সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৩৬ অপরাহ্ন

নিউইয়র্ক হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সগণ মানুষ নয়, তাই বলে দেবতাও নয়-রেজাউল করিম মুকুল

নিউইয়র্ক হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সগণ মানুষ নয়, তাই বলে দেবতাও নয়-রেজাউল করিম মুকুল

নিউইয়র্ক হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সগণ মানুষ নয়, তাই বলে দেবতাও নয়
রেজাউল করিম মুকুল

ব্রোনক্স এর জ্যাকব মেডিকাল সেন্টারের নার্স টমাস রিলি এক সাংবাদিকের কাছে বলেছিলো, “মাঝে মাঝে আমার মনে হয় we’re all just being sent to slaughter,” এই নার্সটি কখোন যে করোনা আক্রান্ত হোয়েছে সে জানতোই না। হটাৎ সেদিন ল্যাব থেকে তাকে জানানো হলো তুমি এখন নিগেটিভ। সত্যিকার অর্থে প্রতি ১২ ঘন্টা পর পর আমাদের টেমপারেচার মাপা হলেও হাসপাতালের অভ্যন্তরে ডিউটিরত ডাক্তার নার্সদের আর জানতে ইচ্ছেই করে না তাদের নিজেদের শরিরের অবস্হাটা কি। সবারই পরিক্ষা হোচ্ছে, শুধু মাত্র নিগেটিভ হলেই জানানো হয়। চিনে ৩ হাজারেরও বেশী ডাক্তার করোনাভাইরাস আক্রান্ত হোয়েছিলেন যার অর্ধেকই উহানে। লি ওয়েনলিয়াং প্রথম ডাক্তার যাকে বাচানো যায়নি। আর ইটালিতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত স্বাস্হ্য কর্মীর সংখ্যা চিনেরও দ্বিগুণ যার মধ্যে ৫০ জনের একটি তালিকার কাউকেই বাচানো যায়নি। স্পেনে কোভিডে মৃত্যুর ১৪% চিকিৎসা কর্মি। আর নিউইয়র্ক পাবলিক হাসপাতালগুলো এই মূহুর্তে চিকিৎসা কর্মিদের কোন তালিকাই দিচ্ছে না। নার্স রিলি জানান যখন আমি হাসাপাতালের ইমার্জেন্সির দিকে তাকাই রোগীদের স্বাভাবিক শ্বাসনেয়ার আকুতি দেখে মনে হতো আমরা এর থেকে কোন মতেই মুক্ত থাকতে পারবো না।“I’m swimming in this, “I’m pretty sure I’m getting this.” আমি এবং আমার স্বামী দুজনই আক্রান্ত ছিলাম এখন নিগেটিভ হলেও মুক্ত নই। নিউইয়র্ক প্রেসবাইটারিয়ান হাসপাতালের প্রধান সার্জন ক্রেইজ্ঞ আর স্মিথ জানালেন ভেতরের চরম সত্যি কথাটি হলো আমাদের হেলথ কেয়ার সিস্টেমটা করোনা মহামারির সাথে যুদ্ধে নেমেছে। এই যুদ্ধে মনে করা হয় আমাদের যা আছে তাই দিয়ে কোভিড-১৯ মোকাবেলা করতে হবে। হৈ হট্টোগোল, বিভ্রান্তির মধ্যেই আমাদের কাজ করতে হবে এটাই মুল কথা। আমাদের অপ্রতুল পিপিই, বার বার ব্যবহার দেখে মনে হোয়েছে ইটালির মতো আমরাই করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছি নাতো? একই গাউন, মাস্ক, গ্লোভস পরে বিভিন্ন রোগীর কাছে যেতে হোচ্ছে। এটা আমাদের নিজেদের এবং রোগীদের বিপদের মুখেই ঠেলে দিচ্ছে। লিংকন মেডিকাল সেন্টারের নার্স রিলিয়ান উদেল বললেন, এখন আমার সব দিন বাসায় ফেরা হয় না, তবে যেদিন বাসায় আসতে পারি, “I come home, I strip naked, put clothes in a bag and put them in the washer and take a shower. এভাবেই চলছে একমাস। ওয়েষ্টচেসটার মেডিকেলের নার্স কিমবারলি মার্স বলেন এত কিছু দেখে, শুনে, বুঝে আমার হাসপাতাল ছাড়ার কোন ইচ্ছেই হয় নাই। যদিও আমার বয়স এখন ৫৩ বছর, ধুমপান করি, নানা রকম অসুবিধাও আছে তারপরেও অবসরের মাত্র ২/৩ বছর আগে চাকুরি ছেড়ে করোনার ভয়ে ঘরে লুকিয়ে থাকাটাকে স্বার্থপরতাই মনে করি। এখন আমার অনেকগুলো ব্যাক্তিগত অসুবিধা যেমন মেনোপোজের একটা সময় পার করছি, বেশী বেশী ওয়াসিংএ যেতে হয়। অনেকে বলেন আমাদের বাধ্য করা হোচ্ছে, কিন্তু না, এখন আমাদের ভেতর বাহির দুটোই সমান, সহকর্মিরা কে থাকবে কে যাবে আমরা জানি না। সম্পূর্ণ অনিশ্চিত একটা সময়।
