দবির চানের মোবাইল
সোহানুর রহমান শাহীন
মোবাইল নিয়ে মর্মান্তিক এক বেদনায় আছে দবির চান। বর্তমানের আধুনিকতা আর ডিজিটাল যুগের যাঁতাকলে পড়ে বছর তিনেক আগে মাটির ব্যাংকে টাকা জমিয়ে একটি এন্ড্রোয়েট ফোন কিনেছিল অশিক্ষিত রিকশা চালক দবির চান। তার রিকশায় উঠে অনেক যাত্রী মোবাইল চালাতে চালাতে ভুলে যায় গন্তব্য। দবির চান রিকশা চালায়, যাত্রী মোবাইল চালায়। এই চালাচালিতে যাত্রী কোথায় নামবেন আর দবির চান কোথায় নামাবে কারো কোনো খেয়াল থাকে না। এক সময় দবির চান নিজেই পিছন ফিরে যাত্রীর ছন্দপতন করে বলে- আপা, কোনটে যাইমেন? তখন যাত্রীর হুঁশ ফিরে দেখে- তার গন্তব্য অনেক আগে পিছনে ফেলে এসেছে। দবির চান ভাবে- এই মোবাইলে আছে কী, সেটাই দেখার কথা আছে। দবির চানের রিকশায় একাধিক যাত্রী এই একই ভুল করে। তারা কী করে মোবাইলের ভিতর ঢুকে দুনিয়াদারী ভুলে যায়! সেই খচখচানির জ্বালা থেকে মোবাইল কেনার সাধ জাগে তার।
তাই দবির চান তার অনেকদিনের আশা পূরণ করেছে একটা এন্ড্রোয়েট মোবাইল ফোন কিনে। মোবাইল কেনার পর তার স্কুল পড়ুয়া ছেলের কাছ থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে ধারনা নেয়, কোথায় কী আছে, কিভাবে কোন অপশনে যেতে হয়, কিভাবে ফেসবুক, ইন্টারনেট চালাতে হয়। এযুগের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মায়ের পেট থেকেই ডিজিটাল হয়ে জন্ম নেয়, সেটা কারো অজানা নয়। ধীরে ধীরে দবির চান অনেক কিছু রপ্ত করে নেয় মোবাইলের কর্মকাণ্ড। বুকের মধ্যে আগলে রেখে দরদ দিয়ে দিয়ে মোবাইল ব্যবহার করতে বেশ ভালই লাগতো। ফেসবুক আর ইউটিউব ব্যবহার নিজেকে ডিজিটাল মানুষও মনে হতো বটে। ফেসবুকে এখন তার ফ্রেন্ড সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে। ছেলের কাছে শিখে নিয়ে বাংলা অক্ষরের লেখাগুলো কিছু কিছু ধরতে পারে, কষ্ট করে হলেও বাংলা লেখা বুঝে অথবা না বুঝে অনেককে কমেন্ট করে নিজের ভাষায়। ম্যাসেঞ্জারে হাই-হ্যালো করছে পরিচিত রিকসা চালক কিংবা পছন্দের ফেসবুব ফ্রেন্ডদের সাথে। দবির চান জানে, লেখাপড়া না জানা মানুষগুলোও আজকাল মোবাইল ব্যবহার করে। যে মোবাইলে বাংলা অক্ষর নেই- ইংরেজিতে নাম সেভ করে, আবার ইংরেজিতে সেভ করা নাম খুঁজে বের করে ফোন করে কথা বলে। খুব ভালো লাগে দবির চানের, লেখপড়া না জেনেও মোবাইলের বদৌলতে বাংলা, ইংরেজি শেখা যায়। রিকশা চালানোর সময় কানে হেডফোন লাগিয়ে পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার গান শুনতে শুনতে চলে যায়, শাবানা-রাজ্জাক ওয়াসিম ববিতার অঞ্জু ইলিয়াস কাঞ্চন সময়কার ইতিহাসে। মনে পড়ে ছোটবেলায় সিনেমা দেখার কথা। মনের ভেতর ভেসে আসে নায়ক নায়িকাদের নাচের দৃশ্য। গানের তালে তালে রিকশার প্যাডেল ঘুরায় দবির চান। তার যেন কোনো ক্লান্তি নেই।
হঠাৎ নারীকণ্ঠে চিৎকার! কানে লাগানো গানের যন্ত্র ভেদ করে সে চিৎকার পৌঁছায় দবির চানের মগজে। ছন্দপতন করে পিছন ফিরে তাকায়, রিকসার সিটে বসে থাকা নারী যাত্রীর গলার সাথে ওড়না পেঁচিয়ে নিচে পড়ে গেছে, ওড়নার অন্য মাথা রিকশার চাকার এক্সেলের ভেতর আটকে আছে অর্ধেকের বেশি । দ্রুত রিকশা থেকে নেমে নারী যাত্রীকে তুলে দাঁড় করে দবির চান। শুধু খক্ খক্ করতে থাকে সেই যাত্রী, মুখে কোনো কথা আসে না। ফর্সা মুখ কেমন লাল টকটকে হয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো, কপালের মাঝখান থেকে মেরুন রঙের বড় টিপ সরে গিয়ে জায়গা বদল করে নেয়। গলায় আর কোমরে সামান্য আঘাত পেয়েছে মেয়েটি। গা ঝারা দিয়ে ওঠে। কোনো দিকে না তাকিয়ে লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচতে আবার রিকশায় উঠে বসে। দবির চানের রিকশায় উঠে মোবাইল চালানো অনেক যাত্রীর অনেক ধরনের ক্ষতি হয়েছে, কেউ ব্যাগ হারিয়েছে কারো ওড়না বাতাসে উড়ে গেছে, কেউ হোঁচট খেয়ে আঘাত পেয়েছেন। এমন অনেক অভিজ্ঞতার কারণে নারী যাত্রীটির জন্য তেমন কষ্ট অনুভব করেনি দবির চান। শুধু এটুকু বলে- ‘আপা, রিকশ্যাত চড়ি আর মোবাইল ধরি নাড়াচাড়া করেন না। বিপদ তো আর কয়া আইসে না।’ মেয়েটির কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে রিকশার প্যাডেলে চাপ দিয়ে এগিয়ে চলে সামনের দিকে।
দেখতে দেখতে দবির চানের মোবাইলের বয়স তিন বছর হলো। এর মধ্যেই সে মোবাইলটি বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছে। হতাশায় দবির চান। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মোবাইলে আগের মতো দৌড়-ঝাঁপ নেই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ফেসবুক চালালে ঘুম আসে, ছবি পোস্ট দিলে শুধু ঘোরে আর ঘোরে, থামতে চায় না। কিছু লিখতে চাইলে বার বার কীবোর্ড সাদা হয়। লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে আসে। তখন নিজের চোখকেও অবিশ্বাস করতে হয়। ব্যাটারি গরম হতে হতে সেটা ফুলেফেঁপে পোয়াতি হবার উপক্রম। মোবাইলের ব্যটারীকে নারী লিঙ্গই মনে করে দবির চান। মোবাইল ফোন কোন লিঙ্গের হতে পারে সে ভাবনা ছেড়ে দেয় মোবাইলপ্রেমিদের ওপর। মোবাইলে নব্বই ভাগ চার্জ দিয়ে বাইরে বের হলে- কিছুক্ষণ পর দেখা যায় সব চার্জ ফুরিয়ে গেছে, মোবাইল বন্ধ! আবার চার্জ দিয়ে চালু করতে হয়। মোবাইল চালু করতেও অনেক সময় লাগে। আরো অনেক বিমার ঘিরে ধরেছে সাধের মোবাইলখানাতে। ছেলেটাও অনেকভাবে চেষ্টা করে দেখেছে কিন্তু নিষ্ফল, মোবাইল ইঞ্জিনিয়ার দেখিয়েছে, ফল ভালো নয়। ইঞ্জিনিয়ার বলেছে- ‘এই মোবাইল এখন কোমায় আছে। এটা ফেলে দিয়ে নতুন মোবাইল কিনে নিন। নতুন মোবাইলের গতি ভালো হবে, চালাতেও খুব ভালো লাগবে।
দবির চান একটু সময় পেলে ফেসবুক চালাত, লাইক কমেন্টস, ম্যাসেঞ্জারে বন্ধুদের সাথে আড্ডামু করে ক্লান্তি কাটাতো। বিকাশের একাউন্ট সম্বলিত সিমকার্ড এই মোবাইলে ফিটিং করা আছে। অনেক যাত্রীর কাছে ভাংতি টাকা না থাকলে তারা বিকাশে টাকা দেয়। এখন যাত্রীরা বিকাশে টাকা দিলে সাথে সাথে দেখবার উপায় নেই, টাকা সমান দিল নাকি কম দিলো। মোবাইলে এমবি কিনতে কার্পণ্য না করলেও সঠিক রিকসা ভাড়া দিতে ঠিকই গা জ্বলে।
মোবাইল কিনতে অনেক টাকা লাগে। একবারে হাজার হাজার টাকা গুনে মোবাইল কেনার মতো টাকা নেই রিকশা চালক দবির চানের। এই সময় গ্রাম্য মজলিশের একটা প্রবাদ মনে পড়ে যায়- ‘কামলার জন্যে দই নোয়ায়।’ দবির চান ভাবে- রিকশাওলার জন্যে মোবাইল নোয়ায়! এখন আবার সেই এনালগ জীবনে ফিরে যেতে হবে! বউয়ের হাতে তুলে দেওয়া ৯২০ টাকার পুরাতন মোবাইল ফিরে নিয়ে ডিজিটাল আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হবে। মাটির ব্যাঙ্কে টাকা জমিয়ে যদি একটা নতুন মোবাইল কিনকে পারে- তবে ভুলে যাবে ব্যথিত সময়ের সব এনালগ গল্প।