সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৪৭ অপরাহ্ন

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব)-৩ ও ৪ : প্রতিবিম্ব-তন্ময় নাহা

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব)-৩ ও ৪ : প্রতিবিম্ব-তন্ময় নাহা

পর্ব-৩
সবকিছুতেই একটা স্বাচ্ছন্দের ব্যাপার থাকে। বিক্রমের স্বাচ্ছন্দ হচ্ছে না। স্বাচ্ছন্দ আসতে গেলে অভ্যস্ত হতে হয়। সে বোধহয় এই অফিসে অভ্যস্থ হতে পারছে না। একবার চেয়ারে বসে আবার উঠে পড়ছে। মনে হচ্ছে সারা শরীরে এক জাতীয় পাতা বুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেটা বুলানোর কারনে চেয়ারে বসা মাত্রই তার চুলকানির মতো হচ্ছে।
আকাশ অফিস ঘরের দরজা থেকে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখছিলো। এখন অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো “আপনি ?”
“হ্যাঁ আমি। আমিই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি।”
“আপনি ডেকে পাঠিয়েছেন ? কেন ?”
“ডেকে পাঠিয়েছি দু’টো বিশেষ কারনে। প্রথম কারণটা হলো …. থাক প্রথম কারন পরে বলবো। আগে দ্বিতীয় কারনটা শোন…”
“আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি না।”
“না চাইলেও যে এখন থেকে আমার কথা শুনতে হবে তোমাকে।” বিক্রম হাসলো।
“দয়া করে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলুন। সিনেমার হেঁয়ালি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করবেন না।”
“আচ্ছা প্রয়োগ করবো না। স্পষ্ট কথা হলো তুমি অবশ্যই এই অফিস থেকে চেয়ার টেবিল সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। কারন আমি চেয়ারে বসতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছি না। এখন থেকে আমার ঘরে যারা আসবে তারা জুতা খুলে মাটিতে বসে যাবে। আমার সাথে কথা বলবে। শেষে জুতা পরে চলে যাবে।”
“এসব আমি করতে যাবো কেন ?”
“করতে যাবে কারন আমি রাইস মিলের বর্তমান মালিক। আশাকরি তুমি এখন কাগজপত্র দেখতে চাইবে না ?”
আকাশ খানিকটা এগিয়ে আসলো। এক গালের বাঁকা হাসি দিয়ে বললো “কিছু মনে করবেন না। আমি এমন কাউকে মালিক ভাবতে পারবো না যে কিনা চোর। অন্তত একসময় কুখ্যাত চোর ছিলো।”
বিক্রমের চাপা ভাঙ্গা চেহারায় কোন ভাবান্তর হলো না। কথাগুলোকে মনে হচ্ছে সে সহজ ভাবেই নিয়েছে। সে সোজা হেঁটে গিয়ে আকাশের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আশ্চর্য ব্যাপার সে গোঁজা হয়ে দাঁড়ায়নি। একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে “আমার মনে হয় কী জানো ? মানুষের ক্ষমতার সাথে সাথে খানিকটা ব্যক্তিত্বও চলে আসে। ক্ষমতা ছাড়া ব্যক্তিত্ব টিকে না, আবার ব্যক্তিত্ব ছাড়াও ক্ষমতা বেশি দিন টিকে না। তোমার ব্যক্তিত্ব দেখতে ভালো লাগছে।”
“ভুল বলছেন। আমি ক্ষমতাবান কেউ নই।”
“তুমি অবশ্যই ক্ষমতাবান। মিলের সবাই তোমাকে নেতার মতো মানে। প্রায় পূজো করে। তুমি এখন চাইলেই আমাদের মিল বন্ধ করে দিতে পারো। এগুলো কী ক্ষমতার উদাহরণ না ?”
“আপনি কী আমাকে খোঁচা দিচ্ছেন ?”
“খোঁচা দিচ্ছিনা। তোমার ক্ষমতায় আমি অভিভূত হয়ে গেছি। আমি চাই তুমি মিলের কাজকর্ম আবার স্বাভাবিক করে ফেল। তোমাকে ডেকে পাঠানোর এটাই প্রথম বিশেষ কারন।”
“কিন্তু আপনার চাওয়া আমাকে অভিভূত করছে না।”
বিক্রম হেসে ফেললো। খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে আপনমনে হাঁটতে শুরু করলো “আমি জানি তুমি ঠিক এটাই বলবে। চ্যাংড়া বয়সের ছেলে। এখনই তো ওসব বস্তাপচা মোরালিটি নিয়ে চলার বয়স। যাইহোক আমি তোমাকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিলাম।”
“আপনি আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন ?”
“মোটেও না। আমি তোমাকে গর্তে ফেলার চেষ্টা করছি। কারন তুমি হলে জাত সাপ। জাত সাপকে দুধকলা দিয়ে প্রথমে পুষতে হয়। তারপর সময় বুঝে মেরে ফেলতে হয়।”
“আমি জাত সাপ ? আমাকে মেরে ফেলবেন ?”
“তুমি কী ভেবেছো আমি জানি না তোমার বাবার নাম জালাল ? যেই জালাল কিনা নিজেও আমাদের ট্রাক চালাতেন। চুরির দায়ে চাকরি হারিয়েছেন। তুমি সেই প্রতিশোধ নিতেই আমাদের পিছনে লেগেছো। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাকে ছড়িয়ে ক্যাসারের মতো বড় করে দিয়েছো।”
আকাশ অবাক হয়ে বললো “আমি এগুলো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে করছি ? আপনি সব জানেন। আমার বাবার সাথে যে আমার সম্পর্ক নেই এটা জানেন না ?”
“এটাও জানি। কিন্তু মিলের কর্মচারীদের সিমপ্যাথি আনার জন্য এই গল্পটা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। এটাও জানানো দরকার যে তোমাকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি যেই ক’মাস অন্যান্য কর্মচারীরা বেতন পায়নি সেখানে তুমি পেয়েছো।”
“এগুলো আপনি কেন করবেন ?”
“মিল বাঁচানোর জন্য করবো। এই মুহূর্তে তোমার মতো জাত সাপকে শেষ করে দেওয়া ভালো। এই মিল থেকে যেমন তোমাদের রুটিরুজিব্যবস্থা হয় আমাদেরও হয়। কিন্তু তুমি সেই পথ বন্ধ করে দিতে চাচ্ছো। এখন থেকে তোমার সেই পথও বন্ধ।”
“আমাকে কী করতে বলছেন ?”
বিক্রম এইবার হাঁটা বন্ধ করে আকাশের দিকে ফিরলো। শান্ত গলায় বললো “বেশি কিছু না। তুমি আবার আগের মতো সব স্বাভাবিক করে ফেল। আমাদের সাথে হাত মেলাও। সবাইকে আশা দেখাও যে আগামী কিছু মাসের মধ্যে সবার বকেয়া বেতন পরিশোধ করে দেওয়া হবে।”
“এটা আমি করতে পারবো না। সবাই আমার উপর ভরসা করে আছে। আমি এতগুলো মানুষের ভরসা ভাঙ্গতে পারবো না।”
“আকাশ পৃথিবীটা এভাবেই চলে। আমরা সাধারন মানুষ কারো উপর ভরসা করি। আর ভরসাবান মানুষেরা সেই ভরসা বিক্রি করে চড়া মূল্যে। যার উপর মানুষের যত বেশি ভরসা তার দর তত বেশি।”
আকাশ চুপ করে আছে। মনে হচ্ছে তার কথাটা পছন্দ হয়নি। হওয়ার কথাও না। তার মতো প্রতিবাদী, নীতিবান মানুষেরা পৃথিবীটা দেখে রঙিন চোখে। বিক্রম পোড় খাওয়া, নেশাগ্রস্ত মানুষ। আসল পৃথিবীটাকে তার ইতিমধ্যে দেখা হয়ে গেছে। এখানে সবাই ভদ্রলোক কিন্তু উপরে উপরে। এখানে সবাই নির্লোভ কিন্তু উপরে উপরে। কারন মানুষের ভেতরটা কেউ দেখতে পায় না।
প্রীতিলতা দেবী সবকিছু চুপচাপ শুনলেন। কথার মাঝখানে কোন প্রশ্ন করলেন না। বিক্রমের কথা শেষে খানিকটা সময় নিয়ে বললেন “এখন তোমার আকাশকে ভুল প্রমাণ করতে হবে। বেতনের ঝামেলাটা আরো কয়েকমাস দীর্ঘস্থায়ী করতে হবে।”
বিক্রম গোঁজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চোখ আগের মতোই উজ্জ্বল এবং লাল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “বেতন না দিতে বলছেন ? আরো কয়েকমাস ?”
“হ্যাঁ, না দিতেই বলছি। শুধু এটাই না। আরো যেই কয়েকটা রাইসমিল ভালো ভাবে চলছে সেখানেও বেতনের ক্রাইসিস তৈরি করো।কৃত্রিম ক্রাইসিস।”
“ইচ্ছে করে ক্রাইসিস তৈরি করবো ?”
“হ্যাঁ। এবং সেখানে লোক মারফত ছড়িয়ে দিবে এই মিলের শ্রমিক অসন্তোষের কথা। এদের স্ট্রাইকের কথা। এটাও বলবে যে মিলের শ্রমিক পক্ষের এক নেতা এখানে দাবি আদায়ের জন্য মিল বন্ধ রাখে।”
বিক্রম উত্তেজনা হীন অথচ অবাক গলায় বললো “এসব আপনি কী বলছেন মামী ? এখন আগুনে ঘি ঢালার সময় না।”
প্রীতিলতা দেবী ঠান্ডা গলায় বললেন “আমি আগুনে ঘি ঢালছি না। আগুন টাকেই পুরোপুরি শেষ করে দিতে চাইছি।”
রফিক চাচা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েছিলেন।কিছুদিন ধরে তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না।আজ কষ্ট করে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছেন। আলোচনার বিষয়বস্তু বুঝতে পেরে অসুস্থ গলায় কিছু বলতে যাবেন। তার আগেই প্রীতিলতা দেবী বললেন “মাঝে মাঝে ঘুড়ি উপরে তুলতে গেলে সুতো ছেড়ে দিতে হয়। আমি এখন যেই কাজটি করছি সেটা হলো সুতো ছাড়ার কাজ। লাটাই আমার হাতেই ধরা আছে। লাটাইটা কে জানো ? আপনি বুঝতে পারছেন চাচা ? লাটাইটা হলো আকাশ।”
“আকাশ আপনার হাতের লাটাই ? যদি সে চাকরি ছেড়ে দেয় ?”
“চাকরি ছাড়বে না। প্রত্যেকটা মধ্যবিত্ত মানুষের স্বপ্ন থাকে কোন না কোন দৃশ্যপটের নায়ক হওয়া। তারপর তাদের কর্তব্য হয় নিজের তুলনায় নিচু শ্রেণীর সবাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করা। আকাশ এই মুহুর্তে এই মিলের নায়ক। এতো তাড়াতাড়ি সে দৃশ্যপট ছেড়ে বিদায় নিবে না।”
রফিক চাচা এইবার ইতস্তত করে বললেন “সেসব তো বুঝলাম কিন্তু সব মিলেই কী এই ঝামেলা পাকানো ঠিক হচ্ছে ?”
“অবশ্যই ঠিক হচ্ছে। শ্রমিকরা যখন মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে এক হতে শুরু করবে তখন তাদের একজন নেতার প্রয়োজন হবে। আমরা তাদের হাতের কাছে এমন একজনকে নিয়ে আসবো। আকাশ। যে একইসাথে আমাদের হয়ে কাজ করবে আবার শ্রমিকদের কাছে হয়ে থাকবে শ্রদ্ধেয় নেতা।”
বিক্রম মাথা নাড়িয়ে বললো “আকাশ এসব মানবে না। অসম্ভব।”
“আকাশের মানা না মানার কথা আসছে না। তাছাড়াও তার দরকারও নেই। আমরা মালিকপক্ষ হিসেবে শ্রমিকদের উপর কর্তৃত্ব না দেখিয়ে শ্রমিকরা যাকে শ্রদ্ধা করে তার উপর কর্তৃত্ব রাখবো। এতে কোন অপরাধ নেই। অন্তত আমি দেখছি না। শ্রমিকরা নিজেদের স্বার্থ দেখবে আর আমরা দেখবো আমাদের স্বার্থ।”
প্রীতিলতা দেবী এরপর খুব শান্ত গলায় কঠোর ব্যক্তিত্বের সাথে বললেন “আমার স্বামীর সম্পত্তি বাঁচাতে যা যা করতে হয় আমি তার সবটুকুই করবো। সবাই হয়তো ভাবছে তার মৃত্যুর সাথে তার সব সম্পত্তি বার ভুতে লুটে খাবে। কিন্তু কথাটা একদম সত্যি না।”

পর্ব-৪
চারপাশের পরিবেশ খানিকটা ধূয়াময় হয়ে আছে। ধূয়াময় জিনিসটা কুয়াশা। অথচ ঠান্ডা নেই। দিনের আলোর সাথে সাথে এই ধূয়াময় অবস্থা কিছুটা ফিকে হয়ে আসছে। আব্বাস হুসাইন বেলকনির খোলা দরজা দিয়ে ফিকে হয়ে আসা কুয়াশা দেখছেন।
সকাল হতে শুরু করেছে। চারপাশের আওয়াজ বাড়তে শুরু করেছে। আব্বাস হুসাইন কফির মগ নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। বেলকনির রেলিং স্বচ্ছ কাঁচের। কিন্তু এই মুহুর্তে রেলিংয়ের কাঁচকে স্বচ্ছ মনে হচ্ছে না। শিশির পড়ে ঝাপসা হয়ে গেছে। তিনি নিতান্তই ছেলে মানুষের মতো একটা কাজ করলেন। রেলিং ধরে বেলকনিতে বসে পড়লেন। কাঁচের ঝাপসা অংশে আঁকিবুঁকি করে নিজের নাম লিখলেন। নিজের মেয়ের নাম লিখলেন। সর্বশেষ লিখলেন তার স্ত্রীর নাম। রৌজি হুসাইন। তারপর কী মনে করে যেন এই নামের পাশেই লিখলেন জাবির চৌধুরীর নাম।
জাবির চৌধুরী তার অতিপরিচিত মানুষদের একজন। অন্তত একসময় ছিলেন। নামকরা ব্যবসায়ী। একসময় এই বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত ছিলো। বিচিত্র কারনে এখন তিনি এই বাড়িতে আসেন না। বিচিত্র কারনটা আসলেই খুব বিচিত্র। তবে এতে তিনি জাবির সাহেবের কোন দোষ দেখেন না।
আব্বাস হুসাইন কফির মগ নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। তবে পারলেন না। বয়স হচ্ছে। শরীর আর ঠিকমতো সঙ্গ দিচ্ছে না। তিনি কোমরের দিকে অসম্ভব ব্যাথা অনুভব করলেন। হাত থেকে কফির মগ পড়ে গেল। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গির একটা অংশ কফিতে ভিজে গেল। তিনি কফির মগ কিছুটা সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। দু’হাতে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছেন। কোমরের দিকের ব্যাথাটা অসম্ভব শক্তিশালী মনে হচ্ছে। তার ধারনা তিনি এখন পড়ে যাবেন। তিনি শক্ত করে রেলিং ধরে দাঁড়ালেন।
ঘরে কেউ নেই। বেশ কিছুদিন হলো তার স্ত্রী তার সাথে এক ঘরে থাকেন না। ঝগড়া নেই, বিবাদ নেই হুট করেই এই সিদ্ধান্ত। তিনি এটা নিয়ে রৌজিকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। প্রত্যেকটা মানুষের কিছু প্রাইভেসি দরকার হয়। তিনি রৌজিকে সেই প্রাইভেসি দিয়েছেন।
কাউকে ডাকতে হবে। কোমরের দিকের ব্যাথাটা প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। যেকোন সময় অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। দো’তলার এই বেলকনি থেকে প্রায় পুরো বাড়িই দেখা যায়। সকালবেলার ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। পরিচিত নেতাকর্মীরা আসতে শুরু করেছে। সিকিউরিটি গার্ডরা সতর্ক দৃষ্টি ফেলে পায়চারি করছে। এরমধ্যে কাউকেই তার ডাক দিতে ইচ্ছে হলো না।
তিনি প্রায় দাঁত চিপে ব্যাথা হজম করে ফেলার চেষ্টা করছেন। ব্যাথা যেমন হঠাৎ করে এসেছিল ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই একসময় চেলেও গেল। তিনি অজ্ঞান হলেন না। পড়েও গেলেন না।
কিন্তু এইবার কাউকে ডাকতে হবে। আরেক মগ কফি দেওয়ার কথা বলতে হবে। গতরাতে তার এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। সারারাত পায়চারি করেছেন। শেষদিকে পরপর তিনটা ঘুমের বড়ি খেয়েছেন। কড়া ডোজের। একটা হায়ম পর্যন্ত আসেনি। ঘুমের বড়ি গুলোর সিডেটিভ ক্ষমতা কমে গেছে। চাইলেও কেউ এক পাতা ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করতে পারবে না। কিন্তু তার ঘুম দরকার। কফিতে অনেকের ঘুম কেঁটে যায়। তার ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটে। অনেক সময় চিনি ছাড়া কড়া এক কাপ ব্ল্যাক কফিতে তার ঘুম পেয়ে বসে।
তিনি কফি খেলেন না। তবে কাউকে না ডেকে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন। বাড়ির পিছনে দিক খানিকটা বাগানের মতো আছে। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করা যেতে পারে। পায়চারি করতে করতে চিন্তা করবেন।
ব্যবসায়ীরা মোটা অঙ্কের টাকা ডোনেশন দিতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু সেই সাথে একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। শর্তটা মেনে নিলে প্রতিদিন প্রায় হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে তারা লোপাট করে নিবে। পুরো টাকার একটা অংশ তাদের দলকে ডোনেশন দেওয়া হবে। সত্যি বলতে এখন টাকার খুব দরকার। নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশকিছু সেক্টরে টাকা ইনভেস্ট করতে হবে। তবে তিনি জানেন পরিকল্পনা উনিশ থেকে বিশ হলেই রাজনীতি থেকে তাদের দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। শর্ত মেনে নেওয়ার আগে বেশকিছু হিসাবনিকাশ করে নিতে হবে।
বাগানের দিকে কিছু চেয়ার টেবিল পাতা। তিনি পায়চারি শেষে অন্যমনস্ক ভাবে সেখানে বসলেন। শীতের দিন। অথচ শীত নেই। ফিকে হয়ে আসা কুয়াশা এখনো খানিকটা রয়ে গেছে। চারপাশ থেকে ফুলের গন্ধ এসে নাকে লাগছে। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন। গভীরভাবে ভাবছেন। ভাবনার ছন্দপতন হলো। লক্ষ্য করলেন রৌজি বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। পাশে বড় একটা লাগেজ। লাগেজটি নিয়ে একজন গ্যারেজের দিকে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই এখন গাড়ি বের হবে। তিনি জানেন না তার স্ত্রী কোথায় যাচ্ছে। কিছুই জানেন না।
রৌজি এই সাতসকালেই সুন্দর করে সেজেছেন। হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরেছেন। চোখে সানগ্লাস। হাতে হিরে বসানো ছোট পার্স। আব্বাস হুসাইন একবার নিজের দিকে তাকালেন আরেকবার রৌজির দিকে। এই মহিলা কোন না কোনভাবে নিজের বয়স বেঁধে ফেলেছেন।সবার যেখানে বয়স বাড়ে সেখানেবোধহয় রৌজির বয়স কমে।
আব্বাস হুসাইন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ভাবনায় মনযোগ দিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ মনযোগ ধরে রাখতে পারলেন না। রৌজি এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করেছেন “তোমার পাঞ্জাবিতে ওটা কিসের দাগ ? রক্ত ?”
আব্বাস হুসাইনের এই উদ্বিগ্ন গলা ভালো লাগলো। তিনি সেটা বুঝতে না দিয়ে পাঞ্জাবির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। মিষ্টি গলায় বললেন “রক্ত না। কফি পড়ে গেছে।”
“গরম কফি ছিলো ?”
“কিছুটা গরম ছিলো।”
“কিছুটা গরম আবার কী ? তোমার তো বরাবরই খুব গরম ব্ল্যাক কফি খাওয়ার অভ্যাস। পুড়ে যায়নি তো ? সাতসকালেই তোমার কফি খেতে হয় কেন ?”
“পুড়ে যায়নি। কফি বেশিটুকু মেঝেতেই পড়েছে।”
“আচ্ছা শোন আমি একটা পিকনিকে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
“পিকনিক দুই দিনের। দু’দিন পর ফিরবো। তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো ?”
“অসুবিধা হবে না।”
“আসলে হুট করেই সব প্ল্যান হয়ে গেল। তোমাকে জানানোর সময় পাইনি। তাই এখন জানাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
“পিকনিকটা কিন্তু আমাদের মহিলা সমিতি থেকে। মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক হয়ে পড়েছি আরেক ঝামেলায়। যখন তখন যেখানে সেখানে চলে যেতে হয়।”
“তুমি তো মনে হয় এই চলে যাওয়া বেশ উপভোগই করো।”
“প্রথম প্রথম ভালো লাগতো। এখন বিরক্ত লাগে।”
“আচ্ছা।”
“কী তখন থেকে আচ্ছা আচ্ছা করে যাচ্ছো ? কিছু বলার থাকলে বলো।”
“ভালো মতো যাও।”
“আচ্ছা ভালো কথা, মহিলা সমিতির কিছু উপদেষ্টাও যাচ্ছেন আমাদের সাথে।”
“ওহ্।”
“তাদের যাওয়ার কথা ছিলো না। হঠাৎ করেই সবকিছু ঠিক হয়ে গেল।”
“তোমাদের উপদেষ্টা জাবির চৌধুরীও যাচ্ছেন তোমার সাথে ?”
রৌজি যেন খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে। ইতস্তত করে বললেন “উনি আমার সাথে না, আমাদের সাথে যাচ্ছেন। মহিলা সমিতির একজন হিসেবে তো উনি যেতেই পারেন তাই না ?”
“হ্যাঁ অবশ্যই পারেন। আচ্ছা এইবার কোথায় যাচ্ছ ? থাইল্যান্ডে না সিঙ্গাপুর ? এই সময়টায় থাইল্যান্ড যাওয়াই বোধহয় ঠিক হবে।”
রৌজি কঠিন চোখে তাকলেন “কী বলতে চাইছো তুমি ?”
আব্বাস হুসাইন অসম্ভব মিষ্টি গলায় বললেন “আমি কিছুই বলতে চাইছি না। যা বলার তুমি নিজেই বলছো।”
“আমি কী বলেছি তোমাকে ? তুমি কী কোনভাবে উনাকে সন্দেহ করছো ? ভাবছো আমি উনার সাথে ঘুরতে যাচ্ছি আর তোমার কাছে মিথ্যে করে পিকনিকের কথা বলছি ?”
“আমি এসব কিছুই ভাবছি না। শোন রৌজি ঠান্ডা হও। কোথাও যাওয়ার আগে মাথা গরম করে যাওয়া ঠিক না।”
“একশো বার গরম করবো। হাজার বার গরম করবো। আমি ভাবতেও পারছি না তুমি এতটা নোংরা মনের। জাবির সাহেবের সাথে তোমার একটা ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে। তারমানে এই নয় যে উনাকে জড়িয়ে খারাপ কথা বলতে পারো।”
“জাবির সাহেবের সাথে আমার ঠান্ডা গরম কোনরকম যুদ্ধই হচ্ছে না। বিচিত্র কারনে উনি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার ধারনা বিচিত্র কারনটা তুমি ধরতে পারছো।”
“না, পারছি না। তুমি কী আমার পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছো ? ভেবো না তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। দেশে এখনো আইন আদালত আছে।”
“আমার মনে হয় তোমার এখন যাওয়া উচিত। পিকনিকের জন্য নিশ্চয়ই তোমার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। আর দয়া করে এরকম চিৎকার করে কথা বলা বন্ধ করো। আমি কোন পাবলিক গসিপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে চাই না।”
রৌজির গলা স্বাভাবিক হয়ে গেল। তিনি শাড়ির আঁচল ঠিক করে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন “তুমি হয়তো যেভাবে বিষয়টা দেখছো, বিষয়টা আদৌও সেরকম না। জাবির সাহেব আমার একজন ভালো বন্ধু। চমৎকার মানুষ। এরকম চমৎকার মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক।”
আব্বাস হুসাইন মৃদু হেসে উদাস গলায় বললেন “রৌজি মানুষের জীবনে সবকিছুই স্বাভাবিক। যা হয় তাও স্বাভাবিক, যা হয় না তা আরো বেশি স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছু হয়তো মানুষের জীবনে ঘটে না। এখন তুমি যেতে পারো। জাবির চৌধুরী নিশ্চয়ই তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
রৌজি আর কিছু বলতে চেষ্টা করলেন না। তিনি বুঝে গেছেন, এই মুহূর্তে এখানে কিছু বলতে চাওয়া অমূলক। তিনি কিছুক্ষণ আব্বাস হুসাইনের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। সানগ্লাসের কারনে আব্বাস হুসাইন এই তাকিয়ে থাকার অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হলেন। কিছু সময় পরে তিনিও উঠে দাঁড়ালেন। কোমরের দিকে ব্যাথাটা আবার বাড়তে শুরু করেছে। সম্ভবত কোমরের হাড়ে কোন সমস্যা হয়েছে। তিনি আঁকাবাঁকা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন।

চোখ খুলেই এ্যানি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলো। তার বাবা বেড সাইডের টেবিলে বসে আছেন। টেবিলে তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিলো। সেই জিনিসগুলো এখন বিছানায় রাখা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সেটা একপাতা ঘুমের বড়ি। তার বাবা এই মুহুর্তে সেই ঘুমের বড়ি হাতে নিয়ে বসে আছেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন। কুঁজো হয়ে বসেছেন। এক হাত কোমরে। মুখ চোখ কুঁচকে আছে। প্রথমবার দেখলেই মনে হবে তিনি খুব বেশি আনন্দে নেই।
সুতরাং ঘুম ভেঙ্গে দেখার জন্য যথেষ্ট অদ্ভুত দৃশ্য এটি। এ্যানি তার স্বভাবসুলভ উচ্ছাস নিয়ে বলে উঠলো “হুয়াট অ্যা সারপ্রাইজ ! মিস্টার লিডার ইজ ইন মাই রুম। এ্যাম আই স্টিল ড্রিমিং ?… স্যার, ক্যান আই টেক অ্যা সেলফি উইথ ইউ ?”
আব্বাস হুসাইন হেসে ফেললেন। কিন্তু তার হাসি চোখ মুখের কুঁচকানো ভাব পরিবর্তন করতে পারলো না।
“তোমার কী কোন সমস্যা হচ্ছে বাবা ? এবং সমস্যাটা কী আমাকে বলা যাবে ?”
আব্বাস হুসাইন সমস্যার মধ্যে গেলেন না। তিনি খুব মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলেন “মা তুমি কেমন আছো ?”
“দু’টো কথা। প্রথমত তুমি আমাকে মা বলে ডাকবে না। আমি তোমার মা নই। এবং তোমার মতো মাঝবয়সী বৃদ্ধ মানুষের মা হওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আগেও কয়েকবার তোমাকে এই ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। যেকোন কারনেই হোক তুমি সেই সাবধানতা অবলম্বন করছো না। তাছাড়াও আমাকে মা ডেকে তুমি দু’টো জেনারেশন কে অপমান করছো। একটা আমার জেনারেশন আরেকটা তোমার মায়ের জেনারেশন। একজন তোমার অগ্রজ আরেকজন তোমার অনুজ। এই দুই জেনারেশনকে অপমান করার কোন ইচ্ছা আশা করি তোমার মধ্যে নেই।”
“না নেই। দ্বিতীয় কথাটা কী ?”
“তুমি সবসময়ই একটা অভিনয়ের মধ্যে থাকো। সবার সাথে মিষ্টি করে কথা বলো। যখন তোমার মনের ভিতরটা রাগে গজরাতে থাকে ঠিক তখনও তুমি মিষ্টি করে কথা বলো। আমার এই অভিনয় পছন্দ না। তুমি আমার সাথে অভিনয় সাইডে রেখে কথা বলবে। বুঝতে পেরেছো ?”
“বুঝতে পেরেছি।”
“এখন বলো, তুমি কী কিছু বলতে চাও ? বলতে চাইলে বলতে পারো। আমি আগামী দশমিনিট তোমার কথা শুনবো ঠিক করেছি।”
“আগামী দশমিনিট কেন ?”
“তোমার কথাবার্তা প্রচন্ড রকম তিতা মনে হয় আমার কাছে। চিরতার পানির কাছাকাছি। সকালে উঠে এই জাতীয় অখাদ্য পানি পান করা শরীরের জন্য ভালো হওয়ার কথা।”
আব্বাস হুসাইন আবার হেসে ফেললেন। তার মেয়ে খুব মজা করে কথা বলতে পারে। এটা তার বেশ মজাই লাগে।
এ্যানি গম্ভীর হয়ে বললো “কোন হাসাহাসি না। আলোচনা শুরু করো। খবরদার কোন রাজনৈতিক আলোচনা হবে না। আমাদের আলোচনা হবে রাজনীতি মুক্ত বিশুদ্ধ আলোচনা।”
“রাজনৈতিক আলোচনা কেন করা যাবে না ?”
“কারন তোমরা রাজনীতিবিদরা নিজেদের সৃষ্টিকর্তার সমকক্ষ মনে করো। তোমাদের ধারনা দেশ তোমাদের আঙ্গুলি হেলনে চলে। তোমাদের এই জাতীয় মিথ্যা ধারনা থেকে বের হওয়া উচিত।”
“এটা খুব ভুল কথা। কোন দেশই কোন রাজনৈতিক দল চালাতে পারে না। দেশ চালায় মূলত সেই দেশের ধনী ব্যবসায়ীরা।”
“আগেই বলেছি আমার সাথে কোন রাজনৈতিক আলোচনা হবে না। সুতরাং এই আলোচনা এখানেই স্থগিত করা হলো।”
“আচ্ছা।”
“তোমার কী কোন কারনে মন খারাপ ?”
“বুঝতে পারছি না। খানিকটা বোধহয় খারাপ।”
“খানিকটা মন খারাপ হওয়ার কারনটা কী ? আচ্ছা তোমাকে বলতে হবে না। আমি প্রশ্ন করে বের করবো। এটার নাম ডিটেকটিভ ডিটেকটিভ খেলা। তুমি এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে চাও ?”
“চাই।”
“তোমার প্রিয় রং কী ?”
“নীল।”
“নীল কেন তোমার প্রিয় রং ?”
“আকাশের রং নীল তাই।”
“তুমি নীল আকাশ পছন্দ করো ?”
“করি।”
“যখন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামে এটা তোমার পছন্দ ?”
“এটাও পছন্দ।”
“এই পছন্দের কারন কী ?”
“কারন তোমার মায়ের সাথে এরকম এক বর্ষার দিনেই দেখা। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্ররাজনীতি পরিচিত মুখ। তোমার মা একজন সাহসী সাংবাদিক ….”
“দয়া করে থামো। কম করে হলেও অন্তত হাজার বার তোমার মুখে এই গল্প শুনেছি। এবং প্রতিবারই লক্ষ্য করি তোমার গল্পে কিছু সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়।”
আব্বাস হুসাইন অবাক হয়ে বললেন “পরিবর্তন হয় নাকি ?”
“অবশ্যই হয়। প্রথমবার যখন গল্পটা শুনি তখন মনে হয় তুমি এক অসহায় ছাত্র নেতা। যে পুলিশের লাঠি সামলাতে ব্যস্ত। কিন্তু প্রতিবার গল্প বলার সাথে সাথে তুমি সূক্ষ্মভাবে নিজের ক্যারেক্টার খানিকটা সিনেমার নায়কদের মতো শক্তিশালী বানিয়ে দাও। হয়তো এটা নিজের থেকে করো না। কিন্তু হয়ে যায়। আমার ধারনা আরো কয়েকবার এই গল্প বলার সুযোগ পেলে তুমি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।”
“তাহলে বরং এই গল্প থাক।”
“অবশ্যই থাকবে। তুমি বরং আমার গল্প শোন। মায়ের সাথে তোমার দেখা যেমন নাটকীয় ভাবে হয়েছে, খানিকটা এরকম ঘটনাও আমার সাথে ঘটেছে। তবে প্রথম দর্শনেই আমি সেই ছেলেটাকে ভড়কে দিয়েছি। খুব সম্ভবত সেই ছেলে এখন আমাকে ঘৃণা করে।”
“ছেলেটার নাম কী ?”
“ছেলেটার নাম অনয়। তবে তোমার সাথে মায়ের যেমন হয়েছে সেরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”
“সম্ভাবনা নেই কেন ?”
“কারন তোমরা ইমোশনাল ফুল। গড়পড়তা মানুষের মতো ভাবো জীবনটা সিনেমার মতো। আমি তোমাদের মতো ভাবি না। আমার ইমোশন তোমাদের চেয়েও অনেক কম। তোমার কী ঘুমে ধরেছে ? বসে বসে ঝিমাচ্ছো কেন ?”
“ধরেছে। কিন্তু বিছানায় শুয়ে পড়া মাত্র ঘুম উড়ে যাবে।”
“উড়বে না। আমি অদ্ভুত রকমের জাদুমন্ত্র শিখেছি। তুমি আমার বিছানায় শুয়ে পড়ো আমি জাদুমন্ত্র বলে তোমার ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।”
আব্বাস হুসাইন লক্ষ্মী ছেলের মতো বেড সাইড টেবিল থেকে উঠে পড়লেন। কুঁজো হয়ে এলোমেলো পা ফেলে বিছানার অন্যদিকে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। তার কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়া দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি মহা ক্ষমতাধর একজন ব্যক্তি।
এ্যানি আলগোছে তার বাবার কপালে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। হাত বুলানোর কারনেই হোক কিংবা তিনটা ঘুমের বড়ির রিএ্যাকশন, এই মুহুর্তে আব্বাস হুসাইনের পৃথিবী অন্ধকার করে ঘুম চলে আসছে। তার খুব করে আশঙ্কা হচ্ছে এই ঘুমেই তার মৃত্যু হবে। তিনি আর কখনোই জেগে উঠতে পারবেন না। তিনি জড়ানো গলায় বললেন “মা একটা কথা….”
“কোন কথা না। তুমি আবারো আমার সাবধান বাণী ভায়োলেট করেছো।”
আব্বাস হুসাইন শুধু মৃদু গলায় বলতে পারলেন “মা একটা….”
এ্যানির তার বাবার দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হচ্ছিল। পৃথিবীর সব মানুষকেই বোধহয় ঘুমের মাঝে নিষ্পাপ দেখায়। কারন কোন ঘুমন্ত মানুষ অন্যের ক্ষতি করতে পারে না।
এ্যানি সগোক্তির মতো বললো “শুধুমাত্র কোন রাজনীতিবিদ না হলে তুমি একজন চমৎকার বাবা হতে পারতে। আমরা দু’জন ভিন্ন পথের মানুষ বাবা।”
আব্বাস হুসাইন ততক্ষণে গভীর ঘুমে ডুবে গেছেন। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখছেন। স্বপ্নে তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন। পিছনের সিটে রৌজি আর জাবির চৌধুরী পাশাপাশি বসে আছেন। তিনি ক্লান্ত হয়ে একজায়গায় গাড়ি থামালেন। কারন স্বপ্নের ভিতরই ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। জাবির চৌধুরী তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। জানালেন কিছু সময় তিনি গাড়ি চালাতে চান। এবং তার ইচ্ছা আব্বাস হুসাইন ততক্ষণ পিছনের সিটে গিয়ে বসেন। অথচ রৌজি অসম্মতি জানাচ্ছেন। তিনি চান না আব্বাস হুসাইন তার পাশে বসেন। আব্বাস হুসাইন অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার ঘুম চলে গেছে। তিনি এখন না ঘুমিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চালাতে পারবেন।

(চলবে…)

পর্ব-২ এর লিংক:

 

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব)-২ : প্রতিবিম্ব-তন্ময় নাহা

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge