নস্টালজিয়ায় প্রাণের সবুজ বাকৃবি
কৃষিবিদ আবিদ করিম মুন্না
দেখতে দেখতে প্রকৃতিকন্যা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ গৌরবের প্রায় ছয় দশক। ভাবতে ভালো লাগে যখন শুনতে পাই প্রিয় বাকৃবি বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছে। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাটাই বোধকরি টেনে নিয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিশিক্ষার অন্যতম সেই বিদ্যাপীঠটিতে আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে। তারুণ্যের অনেক দিনরাত যেখানে কেটেছে। যেদিন ভর্তি পরীক্ষা দিতে ভয়ে ভয়ে প্রায় ১২৫০ একরের সবুজ চত্বরে পা রাখলাম মনে মনে ভাবলাম একদিন আমিও…।
আশরাফুল হক হলে উঠেছিলাম। দেখা রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের সিনিয়র ভাই কামাল হোসেনের সাথে। বিকেলে নাস্তা করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মুন্না, তুমি একা একাই পুরো হলটি ঘুরে দেখো। আমি একটু হলের বাইরে যাচ্ছি।’ একা একা হলের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে চায়ের তৃষ্ণা পেল। চোখে পড়লো চায়ের দোকান। দাঁড়িওয়ালা বয়স্ক একজনকে দেখেই সালাম দিলাম। নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাইতো কী খাইবাইন?’ বললাম, ‘কামাল ভাই ফিরে আসুক তারপর দেখা যাবে।’ লোকটি বললো, ‘আইজক্যা রাইতো গ্যাস-ই খান, কাইল থাইক্ক্যা ফুল-ই খায়েন।’ ভাবলাম, এখানে কি গ্যাস আর ফুলই খাওয়ায় নাকি! আবার ভাবছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল খাওয়াটা অস্বাভাবিক বা অবাস্তব কিছু না। কিন্তু এই ফুল যদি ধুতুরার ফুল হয় তাহলে কালকেই তো পাবনার হেমায়েতপুরে যেতে হবে। আরো মনে পড়ে গেল সদ্য ইন্টারমেডিয়েটে পড়ে আসা হাইড্রোজেন সালফাইড, নাইট্রোজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরোকার্বন, ওজোন গ্যাসের কথা। ভালো করেই জানতাম এসব খেলে মানুষ মরারও সময় পায় না।
রাত হয়ে যাচ্ছে। কামাল ভাই আসছেন না। তখন বাধ্য হয়েই খাবারের সন্ধানে পা বাড়ালাম। মৃদু ভয়কে সঙ্গী করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, গ্যাস আছে?’ আর আল্লাহকে ডাকছি যতগুলো গ্যাসের নাম জানা আছে এর একটাও যেন সেবন করতে না হয়। ডাইনিংয়ের লোকটি বললো, ‘গ্যাস! এটাতো গেস্ট কুপন। একবেলা খেলে গেস্ট আর দুবেলা খেলে ফুল কুপন।’
উচ্চারণগত ত্রুটির কারণে কী কাণ্ডই না ঘটেছিল আশরাফুল হক হলে।
এই সেই কামাল ভাই ১৯৯৬ সালের ৯ নভেম্বর শেষবিকেলে ক্যাম্পাসের কো-অপারেটিভ মার্কেটে চা পান করতে গিয়েছিলেন পাশের শহীদ শামসুল হক হলের কৃষি অনুষদে পড়ুয়া বন্ধু রঞ্জিতকে নিয়ে। কিন্তু ঘাতকদের বুলেট কেড়ে নেয় তরতাজা দুটো প্রাণকে। তাঁদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে মার্কেটটির নাম রাখা হয় কেআর (কামাল-রঞ্জিত) মার্কেট। ভেটেরিনারি অনুষদে পড়তেন কামাল ভাই। মারা যাবার পর তাঁর হলের ফ্লোরবাসীরা ফ্লোরের নাম রাখে ‘কামাল ফ্লোর’। ভালোবাসার এমন নিদর্শন সত্যিই অতুলনীয়।
কামাল ভাইকে প্রায়শই দেখতাম নিবিষ্ট মনে একের পর এক সিগারেট টানতে। সবসময় কী যেন একটা ভাবনায় নিজেকে আবিষ্ট করে রাখতেন। অসম্ভব মেধাবীও ছিলেন। তার পরিচয় রেখেছিলেন প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে। যতদূর জানতাম কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলেন না। যে কামাল ভাই সবচেয়ে বেশি চিন্তা করতেন গণতন্ত্র নিয়ে, বাংলাদেশে লাশের রাজনীতি নিয়ে, সন্তানহারা মায়েদের নিয়েÑসেই কামাল ভাইকে ফিরে যেতে হয়েছিল জন্মভূমি রংপুরে কফিনে শুয়ে।
