প্রত্যাবর্তন
শাহেদুজ্জামান লিংকন
জুম্মার নামাজ শেষ। কোনো কোনো মুসল্লী মসজিদ থেকে বের হতে শুরু করে। কেউ মিলাদে অংশ নেয়। কেউ মাজার জিয়ারত করে। প্রতি শুক্রবার বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসল্লীরা নিয়ত করে নামাজ আদায় করতে আসে কেরামতিয়া জামে মসজিদে। ভিক্ষুকদের সংখ্যাও বেড়ে যায় এদিন। যারা নিয়মিত এখানে ভিক্ষা করে তারা তো থাকেই তাছাড়া শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ভিক্ষুকেরা দু’টা টাকা বেশি পাবার আশায় মসজিদের সামনে ভিড় জমায়। ওরা লাইন ধরে দাঁড়ায়। বাম সারি আর ডান সারি। যারা আগে আসে তারা সারির প্রথমদিকে দাঁড়ায়। প্রথমদিকে দাঁড়ালে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আনজুর আজ আসতে বেশ দেরি হয়ে গেল। ওর মা দীর্ঘক্ষণ থেকে ওকে তাড়া দিচ্ছিল। ধুমসি টপ করি যা। কিন্তু আনজু একটু ঢিলা প্রকৃতির। ওর মায়ের ধারণা অন্ন ধ্বংস করা ছাড়া আনজুর আর কোনো কাজ নেই। সবে বারোতে পা দিয়েছে ও। কিন্তু ওর মায়ের দৃষ্টিতে বিশ পেরিয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। তাই তাকে তাড়ানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। তাড়ানো মানে বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে স্থানান্তরিত করা। ডানদিকের সারিতে ওর অবস্থান অষ্টম। হাতে প্লাস্টিকের থালা। ডানদিকে তাকাতেই ওর দৃষ্টি আটকে যায় এক বৃদ্ধ ভিক্ষুকের প্রতি। এ ভিক্ষুককে এখানে আজ প্রথম দেখলো ও। এর আগে কোথায় যেন দেখেছে। ঠিক মনে করতে পারে না ও। ভিক্ষুকের গলগণ্ড রোগ আছে। গলায় ঝুলে আছে একটা মাংসল পিণ্ড। বৃদ্ধ ভিক্ষুক সুর করে কালেমা পড়ছে। ভিক্ষা চাইছে ছন্দে ছন্দে। এক টাকা করিলে দান, পরকালে পাবে হাজারো সমান। বৃদ্ধের অবস্থান সারিতে চতুর্থ। আনজুর দৃষ্টি ওদিকেই পড়ে থাকে। কারণ আছে। প্রায় সবাই বৃদ্ধের থালায় টাকা দিয়ে যাচ্ছে।
আনজুর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তখন, যখন দেখে এক মুসল্লী বৃদ্ধ ভিক্ষুকের থালায় একটা একশত টাকার নোট দান করে। লোকটা পকেট থেকে টাকা বের করতেই একশত টাকার নোটটা বের হয়ে আসে। কোনো দ্বিধা না করেই তা দান করে দেয় ভিক্ষুককে। বৃদ্ধ ভিক্ষুক টাকার প্রতি উদাসীন। থালায় নজর নেই। একশত টাকার নোটটার দিকে একমাত্র নজর আনজুর। এরকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না। যারা বেশি টাকা দেয়ার নিয়ত করে আসে, তারা মাজারে দেয়। ভিক্ষুকদের ভাগ্যে সর্বোচ্চ বিশ টাকা। আনজুর মনে পড়ে ওর মায়ের কথা। ওর মা এখানে থেকে এ ঘটনা দেখলে প্রতিবাদ করে বসতো। দানকারীর পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলতোÑকামটা ঠিক করনেন না। হামাক টাকা না দিয়া একজনকাকে একশো টাকা দেনেন? প্রতিবাদ করা আনজুর মায়ের স্বভাব। কেউ একজনকে বেশি টাকা দিয়ে আর কাউকে না দিলে আনজুর মায়ের পিত্তি জ্বলে যায়। যে পায়, সে বাঁকাচোখে তাকায় আনজুর মায়ের দিকে কিন্তু কিছু বলতে পারে না। কারণ আনজুর মাকে এখানে সবাই ভয় পায়। আনজুর মায়ের তেজটা তারা দেখতে পারছে না; বেচারি জ্বরে পড়েছে বলে। হালকা জ্বর হলে ঠিকই আসতো। ভীষণ জ্বর। কয়েকদিন থেকে তাই আনজুই একমাত্র ভরসা ওর মায়ের।
মুসল্লীদের যাওয়া শেষের দিকে। ভিক্ষুকরাও চলে যেতে শুরু করে। আনজুর দৃষ্টির বাইরে এখনো যায়নি ওই বৃদ্ধ ভিক্ষুক। আনজুর বড়ো লোভ হয় বৃদ্ধের থালায় জমে থাকা টাকাগুলো দেখে। এতোগুলা ভিক্ষা পাছিস বুড়া! সবার চায়া বেশি। বৃদ্ধ এবার বসে টাকাগুলো গুনতে শুরু করে। আনজু সেদিকে একমনে চেয়ে থাকে। বৃদ্ধের গোনার আগেই আনজু মনে মনে একবার গুনে ফেলে বৃদ্ধের থালার টাকাগুলো। দুইশত তো হবেই। আনজু লক্ষ্য করে বৃদ্ধ ভিক্ষুক টাকাগুলো মনে হয় গুনছে না, গোছাচ্ছে। কোনটার পর কোন টাকার নোট দিচ্ছে ঠিক নেই। আনজু আর বৃৃদ্ধ ভিক্ষুকের দূরত্ব চারহাতের বেশি নয়। কিন্তু ভিক্ষুক একবারও অন্যদিকে তাকায় না। আনজুর বুকটা ধুক করে ওঠে, যখন ও দেখতে পায় একশত টাকার নোটটা বৃদ্ধের হাত থেকে ফসকে গিয়ে হালকা বাতাসে উড়ে বৃদ্ধের ডানপায়ের পেছনে পড়ে থাকে। আনজুর জিহ্বাটা লিকলিক করে ওঠে। ইস! বুড়া যদি টাকাখান ছাড়ি গেইল হ্যায়। আনজুর বাসনা পূর্ণ হয়। টাকাটার দিকে নজর পড়েনি বৃদ্ধের। বৃদ্ধ উঠে চলে যেতেই আনজু গিয়ে ডান পা দিয়ে নোটটাকে চাপা দিয়ে রাখে। এদিক ওদিক তাকায়। দু’একজন লোক এখনো আছে আশেপাশে। হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে একশত টাকার নোটটা পায়ের নিচ থেকে বের করে নিয়ে পায়জামার গোঁজের মধ্যে চালান করে দিয়ে জোরে হাঁটা দেয় বাড়ি অভিমুখে।
জুম্মাপাড়ায় ওদের ছোটো ছাপড়া ঘরটার কাছে পৌঁছতেই আনজুর মনে পড়ে ওর মা আসার সময় কাচারী বাজার থেকে জ¦রের ঔষধ আনতে বলেছিল। একশত টাকার নোটটা পাওয়ার আনন্দে এতক্ষণ তা ও ভুলে গিয়েছিল। এখন মায়ের আরেক দফা গালি খাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। ওর মা টাকা বাঁচানোর জন্য এতদিন ঔষধ খায়নি। কিন্তু জ্বরটা এখন এত বেশি যে আর সহ্য করতে পারছে না। ঘরে ঢুকতেই ওর মা জিজ্ঞাসা করেÑকিরে কয়টাকা পালু? আনজু যেন মনে মনে খুশি হয়। ঔষধের কথা মনে হয় ওর মা ভুলেই গেছে। জ্বরটা একটু কমেছে বোধ হয় তবে এখনো শুয়েই আছে বিছানায়। আনজু বলেÑসোয়াত্তর টাকা আর তিন টাকা আর… বলে থেমে যায় আনজু। ওর মা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেÑথামলু ক্যা? সত্য কথা কবার চাইস না না? টাকা চুরি করি কী ভাতারের জন্যে জমাইস মাগি? আনজু এবার আর স্বীকার না করে পারে না। একশত টাকার নোটটা পাওয়ার কথা বলে। নিজের ভাগ্যের প্রশংসা নিজেই করে। ওর ভাগ্য ভালো না হলে কী আর ওভাবে টাকাটা ফেলে চলে যায় বুড়োটা? এবার বৃদ্ধ ভিক্ষুকের বর্ণনা শুরু করে আনজু। কী সুর করি কলমা পড়ে মা! সবায় টাকা দেয় বুড়াটাক। কোটে বা দেকচিনু বুড়াটাক। লম্বা দাঁড়ি। গালাত একটা ঘ্যাগ। আনজুর মা এবার বিছানা থেকে তড়িৎ বেগে উঠে বসে। কী কলু? গালাত ঘ্যাগ আছে? লোকটা কী লম্বা করি? আনজু সায় দেয় আর বলে লোকটাকে ওরও চেনা চেনা লাগছিল কিন্তু মনে করতে পারছিল না কোথায় দেখেছে। ওর মা এবার বলেÑকপালোত কি একটা কাটা দাগ দেকচিস? আনজুর ঠিক মনে পড়ে না। আর কপালের দিকে ভালোভাবে তাকায়ও নি। তবু সায় দেয়Ñহ্যাঁ মা কপালোত একটা কাটা দাগ আছলো। ওর মা একদম উঠে দাঁড়ায় এবারÑহারামজাদী তর বাপরে ভি চিনবার পারোস নাই? তরে আজ এমুন ঠেঙ্গানি দিমু। আনজু এবার অবাক হয়। কী বলে ওর মা? ওর বাপ না মারা গেছে সেই দশ বছর হলো? মাথাটা পরিষ্কার হলে আনজুর মনে পড়ে ওই লোকটাকে আসলে ও কোথাও দেখেনি, লোকটার বর্ণনা শুনেছে। ওর বাপের কী নিখুঁত বর্ণনা দিতো ওর মা! লম্বা দাঁড়ি। উজ্জ্বল গায়ের রঙ। গলায় গলগণ্ড। সুর করে কালেমা পড়ে। এত সুন্দর সে সুর যে লোকজন ভিক্ষা না দিয়ে পারে না। আরো কত গুণ তার বাপের! কত অভিনয়ও জানতো ওর বাপ! একবার খোঁড়া সাজে, একবার অন্ধ সাজে। একবার লাশ সেজে ওর মাকে দিয়ে অনেক ভিক্ষা করিয়েছে। এসব কথা ওর মায়ের মুখে প্রায়ই শোনে আনজু। অথচ তখন মনে পড়ল না। ওর মা ওর বাপের গল্প করতো আর হাসতো। গর্ব করতো ওর বাপকে নিয়ে। শেষের দিকে এসে শুধু চোখ দিয়ে একটু পানি গড়িয়ে পড়তো।
আনজুর বাবা-মা ভিক্ষা করতো পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকায়। আনজুর বয়স তখন দুই বছর। ওর বাবা বরিশালের এক পীরের মুরীদ ছিল। একবার পীরের ওরস শরীফে গিয়ে উধাও হয়ে গেল। এদিকে ওর মা সদরঘাট এলাকায় অপেক্ষা করছিল কবে আসবে। বারো দিন পর ওর মা স্বপ্ন দেখল, ওর বাবা মারা গেছে মুরীদদের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে। তারপর দিন ওর মা ঘোষণা করলো যে, আনজুর বাবা মারা গেছে পীরের দরবারে গিয়ে। আর মারা গিয়ে বেহেশ্ত পেয়ে গেছে। এই নিয়ে আনজুর মায়ের কত গর্ব! ওর মা অনেক ভালোবাসতো ওর বাবাকে। সদরঘাটের আলতাফ ভিক্ষুকের নজর পড়ল ওর মায়ের প্রতি। আলতাফ এর আগে বিয়ে করেছে সাতটা। এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক বলে ছয়জনকেই তাড়িয়েছে। আলতাফকে ঘৃণা করতো আনজুর মা। আনজুর মা ওর বাবাকে ভালোবাসতো, শ্রদ্ধা করতো। তার শ্রদ্ধাটা আরো বেড়ে গিয়েছিল লোকটা মারা যাওয়ার পর। যার স্বামী বেহেশতে গেছে, সে কিনা দ্বিতীয় বিয়ে করবে দেহলোভী এক ভিক্ষুকের সাথে? তখন ওর মা চলে এসেছিল রংপুরে। এসব কথা আনজু শুনেছে ওর মায়ের মুখে।
আনজু এবার প্রশ্ন করে ওর মাকেÑমা তোমরা না কছনেন আব্বা মরি গেইছে। বেহেশ্তে গেইছে।
: মরছে তো কী হইছে? মরা মানুষ কি জিন্দা হইবার পারে না? হ্যায় তো বেস্তে গেছে। বেস্ত থন আসা হ্যার কাছে ব্যাপার হইলো? আমি কি হ্যারে ভালোবাসি নাই? সোহাগ করি নাই? করি নাই সোহাগ? আমি কি হ্যার সম্মানের লাইগা নিজের জায়গা ছাইড়া আসি নাই? হ্যায় আমারে ভুলবো ক্যালা?
: মরা মানুষ কি ফির বাঁচে মা? কৌতূহলী দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে আনজু।
: ব্যাকটি পারে না। হ্যায় তো বেস্তে গেছে। বেস্তিদের কথা আল্লায় হুনবো না ক্যালা? আমারে একনজর দেখবার লাইগা হ্যায় আইছে।
আনজু ওর মায়ের দৃঢ় প্রত্যয় ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এত কিছু ওর মাথায় ঢুকছে না। মারা যাওয়া মানুষ আবার কীভাবে ফিরে আসে! আর ওই লোকটাই যে ওর বাবা, তা কী করে নিশ্চিত হলো ওর মা? কিন্তু ওর মায়ের দৃঢ়তার কাছে হার মানে ও। পরক্ষণে ভাবে, ওর বাবা মারা গেছে সেটা তো ওর মায়ের স্বপ্নে দেখা। আসল তথ্য তো ওর মা জানে না। ওর মাকে এখন আর একটুও অসুস্থ মনে হচ্ছে না। ওর মা তাড়া দেয়Ñচল আমার লগে। হ্যায় মনে লয় আমারে খুঁজতাছে। কোনদিকে যাইতে দেখছোস হ্যারে? আনজু বলে, পশ্চিম দিকে। ওর মা ছেঁড়া শাড়ির আঁচলটা মাথায় দিয়ে ওর হাতটা ধরে হনহন করে বাড়ি বলে দাবি করা আশ্রয়স্থল থেকে বেরিয়ে আসে। ওর মায়ের হাঁটার গতির সাথে পাত্তা পায় না আনজু। ও বারবার ওর মায়ের মুখের দিকে তাকায়। বাবা কী জিনিস তা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি আনজু। বাবার আদরের কথা ওর মনে নেই। তবু ওর মনে বাবাকে ফিরে পাওয়ার আকুলতা আঁকড়ে ধরে। ধীরে ধীরে বাবার জন্য সঞ্চিত হতে থাকে দরদ ও ভালোবাসা। কাছের মানুষকে ফিরে পাওয়ার আশায় চোখেমুখে যে উৎকণ্ঠা ফুটে ওঠে, মায়ের মুখের দিকে তাকানোর পর তা আনজু কোনোদিন ভুলবে না।