বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০১:৪৩ পূর্বাহ্ন

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া : ০৩-মো. শওকত আলী

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া : ০৩-মো. শওকত আলী

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-০৩
মো. শওকত আলী

ময়মনসিংহ শহরের আর একটি নান্দনিক ঐতিহ্যবাহী ভবনের কথা বলার আগ্রহ সম্বরন করতে পারলাম না।এমনিতেই ময়মনসিংহ অনেক ঐতিহ্যবাহী এলাকা, বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল।

এখানকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, জ্ঞান ও সংস্কৃতি অংগনে কীর্তিমানদের অবদানের বিষয়ে গর্ব করবার মত অনেক কিছু রয়েছে। মৈমনসিংহ গীতিকা তো আমাদের লোক সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে। এ গীতিকাগুলো তো মূলতঃ নর-নারীর প্রেম উপ্যাখান। নামগুলোও সুন্দর যেমন-মহুয়া, চন্দ্রাবতী,কমলা,রূপবতী, কাজলরেখা,দেওয়ানা মদীনা। বেশ আগে আমার প্রেমিক হৃদয় এক বন্ধুকে মহুয়া পালার দুটি লাইন লিখে দিয়ে বলেছিলাম, নে তোর কাজে লাগতে পারে- ‘কোথায় পাবো কলসী কইন্যা কোথায় পাবো দড়ি। তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুব্যা মরি।’ বন্ধু আমার পড়ে সিরিয়াসলি বলেছিল,লেখাটা গ্রাম্য হলেও বেশ আবেদন আছে। তুই একটু আধুনিকভাবে চিন্তা করবি।দেখবি একালের মতো ভালো রোমান্টিক কবিতা লিখতে পারবি। ময়মনসিংহ শহরে কেউ বেড়াতে গিয়েছে কিন্তু শশীলজ দেখতে যাননি এরকম লোকজনের সংখ্যা বোধকরি খুব কমই আছে। আমিও প্রথমবারই ময়মনসিংহ শহরে গিয়েই এটি দেখতে গিয়েছিলাম।তখন মহিলা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল এটি। তেমনভাবে দেখার সুযোগ পাইনি।শুধুমাত্র মূল ফটক এবং সামনের দিকে বাগানে ভেনাসের মূর্তিসহ ফোয়ারাটা দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে।২০১৮ অক্টোবরের শেষ দিকে ময়মনসিংহ শহরে জাতীয় ভাটিয়ালি উৎসব আয়োজন করা হয় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়। উৎসবটির ধারনা,পরিকল্পনাসহ আনুসংগিক বিষয়গুলোতে আমার বড় একটা ভূমিকা ছিল। সেকারনে একাধিকবার ময়মনসিংহ শহরে যেতে হয়েছে আমাকে।ঐ সময়ে সাবিনা ইয়াসমিন যিনি প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের পক্ষে শশীলজের তত্বাবধায়ক ছিলেন একদিন আমার সংগে দেখা করে শশীলজে যাবার জন্য অনুরোধ জানালেন।তার অনুরোধটি ছিল অনেকটা আধা-সরকারি ধরনের।কারন শশীলজ পরিদর্শনে যাবার জন্য সরকারি কোন ভ্রমণসূচি আমার ছিল না।তবে প্রচলিত রীতি আছে যে অন্য কার্যোপলক্ষ্যে গেলেও সম্ভব হলে অধিক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির খোঁজ খবর নেয়া দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।সে বিবেচনায় আমি সাবিনা ইয়াসমিনের অনুরোধ রক্ষা করে শশীলজে যাই। শশীলজ আয়তনে বিশাল কিছু নয়। নয় একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। আজকের যে শশীলজ আমরা দেখি সেটা আসলে এর দ্বিতীয় রুপ।উনিশ শতকের শেষভাগে নির্মিত প্রথম ভবনটি ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হলে এর নির্মাতা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী ভীষণ মনোকষ্ট পান। তখন ভবনটি দোতলা ভবন ছিল। তার উত্তরাধিকারী যার নামে ভবনটির নামকরণ সেই শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী উদ্যোগী হয়ে ১৯০৫ সাল থেকে ভবনটির পুননির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং ১৯১১ সাল পর্যন্ত ভবনটির নান্দনিকতা বর্ধনসহ অনেক কাজ করেন।জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পর ১৯৫২ সালে ভবনটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মহিলা শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্টা করা হয়।

স্বাভাবিকভাবেই তখন ভবনের আদিরূপ কিছুটা নষ্ট হয়। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। ২০১৫ সালে হেরিটেজ ভবন হিসেবে এটিকে প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের নিকট হস্তান্তর করা হয়। বাড়িটির দর্শনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এর মূল ফটক,লাল ইট ও হলুদ রং এর সংমিশ্রণে নির্মিত মূল ভবনের স্হাপত্যশৈলী,ভবনের কক্ষগুলোতে সুশোভিত একই ধরনের স্বচ্ছ কাঁচের ঝাড়বাতি,নাচঘর ,হলঘরের পাশে নানান রঙের মার্বেল পাথরে নির্মিত একটা জলফোয়ারা, ফোয়ারা বরাবরে উপরের ছাদ থেকে নেমে আসা একটি স্বচ্ছ কাঁচের ঝাড়বাতি।এছাড়া ভবনের পিছনে উঠোন পেরিয়ে রানীর ব্যবহারের জন্য দৃষ্টিনন্দন দোতলা স্নানঘর,স্নানঘর লাগোয়া পুকুরটির মার্বেল পাথরে বাঁধানো ঘাট এসব কিছু। তবে জমিদার বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় বস্তুটি হচ্ছে মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করেই বাগানে শ্বেতপাথরের ফোয়ারার মধ্যখানে স্বল্পবসনা স্নানরতা গ্রিকদেবী ভেনাসের মর্মর মূর্তিটি। নাটোরের রাজবাড়ী ছাড়া এতো দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য বাংলাদেশে আমার আর চোখে পড়েনি। আর একটি কথা কিছু কিছু লোকমুখে প্রচলন আছে যে এখানকার স্নানঘরে নাকি একটি সুড়ঙ্গ ছিল যে সুড়ঙ্গ পথে জমিদারের জন্য মুক্তাগাছায় যাবার ব্যবস্হা ছিল। ময়মনসিংহ শহর হতে মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির আনুমানিক দূরত্ব মোটামুটি ১৬কি.মি.।সুড়ঙ্গ পথের বিষয়টি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে হয়তো সুড়ঙ্গটি কোন নৌপথকে সংযুক্ত করেছিল।এ বিষয়টি প্রত্নতাত্বিকগণ পরিস্কার করতে পারবেন।অনুরূপ একটি সুড়ঙ্গ পথের কথা শোনা যায় লালবাগ দূর্গে।যেটা নাকি মোগল আমলে লালবাগ কেল্লা হতে বুড়ীগঙা হয়ে নৌপথে মুন্সিগন্জের ইদ্রাকপুর দূর্গে সৈন্যদের যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা হতো। শশীলজ দেখবার সময়ে মনে হয়ছিল যে জমিদার এ ভবনটি নির্মাণ করেন তাদের নিবাসটি অর্থ্যাৎ জমিদার বাড়িটি না দেখা যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না যখন শুনলাম ঐ জমিদার বাড়িটিও প্রত্নতত্ত অধিদপ্তররের আওতায় নেয়া হয়েছে। তাই পরদিন সকালে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ময়মনসিংহ শহর থেকে মাত্র ১৬ কি.মি. পথ। মুক্তাগাছার জমিদারের ৬ষ্ঠ পুরুষে শশীলজ নির্মাণ করা হয় ৭ম পুরুষের নামে।যিনি এ জমিদারীর গোড়াপত্তন করেন সেই শ্রীকৃষ্ঞ আচার্য ছিলেন মুর্শিদাবাদের দরবারের একজন কর্মচারী।মুর্শীদ কুলী খাঁর সময় রাজস্ব আদায় করাই ছিল তার কাজ।তার কাজে সন্তষ্ট হলে তিনি নবাব দরবার থেকে আলাপসিং নামে একটি পরগণা বন্দোবস্ত নেয়ার অনুমতি পান।মুক্তাগাছা অঞ্চলটি ঐ পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে তখন এর নাম ছিল বিনোদবাড়ী।শ্রী কৃষ্ঞ আচার্যের আদিনিবাস ছিল বগুড়া। তিনি ১৭২৫ সালে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ পেরিয়ে বিনোদবাড়ী অন্চলে তার জমিদারীর গোড়াপত্তন করেন।এলাকাটি তখন ছিল জংগল আর জলাভূমিময়।তেমন জনবসতি ছিল না।যারা ছিল তারাও নেহাৎ জেলে আর প্রান্তিক শ্রেণীর।শ্রীকৃষ্ঞের পুত্ররা যখন ওখানে বসতি স্হাপনের অভিপ্রায়ে আগমণ করেন তখন স্হানীয় প্রান্তিক বাসিন্দারা নানা রকম নজরানা দিয়ে তাদের বরণ করেন।মুক্তারাম কর্মকার নামে একজন তার নিজের পিতলের গাছা (প্রদীপ রাখার আধার) নজরানা দেন।তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে আচার্যপুত্র জায়গার নাম পরিবর্তন করে মুক্তারামের মুক্তা আর তার গাছা এনিয়ে বিনোদবাড়ীর পরিবর্তে মুক্তাগাছা রাখেন যেটি আজ অবধি আছে। মুক্তাগাছায় যে জমিদারবাড়িটি কালের স্বাক্ষী হয়ে এখনও আছে সেটি আসলে শ্রীকষ্ঞ আচার্যের তৃতীয় উত্তর পুরুষ জগৎ কিশোর আচার্য নির্মাণ করেন।প্রায় ১০০ একর জমির উপর তৈরি এ ভবনটির বিশেষ স্থাপত্য কর্মের নান্দনিকতা কালের বিচারে অনন্য। প্রধান ফটক এবং ভিতরে অবস্হিত হাওয়াখানা আদলে খুটির উপরে টিনের ঘরটি এখনও দর্শনার্দের দৃষ্টি কাড়ে।জানা গেল এখানে বহুমূল্যবান বইসহ অনেক সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরী ছিল। জমিদার বাড়ির প্রাংগনে কাঁচারী বাড়ি,পুজোর জায়গাসহ আরও অনেক ঘর ছিল যেগুলোর বেশিরভাগই ধ্বংসপ্রায়।জমিদারবাড়ির কাছেই রয়েছে নানা কারুকার্যময় রাজরাজেশ্বরী মন্দির আর পাথরের শিব মন্দির। বহু মূল্যবান বইসহ অনেক সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরী এবং বিশেষ নঁকশায় তৈরী একটা ঘূর্ণায়ওমান মন্চ ছিল যেখানে নাটক হতো।জমিদারদের রুচির যেমন সুনাম ছিল তেমনি তাদের অত্যাচারের কাহিনীও লোকজনের মুখে মুখে। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হবার আগ পর্যন্ত মুক্তাগাছা জমিদারের ছিল সাত পুরুষ । তবে জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ঞ আচার্য চৌধুরীর তৃতীয় উত্তরাধিকার পুরুষ থেকে সকলেই নিঃসন্তান থাকায় জমিদারীর ধারা রক্ষা করার স্বার্থে তখন থেকে সকল জমিদারই জমিদারের দত্তক পুত্র হিসেবে জমিদারী গ্রহণ করেন।

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge