১. নিঃশব্দের শহর
এই শহর কথা বলে না, শুধু শোনে।
কাচের জানালায় জমে থাকা ধুলো,
রাস্তার ধারের পুরনো ল্যাম্পপোস্ট,
আর মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বেওয়ারিশ কুকুরটি—
সবাই শোনে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না।
রাত বাড়লে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে,
ছাদের কার্নিশে বসে থাকা কাকটিও
একসময় উড়ে যায় নিঃশব্দের দিকে।
শহরের আলো মিটমিট করে,
কেউ বুঝতে পারে না,
এটি ক্লান্ত চোখের ইশারা,
নাকি অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস।
আমি হাঁটি, নিজের ছায়াকে পেছনে ফেলে,
পা ফেলার শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হয়,
তবে কি শহর সত্যিই নিঃশব্দ?
নাকি আমি শুধু ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি?২. শূন্যের সঙ্গীত
অজানা আকাশের গভীরে কোথাও,
একটি নীরবতা বাজে—
শূন্যতার মাঝে অনন্ত সঙ্গীত,
যার অর্থ শুধু সময় জানে।
তারার আলো, পথিকের ছায়া,
ভাসিয়ে নেয় অতীতের স্মৃতি,
একটি নাম, একটি আহ্বান,
অন্ধকারে লেখা গোপন গীতি।
প্রশ্নেরা জন্ম নেয় বাতাসের মাঝে,
উত্তর লুকিয়ে থাকে ধূলিকণায়,
নশ্বর শরীর, চিরকালীন বোধ,
কেন যে মিলিয়ে যায় অসীম ছায়ায়?
একটি রাত, একটি স্বপ্ন,
একটি গল্পের অর্ধেক পাতা,
যেখানে শূন্যতা পায় নিজস্ব ভাষা,
আর নীরবতা হয়ে ওঠে ব্যাকুল ব্যথা।
তবু সময় বয়ে যায়,
শব্দেরা ফিরে আসে নতুন রূপে,
শূন্যের মাঝেও একদিন খুঁজে নেব,
একটি অর্থ, এক জীবনের সুখের সূর্যে।৩. নির্বাণ
জীবন একটি পাণ্ডুলিপি,
শেষ পৃষ্ঠার শিরোনাম— মৃত্যু।
কালো কালির ক্ষতচিহ্নে লেখা
নিঃশব্দতার মহাকাব্য।
সময়ের কঙ্কালচাপা শব্দে
ফাটল ধরে শ্বাসের দেয়ালে,
মাংসপিণ্ডের বন্দিশালা ভেঙে
শরীর নামে ধূলোর দাবানলে।
রক্ত শুষে নেয় অন্ধকার,
নিস্তব্ধতার শিকড়ে বেজে ওঠে
জীর্ণ হাড়ের শূন্য সংগীত,
একটি দীর্ঘ, গভীর উপসংহার।
মৃত্যু কোনো প্রস্থান নয়,
নয় কোনো অনন্ত শূন্যতা।
এ এক কঠিন সমাপ্তি,
যেখানে সব প্রশ্ন—
একটি একা, অনড় দাঁড়ি।৪. অন্ধকারের গহ্বরে
অলক্ষ্য হাওয়ার মতো তুমি প্রবাহিত,
মৃত্যু আর জীবন মিলিয়ে এক স্বপ্নের ভূবনে,
যেখানে শব্দেরা বিলীন, আর দৃষ্টি—
অমলীন আকাশে ভ্রমণ করে অবিরাম।
ছায়া ও আলোর অদৃশ্য লড়াই,
অন্তর্দৃষ্টি বলে, “এখানে কিছু নেই, তবে আবারও সব কিছু আছে।”
শূন্যতার মাঝে জন্ম নেয় প্রতিটি চিন্তা,
যেমন হোমারের বাণী চিরকাল বেঁচে থাকে।
তোমার পদচিহ্নে, আমি দেখি আলেখ্য—
বাহুতে এক দার্শনিকের চোখের অগ্নি,
শুধু বৃষ্টি আর অন্ধকারের বিপরীতে,
মেঘের মুখে অজানা বাণী লেখা হয়।
পথিকের মতো হেঁটে চলেছি এই অবশীষ পৃথিবী,
যেখানে শূন্যতা পূর্ণতার গহ্বর হয়ে ওঠে,
একটি গীতিকার গাওয়ার চেষ্টা করে অবিরত,
আমাদের অস্তিত্বের ভেলোর মধ্যে, এক মায়ার গল্প।
মনের ভেতর অজস্র অনুক্রিয়া,
ধূলির মতো মুছে না যাওয়া জ্ঞান,
কিন্তু শেষে আমি খুঁজে পাই শান্তির শেষ সুর—
নীরবতার মাঝে এক অমোঘ ভাবনা।
তুমি, সেই গভীর অন্ধকারে,
যেখানে মানবিকতা তার আদি রূপ পায়,
এখানে, সেখানেও, জীবন এক মিথ্যা শব্দ,
কিন্তু চিরন্তন সত্যতা গহ্বরে হারায় না কখনো।৫. শহর যখন ঘুমায়
শহর যখন ঘুমিয়ে পড়ে,
রাস্তাগুলো নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে,
বাতিগুলো হঠাৎ জ্বলে ওঠে—
যেন তারা রাতে একা থাকতে ভয় পায়।
আমি একটা নির্জন স্টেশন থেকে
শেষ ট্রেনের শব্দ শুনতে পাই,
কারা যেন দূরে হাত নাড়ছে,
কিন্তু প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা।
আমার ঘরের জানালায় চাঁদ এসে বসে,
তারপর ধীরে ধীরে নেমে যায়—
বিছানার পাশে, বইয়ের ভাঁজে,
আমার ক্লান্ত হাতের ওপর।
আমার ঘুম আসে না,
শুধু মনে হয়,
শহর হয়তো জেগে আছে,
আর আমি একাই ঘুমিয়ে পড়েছি।৬. সহজশুন্য
সকালের রোদে নদীর বুক জেগে ওঠে,
আমি দেখি, অথচ কিছুই দেখি না—
নৌকার গলুই, জলের ঘূর্ণি,
একটা বক ডানা মেলে উড়ে যায়,
তার ছায়া পড়ে আমার শূন্য হাতে।
শহরের ধুলোয় আমি একলা হাঁটি,
পায়ের নিচে পথ, মাথার উপর আকাশ—
তবু কোথাও বাঁশির সুর বাজে,
তবু কোথাও জলের গন্ধ ভাসে।
শহরের রাস্তায় জল নেই,
তবু ডুবে থাকি প্রতিদিন—
একটা হারিয়ে যাওয়া নৌকা,
একটা কুয়াশাভেজা বিকেল,
একটা নদীর ডাক,
যা আমি কখনোই শুনিনি,
তবু প্রতিদিন শুনতে পাই।৭. মিথের ছায়ায় বর্তমান
পুরনো গল্পেরা বেঁচে থাকে,
কখনো শেকড়ে, কখনো ডালে,
আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষের পাতায় পাতায়
গল্পেরা দোলে বাতাসের সুরে।
আমরা হাঁটি রঙিন রাস্তায়,
মুঠোফোনের আলোয় ভাসি,
তবু কানে বাজে—
মহারথীদের রথচক্রের ঘর্ষণ,
সিন্ধুর ফেনায় ভাসমান কূটবাক্য,
অশ্বমেধের ছুটে চলা ধুলোবালির গল্প।
কে বলে কংসের দিন ফুরিয়েছে?
নতুন কংসেরা রাজপথে দাঁড়িয়ে,
বসনহরণ দেখে— নীরব দর্শক!
কৌশিকী নদী আজও কাঁদে,
দুর্গম গুহায় নির্বাসিত সত্য,
মিথ্যে রাজমুকুট পরে হাসে।
তবু আমরা বিশ্বাস করি—
আগুনের ভেতর জন্ম নেবে কোনো নতুন সীতা,
ধুলোমাখা পথের ধুলোয় গড়ে উঠবে
আরেকটি কৃষ্ণপুরী!
পুরনো মিথেরা বদলায় না,
শুধু নতুন মুখে নতুন মুখোশ পরে,
আমরা চিনি না তাদের,
তাদের ছায়ায় বেঁচে থাকি—
সত্যের সন্ধানে।৮. শহর আলতা স্কুল
শহর আলতা স্কুলে
না আছে কালো বোর্ড, না আছে সাদা চক,
শিক্ষক নেই, শিক্ষার্থী নেই,
শুধু আছে শব্দের চুমুক।
প্রথম ক্লাসে শিখি,
কীভাবে রাত নামে আলোর ওপর।
দ্বিতীয় ক্লাসে পড়ি,
কেন ঘুম ভাঙে ভোরের শব্দে।
শেষ ক্লাসে জানি,
জীবনকে গুটিয়ে রাখা যায় কাগজের নৌকায়।
স্কুলে ঘণ্টা বাজে না,
বাজে কেবল মনের ভেতর চুপি চুপি।
আলতা রঙের দেয়ালে
লেখা হয় রোদ্দুরের পাঠ।
কেউ পাস করে না,
তবু সবাই ক্লাস করে প্রতিদিন।
ডায়েরির পাতা খুলে
নিজেকে সাজায় চুপচাপ—