হলের ডাইনিং শুধু নয়; পয়সা একটু বেশি লাগলেও সম্মোহিতের মতো মাঝে মাঝে ছুটে যেতাম জব্বার ভাইয়ের হোটেলে। ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট ক্যাম্পাসের যাত্রা শুরুর বেশ আগেই জব্বার ভাই ময়মনসিংহ শহরে চলে আসেন। প্রথম জীবনে হোটেলের বয়ের কাজ করলেও অক্লান্ত পরিশ্রম করে একদিন হোটেলের মালিক হয়ে যান। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন জব্বার ভাই। ১০ বছর আগে যারা ক্যাম্পাসে ছিলেন তাদের প্রায় সবাই এক কাপ চা পান করার জন্য হলেও জব্বার ভাইয়ের হোটেলে গিয়েছিলেন। বাড়িতে খাবার অভ্যাস থাকায় প্রথম দিকে ডাইনিংয়ের ব্রহ্মপুত্রের জলসদৃশ ডাল আর ইঞ্চি পরিমাণ দৈর্ঘ্যরে মাছ খেতে ভালো লাগত না। আমার মতো অনেকেই ছুটে যেত। যে কেউ গিয়ে জিজ্ঞেস করত, জব্বার ভাই কী আছে? উত্তর দিতেন এক নিশ্বাসে, ‘গরু আছে, মাছ আছে, খাশি আছে, মুরগি আছে, কোইতোর (কবুতর) আছে।’ কোনটা কত এর জবাবে আসতো, ‘গরু ১০, মাছ ১০, মুরগি ১০, খাশি ১২, কোইতর ১৫ টিঞা (টাকা)।’ এভাবে সকল গ্রাহকদের ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতেন। সকলের সাথে গড়ে তুলতেন আত্মিক একটা সম্পর্ক।
ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভালোবাসার মূল্যায়ন জীবিত থাকতে কতটুকু পেয়েছেন তার সঠিক হিসেব জানা না থাকলেও আমার চোখে তিনি একজন সার্থক ব্যক্তি। কারণ তার নামেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠেছে জব্বারের মোড় নামে একটি স্থান। জীবিত অবস্থায় নিজের নামে একটি স্থানের নাম দেখে যাওয়া কজনের ভাগ্যেইবা জোটে।
জব্বারের মোড়ের পাশের অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনার মসজিদটিতে ঢল নামতো তখনও এবং আজো জুম্মাবারে। তার পাশেই কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগ। মনে আছে ক্লাস শুরুর প্রথম দিন আমি এবং সহপাঠী মিলন (বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক করিম ভবনে অবস্থিত প্রাণরসায়ন বিভাগের প্রফেসর ড. মো. তোফাজ্জল হোসেন) ক্লান্ত হয়ে ওই বিভাগের নিচে দাঁড়িয়েছি। দুজনেই নবীন। কাউকে চেনার প্রশ্নই আসে না। মিলন ওই বিভাগের প্রফেসর ড. আ.বা. ম. নুরুল আনোয়ার স্যারকে ব্লক করে দাঁড়িয়েছিল। বেশ রাগান্বিত হয়ে বলেছিলেন, ‘অ্যাম আই ইওর ওয়াল’। ক্ষমা চেয়ে সে যাত্রায়…।
নুরুল আনোয়ার স্যারের কথা বেশ মনে পড়ে। তাঁর ক্রিকেট এবং ইংরেজি জ্ঞান রীতিমতো ঈর্ষণীয়। ক্লাসে একদিন নোট চেয়েছিল এক সহপাঠী। তন্ময় হয়ে শুনতাম লেকচার। সবাইকে বলেছিলেন এত সুন্দর গ্রন্থাগারে যাওয়ার পরামর্শ দিলে তোমরা তো যাবে না। প্রফেসর জব্বার বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড়ো প্রফেসর। তার কাছে গেলেই তো সব নোট মেলে। স্যার প্রফেসর জব্বার বোঝাতে জব্বারের মোড়ে অবস্থিত ফটোকপির দোকানের কথা বুঝিয়েছিলেন যেখানে গেলে সব বিষয়ের হাতে লেখা চমৎকার সব নোট মিলত। আজো ঘটনাটি মনে পড়লে হেসে উঠি অজান্তে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ফিশ মিউজিয়াম এই ক্যাম্পাসেই। এখানে স্বাদু পানির মাছ এবং সামুদ্রিক মাছের বাংলাদেশে যত প্রজাতি আছে তার নমুনা পাওয়া যায়। বেশকিছু সামুদ্রিক মাছের ফসিল দর্শনার্থীদের মনে জাগায় বিস্ময়।
বাকৃবি বোটানিকাল গার্ডেন মনোরম এবং অভূতপূর্ব ভালোলাগার একটি স্থান। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যে গাছপালা তরুলতা একসময় চোখে পড়তো বর্তমানে তা বিলীনপ্রায়। তার প্রায়ই সবই এখানে পাওয়া যায়। যে মানুষটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা জীবন শেষ করে এখনও গার্ডেনটিকে সাজাতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন তিনি ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রফেসর মো. মোস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের শুধু রংপুর কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে মানুষের বাহুর মতো দেখতে যে বিচিত্র ফলের গাছটি দেখা যায় আজ থেকে প্রায় ১৪ বছর আগে তিনিই প্রথম সাফল্যজনকভাবে সেই গাছটির চারা উৎপাদন করতে সক্ষম হন।
বোটানিকাল গার্ডেনের পেছন দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র নদ যেকোনো মনকে রোমাঞ্চিত করে। প্রতিদিন নদের পাড়ে না গেলে পেটের ভাত হজম হতো না। চঞ্চলমনা সবাই মিলে গঠন করেছিলাম একটা সংগঠন যার নাম ছিল ‘গাপা’ অর্থাৎ গানে পাগল। গাপার প্রচার প্রসারিত হলে একটা সময় স্যারদের কানে চলে যায়। ভাইভা বোর্ডে একদিন তো এক সহপাঠীকে বলেই বসলেন, ‘গাপা করলে কি আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাবে?’ সে আসলে গাপা করতো না। টেনশনে সব ভুলে গিয়েছিল।
গানের প্রসঙ্গ যখন এলো তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। একদিন ক্লাস শেষ করে হলে ঢুকে শুনতে পেলাম গগনবিদারী চিৎকার। দেখি লাল টি শার্ট পরা একটি ছেলেকে গেস্টরুমের ভেতরে মারধর করছে ক্যাডার টাইপের কয়েকটি ছেলে। তার অপরাধ লুঙ্গি চুরি। তাকে শাস্তি প্রদান করা হচ্ছিল অভিনবভাবে। যতক্ষণ সে গান গাইতে পারবে ততক্ষণ শাস্তি বন্ধ। আর গান গাওয়া বন্ধ হলেই বেল্ট দিয়ে আঘাত এমনকি বুকে পেটে সবাই মিলে লাথি। সামান্য একটি লুঙ্গি চুরির অপরাধে তাকে যে শাস্তি দেয়া হয়েছিল সেটি মনে পড়লে কষ্ট হয়। আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষিত কতিপয় মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড়ো বড়ো ডিগ্রি নিয়ে যখন চুরি এবং দুর্নীতি করে সেটা সত্যিই বড়ো লজ্জার।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের সাথেই ফজলুল হক হল এবং তার পাশেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হল। সে হলের পেছনে যতদূর চোখ যায় দেখা মেলে আমবাগান, কৃষিতত্ত্ব খামার, উদ্যানতত্ত্ব খামার। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফল জাদুঘর। দেশ-বিদেশের নানা প্রজাতির ফলের মেলা যেন বসে সেখানে। ফল জাদুঘরে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একদিন সস্ত্রীক একজন প্রতিমন্ত্রী এলেন ক্যাম্পাসে। মন্ত্রীপত্নীর ইচ্ছা হলো কর্তার নীরস সভা সেমিনারে না থেকে সময়টা কাটাতে চান ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরে। একসময় তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ফল জাদুঘরে। হাজার হাজার গাছে নানান প্রজাতির ফল দেখে তিনি মুগ্ধ এবং কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন নামধাম। এক পর্যায়ে আমের বিভিন্ন প্রজাতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় যখন ‘আম্রপালি’ আমের জাতটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো তখন ভুল করে বোধহয় শুনেছিলেন তিনি ‘আমরা পালি’ এবং ছাত্রছাত্রীদের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘বাহ! এটা তোমরা পালো।’ সেই কথা শুনে সবার পেট ফেটে হাসি এলেও বহু কষ্টে তা পেটেই চেপে রাখা হয়েছিল।
ফল জাদুঘরটি যে মানুষটির অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ আরো বিস্তৃত হয়েছে তিনি উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম। উদ্যানতত্ত্ব প্র্যাকটিকাল ক্লাসের একটা ঘটনা মনে পড়ে। প্রচণ্ড শীতের সকাল। প্রফেসর এম. এ. রহিম স্যার ক্লাসে এসে বললেন, তোমাদের আজ ফিল্ডে গিয়ে পাডলিং (জমি কাদাকরণ) করতে হবে। স্যারের আদেশ মেনে নিয়ে তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে যার যার প্লটের কাছে চলে গেল। প্লটে তখন হাঁটু পরিমাণ পানি। সবাই নামলেও কয়েকটা মেয়ে মনে মনে ভাবলো তারা হয়ত পার পেয়ে যাবে। কিন্তু সে আশা গুড়েবালি। স্যার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর এলেন এবং মেয়েদের দেখে বললেন, ‘কী ব্যাপার তোমরা এখনো দাঁড়িয়ে কেন?’ আদেশ শুনে একটি মেয়ে সাহস করে বলেই ফেলল, ‘স্যার, জমিতে তো প্রচুর কাদা।’ স্যারও রাশভারী কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘জমিতে তো কাদাই থাকবে, দই তো আর থাকবে না।’
হলের সামনের বিশাল মাঠে পেছনের গ্রামের অনেকেই তাদের গরুকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য সারাদিন বেঁধে রেখে যেত। ১৯৯৮ এর বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় আমরা যারা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল ব্রাজিল সমর্থক গোষ্ঠী ছিলাম তারা ২০ টাকা দিয়ে একজনের কাছ থেকে গরু ভাড়া করে মিছিল নিয়ে সুলতানা রাজিয়া হল এর সামনের সড়ক পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সবাই জানতো আস্ত গরু জবাই দিয়ে খেলার আগে রাতে গরু-খিচুরি খাওয়া হবে। খেয়েছিলাম তবে কেআর মার্কেট থেকে গরুর মাংস কিনে। ক্যাম্পাস জীবনের আনন্দ, হাসি আর উচ্ছ্বাসের সেই দিনগুলো কি আর ফিরে পাওয়া যাবে!
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনে বেশকিছু অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার সুযোগ পেয়েছি। তবে জীবনের প্রথম নাটক ছিল মুক্তমঞ্চে। তখন ছিল দারোয়ানি গোঁফ। আর সেটি থাকার কারণে পেয়ে গেলাম মুক্তিযুদ্ধের একটি নাটকে পাকিস্তানি হাবিলদারের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ। অভিনয় খুব সামান্য থাকলেও চরিত্রটি ছিল ভাইটাল। কাজই ছিল আমার বস অর্থাৎ পাকিস্তানি কমান্ডারের সাথে চলাচল এবং তার নির্দেশমতো মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে তার কাছে পৌঁছানো। রিহার্সেলে সবকিছু ভালোভাবে উতরে গেলেও একটা জায়গায় এসে আটকে যেতাম বিশেষ করে নাটকের অভিনেত্রীকে হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে নেয়ার দৃশ্যে। লাজুক ভাব দেখে সংশ্লিষ্ট অভিনেত্রী সাহস জুগিয়ে একদিন বললো, ‘মুন্নাভাই, এতো লজ্জা পাচ্ছেন কেন? এটাতো অভিনয়।’ তারপরও লজ্জা কি যায়? লজ্জা কাটাতে কি-না করেছি। জাতীয় সংবাদপত্র ভাঁজ করে হাত কল্পনা করে, কখনও ছাতার অগ্রভাগ ধরে। শেষ পর্যন্ত সেই দৃশ্য চমৎকারভাবেই মঞ্চায়িত হয়েছিল।
লজ্জা এবং সংবাদপত্র প্রসঙ্গটি যখন এসেই পড়ল তখন কেআর মার্কেটের ‘পত্রিকা বিচিত্রা’ বুক স্টলের কথা বলতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মরহুম হাবীবুর রহমান সাহেবের এই দোকানটি ‘হুজুরের দোকান’ নামে পরিচিত ছিল। কারণ সারাদিন যে সেলসম্যানটি থাকতেন কাকাডাকা ভোর থেকে রাত অবধি তার নাম মো. রফিকুল ইসলাম। গোলাপি রঙের পাঞ্জাবি, পায়জামা, মাথায় টুপি আর দাড়ি থাকবার কারণে শুধু ছাত্রদের কাছে নয়, লেডিস হলের নবাগতা ছাত্রীটির কাছেও তিনি ‘হুজুর’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। একদিন সকালের ঘটনা। টাটকা খবরের কাগজে চোখ বোলাতে প্রতিদিনের মতো ছুটে গেলাম হুজুরের দোকানে। এই কামাল-রঞ্জিত মার্কেটেই টাটকা সংবাদপত্রের পাশাপাশি টাটকা শাকসবজি, মাছ, মাংস তথা নিত্যদিনকার বাজার করতে ছুটে আসেন অসংখ্য শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী। এদেরই একজন কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের সাবেক প্রফেসর ড. এস.এম. জিয়াউল করিম। প্রতিদিনের মতো বাজার শেষ করে হুজুরের দোকানে এসেছেন পত্রিকা নিতে। ঠিক তার পিছু পিছু ছুটে এলো ঝোলা কাঁধে এক ভিক্ষুক। স্যার যখন পত্রিকার দোকানে এসে পৌঁছলেন তার আগেই তাঁর এক ছাত্র ইংরেজি দৈনিক কিনতে এসেছিল। ছাত্রের ইংরেজি পত্রিকা পড়ার অভ্যাসের কথা শুনে ভূয়সী প্রশংসা করলেন। এদিকে ভিক্ষুক ভিক্ষা চাওয়ার জন্য হাত প্রসারিত করেই রেখেছে। স্যার ভিক্ষুকের জন্য মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করার মুহূর্তে বললেন, ‘আমি বুঝি না আমি এই মার্কেটে প্রবেশ করবার সাথে সাথে এই ভিক্ষুকটি প্রতিদিন কী করে টের পায়। বেগিং ইজ ভেরি ব্যাড হ্যাবিট বাট রিডিং ইংলিশ নিউজপেপার ইজ ভেরি গুড হ্যাবিট।’ ভিক্ষুক কি আর স্যারের ইংরেজি বোঝে! খুব ভালো মানুষ ছিলেন। চমৎকার অভিনয় করতেন শুনেছি।
ভিক্ষুক তো তবু হাত পেতে টাকা উপার্জন করতো। যারা তখন টাকা উপার্জন করতে শিখিনি আমাদের টাকা আসতো পোস্ট অফিসে মানি অর্ডারে, কারো সেই সময় টিএসসির পাশে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডে টিটি এবং ডিডির মাধ্যমে। ইন্টারনেট, ফেসবুকের কল্যাণে সবকিছু কত সহজ হয়ে গেছে। যাযাবার ‘দৃষ্টিপাত’ উপন্যাসে যথার্থই লিখেছেনÑ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ এখন বাবা-মায়ের কষ্টার্জিত টাকা চলে আসে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কিংবা বিকাশে। শুধু কষ্ট করে ব্যাংকের বুথ বা বিকাশের দোকানের দিকে পা বাড়ালেই…।
সেই সময় আমাদের মা-বাবা প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখে মন দিয়ে পড়াশোনার উপদেশ দিতেন। আমরাও নিয়মিত চিঠি লিখতাম। বাবা পোস্ট কার্ডে প্রতিদিন একটি করে চিঠি লিখে হলের পোস্টবক্সে ফেলতে বলতেন। সেই দিনগুলো কি আর ফিরে পাওয়া যাবে। বাবা আজ নেই। কিন্তু মনে পড়ে তাঁর উপদেশ। ক্যাম্পাসের শেষ মোড়ে কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম। যে জায়গাটিতে আমি যেতাম তখনও এবং এখনও ক্যাম্পাসে বেড়াতে গেলে। সেখানে ছোট্ট একটি কবরস্থানে শায়িত আছেন বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের পারিবারের সদস্যরা। প্রত্যেকটি জীবনেরই অবসান আছে। সেটি সফল বা ব্যর্থ যেভাবেই হোক না কেন।
বাকৃবি ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ ভীষণ ভালো লাগে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে যখন তার পাশ দিয়ে চলা রাস্তাটিতে কৃষ্ণচূড়ায় যখন আগুন লাগে। ১৫ বছর আগে বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ এর নাম যেদিন পরিবর্তন করে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদালয়, বাংলাদেশ করার সিদ্ধান্তের খবর বাংলাদেশে টেলিভিশন এবং একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত হলো ঠিক তখনই বিক্ষোভে ফেটে পড়ল পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। কারণ এ সিদ্ধান্তের সাথে সকলের মান সম্মানের প্রশ্ন জড়িত ছিল। কাজেই প্রতিবাদস্বরূপ প্রতিটি হল থেকেই ‘মকৃবি চাই না, বাকৃবি চাই’ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করতে দেয়া হবে না’ প্রতিটি স্লোগান নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ছাত্রছাত্রীরা। রাতে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা না ঘটলেও প্রতিবাদ তীব্রতর হয়ে বিক্ষোভের দাবানল ছড়িয়ে পড়ল পরের দিন কাকডাকা ভোরে। ছাত্রীরাও তীব্র ক্ষোভে মাথায় লালফিতা বেঁধে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য পুলিশের মুখোমুখি হতে দ্বিধা করেনি। মুহূর্তের মধ্যেই পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে পুরো ক্যাম্পাস রণাঙ্গনের দিকে এগিয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীদের সম্মিলিত শক্তির মুখে চকিতে অবিশ্বাস্য এক ঘটনা ঘটে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা রেললাইনের পাত উপড়ে ফেলে। ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনের সামনে মিছিল নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে গেলে পুলিশ ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। পুলিশের রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হয় ৩ জন শিক্ষকসহ প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্র। বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা শিলাবৃষ্টির মতো ইট পাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে যায়। এদিকে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী রেলের পাতটি তুলে নিয়ে সেটিকে বিসর্জন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রহ্মপুত্র নদে। তারা পালাক্রমে লাশ কাঁধে বহন করার মতো রেলের পাতটিকে নিয়ে চলেও আসে অর্ধেকের বেশি পথ। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর স্যারের বাসভবনের সামনে অবস্থানরত বেরসিক পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের কাঁধে তোলা রেলের পাত (পুলিশ ভেবেছিল নতুন আবিষ্কৃত কোনো অস্ত্র) দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সংলগ্ন লাভলেনেই ফেলে রেখে আসে রেলের পাতটি। এভাবেই পড়ে থাকে দীর্ঘ ১০০ ঘণ্টা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রিয় ছোটোভাই আব্দুল মুক্তাদির হিমু এসে জানায়, ‘মুন্নাভাই, আইজক্যা পোলাপাইন যেই রেইল লাইনড্যা তুইল্লা লাবলেনে ফালায়া রাইক্কা আইছে হেইডার সাইজ কত হইবার পারে?’ বলেছিলাম ২০-৩০ হাত হবে। হিমু জানিয়েছিল সে মেপে দেখেছে সেটি দৈর্ঘ্যে ৯১ হাত। কী পরিমাণ ক্যাম্পাসের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থাকলে ওই অসাধ্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নেয়া সম্ভব?
আজ কর্মজীবনের এ পর্যায়ে এসে একাকী যখন প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা ভাবি তখন মনে হয় হৃদয়ের উষ্ণতা কতটা প্রবল হলে ক্যাম্পাসের ওই ছোট্ট রেলস্টেশনের ৯১ হাত দৈর্ঘ্যরে রেলের পাত তুলে নিয়ে আসা সম্ভব! সেদিন প্রমত্তা যমুনার দু’তীরের এদেশের অসহায় রেলযাত্রীদের জিম্মি করে অবর্ণনীয় কষ্টে ফেলে ভীষণ অন্যায় করেছিলাম। একটা অপরাধবোধ তাড়িত হই আজো। কিন্তু বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ আমাদের প্রিয় ‘বাকৃবি’ নামটাই যে শেষ পর্যন্ত সমুজ্জ্বল ও দীপ্তিমান কথাটা ভাবতেই গর্বে গৌরবান্বিত হয় আমারই মতো সেদিনের সেই সহযাত্রীদের হৃদয়।
লেখক : গল্পকার, প্রকৃতিবিষয়ক কলাম লেখক এবং সহকারী সম্পাদক, ফোকলোর জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা