শুক্রবার, ১৩ Jun ২০২৫, ০৭:৩৪ অপরাহ্ন

ত্রয়ী ভাবনায় ‘তিন ইয়ারি পদাবলী’-প্রমথ রায়

ত্রয়ী ভাবনায় ‘তিন ইয়ারি পদাবলী’-প্রমথ রায়

‘প্রেম, প্রকৃতি ও নারী’ এই তিন ভাবনার সংমিশ্রণে রচিত হয়েছে ই-কাব্যগ্রন্থ ‘তিন ইয়ারি পদাবলী ‘। গ্রন্থটিতে ও বাংলার কবি শুভদীপ রায় এবং সুশান্ত নন্দী, এ বাংলার কবি জাকির আহমদের ৩১ টি কবিতা সংকলিত হয়েছে।

কবি শুভদীপ রায় তাঁর ১১ টি কবিতায় রূপক ও উপমার আবরণে পরিপক্ব শব্দের ব্যঞ্জনায় চিরায়ত প্রেমের ভাবনাকেই প্রস্ফুটিত করেছেন। এ প্রেম হতে পারে মানবের সাথে প্রকৃতির, পুরুষের সাথে নারীর। প্রেম যেমন পেয়েছে শারীরিক অবয়ব, তেমনি হয়েছে আত্মিক অন্তরময়। তিনি তাঁর ‘এবং সূর্যমিতা’ কবিতায় বলেছেন, ‘ব্যথার বিছানায় জাগুক দ্যুতিময় আলো’। একই কবিতায় বলেছেন, ‘আত্মিক দিশা খুঁজি শীৎকার স্রোতে’। শরীরের সাথে আত্মার যখন সম্মিলন ঘটে তখনই হয়তোবা আলো দ্যুতি ছড়ায়। কিংবা আমরা ‘বাতিঘর’ কবিতায় খুঁজে পাই, ‘আদরের শামিয়ানায় প্রজ্জ্বলিত আলোকদীপন’। হয়তোবা একই ভাবনার ভিন্ন অবয়ব খুঁজে পাওয়া যায়, ‘দৃশ্যবন্দি’, ‘ঝুঁকতে ঝুঁকতে ‘ কিংবা ‘অভিস্রোত মিশে থাকে নাভীর বলয়ে’ কবিতায়। তিনি ‘বিমূর্ত কথার ক্যানভাসে’ যে শারিরীক প্রেমকে বিমূর্ত করতে চেয়েছেন, সেই প্রেম যদি হৃদয় দিয়ে হয়, তবে তিনি সে প্রেমকে পবিত্র বলেছেন। যেমন তিনি ‘দৃশ্যবন্দি’ কবিতায় বলেছেন, ‘আমরাতো হৃদয়ের ঘরে অপাপবিদ্ধ দোসর’। আগেই বলেছি কবির প্রেম কখনো নারীর সাথে কিংবা প্রকৃতির সাথে। কিন্তু নারী যে প্রকৃতির চেয়েও সুন্দর। প্রকৃতিকে নারী ভাবতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘অথচ তুমি বিনোদিনী হতে পারলে না গোধূলি রমনী’। আবার ‘অভিস্রোত মিশে থাকে নাভীর বলয়ে’ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘বুঝি যতটা অভিস্রোত মিশে থাকে নাভীর বলয়ে/ তার থেকে বেশি দহন বুকের দক্ষিণ আস্তিনে’। তাহলে কি বেদনায় সত্য কিংবা পরিণতি? যে কথা বারংবার ধ্বনিত হয়, ‘বেঠোফেন পুরুষ’ ‘নিশিঢেউ’ ‘বিদ্রুপ নকশা আঁকা ঠোট’ ‘ব্যথানদ এবং কৃষ্ণচূড়া ক্ষত’ কবিতায়। এ ব্যথা শুধু নদের কিংবা পুরুষের। তবু কবি বলেছেন, ‘এসো নদী, গান বাধি, মন বাঁধি পরাগে পরাগে’। সব প্রেম ফুরায়ে, সকল অভিমান মুছে, সার্বজনীন প্রেম জাগরিত হয়, ‘অক্ষরজন্ম পথিক কবিতায়’। কবি বলেছেন, ‘কই যাও চন্দ্রমোহন…./ চৌদ্দ পুরুষের ভিটা ছাইড়া/ কই যাও…..’।

হয়তোবা মাটি ছেড়ে মাটিতেই যেতে হবে। যে কথা অনুরণিত হয় এপার বাংলার কবি জাকির আহমদের কবিতায়। তিনি তাঁর ‘আমি মাটি হয়ে যাই’ কবিতায় বলেছেন, ‘আর কারো কাছে যাওয়ার নেই আমার/ আমি ফিরে যাই মাটির কাছে/ আমি মিশে যাই মাটির সাথে/ আমি মাটি হয়ে যাই….’। মৃত্যুই ধ্রুব সত্য। ‘ক্ষমা করে দিও’ কবিতায় বলেছেন, ‘চল্লিশ পেরোলেই কি যাওয়ার তাড়া শুরু হয়ে যায়!/ অসমাপ্ত কাজগুলো হবে কি শেষ?’ এ হতাশা শুধু জীবন ফুরানোয় নয়, প্রেম ফুরালেও হয়। তাইতো তিনি ‘নবান্নের ঘ্রাণ’ কবিতায় ভাদ্রে স্বপ্নের বীজ বুনেও অঘ্রাণে নবান্নের ঘ্রাণ নিতে পারেন না। ‘ফেরা’ ‘চেনা মুখের অপেক্ষা ‘ কবিতায়ও একই অভিমান, একই হতাশার সুর। তবুও কবি এক পশলা বৃষ্টির অপেক্ষা করে, যে বৃষ্টি তাঁর হৃদয়ে জ্বলন্ত হতাশাকে প্রশমিত করবে, শীতল করবে হৃদয়। তাইতো তিনি মানুষের স্বপ্ন দেখেন। যে মানুষ স্বপ্নবাজ হয়ে ওঠে, ‘খুঁজি ‘ ‘মানুষ’ ‘সবাই মানুষ হতে জানে না’ কবিতায়। শুধু বর্জ্য ত্যাগ করা মানুষ নয়। এ মানুষ হোক মানবিক, সকল পেশার মানুষ।

ওপাড় বাংলার আর এক কবি সুশান্ত নন্দী তাঁর বৈচিত্র্যময়ী ভাবনার কেন্দ্রে রোপণ করেছেন স্মৃতিকাতরতা। তিনি তাঁর ‘যাচ্ছি ‘ কবিতায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একজন বিদায়ী শিক্ষক ও তাঁর শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি ‘শূন্য পর্বের কবিতায়’ বলেছেন, ‘স্বপ্ন ও স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে এখনও/কত স্নেহ আর ভালোবাসা দুচোখের জল মুছে।’ স্মৃতি কখনো দুঃখ এনে দেয়। যেমন, ‘একটি জন্মদিন ও বৃদ্ধাশ্রম’ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘ছেলেরাও কিংবা মেয়েরা কেউই আসেনা এখন/ পায়েস খেতে কিংবা খাওয়াতে/ আসেনা ধান দুখ্য নিতে/আসলে জন্মদিনটাই ভোমরা ভুলে গেছো/ অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে/ তোমরা অপেক্ষা করছো অন্য এক বিষাদ দিনের জন্য’।সুশান্ত নন্দী তাঁর কবিতায় যেমন তুলে ধরেছেন প্রকৃতি ও প্রেম, তেমনি স্পষ্ট করেছেন সমাজের ক্রুর বাস্তবতা। ‘রাত বড় ভয়ংকর ‘ কবিতায় তুলে ধরেছেন শ্রমজীবি, রাতজীবি মানুষদের কথা। তিনি তাঁর প্রেম, অভিমানকে পুনর্জাগরণ করেছেন ‘সুনীলের নীরা’ কবিতায়। একই বিষয়ের দ্যোতনা ঘটে, অনবদ্য গঠনশৈলীর কবিতা ‘টু লাইনার’ এ। সর্বোপরী কবিতা নতুনের কথা বলে, আশার কথা বলে, স্বপ্নের কথা বলে। তিনিও ‘শিকারায় বিকেলের ধুন’ কবিতায় বলেছেন, ‘ এভাবেও নোঙর ফেলে দাও যদি/নদীটির তীরে এসে থেমে যাবে ঢেউ/হৃদয় বাগানে এসে দাড়িয়ে পড়বে কেউ কেউ।’

গদ্যছন্দে রচিত ৩১ কবিতা ভাবনাকে নতুন করে নাড়া দিয়ে যায়। শব্দের ব্যঞ্জনা হৃদয়ে জাগরিত করে আবেগ আহ্লাদের সুর। কবি শুভদীপ রায়ের কবিতাগুলো যতটা ব্যঞ্জময় ও আলংকারিক মনে হয়েছে, জাকির আহমদ ও সুশান্ত নন্দীর কবিতায় তা কিছুটা শিথিল হয়েছে। আবার তাঁদের কবিতা ভাবার্থ করা যতটা সহজতর, শুভদীপ রায়কে বোঝা জটিল বটে। তারপরও প্রতিটি কবিতা উপভোগ্য। অনবদ্য এক কাব্যগ্রন্থ।

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge