হাফ ফ্রি তে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয় নতুন স্কুলে।বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে তুষারের মেধা তার স্কুলের বিএসসি শিক্ষক দীলিপ সাহার নজরে পড়ে।দীলিপ স্যার তাকে ডেকে বি¯তারিত জানতে চায়।তুষার তার পারিবারিক অবস্থা,লজিং বাড়ির সমস্যা বি¯তারিত বললে দীলিপ স্যার ওনার মেসের পাশে তুষারের জন্য নতুন একটা লজিং এর ব্যবস্থা করে এবং একটা টিউশনি ঠিক করে দেয়।তুষার লজিং বাড়ির একটা বাচ্চাকে পড়ায় আর বিকেল বেলা টিউশনি করায়।টিউশনিতে যা পায় তাই দিয়ে তার মাসের খাতা কলম কেনার খরচা হয়ে যায়।এর কিছুদিন পর ঘটে যায় আর এক ঘটনা।তুষারের পূর্বের ¯কুলের গাজিয়ার বিএসসির সাথে শহরে দেখা হলে গাজিয়ার স্যার তাকে স্কুল ত্যাগ করতে নিষেধ করে।এমনকি তাকে স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে রেজিস্ট্রেশনের জন্য ছবি তুলে ছবির রিসিভ কপি নিয়ে যায়।চিšতায় পরে তুষার।কি করবে ভেবে পায়না ।একদিকে দীলিপ স্যার অন্য দিকে গাজিয়ার স্যার।কোনো স্যারের কথাই ফেলতে পারবেনা সে।পরে বাধ্য হয়ে দীলিপ স্যারকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললে দীলিপ স্যার অনুমতি দেয় পুর্বের স্কুলে রেজিস্ট্রেশনের জন্য।কিন্তু লজিং এবং টিউশনি চেঞ্জ না করার শর্তে।তুষার দীলিপ স্যারের কথামত ওখানে থাকে আর পড়ে পুর্বের স্কুলে।
লজিং,টিউশনি,স্কুল ভালোই চলছে তুষারের।এভাবে চলে যায় এক বছর।তখন সে দশম শ্রেনীর ছাত্র।একদিন তার স্কুলে সাপুড়ে আসে খেলা দেখাতে।সকল ছাত্র-ছাত্রী ভিড় করে সাপের খেলা দেখতে।হঠাৎ তুষার খেয়াল করে তার সোজা বিপরীত দিকে তার সামনা সামনি সম্পর্কে চাচাতো বোন রানু সাপের খেলার ফাঁকে ফাঁকে তার দিকে বার বার তাকাচ্ছে।তুষার ব্যাপারটি বুঝতে পেরে স্থান ত্যাগ করে অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করে আবার রানু তার সামনা সামনি দাঁড়িয়ে তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে এবং কিছু একটা বলবে বলবে ভাব।সাপখেলা শেষ হয় কিন্তু তুষারের চিšতা শুরু হয়।ভাবনায় ডুবে যায়।কোন কিছুতে মন বসেনা।রানু কেনো তার দিকে এভাবে তাকিয়েছিলো,কি বলতে চেয়েছিল সে ?কারণ তুষার রানুকে খুব পছšদ করতো।সব সময় সে রানুর চলাফেরা খেয়াল করতো।যখন সে হালচাষ করতো তখন বিভিন্ন ছুতোয় সে রানুদের বাড়িতে যেতো।আর রানুর বড়ভাই শাহ্জাহান তুষারের সাথেই পড়তো।কিন্তু যখন তুষার স্কুল পরিবর্তন করে তখন শাহ্জাহানও স্কুল পরিবর্তন করে পাশের থানার স্কুলে ভর্তি হওয়ায় এখন তেমন ছুতো খুঁজে পায়না ঘন ঘন তাদের বাড়িতে যাওয়ার।কয়েকদিন পর সে লজিং বাড়িতে কোন একটা প্রয়োজনের কথা বলে কয়েক দিনের জন্য বাড়িতে আসে।
রানুদের বাড়ি তুষারের বাড়ি থেকে একটু দুরে হওয়ায সেদিন আর দেখা হয়না।পরের দিন বিকেলে রানুদের বাড়িতে গেলে তার মধ্যে আগের চেয়ে কিছু একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে তুষার।এতোদিন রানু তার পছন্দের মধ্যে থাকলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি সে।রানুর মা বরাবরই তুষারকে খুব ভালবাসতো,বাবাও।মাঝে মাঝে তুষারকে বলতো সময় পেলে রানুর পড়াশোনার খোঁজ নিতে।এবার সে সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায় না তুষার।তখন থেকে তুষার বাড়িতে এলে সময় পেলেই ষষ্ঠ শ্রেণীর রানু এবং তার বোন সাবিনাকে পড়ানোর জন্য তাদের বাড়িতে যেতো।একদিন তুষার পড়ানো শেষে চলে আসার সময় খেয়াল করে রানু কিছু একটা দেয়ার জন্য বার বার সুযোগ খুঁজে কিন্তু বাড়ির অন্যান্য লোকজনের জন্য দিতে পারছে না।একসময় সুযোগ বুঝে দৌড়ে এসে তার হাতে একটি কাগজ দিয়ে বলে ”ভাইজান উত্তর দিয়েন”।কাগজ হাতে পেলো নাকি আকাশের চাঁদ হাতে পেলো এমন অবস্থা তুষারের।আর কোথাও দেরী না করে সোজা বাড়িতে চলে আসে।এত∂ণে তার মনে হয় সে একটি হীরের টুকরা বয়ে বেড়াচ্ছে।কারণ,রানুর এ কয়দিনের আচরণে সে বুঝেই ফেলেছে যে তার জন্য পজেটিভ কিছু একটা হবে।
নির্জনে গিয়ে কাগজটি খোলে তুষার।
”আমি আপনাকে ভালবাসি”
একটি লাইন তুষারের মনে কঠিন তুফানের সৃষ্টি করে।
কিভাবে উত্তর দেবে ভেবে পায না সে।
প্র¯তাবটি এতদিনে তারই ছিল কিন্তু সে কখনো বলতে পারে নি, আজ সে রানুর কাছ থেকে এমন প্র¯তাব পেয়ে আনন্দে আত্মহারা ।