টিলা পাহাড় আর সবুজ বন মহলের মাঝে এখনো ত্রিপুরায় ইতিহাস কথা বলে গোমতী; উদয়পুর মহকুমা সদরের বুক চিরে ইতিহাস খ্যাত গোমতী নদী পেরিয়ে জগন্নাথ দীঘি এক নিমেষেই যেন সমস্ত ক্লান্তিতে শান্তি এনে দেবে।
রাজআমলের লক্ষী নারায়ণ মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী অসাধারণ। কিছুটা পশ্চিম বঙ্গের বাকুড়ার টেরাকোটার মন্দিরের ধাঁচে যেন তৈরি। পাশেই রাজবাড়ী। যেন ত্রিপুরা রাজের স্মৃতি মন্থন করে বাতাসের কাছে এসে নীরবে বলে যায় অনেক গোপন কথা। তবে এলাকার বর্ষীয়ান বাসিন্দা স্বপন কুমার রায় জানান রাজা রাধাকিশোর মানিক্যর সময়ে তৈরি হয় এই বাড়িটি। এখানে রাজা স্থায়ীভাবে না থাকলেও তিনি বিচার বিভাগীয় সমস্ত কিছু পরিচালনা করতেন এখানে বসেই। উদয়পুরের মন্দির ও তার স্থাপত্য শৈলী বেশ নজরকাড়া। তাই জায়গাটাকে মন্দির নগরীও বলে থাকেন। ওই মন্দির নগরীর শীর্ষে অবস্থান করছে মাতাবাড়ির ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের। একান্ন পিঠের এক পিঠ। ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা ধন্যমাণিক্য এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মায়ের ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ এখানে পড়েছিল বলে কথিত আছে। সেই থেকেই ত্রিপুরার একমাত্র সতিপিঠ ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির। মন্দির সংলগ্ন দীঘিতে স্নান সেরে পুজো দেবারও একটা প্রথা রয়েছে এখানে। দীঘির স্বচ্ছ জলে মাছ ও কচ্ছপের জলকেলি পথের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় এক নিমেষেই। যারা পূজো দেন না তাদের দর্শনের জন্য পৃথক ফটক রয়েছে মূল মন্দিরে।
ছবিমুড়া:
উদয়পুর থেকে বারো কিমি দূরে মহারানী ঝোড়া হয়ে গোমতী নদী পথে নৌকো বিহারে দেখে নেওয়া যেতে পারে ছবিমুড়া। উদয়পুর থেকে যাত্রাপথে স্থানীয় জনজাতিদের বাজার থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে বাঁশ করুল কিংবা কাউফল।তবে বাঁশ করুল রান্না করেই খেতে হবে। ত্রিপুরার জনজাতিদের একটি প্রধান সুস্বাদু খাবার বাঁশ করুলের গোদক। এই ছবিমুড়াকে অনেকে ত্রিপুরার আমাজন বলেও ডাকে। দুই দিকে সবুজের টিলাপাহাড়ের মাঝপথ দিয়ে এই ভ্ৰমন বেশ এডভেঞ্চারস। যাতায়াত মিলিয়ে প্রায় চার ঘন্টা ঘুরিয়ে আনবে সেই জলযান। ভাড়া প্রায় আড়াই হাজার টাকা বোট পিছু। যদিও এই দীর্ঘ ভ্রমণে যদি কারও আগ্রহ না থাকে তবে ছবিমুড়া সংলগ্ন এলাকা ঘুরে আসতেও পারেন বোটে। সেক্ষেত্রে ভাড়া বারোশ টাকা। তবে দুর্ঘটনা এড়াতে জ্যাকেট পড়া বাঞ্ছনীয়।যাত্রাপথে পাথুরে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা ভাস্কর্য দেখে মনে হতেই পারে এক অলীক সৌন্দর্যের মহলে প্রবেশ করার কথা। ঘন সবুজের ক্যানভাসে এতো সৌন্দর্য! আহা! দুচোখ জুড়িয়ে যায়। যারা ওড়িশার সিমলাপাল গিয়েছিলেন তারা এই দৃশ্যপটের সাথে কিছুটা মিল খুঁজে পাবেন। গাছেদের মিছিল বুক দিয়ে যেন আগলে রেখেছে গোমতীকে। দিগন্ত বিস্তৃত নীলাকাশের সাথে ঘন সবুজের মেলামেশার অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি না করে উপায় নেই। প্রকৃতি যেন নিপুণ হাতে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে সবুজের আল্পনায়।মনে হতেই পারে দুদিকে পাহাড়ের বুক চিরেই সৃষ্টি হয়েছে এই জলনদী। ভরা বর্ষায় নদীর জলতরঙ্গ আর পাখির কুজন যেন মিলেমিশে একাকার। ছবিমুড়ায় পাহাড়ের গায়ে দুর্গা সহ অন্যান্য দেব মূর্তিটির একাধিক খোদাই চিত্র যেন এক আশ্চর্য কিছুর সন্ধান। কে এই নিখুঁত ভাস্কর্যের কারিগর তা জানা নেই কারো। কথিত আছে, অমাবস্যা ও পূর্ণিমার রাতে এখনও সেখানে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে। রাত জেগে জেলেডিঙি যখন মাছ শিকারে ব্যস্ত তখন ভেসে আসে সে শব্দ আর সঙ্গে ধুনোর গন্ধ। ছবিমুড়ার হোটেলে খেতে পারেন স্থানীয় উপজাতিদের খাবার গোদক(শুঁটকি মাছ ও বাঁশ করুল মিশিয়ে রান্না)। বাঁশ করুলের ভর্তাও খেতে পারেন সহজে।
তৃষ্ণা ওয়াইল্ড লাইফ সেংচুয়ারি:
দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার এটি একটি অন্যতম অভয়ারণ্য। শাল, সেগুন, আর কত অজানা সারি সারি গান সবুজ করে দেয় মন। সেখানে রাত্রি যাপন যেন রোমাঞ্চ ডেকে আনে। বুনো শুকর, বাদর কিংবা বাইসনের ডাকে মাঝরাতে হঠাৎ একটু আঁতকে ওঠাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সাত সকালে নাম না জানা অনেক পাখির কুজনে ঘুম ভাঙবেই । আর তখনই মাছরাঙা আর পানকৌড়ির ছলাৎ ছলাৎ আওআজ শুনতে শুনতে অরণ্য জুড়ে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করবে। বন দপ্তরের বাংলো থেকেও প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারবেন। শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য রয়েছে পিকনিক স্পটের পাশে পার্ক। এছাড়া বুনো গন্ধ গায়ে মেখে পায়ে পায়ে বন পথে বেড়িয়ে নেওয়া যেতেই পারে। অজস্র বানর, কাঠবেড়ালি আর হনুমানদের লাফিয়ে বেড়ানো এক সুন্দর অনুভূতি এনে দেবে মনোজগতে। বনবাংলো থেকে এক কিলোমিটার দূরেই বাইসন দেখতে যাওয়া যেতে পারে হঠাৎ। টোটোতে করে বুনো বাইসনের দল দেখলেই ক্যামেরার সাটারে এমনিতেই হাত চলে যাবে। এছাড়াও কাছে পিঠেই দেখে নেয়া যেতে পারে প্রজাপতি পার্ক। রং বেরঙের একশো পঁচিশটি প্রজাতিকে ঘিরে যেন এক স্বপ্ন জগৎ। প্রজাপতির জীবন চক্রকে চাক্ষুষ দেখে নিজে হাতেই প্রজাপতি ছেড়ে দিতে পারেন ফুল বাগিচায়। আপনার হাতেই প্রজাপতি যেন প্রথম পাখনা মেলে উড়ে যাবে। আ! কি সেই অনুভূতি।
ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান:
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ স্মারক স্মৃতি পার্ক মৈত্রী উদ্যান। ভারতের ত্রিপুরার চোত্তাখোলায় ২০ হেক্টর জমির ওপর গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মানের এই পার্ক। উদ্যান ভূমিতে পা রাখলেই নিপুণভাবে তৈরি সব শিল্পকর্ম দেখে স্মৃতিপথ ধরে আপনি অনায়াসেই চলে যেতে পারেন একাত্তরের সময়কালে। দুচোখের জল গড়িয়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসবে শহীদদের প্রতি।
২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবসে এই উদ্যানের উদ্বোধন করবেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। এর নাম রাখা হয়েছে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পার্ক’। ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ ত্রিপুরার চোত্তাখোলায় এ উদ্যানটি নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই চোত্তাখোলাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের ছাউনি ছিল। সে সময় মুক্তিবাহিনী এখানে বেসক্যাম্প তৈরি করে দেশের ভিতরে প্রবেশ করে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। সেই স্মৃতি বিজড়িত এলাকার প্রেক্ষাপটকে ধরে রাখতেই ২০০৯ সালে স্থানীয় বিধায়ক সুধন দাস ওই স্থানকে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পার্ক নাম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ উৎসব শুরু করেন।যদিও পরে ওই স্থানের নামকরণ করা হয় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান এবং ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এই পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এটি শুধু একটি উদ্যানই নয়, আরও অনেক কিছু রয়েছে এতে। একটি যুদ্ধ জাদুঘর, উঁচু টিলা, সবুজ উপত্যকা, হ্রদ, গাছপালা, আর্ট কলেজের পড়ুয়াদের ও বাংলাদেশের শিলীদের অসংখ্য ভাস্কর্য, বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান ছাড়াও আরও অনেক কিছু স্থাপত্যের ঠিকানা এই উদ্যান। এই উদ্যানের ভিতরেই রয়েছে একটি উচ্চ ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে দেখা যাবে বাংলাদেশের কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালীর একাধিক জায়গা। ’ এই উদ্যানের ভিতর বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশাল মূর্তি রয়েছে। প্রাচীরের গায়ে দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত যেমন লেখা রয়েছে তেমনি দুই দেশের জাতীয় পতাকার ছবি সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করেছে।
পিলাক:
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ১০০ কিলোমিটার বা উদয়পুর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য নীরবে বহন করে চলেছে ছোট্ট গ্রাম পিলাক। গ্রামের পেছনে টাক্কাতুলসী পাহাড়। বৌদ্ধ দর্শণ অনুযায়ী ‘পিলা’ কথার অর্থ ‘এগিয়ে আসা’। গ্রামের মধ্যে বহুবছর ধরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে পাথরের নানান দেবমূর্তি। ১৯৯৫ সালে খনন কার্য শুরু হয় ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের উদ্যোগে। শ্যামসুন্দর টিলায় মাটির ঢিবি সরাতেই বের হয়ে এল প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। জ্যামিতির নিঁখুত নকশায় বারোটা দেওয়াল আর আটকোন বিশিষ্ট মন্দিরটি । প্রবাদ অনুযায়ী এটি একটি বৌদ্ধস্তূপ। পুজোর বেদী রয়েছে মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে। গোলাকার পুজোর ঘরের চারদিক থেকেই প্রবেশ করা যায়। পাথরের বেদীর ওপর একটা পাথর। সেটি একটা অবয়বের পা এর অংশবিশেষ। হয়তো সেটি পূজিত হতো। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো রয়েছে সূর্যমূর্তি। আরো দুটো ভাস্কর্য্যের দেখা গেল সেখানে। তার মধ্যে একটি ‘অবলোতিকেশ্বর’ । ভেঙে যাওয়া মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটার কারুশিল্প। পাশাপাশি বৌদ্ধ কৃষ্টির ধারায় জায়গা করে নিয়েছে অর্ধমানব,অর্ধপশু ,পদ্মকোষ এসব মন্দিরের গায়েই। পুরাতত্ত্বিকদের কথা অনুযায়ী বাংলাদেশের ময়নামতীতে ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া স্থাপত্য–ভাস্কর্য্যের সাথে পিলাকের পুরাকীর্তির আশ্চর্য মিল রয়েছে। বাংলাদেশের কুমিল্লার ময়নামতী ছিল বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন চর্চার বড় কেন্দ্র। সেখান থেকে বক্সনগর হয়ে বৌদ্ধসন্ন্যাসীরা পিলাক যেতেন বলে কথিত রয়েছে ।
একটু এগিয়েই পিলাক বাজার। বাজারের পাশেই ঠাকুরাণী টিলার অবস্থান। ১৯৯৮–১৯৯৯ সালে স্তুপীকৃত মাটির স্তর সরাতেই পাওয়া গেল একাধিক পুরাকীর্তি। চাতালের নীচে রাখা দশফুট উচ্চতার সূর্যমূর্তি। গ্রামের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গণেশ,শেষনাগ সহ আরো অনেক মূর্তি । ধানমাঠের মাঝে জেগে আছে আরো ঢিবি, সেগুলো এখনও খননের অপেক্ষায়। আশপাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে আছে অনেক প্রাচীন নিদর্শন।
রাজরাজেশ্বরী মন্দির:
মুহুরীরপুরে পূজিত হন আঠারো হাতবিশিষ্ট দেবী রাজরাজেশ্বরী। ওই মূর্তির সঙ্গে আছে সূর্যদেব, মঙ্গলচন্ডী, গণেশ। মহারাজা বীরবিক্রম মানিক্যের আমল থেকেই এখানে এই চার দেবদেবীর অধিষ্ঠান। পূজারীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, কোনো একসময় গরুর গাড়ি করে পিলাক থেকে দেবীর মূর্তিটি এখানে এনে স্থাপন করা হয়েছিল। ফেরার সময় শহীদ ধনঞ্জয় স্মৃতি ইকো পার্কটিও বেড়িয়ে নিতে পারেন। সেখানে ত্রিপুরার অনেক প্রাচীন জনজাতিদের সাথেও দেখা হয়ে যেতে পারে।
মহামুনি প্যাগোডা:
দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার আরও একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র হল মহামুনি প্যাগোডা। আগরতলা থেকে যার দূরত্ব ১৩৪ কিলোমিটার এবং উদয়পুর থেকে দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার । মহামুনি প্যাগোডার অবস্থান যেখানে সেটি মনু বনকুল নামে একটি স্থানে। স্বর্নাভ প্যাগোডাটি শুধু যে সুদৃশ্য তাই নয়, সারা বছরই দেশ বিদেশের প্রচুর বৌদ্ধ পুণ্যার্থীও আসেন এই বৌদ্ধতীর্থ ক্ষেত্রে।
নীর মহল: নীর অর্থাৎ জল।আর সেই জলে যে মহল তাই-ই নীরমহল। এক বিশাল প্রাকৃতিক লেকের মধ্যে তৈরি এই নীরমহল। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে যার দূরত্ব ৫৩ কি. মি.। সিপাহীজলা জেলার মেলাঘরের রুদ্রসাগর লেকের মধ্যে অবস্থিত এই নীরমহল; রক সুরম্য প্রাসাদ। ৫ বর্গ কিলোমিটারের বেশি জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই রুদ্রসাগর । ত্রিপুরার শেষ রাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুর ১৯৩৮ সালে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।
১৯২১ সালে রাজা মাণিক্য বাহাদুরের মনে রুদ্রসাগরের মধ্যে একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণের ভাবনা আসে। কলকাতার একটি নির্মাণ সংস্থাকে এই প্রাসাদ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্মাণ সংস্থার কর্মীরা আট বছরের চেষ্টায় হিন্দু ও মুসলিম নির্মাণ শৈলীর সংমিশ্রণে প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।
রাজা পরিবার সহ গ্রীষ্মকালে প্রমোদ ভ্রমণের ক্ষেত্র হিসেবে এই প্রাসাদটিকে ব্যবহার করতেন। গ্রীষ্মের রোদে তীব্র দাবদাহে রাজা রাজমহলের সকলকে নিয়ে পাড়ি দিতেন নীরমহলে। রুদ্রসাগর লেকের শীতল হাওয়া স্বস্তি দিতো রাজা, রানীসহ রাজপরিবারের সকল সদস্যদের। এখনো গ্রীষ্মকালে নীরমহলে গেলে প্রচণ্ড গরমেও শীতল হাওয়ার ছোঁয়া লাগে শরীরে।
এই প্রাসাদ মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত, অন্দর মহল ও বাহির মহল। অন্দর মহল রাজ পরিবারের লোকজনদের জন্য এবং বাহির মহলে ছিলো দরবার কক্ষ, নাচঘরসহ খোলা মঞ্চ, সৈন্যদের পাহারা দেওয়ার গম্বুজ, তাদের থাকার জায়গা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এখানে মোট ২৪টি কক্ষ রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরণের ফুলের বাগান।
জলের মধ্যে এমন মহল ত্রিপুরারই শুধু নয় সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে একমাত্র এবং সমগ্র ভারতের মধ্যে দ্বিতীয় মহল। এমন আরো একটি জল মহল রয়েছে রাজস্থানে।
রাজ পরিবারের লোকজন রাজঘাটে এসে নৌকায় চড়ে প্রাসাদে পৌঁছাতেন। এখনো পর্যটকদের নৌকায় চড়ে নীরমহল দেখতে যেতে হয়। জল ভর্তি লেকের মধ্য দিয়ে নীরমহলে যাওয়া এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। ভারতের স্বাধীনতার পর নীরমহল প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চলে যায় ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের হাতে। সেই থেকে এখনো নীরমহলের দায়িত্ব রয়েছে ত্রিপুরা সরকারের পর্যটন দফতরের হাতে। এখনো পর্যটকরা নৌকায় চড়ে নীরমহল দেখতে যান। এই জলযানে জলযাত্রা যেন এক অন্য অনুভূতি এনে দেয়।
সিপাহিজলা:
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ২৫ কিমি দূরে সিপাহিজলা অভয়ারণ্যের অবস্থান। এর খ্যাতি মূলত চশমা বাঁদরের জন্য। ভাগ্য ভালো থাকলে তা চাক্ষুষ দেখতে পাবেন। তবে এই অভয়ারণ্যের আয়তন মাত্র ১৯ বর্গকিমি। তা হলেও জীব জন্তুর জন্য এই অভয়ারণ্যের একটা আলাদা খ্যাতি আছে। আগরতলা থেকে সিপাহিজলা যাবার পথটি ঘন সবুজে মোড়া। যেন এক রোমাঞ্চকর জার্নি। রাস্তার দুদিকে বেশির ভাগ রবার গাছের সারি। ত্রিপুরায় যথেস্ট রবার চাষ হয়। রয়েছে শাল, ও সেগুনের ঘন জঙ্গলও। তবে জীব জন্তুদের মধ্যে চশমাবাঁদর ছাড়াও লেঙ্গুর, বাকিং ডিয়ার, বুনো শুয়োর, বন মোরগ, শেয়াল, খরগোশ প্রভিতি প্রানি বেশ নজর কাড়ে। এই অভয়ারণ্যের মধ্যে রয়েছে এক ছোট্ট চিড়িয়াখানা। সেখানে রয়েছে একটা কৃত্রিম হ্রদও। প্রতি বছর শীতের সময় প্রচুর পরিযায়ী পাখি ভিড় করে সিপাহিজলার হ্রদে। সেই মুহূর্ত গুলি ক্যামেরাবন্দি করে নিয়ে আসেন পর্যটকরা। তবে বন দপ্তরে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে সেটি হবে এই ভ্রমণের বাড়তি পাওনা। কারণ যেভাবে রংবাহারি করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে তাতে পর্যটক দের ভালো না লেগে উপায় নেই। সেখান লেকের জলে বোটিং করারও সুযোগ রয়েছে। তবে প্রতি শুক্রবার কিন্তু বন্ধ থাকে সিপাহিজলা অভয়ারণ্য। সেটা খেয়াল রাখতে হবে। তবে সেখানে না থাকলেও হয়, কেননা আগরতলা থেকে দিনে দিনে দেখেও ফেরা যায়। তবে প্রকৃতির কোলে নির্জনে রাত্রিবাসের মজা কিন্তু একটু আলাদাই বটে। সকালটাও বেশ সুন্দর।
ঊনকোটি:
ঊনকোটি শব্দটির বাংলায় অর্থ হচ্ছে এককোটি থেকে এক কম। ত্রিপুরার পর্যটনকেন্দ্র গুলির মধ্যে অন্যতম এটি। এটি একটি শৈব তীর্থ । ইতিহাসে মোড়া এই পর্যটন কেন্দ্রটি আগের উত্তর ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত ছিল। বর্তমানে ঊনকোটি একটি জেলা । ওই জেলার কৈলাসহরে চারদিকে পাহাড় আর ঝরণার মাঝে ইতিহাস যেন কথা বলে। প্রকৃতি কতটা উদার হলে এমন সৌন্দর্য ছড়াতে পারে তা চাক্ষুষ না হলে বোঝা মুশকিল। কথিত আছে,কয়েক হাজার বছর আগে শিবের ভক্তরা সেখানে এসে পাথরের পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন দেবতার মূর্তি খোদাই করেন। ওই খোদাই করা মূর্তিগুলির সংখ্যা এক কোটির চেয়ে একটি কম ছিল। এলাকার বর্ষীয়ান মানুষরা সেই প্রবাদের কথাই বলেন। প্রতি বছর এখানে প্রচুর তীর্থযাত্রীরা অনেক দূর থেকে ছুটে আসেন। এই তীর্থক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে প্রি বছর উৎসব পালিত হয়।
কমলা সাগর:
বাংলাদেশ সীমান্তের একদম লাগোয়া একটি বিশাল লেক। পঞ্চদশ শতাব্দীতে খনন করেছিলেন মহারাজা ধন্যমানিক্য। এই লেকের পাশে ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত প্রাচীন কালি মন্দিরের অবস্থান। প্রতিবছর এপ্রিল ও আগস্ট মাসে মন্দির প্রাঙ্গণে বিশাল মেলা বসে। যা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় জমান অসংখ্য পর্যটক। নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই স্থান। পিকনিকের মরশুমে বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। পাশাপাশি ধর্মীয় কারণে এটি ভারত ও ভারতের বাইরের পূণ্যার্থীদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। আগরতলা শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটারের কাছাকাছি।
আগরতলা:
উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ :
আগরতলা শহরের একদম প্রাণকেন্দ্রে প্রায় আধ মাইল এলাকাজুড়ে দ্বিতল এই প্রাসাদটি অবস্থিত। মিশ্র স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি হয়েছে এই প্রাসাদটি।সেটিকে তিনটি গম্বুজ ঘিরে রয়েছে মুঘল আমলের বাহারি খাঁজকাটা নকশা। ১৮৯৯ সালে এই সুদৃশ্য ও মনোরম প্রাসাদের নির্মাণ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯০১ সালে। সে সময়ই এটি তৈরি করতে ব্যয় হয় ১০ লাখ টাকা। মূলত মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্য বাহাদুরের উদ্যোগেই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ নির্মাণ হয়। দু’পাশে দুটি দীঘি। সেখানে যেন অরণ্য সেজেছে সবুজে। প্রাসাদের প্রবেশ পথের মাঝখানে ফোয়ারা আর ভাস্কর্যসমৃদ্ধ একটি সুন্দর বাগান। প্রাসাদের ভেতরে সারিবদ্ধ ভাবে অজস্র কক্ষ। এগুলোর প্রতিটির রয়েছে আলাদা নাম, যেমন- শ্বেতমহল, লালমহল, সদর বাড়ি, তহবিল খানা, আরাম ঘর, পান্থশালা আরও কত কি। এই প্রাসাদের নামকরণ করেছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কুঞ্জবন প্রাসাদ:
উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের থেকে প্রায় দেড় কিমি দূরে মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্যের নির্মিত কুঞ্জবন প্রাসাদ। এটি আগরতলার আরও একটি চমৎকার স্থাপত্যকর্ম। সেসময় এ প্রাসাদটি তৈরি করা হয়েছিল বিভিন্ন মহারাজা এবং তাদের অতিথিদের অবকাশ যাপনের জন্য। ১৯২৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আগরতলায় তার সপ্তম ও শেষ সফরে কুঞ্জবন প্রাসাদে এসে ছিলেন।
জম্পুই হিলস:
অপরূপ পাহাড়িয়া সৌন্দর্য আর শীতল আবহাওয়ার জন্য জম্পুই হিলস ত্রিপুরার অন্যতম আকর্ষণ। যার দূরত্ব আগরতলা থেকে প্রায় ২১৮ কিলোমিটার । এর একদিকে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ এবং আরেকদিকে চট্টগ্রাম বিভাগ। জম্পুই হিলসের নামকরণের পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুজন ইংরেজ ব্যক্তি এরোপ্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে প্যারাসুট দিয়ে লাফিয়ে পরেছিল এই পাহাড়ে। জম্পুই হিলসের স্থানীয় অধিবাসীরা হলো ত্রিপুরার আদিবাসী রিয়াং ও সিকাম সম্প্রদায়ের। সিকামদের আবাস গেড়েছে দশটি গ্রাম জুড়ে । এসব গ্রামের অবস্থান পাহাড়ের বিভিন্ন উচ্চতায়। গ্রামগুলো ঘুরে দেখলে ছবির মত মনে হয়। জম্পুই হিলসে কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত। স্বাদের জন্য বাজারে এর চাহিদাও অন্যসমস্ত কমলালেবু থেকে অনেক বেশি। তবে এক অসাধারণ ভিউ পয়েন্ট জাম্পুই হিলসের বেথলিং শিব। এটি হলো সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যের উচ্চতম স্থান। এখানে দাঁড়িয়ে চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দৃশ্যবন্দি হলে দুচোখ জুড়িয়ে যাবে। এখানে রয়েছে একটি শিবমন্দির। যা ১৪০০ বছর আগে তৈরি করেছিলেন ত্রিপুরা রাজপরিবার। ত্রিপুরার পবিত্র স্থানের তালিকায় এই মন্দিরের নামও উল্লেখ আছে।