দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-০৯
মো. শওকত আলী
২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অর্থ বিভাগের একটি প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য রাতে ভোলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছিলাম নদীপথে। আমি উজানদেশের মানুষ। জলে আমার আতংক। শৈশবে বড় মামার বিয়েতে নওগাঁ শহরে গিয়ে যমুনার শাখা নদীতে ডুবতে বসেছিলাম। সেথেকে পানি দেখলে আমার কেমন যেন দম আটকে আসে। তাই নদীপথ আমি এড়িয়ে চলতাম। তবে ২০০৭ সালের গোঁড়ার দিকে বরিশাল যেতে হয়েছিল দাপ্তরিক কাজে।
বরিশালের কর্মকর্তাদের পীড়াপীড়িতে বিমানপথ বাদ দিয়ে নদীপথে গিয়েছিলাম।ভ্রমণটা অনেক সুখকর উপভোগ্য আর আরামদায়ক ছিল। তাই যখন অর্থবিভাগ থেকে নতুন সরকারি আর্থিক ব্যবস্হাপনা পদ্ধতির প্রশিক্ষণে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে কোন্ কোন্ জেলায় যেতে ইচ্ছুক জানতে চাইলো, সাগ্রহে অন্য জেলার সংগে ভোলা জেলা বেছে নিয়েছিলাম।কারণ ছিল দুটো। এ দ্বীপ জেলা শহরটিতে কখনও যাওয়া হয়নি। আর বড় লন্চে জলপথে যাবার আতংক যেহেতু কেটেছে তাই রাতের যাত্রায় নদীর রুপ কেমন হয় তা প্রত্যক্ষ করা।
নদীপথে রওয়ানা হলাম। লঞ্চ চলতে শুরু করে সদরঘাট এলাকার বুড়ীগংগার কটু গন্ধ থেকে বেড়িয়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যে । মাঝে মাঝে হরহর শব্দ করে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলে যায়। নদীর তীর ঘেঁষে কলকারখানার কিছু বিজলীবাতি দেখা যাচ্ছিলো। ঐ নদীপথে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। দূরের বাতিগুলো আস্তে আস্তে জোনাকির আলোর মতো হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছিলো।কোন্ নদী থেকে কোন্ নদীতে গিয়ে পড়ছিলাম জানার উপায় ছিল না। কেবিনের পিছনে একাকী বসে অন্ধকারের রুপ দেখতে দেখতে জগত সংসারের অনেককিছুই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
রাত শেষে ভোরের আলো ফোঁটার কিছুক্ষণের মধ্যে ভোলা শহরের লঞ্চঘাটে পৌঁছেছিলাম।ঢাকা থেকে নদীপথে ভোলা শহরের দূরত্ব ১৯৫ কি.মি। ভোলা বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা শহর । ৪৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ শহরে জনবসতি প্রায় ৭৫ হাজারের মতো। আয়তন,জনসংখ্যা সবদিক থেকে একেবারে ছোট জেলা শহর এটি। দ্বীপ শহরটির সংগে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ মূলতঃ নদীপথেই।
‘ভোলা’র আদিনাম ছিল দক্ষিণ শাহবাজপুর।
মনের মধ্যে একটা ঔৎসুক্য ছিল, কেন এর নাম পরিবর্তন করে ভোলা হলো। এর পিছনে একটা লোককাহিনী শুনেছিলাম সেখানে। ভোলা শহরের মধ্য দিয়ে একটা খাল বয়ে গেছে যেটার নাম বেতুয়া। এক সময় এটা অনেক প্রশস্ত ছিল। যার কারনে অনেকে বেতুয়া নদীও বলতো। ভোলা গাজি পাটনি নামে এক খেয়া মাঝি এ বেতুয়া নদীতে খেয়া পারাপার করাতেন। তার ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারনেই একসময় ঐ এলাকার নাম তার ‘ভোলা’ নামে পরিচিতি পায়।
ভৌগোলিক অবস্থান আর প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনার কারণে ভোলা অতীতকালে শাসক এবং জলদস্যু — সকলের কাছে আকর্ষনীয় ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫১৭ সালে জন ডি সিলবেরা নামক একজন পর্তুগীজ জলদস্যু এ দ্বীপটি দখল করে নিয়েছিল। আবার আরাকানের বর্গি আর মগ জলদস্যুরাও একসময় তাদের ঘাঁটি গেঁড়েছিল এ দ্বীপে।
মেঘনা নদীর গতিপ্রকৃতি আর আকার-আকৃতির পরিবর্তনের সংগে সংগে ভোলার প্রশাসনিক শাসন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির পালাবদল ঘটে বার কয়েক। ১৮২২ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বাকেরগন্জ্ঞ জেলার অংশ ছিল ভোলা। উনিশ শতকের প্রথমদিকে এটি সংযুক্ত হয় নোয়াখালী জেলার সংগে। তারপর ১৮৪৫ সালে নোয়াখালীর মহকুমাও করা হয় ভোলাকে। কিন্তু পরে ১৮৬৯ সালে বরিশাল জেলার সংগে মহকুমা হিসেবে যুক্ত করা হয়। তখন এর সদর দপ্তর ছিল দৌলতখানে। ১৮৭৬ সালে সদর দপ্তর বর্তমান ভোলা শহরে স্থানান্তর করা হয়। সুতরাং, বলা যায় ভোলা শহরের গড়ে উঠবার ইতিহাস মূলতঃ ১৮৭৬ সাল থেকে।
ভোলার সংস্কৃতি বরিশাল, লক্ষ্মীপুর আর নোয়াখালীর মিশ্র সংস্কৃতির নামান্তর।
সেবারে দু’দিন ছিলাম ভোলা শহরে। দাপ্তরিক কাজ সেরে বিকালের দিকে ঘুরতে বের হতাম।ছোট্ট মফস্বল শহর। শহর এবং শহরের বাইরে আশপাশের এলাকায় গিয়েছি। দেখেছি –মেঘনা, তেতুলিয়া নদী,তুলাতুলি ঘাট,ইলিশা ঘাট, বাগবাড়ি সেতু, স্বাধীনতা জাদুঘর ইত্যাদি।
নদী, নদীর ঘাট, শহরের বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ মনোমুগ্ধকর। তবে আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে স্বাধীনতা জাদুঘর।
শহরের বাংলাবাজার এলাকায় নান্দনিক স্হাপনায় স্হাপিত এ জাদুঘরটি এক কথায় অনন্যসাধারণ। এর একপাশে একটি বৃদ্ধাশ্রম আর একপাশে দৃষ্টিনন্দন স্হাপত্যশৈলীতে নির্মিত একটি মসজিদ রয়েছে। আর এসবগুলোই তৈরি করা হয়েছে তোফায়েল আহমেদ ট্রাস্টবোর্ডের উদ্যোগে।
স্বাধীনতা জাদুঘর –নামেই বুঝা যায় এটি একটি থিমেটিক জাদুঘর এবং তা’ অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কিত। বাংগালীর হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ আর শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে স্বাধীনতা অর্জন। গাঙেয় এ বদ্বীপটিকে যে সোনার বাংলা বলা হতো তা’ একসময় যথার্থ ছিল। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ সবুজ শ্যামল এ দেশটি ছিল প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরপুর। যার কারনে বিভিন্ন সময়ে বহিঃশক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছে আমাদের বাংলাদেশ। হয়েছে পদাবনত। তবে এ অঞ্চলের মানুষ ছিল বরাবরই স্বাধীনচেতা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হচ্ছে যে স্বাধীনতা লাভের জন্য বিদ্রোহ, লড়াই করেও তাদের থাকতে হয়েছে পরাধীন। অবশেষে দীর্ঘ সংগ্রাম, বিদ্রোহ আর আন্দোলনের পথপরিক্রমায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংগালী, বাংগালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এসেছে সেই সুর্দীঘ কাঙ্ক্ষিত মহামূল্যবান স্বাধীনতা।
ব্রিটিিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে বাংগালীর ভাষা,সংস্কৃতিসহ অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ,ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর আড়াই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জন আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বোচ্চ গৌরবগাঁথা। আর এসব কিছুই আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে জানানোর দায় রয়েছে। সে কাজটিই করেছেন ঐ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা, বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ জনাব তোফায়েল আহমেদ।
ভোলার এ দৃষ্টিনন্দন জাদুঘরটি প্রায় এক একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি উদ্বোধন করা হয় ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে। স্বনামধন্য স্হপতি ফেরদৌস আহমেদ এর স্হাপত্য নঁকশা প্রণয়ন করেন। অভ্যন্তরীণ সজ্জা আর বিন্যাসের কাজ করেছেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তারিক সুজাত ও তার দল।
তিনতলা বিশিষ্ট জাদুঘরটিকে সাজানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আলোকে।
প্রথম তলায় রয়েছে তিনটি ভাগ – একটি লাইব্ররি, একটি অডিটোরিয়াম আর একটি প্রদর্শনী হল। প্রদর্শনী হলে রয়েছে বংগভংগ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দেশভাগ ও ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার ধারাবাহিক ইতিহাস। লাইব্রেরিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বইয়ের সংগ্রহ। মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন,সেমিনার আয়োজনের ব্যবস্হা রয়েছে অডিটোরিয়ামে। রয়েছে তথ্যভিত্তিক অডিও ভিডিও দেখার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ।
২য় তলায় রয়েছে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পর্যন্ত ইতিহাসের পরিক্রমা। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ‘৫৮’র সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ‘৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬’র ৬দফা আন্দোলন, ‘৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০’র নির্বাচন, ২৫মার্চের গণহত্যা, প্রতিরোধ যুদ্ধ, ‘৭১’র ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্নসমর্পণ স্হান পেয়েছে ২য় তলার গ্যালারীতে।
৩য় তলায় রয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসসহ বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অর্জনের স্বাক্ষী জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ সহচর মুক্তিযোদ্ধা তোফায়েল আহমেদের সংগ্রামী জীবনের উপ্যাখান।
জনাব তোফায়েল আহমেদ ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তাঁর এলাকার তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাসের পাঠ দেবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আমি মনে করি তরুণ প্রজন্মকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস জানার সুযোগ করে দেয়ার জন্য প্রতিটি জেলায় এধরণের একটি স্বাধীনতা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা ব্যক্তিক, প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রীক পর্যায়ে দায়বদ্ধতা থাকা উচিত।