দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-৮
পানাম সিটি বা পানাম নগরী
মো. শওকত আলী
ছাত্রজীবনের শেষ পর্য্যায়ে তখন আমি।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলে থাকি। একদিন ছুটির দিনের পত্রিকায় শিরোনাম দেখলাম ‘ধ্বংসের পথে ঐতিহাসিক পানাম নগরী ‘ জাতীয় একটা ফিচার। শিরোনাম দেখে মনে করেছিলাম দক্ষিণ আমেরিকার কোন দেশের ইতিহাসখ্যাত পুরানো সভ্যতার ধারক কোন শহরের বিষয়ে হয়তোবা ফিচার লিখা হয়েছে।আগ্রহ নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখি এতো আমাদের সুলতানী আমলের রাজধানী সোনারগাঁ এর ভিতরে আর একটা শহরের কথা বলা হয়েছে।।তখনই মনস্হ করেছিলাম সময় সুযোগ মত পানাম নগরী দেখতে যাবো। এ প্রসংগে বলে রাখি, এখন থেকে তিন দশক আগে যোগাযোগ ব্যবস্হা এখনকার মতো উন্নত ছিল না দেশে।তাই ঢাকার কাছাকাছি হলেও চট করে যাওয়া যেতো কোন স্হানে।
আগেও বলেছি আশির দশকের শেষদিকে প্রথম বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এবং পানাম নগরী দেখার উদ্দেশ্যে ঐ এলাকায় গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য অনেকবারই গিয়েছি সেখানে।
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের কাছাকাছি পানাম সিটি বা পানাম নগরী। ঈসা খাঁর আমলে যখন সমৃদ্ধ শহর হিসেবে সোনারগাঁয়ের খ্যাতি দেশের গন্ডি অতিক্রম করে বিদেশেও ছড়িয়েছিল তখন এখানে ঈসা খাঁ তার প্রধান সামরিক সদরদপ্তর স্হাপন করেন সোনারগাঁয়ে। এবং নামকরণ করেন পানাম সিটি বা নগরী। পানাম সিটিতে নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে চারদিকে পরিখা খনন করে মাঝখানে নির্মাণ করা হয়েছিল ছোট ছোট লাল ইটের ইমারত।
আবার বৃটিশ আমলে বৃটিশরা পানাম নগরে নির্মাণ করেছিল কিছু নীলকুঠি। সেসংগে জমিদার আর ব্যবসায়ীরাও তৈরি করেছিল কিছু আবাসিক ভবন। ভিন্ন, ভিন্ন কালে নির্মিত ভবনগুলির নির্মাণ স্হাপত্যরীতিতে রয়েছেও ভিন্নতা। কতকগুলো মোঘল, কতগুলো পার্সিয়ান আবার কতগুলোতে ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর ছাপ রয়েছে।
আবার ভবনগুলোর বর্তমান অবস্থাতেও বয়সের ভিন্নতার ছাপ স্পষ্ট । কতগুলির জীর্ণদর্শা,কতগুলোর ভংগ্নদশা আবার কতগুলো আপাতঃদৃষ্টিতে মোটামুটিভাবে শক্ত রয়েছে। তবে সংস্কারের নামে অনভিজ্ঞভাবে কতক ভবনে মেরামত কাজ করতে গিয়ে এর আদি ঐতিহ্য, সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে।
পানামা সিটিতে পাঁচ মিটার প্রশস্ত একটি রাস্তা রয়েছে। এ রাম্তার দুপাশে এখনও ৫২টি ইমারত রয়েছে। এগুলো এখনও সোনারগাঁ তথা বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সঠিকভাবে সংস্কার করে যদি পানাম নগরীকে সংরক্ষণ যায় তাহলে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য যেমন সংরক্ষিত হবে তেমনি দৃষ্টিনন্দন একটি প্রত্নতাত্বিক পর্যটন স্হাপনা হিসেবে পর্যটকদের আরও দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হবে।
সোনারগাঁ টাকশাল
বাংলাদেশে আমরা যে কাগজের মুদ্রা ব্যবহার করি সে মুদ্রা ১৯৮৯ সালের আগে বিদেশ থেকে ছাপিয়ে আনা হতো। আর ধাতব মুদ্রা এখনো বিদেশ থেকে তৈরি করে আনা হয়। অথচ মুসলমান সুলতানরা যখন বাংলা শাসন করতো (১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত ২০০বছর) সেসময় সুলতানরা বাংলায় তৈরি নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন করেছিল।
১৩১২ সালে সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ সর্বপ্রথম সোনারগাঁ টাকশাল থেকে তৈরি মুদ্রা চালু করেন। পরবর্তী সময়ে সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ও সুলতান গিয়াসুদ্দীন আলম শাহ সোনারগাঁ টাকশাল থেকে তৈরি মুদ্রা চালু করেন। ঐ সময় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সোনারগাঁ ‘টাকশাল শহর’ হিসেবে পরিচিত ছিল।সেখান থেকে সর্বশেষ ১৪২১ সালে মুদ্রা তৈরি করা হয় বলে জানা যায়। তবে সোনারগাঁওয়ের ঠিক কোন স্হানে টাকশালের অবস্থান ছিল এটি সম্পর্কে নিশ্চিত নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য এখন আর পাওয়া যায় না।
ধারণা করা হয় সোনারগাঁওয়ের নিকটবর্তী মুয়াজ্জামাবাদ এবং রাজধানী শহর সোনারগাঁ এ টাকশাল ছিল। সুলতানী আমলে সম্পদশালী বাংলাদেশে শুধুমাত্র সোনারগাঁয়ে টাকশাল ছিল এমনটা নয়। ইতিহাসবিদগণের মতে সে সময়ে বাংলাদেশের বাগেরহাট এলাকার খলিফাবাদ, রাজশাহীর মহিসন্তোষের বারবাকাবাদ, চট্টগ্রাম
টাকশালসহ প্রায় ৮০টি স্হানে টাকশাল ছিল বলে ইতিহাসবিদগণ মনে করেন। আমরা যে আমাদের মুদ্রাকে টাকা বলি এ শব্দটিও সংস্কৃতের ‘টঙ্ক’ শব্দ থেকে এসেছে বলে মনে করা হয় যার অর্থ রুপার মুদ্রা। সুলতানদের রুপার মুদ্রাই মনে হয় টঙ্ক থেকে টাকা হয়েছে।