ফ্যাসন ডিজাইনার এবং প্রধান সম্পাদক আন্না উইনটুয়ার জানালেন “আমার ছেলে ম্যানহাটেন হাসপাতালের করোনা রোগীদের ফ্রন্ট লাইনের ডাক্তার, সে নিজেও পজেটিভ ছিলো, এখনও অসুস্হ, কোয়ারেনটাইনে বাসায় আছে, সুস্হ হলে সে আবার তার হাসপাতালে আইসিইউতে যোগ দেবে। চার্লি এ্যাডাম টেক্সাস থেকে এলহার্স্ট হাসপাতালে নার্সের কাজ করতে এসেছে। আমাদের সাপ্লাই শেষ হোয়ে আসছে, ভেন্টোলেটর সংখ্যাও কম, আমি এন৯৫ মাস্কটি এক সপ্তাহ ধরে পড়ে আছি। আমার ৬টি রোগীর ৪টি বিছানায় নাই, হয় আইসিইউতে ভেন্টোলেটরে নিয়ে গেছে, নয়তো মারা গেছে। আমরা আত্মিয় স্বজনদের সাথে রোগীদের ফোনালাপের একটা ব্যবস্হা রেখেছি যাতে তারা তাদের রোগীটিকে গুডবাই বলতে পারে। নিউইয়র্ক হাসপাতালে ডাক্তার নার্স যারাই কাজ করে অবশ্যই সাহসী, তারা দিনরাত হাসি মুখে মরণাপন্ন মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যারা ভোলান্টিয়ার স্বাস্হ্যকর্মি হিসেবে নতুন আসে এ্যাডাম তাদের ব্রিফিং করে, তার অভিজ্ঞতার কথা বলে, সাহস যোগায়। মিনেসোটা থেকে আসা মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে কর্মরত নার্স এলিজাবেথ স্কাফার তার টিমকে প্রতিদিনই তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা শোনায়। সেদিন সে বললো অবসরে যাওয়া ইটালির এক ডাক্তারের কথা।
ডাঃ রোমানো পাওলোসি চাকুরি শেষে সদ্য অবসরের চিঠি পেয়েছেন। নিজের জমানো টাকা, পেনসন, হিসাব নিকাশ, অনুমোদন এসব কাজ চলছে। আমাকে এক রকম বিদায়ও দেয়া হোয়েছে, তখনই ঘটলো করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ আক্রমণ। ফারাক্কার বানের পানির মতো রোগী ঢুকতে শুরু করলো আমাদের হাসপাতালে। ইটালির ছোট্ট একটি হাসপাতাল নাম ওগলিও পো হাসপাতাল, এইতো মাত্র মাসখানিক আগেও একটি সাধারন প্রাদেশিক চিকিৎসা কেন্দ্র ছিলো। এখানে টনসিল থেকে টিউমার সব রোগেরই চিকিৎসা হতো। এখন এটা করোনাভাইরাস চিকিৎসা কেন্দ্র ক্রিমোনার এই হাসপাতাল, সবচেয়ে খারাপভাবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত, চারটি প্রদেশের একটি। আমিসহ ৭০ জন ডাক্তার এখানে দিনরাত কাজ করতে করতে আমরা ক্লান্ত। অনেকটা এমন যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে যেনো। গতকাল কে মারা গেছে, তাদের কি নাম এসব পরের দিন ভুলে যাচ্ছি। কারণ আজ মৃতের সংখ্যা কালকের চেয়ে বেশী। তাছাড়া ডাক্তার, নার্স, রোগী সবারই মুখতো প্লাসটিক বা কাপড়ে ঢাকা থাকে। আমি নিজেও ভীষণ ক্লান্ত। এলেশিয়া বনারী নার্স, সে ইটালির মিলান থেকে এসেছে। ও বললো করোনাভাইরাস এর পিপিই ডিভাইস যেমন গাউন, গ্রোভস, ও প্রাসটিকের ড্রেস দিয়ে শরিরটা এমন ভাবে ঢেকে নিতে হয় যে ভেতরটা যখন ঘামতে থাকে, বাইরে থেকে করার কিছুই থাকে না।, এক গ্রাস পানি খাওয়া কিংবা টয়লেটে ওয়াসিংএ যাওয়ারও সুযোগ থাকে না। তারপরেও হাসিটা মুখে ধরে রাখতে হোচ্ছে।
রেজাউল করিম মুকুল, ১২ এপ্রিল, ২০২০খ্রিঃ। কৃতজ্ঞতাঃ দি গার্ডিয়ান এর পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিবেদক ও সাংবাদিক Sophia Ankel এর চিত্র প্রতিবেদন Dramatic photos show doctors and nurses struggling on the front line of the coronavirus pandemic around the world এবং দি নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক Michael Schwirtz এর প্রতিবেদন Nurses Die, Doctors Fall Sick and Panic Rises on Virus Front Lines (সদয় অনুমোতি সাপেক্ষে)।

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge