দ্য লাষ্ট সাপার
মিম্ মি
“রাজধানীর অভিজাত এলাকায় নিজ বাসভবন থেকে স্বামী স্ত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার”—- নাস্তার টেবিলে বসে পেপারের হেড লাইন দেখে চমকে উঠলো লইয়ার কাবেরি হোসেন। পুরো রিপোর্টটা পড়ে বুঝল যা ঘটার তা ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। নাস্তা শেষ না করেই বের হল থানার উদ্দেশ্যে।
মৃত ব্যক্তিদের একজন তার ক্লায়েন্ট ঈশান। মাস তিনেক চারেক আগে ডিভোর্স ফাইল করার জন্য লইয়ার হায়ার করেছিল ঈশান।
কেইসটা শুরু থেকেই ব্যতিক্রম লাগছিল কাবেরির। ঈশান বলেছিল আমার স্ত্রী ডাক্তার টুপুর নিজের সাথে নিজে কথা বলে বিড়বিড় করে। কাল্পনিক জগতে বসবাস করে। এই সমস্যা প্রথম প্রথম তেমন প্রকট ছিল না। কিন্তু দুই বছর আগে আমাদের বাচ্চাটা মারা যাবার পর থেকেই পরিস্থিতি মারাত্মক হচ্ছে দিনে দিনে। শুধুমাত্র রোগী দেখার সময়ে ও একদম নর্মাল থাকে।
তবে লোক জানাজানি হোক ও অসুস্থ এটা আমি চাই না। ওর চিকিৎসা করানোর চেষ্টাও আমি করেছি। কিন্তু সে মেডিসিন ঠিকমতো খায় না। এখন ওর সাথে এক ছাদের নীচে থাকতে ভয় লাগছে আমার। সকালে এক মানুষ, রাতেই অন্য মানুষ যেন টুপুর।
টুপুর আমি ডিভোর্স চাচ্ছি। লইয়ার বলল তুমি পেপারে সাইন করবে না বলে জানিয়েছ। কেন ? এভাবে জোর জবরদস্তি করে সম্পর্ক টেকে না। আমি আর অশান্তি চাচ্ছি না। মিউচুয়ালি বিষয়টি শেষ হলে ভালো হবে।নাহলে আমাকে কঠিন হতেই হবে। সেটা তোমার জন্য খুব সম্মানজনক নাও হতে পারে।
—–বেশ উচ্চস্বরে কথাগুলো বলল ঈশান।
অথচ ঈশান জোরে কথা বলার মানুষ না। আচার আচরনে সংযত মানুষ ও। বছর খানেক ধরে পরিবর্তন ঘটেছে তার। হুটহাট রেগে যাচ্ছে।
— তুমি তাহলে রীতুকে বিয়ে করছ ? প্রশ্ন করলাম ঈশানকে।
— দুই মাস ধরে তোমাকে বলছি। আমি ডিভোর্স চাই।
— ওকে ফাইন। ডিভোর্স পেপারে কারন হিসেবে লেখা ছিল বনিবনা হচ্ছে না। এই বনিবনা হচ্ছে না মানেটা কি জানার ছিল আমার। আমাদের বিয়ের সাত বছর চলছে। মনোমালিন্য বা ঝগড়াঝাঁটি ঘটেনি আমাদের । একবারের জন্যও রাগ করে চলে যাইনি আমি। তুমিও কখনো এমন কোন আচরন করনি। টুকটাক ভুল বোঝাবুঝি ঘটলেও মিটমাট করে নিয়েছি আমরা । হঠাৎ গত এক বছর ধরে এমন কি হল যে তোমার মনে হচ্ছে বনিবনা হচ্ছে না ? আসল কথা লিখলেই হয়। নতুন নারী এসেছে তোমার জীবনে ! আমি পুরনো হয়ে গেছি। ভালো লাগছে না আমাকে আর। সেজন্যই আর একসাথে থাকতে চাওনা তুমি।
— ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে না এটাই স্বাভাবিক না। আমাদের সম্পর্ক কেন এত শীতল তা ভেবেছ কখনো তুমি ? অবশ্য রোগী দেখে সময় পেলে না এসব ভাববে তুমি। এই শীতল লোক দেখানো ভদ্রতার মুখোশ পরা জীবনে আমি ক্লান্ত। হয়ে। তাই মুক্তি চাই। আর অন্য কাউকে ডিভোর্সের কারন বানিও না। তুমি খুব ভালো করে জানো আমি মিথ্যা বলি না।
— তাহলে ডিভোর্স পেপারে সত্য কারনটাই লিখতে বল তোমার লইয়ারকে। আমি সাইন করে দিব।
আমি টুপুর। পেশায় চিকিৎসক। আটটা থেকে দুইটা পর্যন্ত হাসপাতালে জব করি। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত চেম্বার। বেশ ব্যস্ততায় কাটে দিন আমার।
ঈশান আমার হাজবেন্ড। পেশায় শিক্ষক। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে এসিসট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে। বিকেল পাঁচটার মধ্যে সে বাসায় ফিরে আসে।
তারপর অনেকটা সময় ওকে একাই কাটাতে হয়। ও অবশ্য লেখাপড়া করে ঐ সময়টা ।
ভালোই চলছিল আমাদের সংসার। দুই বছর আগে আমাদের বাচ্চাটা মিস ক্যারেজ হয়ে যায়। সাতাশ সপ্তাহের ছিল বাচ্চাটা। মৃত বাচ্চাটাকে সিজার করে বের করতে হয়। এরপর মাস ছয়েক আমি পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনে চলে যাই। ঐ সময় থেকেই আমাদের মাঝে দূরত্বের সূচনা।
সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সময়ে ঈশান বলল আজকে রাতেই ও বাসা শিফট করবে। ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব প্যাকিং করা আছে। দুপুরে ড্রাইভার এসব নিয়ে যাবে ওর নতুন ফ্ল্যাটে। আগামীকাল লইয়ার নতুন পেপারস পাঠাবে হাসপাতালের ঠিকানাতে । আমি যেন সাইন করে দেই।
এই ফ্ল্যাটটা আমার হাসপাতালের বেশ কাছে। তাই ভাড়া একটু বেশি হলেও বিয়ের পরে আমরা এখানেই সংসার সাজিয়ে নিয়েছি।
ঈশান লিফটের বাটন প্রেস করতেই আমি দরজা থেকে বললাম আজ রাতে কি আমরা একসাথে শেষ ডিনার করতে পারি ?
পেছনে ঘুরে আমাকে এক পলক দেখল ও। লিফটে উঠে বলল — ওকে টুপুর।
ছুটি নিয়েছিলাম আমি। আজ আমাদের সপ্তম বিবাহ বার্ষিকী। ঈশানের মনে নেই সম্ভবতঃ। ও এখন ব্যস্ত রীতুকে নিয়ে। নয় বছর আগে আজকের দিনে ঈশান প্রোপোজ করেছিল আমাকে। আর এই দিনটাকে মেমোরেবল করে রাখতেই বিয়ের ডেট ফিক্সড করি আমরা। সে কি উথাল পাথাল প্রেম করলাম দুই বছর আমরা।
আজকে কেন যেন মনে হচ্ছে নুসরাতকে ডাম্প করে ঈশান যখন আমার কাছে এল তখন ওকে একসেপ্ট করাটা ভুল ছিল। নুসরাত আর আমি স্কুল জীবন থেকে বেষ্ট ফ্রেন্ড। কলেজ, টিউশন, মেডিকেলের কোচিং সব জায়গাতে একসাথে পড়েছি। মেডিকেলের কোচিং করার সময়ে ঈশানের সাথে নুসরাতের সম্পর্কের শুরু। ঈশান আমাদের কোচিং এ ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার ক্লাশ নিত।
আমরা যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি তখন ওদের ব্রেকাপ হলো। ঈশান আমাকে প্রোপোজ করল। আমি একসেপ্ট করলাম। নুসরাতের সাথে তেরো বছরের বেষ্ট ফ্রেন্ডের সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেল আমার।
আসলে আমার জীবনে কোন মানুষ ই খুব বেশিদিন থাকে না। যখন ক্লাশ টুতে পড়ি তখন ডেঙু জ্বরে মা মারা গেল। বছর না ঘুরতেই বাবা আমাকে ফেলে কোথায় চলে গেল। নানা বাড়িতে আশ্রয় মিলল তখন আমার। ঐ সময় থেকেই শুরু হলো আমার নরক জীবনের। ঐ যন্ত্রণাময় সময়ে পরিচয় , বন্ধুত্ব নুসরাতের সাথে আমার। সেই বন্ধুকেও ধরে রাখতে পারলাম না আমি।
ঈশানকেই আঁকড়ে ধরলাম। ইন্টার্নশীপ শেষ করে নুসরাত এএমসি পরীক্ষা দিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। আর যোগাযোগ হয়নি কখনোই। শুনেছি ও একটা বাচ্চা দত্তক নিয়েছে। বিয়ে থা করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমাদের বাচ্চাটা যখন পেটে এল আমার ডায়বেটিস ধরা পরলো। সাথে হাইপারটেনশনও। দুটোই আনকন্ট্রোল থাকতো। ইনসুলিন নিতাম সকালে রাতে। বাচ্চাটার গ্রোথে সমস্যা হচ্ছিল। প্রতিবার আলট্রাসোনোগ্রাফিতে মন খারাপ হতো। তারপর তো ঠিকমতো অক্সিজেন সাপ্লাই না পেয়ে পেটের ভেতরেই মারা গেল বেবীটা। ঐসব দিনে খুব মনে হতো নুসরাতের অভিশাপে আমাদের বাচ্চাটা চলে গেল ! এই ভাবনা থেকেই পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেসনে আক্রান্ত হলাম।
দুইবার সুইসাইডাল এটেম্পও নিয়েছিলাম। প্রায় প্রায় গভীর রাতে শিশুর কান্না শুনতাম আমি। কান্নার উৎস খুঁজতে বারান্দায় ছুটে যেতাম। আমাদের বারান্দাতে গ্রিল নেই। লো হাইট দেয়াল। কিন্তু চওড়া অনেক। উঠে বসা যায় সেখানে। বাচ্চার কান্নার শব্দে অস্হির হয়ে বারান্দার দেয়ালে দাঁড়িয়ে নীচে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করেছিলাম একবার। নীচ থেকে সিকিউরিটি গার্ড এটা দেখতে পেয়ে ঈশানের মোবাইলে ফোন দেয়। ও এসে আমাকে টেনে নামায় দেয়াল থেকে।
তারপর শুরু হয় আমার চিকিৎসা সাইক্রিয়াট্রিস্টের কাছে। রেগুলার মেডিসিন আর সেশন চলতে থাকে। আটটা সেশন নেবার পরে শুধু মেডিসিনে চলে আসে ডাক্তার। ঐ সময়ে ডায়াগনোসিস হয় আমি নাকি মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজওর্ডারে ভুগছি !
কারন হিসেবে ডাক্তার ফাইন্ড আউট করলেন আমার ছোটবেলার ট্রমাগুলোকে। মায়ের মারা যাওয়া। বাবার মিসিং হওয়া। নানাবাড়িতে বছরের পর বছর চাইল্ড এবিউজের শিকার হয়েছিলাম আমি দূর সম্পর্কের এক মামার কাছ থেকে। তখন থেকেই মূলতঃ নিজের সাথে নিজের কথা বলার শুরু আমার। কিন্তু প্রচন্ড মেধাবী হওয়াতে লেখাপড়াতেই ব্যস্ত রাখতাম নিজেকে। রেজাল্টও ভালো হচ্ছিল বলে কেউই আমার সমস্যা ধরতে পারেনি। এমনকি আমি নিজে ডাক্তার হয়েও বুঝতে পারিনি কি ঘটছে আমার ভিতরে। এক শরীরের মধ্যে কয়জনাকে ধারন করছি আমি জানতে পারিনি।
সারাদিন ভরে রাঁধলাম ডিনারের জন্য । সব ঈশানের পছন্দের ডিশ। মোটা চালের লেটকা খিচুড়ি, ইলিশ ফ্রাই, ধনেপাতা, শুকনা মরিচ ভর্তা, গরুর মাংস ভুনা, আলুর চপ, বিন্নি চালের পায়েস আর বোরহানি।
বিকেলে বের হলাম একটু। প্রথমে গেলাম রেড বাটন বারে । এই বারটাতে ঈশানের সাথে কয়েকবার এসেছি আমি। হুইস্কি কিনলাম এক বোতল। ব্লু লেভেল ব্রান্ডটা ঈশানের প্রিয়। লাষ্ট সাপারে ড্রিঙ্কস না থাকলে কি চলে?
এরপর গেলাম ফার্মাসিতে। সাইক্রিয়াট্রিষ্টের লেখা আমার প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে। এক পাতা এমিট্রিপটাইলিন ট্যাবলেট কিনলাম। এক পাতাতে আছে দশটা ট্যাবলেট। বাসাতে গত মাসের তিন পাতাই পরে আছে। তারমানে মোট চল্লিশটা হলো ট্যাবলেট। আরো এক পাতা কিনতে পারলে বেশ হবে। এই ফার্মাসি থেকে নেয়া যাবে না। এক পাতার বেশি এরা বিক্রী করে না। প্রেসক্রিপশন থাকলেও। সামনেই আছে আরেকটা ফার্মাসি। ঐখান থেকে নিলাম আরো একপাতা। মোট পঞ্চাশটা ট্যাবলেট !
বাসায় ফিরে লম্বা একটা হট শাওয়ার নিতে হবে আজকে। শাওয়ারের সময় মিউজিক শোনা আমার বহুদিনের অভ্যেস। আমাদের বেডরুমের ওয়াসরুমে একটা মুভেবল সাউন্ডবক্স সেট করা দেয়ালে। ঈশান নিজ হাতে এটা করে দিয়েছিল। মোবাইলে গান ছাড়লাম জাস্টিন বিবারে intentions
Picture-perfect, you don’t need no filter
Gorgeous, make ’em drop dead,
you a killer !
Shower you with all my attention
Yeah, these are my only intentions
Stay in the kitchen, cooking up, cut your own bread
Heart full of equity, you’re an asset
Make sure that you don’t need no mentions
Yeah, these are my only intentions
.
আকাশ নীল রঙের একটা শাড়ি পরব ভাবছি। ঈশানের পছন্দের রঙ। কপালে কালো টিপ আর চোখে মোটা করে কাজল টেনে দিলাম । শ্যানেল পারফিউম ছোঁয়ালাম পুরো শরীরে।এই হালকা ঘ্রাণের পারফিউমের মাদকতায় ঈশান ডুবতে ভালোবাসতো। ও সব সময় আমাকে কানের লতিতে চুমু খেয়ে আদর শুরু করত। অবশ্য গত দেড় দু বছরে আদর আর হয়নি আমাদের মাঝে । যা ঘটেছে দুই তিন মাস অন্তর তা জৈবিক চাহিদ পূরণ মাত্র।
সাতটার দিকে ফোন দিল ঈশান। জানালো ওর আসতে আসতে নয়টা বেজে যাবে। আর ও এসে বেশিক্ষণ থাকবে না। ডিনার যেন রেডি থাকে।
ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো আমার। এতোই তাড়া তোমার প্রিয়তম !
নয়টা বাজতেই ডোরবেল বেজে উঠলো। ঈশান ভেতরে ঢুকে বলল ডিনার রেডি ? আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
ডাইনিং টেবিলে এসে বসলাম দুজনে। নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিচ্ছে ঈশান নিজেই । একবারও আমাকে বলল না তুমিও বস খেতে। অবাক হলাম না। তবে মনটা সামান্য খারাপ হলো বটে। দুই গ্লাস পানি খেলাম সময় নিয়ে আমি।
খুব সুন্দর মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে খাবার থেকে বলল ঈশান।
—রান্না ভালো হয়নি ? জানতে চাইলাম আমি।
মাথা ঝাঁকিয়ে হুম বলল ও।
মুখে উত্তর দিতেও যেন অনীহা।ঈশান এখন মজে আছে নুসরাতে। হুমম রীতুই যে নুসরাত তা জানতে আর বাকী নেই আমার। নুসরাতের নামের রাত অংশকে ঈশান আদর করে রীতু বলে ডাকতো। ওদের অনেকগুলো প্রেম পত্র পড়েছিলাম আমি। নুসরাতের ব্যাগ থেকে নিয়ে। তখন থেকেই জানি।
খাওয়া শেষ হতেই ঈশান বলল আমাকে এখুনি বের হতে হবে। আমি ওর হাতটা একটু ছুঁয়ে বললাম শেষ বারের মতো এক পেগ হুইস্কি খাবে আমার সাথে! প্লিজ !
না করলো না ঈশান। বলল তুমি তো ডিনার করলে না।
—-পরে খাব। চল বারান্দায় যেয়ে বসি। আমি আইস নিয়ে আসছি। তুমি হুইস্কি নিয়ে যাও। বেডরুমের সাইট টেবিলে রেখেছি। আজ কিন্তু ভুল করিনি। আড়াআড়ি করেই রেখেছি বোতলটা। মনে আছে আমি সোজা করে হুইস্কির বোতল রাখতাম বলে তুমি কী ভীষন রাগ করতে?
হাসলো ঈশান। বলল ফ্রিজেও রেখেছ কত বার ভুল করে।
আমি কিচেনে এলাম। কেন যেন খুব আনন্দ হচ্ছিল। চোখের কোণে একটু জ্বালা করছে। না এখন কাঁদা যাবে না। একটু আগের মন খারাপের ভাবটা কেটে গেছে। ফ্রিজ খুলে আইসবক্সটা বের করলাম।
বারান্দায় এসে দেখি ঈশান মোবাইলে টেক্সট করছে। মনে হয় রীতুকে। দু’জনের গ্লাসে দুই আউন্স ঢাললাম। আইসবক্সের ডান পাশ থেকে তিন টুকরো বরফ তুলে ঈশানের গ্লাসে ফেললাম। আমার জন্য বাম পাশ থেকে তুললাম এক টুকরো বরফ।
ঈশান বলল কাল লইয়ার পেপারস পাঠালে সাইন করে দিও। প্রতিমাসে তোমার ব্যাঙ্ক একাউন্টে জমা করে দিব প্রাপ্র টাকাটা। এর বাইরে যদি কোন কিছুর দরকার হয় আমাকে জানিও। ওষুধ খেও ঠিকমতো। নিজের যত্ন নিও।
গ্লাসের হুইস্কি শেষ হবার আগেই ঢুলতে শুরু করলো ঈশান। বলল বমি পাচ্ছে, পেটে ব্যাথা হচ্ছে টুপুর।
আমি বললাম ওঠ। আমাকে ধর। চল রুমে যাই। রুমে এসে বিছানায় বসতেই হেলে পরলো ঈশান। কাজ শুরু করে দিয়েছে মেডিসিন।
ঈশানের পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম। লক করা স্ক্রিন। পাসওয়ার্ড জানি আমি। মোবাইলের কল লিষ্টে গেলাম। আকাঙ্ক্ষিত রীতুর নামটাই সবার আগে ছিল। ঘন্টাখানেক আগে শেষ কথা হয়েছে ওদের। মানে লিফট থেকে নেমে বাসায় ঢোকার আগে। হাসলাম একটু আমি। দুই বার রিং হবার পরে ফোন পিক করলো।
— হ্যালো ঈশান কাজ শেষ ? এত সময় লাগলো একটা ইনজেকশন পুশ করতে ? সেই কখন থেকে ফোন হাতে বসে আছি আমি। এক একটা মিনিট যেন এক একটা ঘন্টা মনে হচ্ছিল। টুপুরকে বিছানাতে শুয়ে লাইট অফ করে বের হও এবার। ঘুমাক ও।
আমি চট করে ঈশানের বুক পকেটে হাত ঢুকলাম। একটা সিরিঞ্জ পেলাম। সিরিন্জের ভেতরে মেডিসিন ভর্তি ! অট্টহাসিতে ফেটে পরলাম এবার আমি। মোবাইলের ঐ পাশ থেকে ভেসে এল — কে কে ?
— আমাকে চিনতে পারছিস না নুসরাত ?
— টুপুর !!! তু ….তুই !
— চমকে গেলি ?
— ঈশান কই ? ঈশানকে দে।
— হাহাহা ঈশান আর তোর ফোন ধরবে না রে।কোনদিন ই।
— কি করেছিস তুই ঈশানের সাথে ?
— তুই যা করতে চেয়েছিলি আমার সাথে।
— মা….. মানে কি বলছিস তুই ?
— সিরিঞ্জে কি মেডিসিন দিয়েছিস আমাকে মেরে ফেলতে ? তুই আমাকে এত বোকা কি করে ভাবলি ? নাকি তেরো বছরে সবকিছু ভুলে গেলি ?
— কি বলছিস টুপুর তুই ?
— ঈশান আমার ছিল। আমার থাকা অবস্থাতেই মারা গেল। আমাদের বাচ্চাটা মারা গেছে জানিস। তুই তুইইই দায়ী এসব কিছুর জন্য।
— কি বলছিস তুই ? আমি !
— হুমম আমাদের বাচ্চা, ঈশান, আমার…… আমাদের সবার মৃত্যুর জন্যে তুই ই দায়ী নুসরাত।
— কি আশ্চর্য! কি বলছিস এসব ? আর তোর মৃত্যু মানে কি ? তুই কথা বলছিস এখনো আমার সাথে।
— হাহাহা তুইই তো ঈশানের পকেটে সিরিঞ্জে পয়েজন পাঠিয়েছিস আমার জন্য । আমাকে মেরে বিছানাতে ফেলে লাইট অফ করতে বলেছিস। বলিসনি ? কিন্তু এসব কিছুই হবে না। তোর খেলা শেষ।
ফোন কেটে বারান্দায় এলাম। গ্লাসে তখনো ঈশানের খাওয়া হুইস্কির অনেকটা পড়ে আছে। সময় নষ্ট না করে এক চুমুকে শেষ করলাম তা। গভীর ঘুম ঘুমাব বলে ইথিলিন গ্লাইকল অনেকখানি মিশিয়ে রেখেছিলাম হুইস্কির বোতলে, ডিনারের সব আইটেমে। গত সপ্তাহে ওটি রুম থেকে নিয়ে এসেছিলাম ইথিলিন গ্লাইকল।
সাথে এমিট্রিপটাইলিনের গুঁড়ো মিশিয়েছি ডিনারের ডিশগুলোতে । কতদিন কত রাত হলো শান্তি মতো ঘুমাই না। কিন্তু ঈশানকে ঘুম পাড়ানোর কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। ঈশান কেন একবারও বলল না টুপুর এস লাষ্ট সাপার দুজনে একসাথে করি। এতো অপছন্দ এখন আমাকে ওর ? আমি পাগল ? আমি কি ইচ্ছে করে Dissociative identity disorder এ ভুগছি ? কেন আমাকে একটু বুঝতে চেষ্টা করলো না ঈশান ? ও ছাড়া আর কেইবা আছে আমার ?
ঈশানের পাশে শুয়ে পড়লাম। ঠোঁট ছোঁয়ালাম ঈশানের ঠোঁটে। চোখের কোণে জল। গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে । ঈশানের বুকে মাথা রাখলাম।
পরের দিন দেশের প্রথম সারির সব দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম হলো রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বামী এবং চিকিৎসক স্ত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার।
ড্রাইভার প্রতিদিনকার মতো সকালে ডিউটিতে এসে দরজায় নক করে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে স্যার আর ম্যাডামের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করে। তাতেও ব্যর্থ হলে এপার্টমেন্ট সোসাইটির গার্ডকে ইনফর্ম করে । তখন এই হাউজিং এর সভাপতিকে জানানো হলে পুলিশকে জানায় অথোরিটি ।
প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারনা করছে এটা সুইসাইড কেইস। স্বামী স্ত্রী দুজনে কমিটেড সুইসাইড করেছে। বাসাতে কোন কিছু এলোমেলো নেই। বাইরে থেকেও কেউ আসেনি। ডাইনিং টেবিলে খাবার পরে আছে। সম্ভবতঃ খাবারেই কিছু মেশানো হয়েছে।
সাসপেক্টেড এলিমেন্টস কালেক্ট করেছে পুলিশের তদন্তকারী সংস্থা। বডি দুটো ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট হাতে এলে মৃত্যুর প্রকৃত কারন জানা যাবে।
তিন মাস পর।
লইয়ার কাবেরী হোসেনের চেম্বারে হাজির সিআইডি ডিপার্টমেন্ট কর্মকর্তা আরিফ। সে ঈশান টুপুর কেসের তদন্তকারী অফিসার। কাবেরীর ভার্সিটির বন্ধু। মেয়ের জন্মদিনের দাওয়াত দিতে এসেছে কাবেরীকে।
কাবেরী জানতে চাইলো ঈশানদের কেসটা সম্পর্কে।
—– গত সপ্তাহে ফাইল ক্লোজ হলো। এতো পুরাই পাগলা কেস দোস্ত । ঈশানের স্ত্রী অসুস্থ ছিল জানতি তো। মাল্টিপল পার্সোনালি ডিজঅর্ডারে ভুগছিল । নুসরাত বলে কেউ একজিষ্ট করে না। টুপুরেরই আরেক
স্বত্তা এই নুসরাত। যা টুপুরেরই তৈরী !
—যাহ কি বলিস ?
— হুম। ইনভেস্টিগেশনে ওর ডাক্তার জানিয়েছে এই তথ্য। প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্টস কালেক্ট করা হয়েছে। নুসরাতের সৃষ্টি খুব সম্ভবতঃ ওর টিনেইজ পিরিয়ডে। যখন থেকে চাইল্ড এবিউজের শিকার ঐ সময়ে। মা বাবা কেউ নেই। নানা বাড়িতে থাকে। দূর সম্পর্কের আত্মীয় হ্যারাস করছে । কাউকে বলতে পারছে না। তখন ও নিজের মনে মনে কথা বলতো নুসরাতের সাথে। ওর নানা বাড়ির লোকের সাথে কথা বলে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে। টুপুরের স্কুল কলেজে এমনকি মেডিকেলেও নুসরাত নামে কেউ ওর ক্লাশমেট ছিল না। ও নিজেই নিজের দুটো স্বত্তা নিয়ে প্রেম করেছে ঈশানের সাথে। কিন্তু যখন বিয়ের প্রসঙ্গ চলে এল তখন নুসরাতকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিল। নুসরাত চ্যাপ্টার ঐখানেই শেষ হয়েছিল। কারন ঈশানকে তখন ও পেয়ে গিয়েছিল। বিয়ের প্রথম কয়েক বছর ওরা বেশ ভালো ছিল।
— হুম । এটা ঈশান আমাকেও বলেছে । ওদের বাচ্চার ইনসিডেন্সের পরেই টুপুরের পাগলামো বেড়ে যায়।
— সবথেকে যেটা খারাপ হয়েছে তাহল ওষুধ ডিসকন্টিনিউ করা । ঈশান ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে বহুবার । কিন্তু টুপুর ওষুধ খেত না। ফলে ওর দ্বিতীয় সত্বা নুসরাতের আগমন আবার ঘটে। একা একা ওর সাথে কথা বলতে শুরু করে। আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে কল্পনা করে নিল ঈশানের সাথে নুসরাতের পুনরায় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
— আচ্ছা। দুজনেই মারা গেল কিভাবে? পয়জনিং ?
— ওদের বাসাতে প্রচুর পেইন্টিং দেখেছিস? ডাইনিং রুমে দ্য লাষ্ট সাপারের রেপ্লিকা আছে একটা। ঐখান থেকেই আইডিয়া নেয়া যতদূর মনে হয়। কাজটা টুপুর করেছে বলেই ধারনা আমাদের। ডাক্তার মানুষ। ইথিলিন গ্লাইকল কালেক্ট করা সহজ ওর জন্য । ওটি থেকে নিয়ে এসেছিল হয়তো।
ঐদিন রাতে যেসব খাবার ওদের ডাইনিং টেবিলে ছিল তা পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে ইথিলিন গ্লাইকল আর এমিট্রিপটাইলিন। বারান্দার হুইস্কির গ্লাসেও।এমনকি খাবার পানিতেও। এটা খুবই শক্তিশালী মেডিসিন । দশ থেকে বিশ মি লি ই যথেষ্ট চির নিদ্রায় যেতে। পাঁচ ছয় ঘন্টার ভেতরে ডায়ালাইসিস বা অন্য কোন চিকিৎসা না পেলে কনফার্ম মৃত্যু। ওদের ডেড বডি প্রায় দশ বারো ঘন্টা পরেছিল ফ্ল্যাটে।
—- দুঃখজনক। দুটো মেধাবী মানুষ এভাবে শেষ হয়ে গেল। দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বলল কাবেরী।
— আমার কি মনে হয় জানিস দ্য লাষ্ট সাপার ছবিটা ডাইনিং রুমে না থাকলে টুপুরের মাথায় এই ভয়ংকর আইডিয়াটা কখনোই আসতো না। যত নষ্টের গোঁড়া লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির এই লাস্ট সাপার। ডাক্তার মানুষ। প্রচন্ড মেধাবী ছিল। তাই মৃত্যুটাকেও এলেবেলে করতে চায়নি বোধহয়…