শুক্রবার, ১৩ Jun ২০২৫, ০৭:১১ অপরাহ্ন

পাঠ প্রতিক্রিয়া: তুমি আমার ইবাদত-মুস্তাফিজ রহমান

পাঠ প্রতিক্রিয়া: তুমি আমার ইবাদত-মুস্তাফিজ রহমান

বইয়ের নাম : তুমি আমার ইবাদত
লেখক : আদিল ফকির
বইয়ের ধরণ : কাব্যগ্রন্থ
প্রচ্ছদ : সারাজাত সৌম্য
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান : মূর্ধন্য
মুদ্রিত মূল্য : ২০০ টাকা

‘রথ মত শেষে-
খুঁজে পাই পথ
তুমি আমারই ইবাদত।’
কবি আদিল ফকির এর অনবদ্য সৃষ্টি কবিতার বই ‘তুমি আমার ইবাদত।’ যার পরতে পরতে প্রেম বিরহ আর অতি প্রাকৃত মানবীয় চাওয়া পাওয়ার সুচারু বিন্যাশ। কাব্যগ্রন্থের নামিয় প্রথম কবিতা ‘তুমি আমার ইবাদত’ পাঠের মাধ্যমেই পুরো কাব্যগ্রন্থের ৮০ ভাগ স্বাদ উপভোগ করে ফেলা যায়। যার শুরুটা হৃদয় কাড়ে-
জপমালার মত জপি তোমার স্তনবৃন্ত
বুকে খুঁজে পাই একটি জায়নামাজ
অর্ধস্ফুট গোলাপের মতোন নাইকুণ্ডল।
এমন সুন্দর কাব্যশৈলী আর উপমায় ভরা পুরো কাব্যগ্রন্থটি। যা পাঠক হৃদয়ে একটি পূর্ণ কাব্যময় তৃপ্তির সঞ্চার করবে। কবিতায় ব্যাবহৃত উপমা, উদ্ধৃতি, সাবলিল বর্ণনায় পাঠক যেমন প্রেম আর বিরহের দোলাচলে ভুগবেন। তেমনি বিভিন্ন বিখ্যাত কবির অনেক কবিতা চোখের সামনে ভেসে উঠবে। যেমন
কবির ‘কষ্ট ভাঙা মেশিন’ কবিতা-
তোমার কষ্ট, আমার কষ্ট
রাধার কষ্ট, লাইলীর কষ্ট
মজনুর কষ্ট, বৃক্ষের কষ্ট..
পড়তে পড়তে হেলাল হাফিজের ফেরিওয়ালার কথা মনে পরবে। কবি অবশ্য নিজেই লিখেছেন-
লাল কষ্ট, নীল কষ্ট – হেলাল হাফিজের সব কষ্ট।
কবির পান্ডুলিপি হারানোর কষ্ট যে সব কষ্ট ছাপিয়ে যায় তাও উঠে এসেছে। কবি নিজেও একজন বিচক্ষণ পাঠক, সাহিত্যের আদি অন্তের খবর যে তার নখদর্পণে তার স্বাক্ষর বিভিন্ন কবিতায় উঠে এসেছে। যেমন- তিনি ‘বাসন্তীর কাছে আবেদন’ কবিতায় লিখেছেন-
কোন এক অচেনা মাঝির অনুমতিতে দুজনের ভেসে যাওয়া। হয়তো-বা হাজার বছর ধরে- টুনি- মন্তর মতোন- এতোটুকুই আমার চাওয়া।
এভাবে প্রেমে, বিরহে, কামনায়, বাসনায় কবিতার ভেলা ভেষে চলেছে অনন্তে। কবির কবিতায় উপমার ব্যাবহার সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। প্রতিটি কবিতাই উপমায় ভরপুর। যা কবিতাগুলোকে সুঠাম ও উপভোগ্য করে তুলেছে। যেমন-
উপত্যকায় আসে ঝর্ণার ঢল
সুখ, সুখ, সুখ, সুখের কোলাহল। (তুমি আমার ইবাদত)।
আমার ভেতরে একটা মিছিল আছে- যা আপনার পদতলে এক নিমিষে শেষ। স্লোগানটা ছিলো মর্মর। (একটি পাতার আত্মকথা)।
সব ঝিঙে ফুল-
গগন সমান ভুল,
ভেসে থাকা মেঘমালা-
অযত্ন এক ভালোবাসা। (অযত্ন ভালোবাসা)।
শুকিয়ে যাওয়া নদী কপোলে বয়-
বৃষ্টির অপেক্ষা-
আর ভালো লাগে না। (দুঃখ)।
ঝুলে আছে হ্যাঙ্গারে বাসন্তীর অ্যাপ্রোন
শ্রাবণ মেঘমালার মতোন- (বাসন্তীর অ্যাপ্রোন)।
কদবেল পাতায় ঝুলে আছে -নিপলের মতো বৃষ্টির ফোঁটা- (দুই কাপ চা এবং একটি চামচ)।
সোনালু ফুলের নোলক হবো
তিস্তা নদীর ভেলা হবো
তোর বাড়ির উঠোন হবো
টিনের চালের বৃষ্টি হবো। (একটি পোকা)।
নিতম্বের এক গালে ( আব্বা ও আমার রাজনীতি)।
আমাকে কুলুখ বানিয়ে
আপনার ছোট মাথায় ধরে- চল্লিশ কদম হাঁটলেন- আবার ছুড়ে দিলেন- (আমি মাটি)।
এমন অসংখ্য উপমা পাবেন কবিতা পড়তে পড়তে। শেষ কবিতায় কবি লিখেছেন-
একবার বুকে নিয়ে-
মুখে বলো-
‘দিলেম একটা তিল’।
সত্যি বলছি-
পাহাড় ভেঙে-
আমি তোমায়-
দিয়ে দেবো
আমার হাতিরঝিল।
এ যেন মধ্য যুগের কবি হাফিজের প্রিয়ার কপোলের তিলের জন্য সমরখন্দ লিখে দেয়ার সামিল।
উপমার পাশাপাশি পুরাতন ও আঞ্চলিক কিছু ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায় কবিতায়। যেমন- ওরা পাথরের বর্ণ কবিতায় লিখেছেন, টালাতে মুড়ি আর গুড় খাচ্ছিল’। এক সময় ধান চাল মাপার জন্য বেতের তৈরি এক ধরনের পাত্র পাওয়া যেত। যাকে আঞ্চলিক ভাষায় টালা বলে। এই টালা এখনো কালে ভাদ্রে দেখা যায়। পানসে কবিতায় লিখেছেন, ‘সেই পাথার। পাথারের পর পাথার।’ পাথার বলতে আমরা বুঝি বিস্তির্ন খোলা প্রান্তর। ‘তেলি বাড়ির ঘানি টানা সরিষার তেল।’ তেলি মানে যারা ঘানি টেনে সরিষার তেল তৈরি করেন। এমন অনেক পুরাতন এবং গ্রামে প্রচলিত উপকরণ ব্যবহার করে কবি যেমন কবিতায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তেমনি এই উপাদান ও ভাষাগুলোও অমর হয়ে থাকবে গ্রন্থটিতে।
আমরা ছোট বেলায় যেভাবে বর্ণমালা শিখেছি সেটিও কবি তার কবিতায় তুলে ধরেছেন। যেমন- ওরা পাথরের বর্ণ কবিতায় লিখেছেন –
হাঁটুভাঙা- দ
কান মুচরি- ধ
পেট কাটা- ষ।
কাব্যগ্রন্থের কিছু লাইন কাপলেট হিসেবে খুব চলবে। বিশেষ করে এই অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে। যেমন-
সেই প্রেমটার নাম ছিলো-
নাম ছিল
এলোমেলো। (একটা প্রেম)
কষ্টের ভেতর কষ্ট আমি,
কষ্ট করি চাষ-
ভেতর ভেতর কিছু কষ্ট,
ফলে বারোমাস। (কষ্ট)।
মন পাড়াতে মনের বাড়ি, ছোট্ট একটা ঘর
সেই ঘরে-তে বাস করে, বড্ড একটা ‘পর’। ( বুকের ভেতর একটা ট্রেন)।
আকাশে তাকাই-
শুন্য
বাতাসে তাকাই-
শুন্য
তোমাকে তাকাই-
শুন্য ( আমার শুন্য ঘরের নামতা)।
সবগুলো কবিতাই সুখপাঠ্য। প্রত্যেকটি কবিতাই আলাদা করে আলোচনা করবার দাবি রাখে। সব বলে দিলে পাঠক পড়বে কী? তাই পাঠকের জন্য রেখে কিছু কবিতা নিয়ে বলি। যেমন- ‘সংসার’ কবিতায় কবি দেখিয়েছেন, যত দৈন্যতাই থাক না কেন তারপরও ভালোবাসাতেই বেঁচে থাকার আসল স্বাদ। নিজেকে গুটিয়ে না রেখে বিলিয়ে দেয়ার মহানুভবতার প্রকাশ ঘটেছে ‘ভাঙতি টাকা’ কবিতায়। ‘কাজলজল কপোল’ কবিতায় সংসারের টানাপোরেন স্পষ্ট হয়েছে।
‘পানসে’ নিতান্তই নিটোল প্রেমের কবিতা। পয়সা অচল হলেও তার মূল্য ঠিকই থেকে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে তা বহুগুণ বেড়ে যায়। এর মাধ্যমে কবি কি বোঝাতে চেয়েছেন পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন ‘কয়েন’ কবিতার মাধ্যমে। ‘একজন নারীর আত্মজীবনী’ কবিতায় কবি নারীকে বয়সের ফ্রেমে আটকে রাখতে চাননি। তার সৌন্দর্য চির অম্লান সেটাই কবি বলেছেন। আমরা প্রতিদিন মাইকে অনেক শোক সংবাদ শুনি। বিদায়ের বার্তা জানায় মাইক গুলো কিন্তু আগমনের সু সংবাদ, জন্মের খবর মাইকে প্রচার হয়না। কবি ‘মাইক’ কবিতায় সেই আক্ষেপের কথাই তুলে ধরেছেন। ‘আমি মাটি’ কবিতায় নিজেকে মাটির সাথে তুলনা করে উদার মন মানসিকতার পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন। এভাবেই ৬৪ পৃষ্ঠার কাব্যগ্রন্থটিতে ৩৯ টি কবিতায় কবি তার কবি মনের কল্পনার বিস্তার ঘটিয়েছেন।
চমৎকার প্রচ্ছদে সুন্দর ঝকঝকে বর্ণবিন্যাসে সুবিন্যস্ত কাব্যগ্রন্থটি হাতে নিয়েই যেমন সুখানুভূতির সৃষ্টি হবে তেমনি সহজ সরল ভাষায় এর কাব্যময়তা পাঠক মনকে তৃপ্ত করবে।
তবে দু একটি কবিতায় সাধু চলিতের মিশ্রণ ও কথ্য ভাষার প্রয়োগ লক্ষ করা গেছে। শেষের দিকের কবিতাগুলোর তুলনায় শুরুর দিকের কবিতাগুলো বেশি শক্তিশালী মনে হয়েছে। প্রথম কবিতা নাম ভুমিকায় সব রকম সমালোচনা উৎরে গেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। এবং শেষের কবিতা পরে পাঠকের মনে কবির নতুন কবিতা পড়ার আকাঙ্খা তৈরি হবে বলেই বিশ্বাস। কবি এবং কাব্যগ্রন্থটির বহুল প্রচার, প্রসার, সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করছি।

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge