জীবন সাইকেল
আবিদ করিম মুন্না
অ্যাই রূপকথা, তুই তো ভীষণ মিস করলি! কী চমৎকারই না গাইলেন পার্থ স্যার আর ম্যাডামÑ ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে আকাশে তারাদের ওই মিছিলে তুমি আমি আজ চলো চলে যাই শুধু দুজনে মিলে।’ ডাক্তাররা এত ভালো গাইতে জানে এতদিন অজানা ছিল রূপকথার। হরতালের কারণে বাসায় আটকে পড়ায় কলেজের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের ওল্ড ইজ গোল্ড অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত সন্ধ্যা নামিছে গগনে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করতে পারে নি।
রংধনুর কাছে শুনে একটু খারাপই লাগল। দুজনেই ভালো বন্ধু। একসাথেই পড়াশোনা করে এমনকি শপিংও। একজনের মেডিকেল ক্যাম্পাসের বাইরে কোনো কাজ থাকলে আরেকজন সফরসঙ্গী হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আর কদিন পর কলেজে আসবে ফার্স্ট ইয়ার। পার্থ স্যার খুঁজে বেড়াচ্ছেন ওল্ড ফার্স্ট ইয়ারের সেইসব ছেলেমেয়ে যারা একটু আধটু গাইতে জানে। দুজনই দেখা করে। রূপকথাকে বললেন, শুনেছি তুমি দারুণ গাইতে জানো। এমনভাবে বলছিলেন ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিল।
মেডিকেল কলেজের ৪৪তম জন্মদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক করা হয়েছে তাকে। শুরুটা করতে চান নতুন করে একটু অন্যভাবেÑ বাংলা সিনেমার গান দিয়ে। গানটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য পুরোটাই মেডিকেল রিলেটেড। গানটি লিখে দেন পার্থ স্যার। ডাক্তারদের হাতের লেখা নিয়ে একটা অভিযোগ থাকলেও এক্ষেত্রে তিনি একশতে একশ। রূপকথার লেখাও মুক্তোর দানার মতো।
হোস্টেলে ফিরে এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলে।
উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত সাগরিকা সিনেমাটির শুভমুক্তির ৫৮ বছর পেরিয়েছে। ১৯৫৬ সালে রিলিজ পাওয়া সিনেমার এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, দ্বিজেন মুখার্জী এবং সহশিল্পীরা। মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন রবীন চ্যাটার্জি আর গানটি লিখেছিলেন নিতাই ভট্টাচার্য।
আমরা মেডিকেল কলেজে পড়ি
অ্যানাটমি প্যাথলজি
মেডিসিন সার্জারি
আরো কত ঝুড়ি ঝুড়ি
নাম আছে আহামরি
কার্ডিওলজি হেমাটোলজি
ফিজিওলজি আরো কত লজি
কিছু তার বুঝি
আর কিছু নাহি বুঝি
মরা কেটে কেটে
পাকাই যে হাত আমরা
হাড়গোড় সব মেরামত করি
সেলাই যে করি চামড়া
ব্যাধি ও বালাই আমাদের ভয়ে
পালাই পালাই করে
কারো দেহ ফুঁড়ি
কাটি আর জুড়ি
কারো পেট চিড়ে
কাটি নাড়ি ভুঁড়ি
আমাদের প্রিয় সাথী
কাঁচি আর ছুরি
যমের দম্ভ ভেঙ্গে
শুধু যে বড়াই করি আমরা…
আমরা মেডিকাল কলেজে পড়ি
ইউটিউবে আমরা মেডিকেল কলেজে পড়ি সার্চ দিয়ে খুঁজে পায় রূপকথা। গানটিতে খুব নয়েজ। তারপরও লিরিক আগেই পেয়ে যাবার কারণে মিলিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট হয় না। সাহস করে পার্থ স্যারকে ফোন দিয়ে প্রতিদিন রিহার্সেলে গাইতে অনুরোধ করে। অবশ্য মূল অনুষ্ঠানে স্যার আর ম্যাডাম দুজনে মিলে গাইতে চান প্রিয় শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা এখুনি নামবে অন্ধকার’ এবং ‘আমার এ গানে স্বপ্ন যদি আনে আঁখি পল্লব ছায় স্বপ্ন দেখে যাব ছন্দ ভরা রাতে তুমি আমি দুজনায়’Ñ এই দুটো গান।
বাইশে শ্রাবণ সিনেমাতে শ্রেয়া ঘোষালের গাওয়া রূপকথা টাইটেলের সলো গানটি রূপকথাকে চয়েজ করে দেন। গানটি সবদিক দিয়েই পারফেক্ট। বলেন, জানিসরে মা সাগরিকা সিনেমাটি ৪০ বছর আগে দেখার পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মেডিকেলে যে কোনো মূল্যে পড়তেই হবে এবং এসে প্রেম করব। প্রেম যে কোনো সময় হয়েই যেতে পারে। কখন হয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। এই মেডিকেল কলেজেই গানের একটি অনুষ্ঠানে তোর ম্যাডামকে আমার ভালো লেগে যায় এবং তারপর…। ফাইনাল ইয়ারে গাইনির অনুরাধা ম্যাডামকে পাবি এবং জানিস বোধকরি উনি আমার একমাত্র বউ।
আজকাল তো তোরা এইসব ক্ল্যাসিক সিনেমা দেখিস না। গানটির সঙ্গে স্পেশাল কোরিওগ্রাফির চিন্তাটাও করে ফেলে রংধনু। মেয়ে দুটোর আগ্রহ দেখে খুব খুশি। এমন মেয়েই তো আমাদের দেশে খুব বেশি প্রয়োজন। বিখ্যাত সেই কবিতার চরণ দুটো একটু উলটিয়ে খানিকক্ষণ ভাবেনÑ ‘আমাদের দেশে হবে সেই মেয়ে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। পারফরমেন্স দেখতে চান তিনি। ছোটোবেলা থেকে ঢাকায় বাবা-মার সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানে গিয়ে কোরিওগ্রাফি বিষয়টা রংধনুর কাছে অনেকটা পানিভাত। প্রতিদিন ক্লাস শেষে রিহার্সেল চলে কলেজ অডিটরিয়ামে।
চমৎকার পারফরমেন্স হলো রূপকথা আর রংধনুর যৌথ প্রয়াসে।
বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়।
থার্ড ইয়ারে উঠে গেছে ওরা।
আজকালকার মেয়েরা কোনোরকম রিলেশনে জড়াবে না এটা ভাবাও তো অন্যায়। মেডিসিন ওয়ার্ডে অ্যাসিসট্যান্ট রেজিস্ট্রার হিসেবে নতুন জয়েন করেছেন ডা. ইমতিয়ার রেজা। বেশ হ্যান্ডসাম কিন্তু গড়নটা একটু নাদুসনুদুস। বিয়ে করেন নি।
ডা. রেজা প্রায় ৫ বছর পর কলেজ লাইব্রেরিতে এলেন। ক্যাডেট কলেজে পড়তেন। জুনিয়র ক্যাডেট আরফানের সঙ্গে দেখা। রেজা ভাই যে, কেমন আছেন। ভালো আর রাখলা কই মিয়া। বয়স তো হয়ে যাচ্ছে। বিয়েশাদি করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা দরকার। কাকে ভালো লাগে আমাকে বলেন। সবাই তো শুনি টিকেট কেটে বসে আছে। এ আরেক যন্ত্রণা! যে মেয়ের ভূগোল ভালো লাগে খোঁজ নিয়ে দেখি ইতিহাস ঘোলাটে।
জীবনের হাসি-কান্না, রোমান্স-ভালোবাসার অনেক দৃশ্যই প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হয় হাসপাতালে। আরফানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে কার্ডিওলজি ওয়ার্ডের সামনে। দূর থেকে হেঁটে আসছে দুটো মেয়ে অ্যাপ্রন গায়ে চাপিয়ে গলায় গোলাপি রঙের স্টেথো ঝুলিয়ে। ড্রেসআপ এবং হাইট একই। শুধু অমিল রূপকথা চশমা পরে না আর রংধনু…। আরফানের সঙ্গে হাই হ্যালো করে ওরা ওয়ার্ডে ঢুকে পড়ল।
আরফানের কাছে গল্প শুনে ইমতিয়ার রেজার রূপকথাকে ভালো লেগে যায়। ডা. রেজা গানবাজনা পছন্দ করেন। নিজে গুনগুন করে গাইতেও ভালোবাসেন। গিটার বাজাতেন চমৎকার। সংগ্রহে আছে হাজার হাজার গানের সিডি। গান গাইতে জানে এমন গুণী মেয়ে পেলে তো সোনায় সোহাগা।
স্কুল জীবনের শেষদিকে রূপকথাকে একটি ছেলের ভালো লেগেছিল। রূপকথাও তাকে পছন্দ করত। আরফানকে এমনটাই জানিয়েছিল। ওই সময় ফ্যামিলিতে জানাজানি হয়ে গেলে ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্যাপারটায় ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিল রূপকথা। অনেক দূর এগিয়েছিল সম্পর্কটা। রূপকথার মার সায় থাকলেও বদরাগী বাবার কারণে বেশিদূর গড়ায় নি। কিছুদিন আগে সেই ছেলেটি বিসিএস কোয়ালিফাই করবার পর বিয়ে করেছে।
বাবার ইচ্ছে ছিল একমাত্র মেয়ে ডাক্তারি পড়ে গাইনোকলজিস্ট হবে। সেই স্বপ্নপূরণ করতে রূপকথা এখন বহুদূরে এসেছে। শপথ করিয়েছিলেন বাবা মেডিকালে পড়ার কখনও সুযোগ হলে সেখানে কারো সাথে রিলেশন কিংবা বিয়েও যদি করতে চায় তবে কোনো আপত্তি থাকবে না।
মেডিসিন ওয়ার্ড ক্লাসে ডা. রেজার সাথে আজ প্রথমবারের মতো রাউন্ডে যাচ্ছে রূপকথা-রংধনু। খুব ভালো লেগেছে স্যারকে। ডা. রেজা বললেন, তোমরা যত বেশি পেশেন্টের সাথে সময় কাটাবে ততই তোমাদের দক্ষতা বাড়বে। যখন মন চাইবে হাসপাতালে চলে আসবে।
একদিন তাকেই আপনি থেকে তুমি বলবে এটা কি ভাবতে পেরেছিল রূপকথা? বেশ কিছুদিন ধরে প্রফেসর আহসান ডা. রেজার আচরণে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছিলেন। সবকিছু খুলে বলাতে আহসান স্যার বলেন, দেখো রেজাÑ তুমি আমার প্রিয় ছাত্র ছিলে, এখন প্রিয় সহকর্মী। তোমার যাকে ভালো লাগে আমি তার সাথে কথা বলব, প্রয়োজনে অভিভাবকের সাথে কথা বলতেও আপত্তি নেই। তোমার বিয়ে দিতে পারলে হজের সওয়াব পাব। কেন বাবা নিজেকে বঞ্চিত করব।
ফাইনাল ইয়ারে এসে বিয়ের পিঁড়িতে বসল রূপকথা। ইন্টার্নির মাঝামাঝি জানতে পারল ঘরে নতুন অতিথি আসছে। একসময় জানল মেয়ে আসবে ঘর আলো করে। দুজনের প্রথম অক্ষরের সাথে মিল করে নাম রাখল রূপন্তি।
ডা. রেজার বড়োবোনের পড়াশোনা ইংরেজি সাহিত্যে। সরকারি চাকুরে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বোনকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যাপারে সতর্ক করবে কি, উলটো বোন রুমানা একদিন ঢাকা থেকে কুরিয়ারে পার্শ্বেল করে একটি রেসিং সাইকেল পাঠিয়ে দেয়। সাইক্লিং করে কিছুটা মেদ যদি কমে। সাঁতার কাটলেও ভালো কাজ হবেÑ কথাটাও মনে করিয়ে দিত বারবার সেলফোনে।
রূপকথা ইন্টার্নি শেষ করে এখন একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের লেকচারার।
কয়েকদিনের মধ্যে ঘর আলো করে রূপন্তি এল।
যেখানেই কাজ থাকুক ডা. রেজার নিত্যসঙ্গী সেই সাইকেল। সকালে সন্ধ্যায় হাসপাতালে ডিউটিতে যাওয়া থেকে শুরু করে বাজারঘাট সবখানে।
একদিন সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে খবর এল। যেতেই হবে ডা. রেজাকে। কালবিলম্ব না করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
মেডিকেল মোড় এসে পৌঁছেছেন।
ডানদিকে টার্ন নেবেন।
চলে গেল ইলেকট্রিসিটি।
ঘুটঘুটে অন্ধকার।
পেছন থেকে একটি ট্রাক এসে সজোরে ধাক্কা দিল।
ছিটকে পড়লেন। প্রচণ্ড আঘাত পেলেন মাথায়।
রাস্তায় থাকা লোকজন নিয়ে গেলেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।
অবস্থা সংকটাপন্ন। ঢাকাতে নিতে হবে। চলে এল এয়ার অ্যামবুলেন্স।
লাইফ সাপোর্টে দেশসেরা একটি হাসপাতালে ডা. রেজা। প্রাণপণ চেষ্টা চলছে তাকে বাঁচানোর। বিদেশে নিতে হলেও সবাই মনে মনে তৈরি…।
কিন্তু দুদিন পর কাকডাকা ভোরে ডাক্তারদের প্রাণান্ত প্রয়াস, রূপকথার অঝোর অশ্রুধারা কিংবা রূপন্তির তুলতুলে ভালোবাসা সবকিছুকে উপেক্ষা করে ডা. রেজা হারিয়ে গেলেন নিঃসীম অসীমতায়।