দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া
মো. শওকত আলী
ক’দিন ধরেই ভাবছিলাম যা দেখে এসেছি তার একটা বিরক্তিকর বর্ণনা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলে কেমন হয়?কিন্তু মন্ত্রণালয় আর জাদুঘরের দু’দায়িত্বের মাঝে সময় বের করে লিখতে ইচ্ছে করছিল না।এর মাঝেই এসে গেল বিশ্বমারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাধি। আতংকের নাম কোভিড-১৯ ।পৃথিবী দেখছে প্রকৃতি বা সৃষ্টিকর্তা আমরা যে নামেই বলি না কেন, তার কাছে মানুষ কতো অসহায়। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মানুষকে আক্রান্তের ক্ষেত্রে সাম্যবাদী(?) এ ভাইরাস যেন মানুষের অদৃশ্য শত্রু।আর অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যে কত কঠিন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মনুষ্য সমাজ। সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়েও কোন বিত্তশালী পাচ্ছে না নিরাপদ স্হান কিম্বা নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা। ভরসা একটাই প্রতিরোধ।তাও সকলে মিলে একসঙ্গে বিচ্ছিন্ন থেকে, অনুসরণীয় নির্দেশনা মেনে। যা’হোক, মার্চ মাসের গোঁড়ার দিকে গিয়েছিলাম নেত্রকোনার বিরিশিরি। অনেকদিন থেকেই যাবার ইচ্ছে। উদ্দেশ্য দু’টো।একটি দাপ্তরিক অন্যটি ব্যক্তিগত।দাপ্তরিকটি হলো সেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মূলতঃ গাঁড়োদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে। তাদের সরকারি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান।অন্যটি বিরিশিরির প্রাকৃতিক দৃশ্য আর সোমেশ্বরী নদীর ‘কাকচক্ষু’ স্বচ্ছ জল দেখা। গত ৩/৪ বছর অনেকবার পরিকল্পনা করেও যাওয়া হয়নি।যখনই রাস্তার দূরাবস্হার কথা শুনেছি তখনই ‘পরি’ উড়ে গিয়ে কল্পনা মনের ভিতরে রয়ে গেছে। গত প্রায় মাস ছয়েক থেকে নতুন পরিচালক নাছোড়বান্দার মত লেগে থেকে পাকা কথা নিয়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে।মনে মনে ঠিক করলাম, যাবোই যখন রথ দেখা কলা বেচা দুটোই করে আসবো।তাই সকাল সকাল বাসা থেকে বের হবার মনস্থ করলাম।কিন্তু মনস্হ করলেই তো হয় না।ছুটির দিনে কি সকাল সকাল উঠতে ইচ্ছে করে? যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি বের হবার চেষ্টা করলাম।পথে ট্রাফিক জ্যামের কথা মাথায় ছিল। গাড়ীতে উঠে রওনা দিলাম। আর অমনি শুরু হলো হঠাৎ বৃষ্টি, সাথে দমকা হাওয়া।যা হবার তাই হলো।আজিমপুর থেকে উত্তরা পার হতেই লেগে গেল দু’ঘন্টার উপর। সামনে জয়দেবপুর চৌঁরাস্তার জ্যাম তো আছেই।ভাবলাম ছুটির দিন, সামান্য হলেও রাস্তা ফাঁকা পাবো। অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়।ওদিকে নেত্রকোণায় বলা হয়েছে যে আমরা সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছাবো।বিলম্ব দেখে শুরু হয়েছে তাদের উৎকন্ঠা। কিছু সময় পরপর সংগে থাকা সহকর্মীকে ফোন করে অবস্থান জানতে চায়।আমরা তো সাড়ে দশটায় চৌঁরাস্তাও পার হয়নি। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বিরিশিরি।মনে মনে ঠিক করলাম, আগে কাজ তারপর ঘোরাঘুরি। বিরিশিরি নামটা নিয়ে মনে আমার কৌতুহল ছিল। নামটার মধ্যে একধরনের কাব্যিকভাব আছে। তাই পৌঁছানোর পর পুরাদস্তুর পেশাদারী মনোভাবে প্রশিক্ষণের কাজ শেষ করেই জানতে চাইলাম বিরিশিরি নামের মাহাত্ম্য কি।জিজ্ঞেস করে পেলাম এক মজার কাহিনী।ওখানে একটি গ্রাম আছে, নাম শিরবির।কেউ কেউ বলেন ঐ শিরবির নাম থেকেই বিরিশিরি নামের উৎপত্তি। বলা রাখা ভালো, বিরিশিরি কিন্তু নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুর উপজেলার একটি ইউনিয়ন। আবার আর একটি গল্প প্রচলিত আছে এ নামের পিছনে। এ এলাকাটা অনেক দূর্গম ছিল একসময়। এমনই দূর্গম ছিল যে ব্রিটিশ ভারতের শাসন বহির্ভূত এলাকা ছিল এটি।Indian Act,1935 অনুযায়ী এ এলাকাকে বলা হতো Excluded Area in British India. কিন্তু ব্রিটিশদের যাতায়াত ছিল ঐ এলাকায়।বৃটিশরা জাজিরা নামক স্হান পর্যন্ত রেলপথ স্হাপন করেছিল।সেখান থেকে পায়ে হেঁটে তারা চলে যেত ঐ এলাকায়। একবার এক বৃটিশ ভদ্রলোক হেঁটে গিয়েছিলেন ঐ এলাকায়। যাবার পথে স্হানীয় এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি কোথায় যাচ্ছেন । বেচারা ইংরেজ বাংলা না বুঝতে পেরে বলেন ‘ভেরী স্যরি’।সেটাই কালক্রমে হয়ে যায় বিরিশিরি। যাহোক,সাড়ে তিনটা নাগাদ মোটরবাইকে রওনা হলাম। প্রথম চিনামাটির পাহাড় দর্শনে।পথে পেরুতে হবে সোমেশ্বরী নদী।তার আগে কালচারাল একাডেমি, বিরিশিরি নিয়ে একটু বলি। একাডেমিটি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্বিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চর্চার একটি কেন্দ্র।বিভিন্ন নৃ-তাত্বিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান এখানে হয়ে থাকে। ১৯৭৭ সালে এটি প্রতিষ্টিত হয়।এখানে একটি ছোট জাদুঘরও রয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এটি।এটিও এ এলাকায় একটি দর্শনীয় স্থান। এর অফিস প্রাংগনে ওয়াচ টাওয়ার ধরনের বাঁশের তৈরি
এবং উচুঁতে স্হাপিত একটি জিনিস আমার নজরে আসে ।একজন কর্মকর্তাকে জিগ্যেস করাতে জানলাম ওটার নাম গাড়োদের ভাষায়’বরাং’ যার বাংলায় অর্থ হলো পাহারা বা টং ঘর।জুম খেতে রাতে পাহারা দেয়ার সময় রাত্রিযাপনের জন্য এটি ব্যবহার করা হতো । স্হানীয় কর্মকর্তাদের সংগে করে মোটরবাইকের পিছনে চেপে সোমেশ্বরী নদীর উপর কাঠের সরু সাঁকো পেরিয়ে চীনা মাটির পাহাড়ে পৌঁছলাম।মেশিন দিয়ে সোমেশ্বরী নদীর বালু আর পাথর উঠানোর প্রতিযোগিতা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এ নদীর যে সৌন্দর্যের কথা আমি শুনে এসেছিলাম মনে হলো সেটার হানি তো বটেই ক’দিন পর নদী এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হতে শুরু করবে এখানে। সাদা মাটির টিলা-পাহাড় দূর্গাপুর উপজেলার কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বিজয়পুর গ্রামে পড়েছে।সংগের সহকর্মীদের কাছে জানতে চাইলাম যে এ সাদা মাটি তো আপনাদের দূর্গাপুরের মাটি। তো এ মাটিকে কেন চীনা মাটি বলা হয়? চীন দেশের মাটি কি এরকম দেখতে? সকলে দেখি আমতা আমতা করছে।আমার আসলে বিষয়টা জানা ছিল। মজা করার জন্য জিজ্ঞেস করেছিলাম।তাদের বললাম আসলে চীনারা প্রথম এ ধরনের সাদা মাটি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র তৈরি করা শুরু করে। সে থেকেই এ ধরনের মাটি পৃথিবীর যেখানেই পাওয়া যাক তাকে Chaina Clay বা চীনা মাটি বলা হয়।এ মাটির একটা বৈশিষ্ট্য হলো বেশি তাপে আগুনে পোড়ালে এটি সাদা,মসৃণ ও চকচকে হয়ে যায়। আর এ বৈশিষ্ট্যের কারনেই এ মাটি ব্যবহার করে কাপ,প্লেট,বাটিসহ নানারকম তৈজসপত্র তৈরি করা হয়। প্রায় ৪৬% বালু,৪০% এ্যালুমিনা এবং ১০% পানি রয়েছে এ মাটিতে।আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত আর কোথাও চীনা মাটি পাওয়া গেছে বলে জানা নেই আমার।তবে জানলাম ১৯৫৭ সাল থেকে খনিজ এ মাটি উত্তোলন শুরু হয় এখানে।বিভিন্ন রংয়ের মাটি, পানি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বেশ আকর্ষণীয় এখানকার।প্রাকৃতিক তাপে ছোট ছোট টিলাগুলোর কোনটির মাটি সাদা,কোনটির আবার হাল্কা গোলাপি, হলুদ,খয়েরী বা নিলাভ।এর দর্শন অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা।আমরা যখন ছিলাম টিলার পাশের জলাধারে তখন এর পানির রং অনেকটা সবুজাভ।সূর্য কিরন বাড়াকমার সাথে সাথে পানি কখনও সবুজাভ কখনও নীলাভ রঙ ধারন করে। আশেপাশে কিছু আদিবাসীদের বসতিও দেখা যায়। এখান থেকে রওয়ানা হলাম রানী খং মিশনের চার্চ দর্শনে যার নাম ‘সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী’। সূর্য প্রায় অস্তাচলগামী। মূল সড়ক বাঁয়ে রেখে পেচানো সরু রাস্তা।সেটির মাথা শেষ হয়েছে রানী খং বিদ্যালয়ের সামনে।এর পাশেই চার্চ।কিন্তু বিদ্যালয়কে পিছনে রেখে যে সোমেশ্বরী নদী।তাকে না দেখে চার্চে ঢুকি কি করে?যে সোমেশ্বরী দেখার বাসনা ছিল মনে মনে সেই সোমেশ্বরীকে পেয়ে গেলাম।পড়ন্ত বেলায় যে নদীরও সৌমকান্ত রুপ প্রকাশ পায় সেটি তখনকার সোমেশ্বরীর অবস্থা না দেখলে বুঝতে পারতাম না।তবে বিবরণ দিতে আমি অপারগ।আমার হয়তো ভাব আছে কিন্তু ভাষা নেই।কবি – সাহিত্যিক কেউ হলে হয়তো একটা সুন্দর বর্ণনা দিতে পারতেন।হয়তো সেটিই একটি সুখকর পাঠ্য হতো। কিছুটা বালি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম সোমেশ্বরীর বুকে।কিছুটা সামনে নদীটা বাঁক নিয়েছে।শান্ত পানিতে একটা রঙিন ইঞ্জিন চালিত নৌকা নোঙর করানো।নৌকাটায় উঠে সোমেশ্বরীর কাকচক্ষু স্বচ্ছ পানি দেখলাম। হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলাও করলাম।নদীর অপরপাড়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্য।দূরের পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে অলসভাবে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর চলে গেলাম সেই চার্চে যেটি ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অনেকটা টিলা আকৃতির উঁচু জায়গায়। মজার একটা মিথ আছে এটিকে ঘিরে।বহুদিন আগে এ অন্চলে ‘খং রানী’ নামে এক রাক্ষস বাস করতো।গারো আদিবাসীরা এই রাক্ষসটিকে হত্যা করে এ অন্চলে শান্তি প্রতিষ্টা করেছিল।সে কারনে এ অঞ্চলটির নাম রানীখং হয়েছে। এবং সে নামেই চার্চের নাম।শান্তিনিকেতন নামে রয়েছে ছোট্ট একটি বিশ্রামাগার ওখানে
।বিশ্রামাগারে বসে নদী,পাহাড়, মেঘ,নদীর বাঁক, বনবিহার সবকিছু খুব সুন্দর দেখা যায়।যার যত সৌন্দর্য্য পিয়াসী মন তিনি তত বেশি প্রকৃতির এ ক্যানভাস উপভোগ করতে পারবেন। কিন্তু আমার হাতে বসবার মত বেশি সময় ছিল না। কারন, বেলা গড়িয়ে গেছে। পথে ফেলে এসেছি আর একটা দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ। রানী খং যাবার পথে রাশমনি স্মৃতিসৌধটি নজরে পড়েছিল।বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিল বলে আগে রানীখং মিশনে যাই।কিন্তু ফেরার পথে আর বাদ দেইনি।কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বহেড়াতলী গ্রামে চৌরাস্তা মোড়ে রাশমনি স্মৃতিসৌধটি অবস্থিত।রাজমনি হাজং ছিলেন টঙক ও কৃষক আন্দোলনের নেত্রী। ১৯৪৬ সালের ৩১জানিয়ারি কুমুদিনী হাজংকে বাঁচাতে গিয়ে তীর-ধনুক নিয়ে মুখোমুখি সংগ্রামে ব্রিটিশ বাহিনীর গুলিতে সহযোদ্ধা সুরেন্দ্র হাজংসহ শহীদ হন এই নারী বীর যোদ্ধা। তাঁর নামে পরিচালিত ট্রাস্ট তীর-ধনুকের আদলে দৃষ্টিনন্দন এই স্মৃতিসৌধটি নির্মান করে।প্রতি বছর বেশ জমজমাট মেলা বসে এখানে। ভারত থেকেও নাকি অনেকে মেলায় আসে। উপজেলা সদরেই আর একটি জায়গায় গিয়েছিলাম।সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের আর এক স্মরণীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির এককালীন পুরোধা ব্যক্তিত্ব কমরেড মনি সিংহ এর স্মৃতি কমপ্লেক্স এ । বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের খোঁজখবর যারা রাখেন তারা জানেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে মনি সিংহের অবদানের কথা। দূর্গাপুর নেত্রকোণা জেলার একটি উপজেলা। নেত্রকোণা জেলাটি একটি ছোট জেলা সেই জেলার একটি উপজেলায় এতোকিছু দেখার এবং জানবার আছে তাহলে তো আসলেই চোখ মেলে দেশটাকে দেখতে হয়।