রাত ১টা থেকে আমি হাঁটাহাঁটি করছি রায়ের বাজার এলাকার গলিতে গলিতে।
আমি ঢাকার এই এলাকাতেই থাকি। ঘুম আসছে না তাই রাস্তায় নেমে হাঁটছি। নভেম্বর মাস। মধ্যরাতের পর ভালো শীত পড়ে। গরমকালের থেকে শীতের দিনে হাঁটাহাঁটি করা আরামদায়ক সন্দেহ নেই, কিন্তু শীতের রাতে লেপ-কম্বল ছেড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসাটা কোনো সুস্থতার লক্ষণ না। একমাত্র জরুরি কাজ থাকলেই এই সময়ে বের হওয়া যায়। আমার কোনো কাজ নেই। আমি বের হয়েছি একধরণের অস্থিরতা থেকে। আমার প্রাক্তন প্রেমিকা তুলির গতরাতে বিয়ে হয়ে গেছে। অস্থিরতার মূল কারণটা নিজের সাথেই নিজে স্বীকার করতে চাচ্ছিলাম না। মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী।আমার নাম সোহেল মাহমুদ। বয়স ২৯। সাইকোলজিতে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করে বেশ কিছু দিন একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে একসময় বের হয়ে আসি। চাকর হয়ে বেশি দিন টিকতে পারিনি। এখন কাজকর্ম ছাড়া বেকার জীবন কাটাচ্ছি। বাবা মারা গেছে অনেক আগে। মা দেশের বাড়িতে থাকে আমার বড়ভাইয়ের সাথে। প্রেম করার সময়ও অর্থ উপার্জনের তাগিদ ছিল, গত দেড় বছর ধরে তাও নেই। যেই মেয়ের সাথে এত আগে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে, তার বিয়েতে আমার মন খারাপ করার কিছু থাকার কথা না। তবুও মন খারাপ লাগছে। এর কারণ একটা ফোন কল… আচ্ছা ফোন কলের কথায় একটু পরে আসছি।
গলির মুখে কিছু ছেলেপুলে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। একটা মোটর সাইকেল আছে ওদের সাথে। সিগারেটের একটা ছোট্ট দোকান খোলা। এই সিগারেট বিক্রেতাকে আগে কখনো দেখিনি। রাতেই ব্যবসা করে হয়ত, দিনে ঘুমায়। এই ধরণের অনেকেই রয়েছে যাদের ব্যবসা রাতে। এরা খুচরা মাদক বিক্রি করে, রাতের প্রজাপতিদের সন্ধান দেয়। রেললাইনের ধারে কি পরিমাণ মাদক ও দেহ ব্যবসা চলে তা যে না দেখেছে বিশ্বাস করবে না। সে যাক, আমি দোকানে গিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে একটা ধরালাম। ছেলেগুলো আড় চোখে আমার দিকে তাকাল। ওদের আড্ডার স্রোতে ক্ষাণিকটা বাধা পড়ছে বুঝা যাচ্ছে। এই গভীর রাতে তারা আমার মত কোনো আগন্তুক আশা করেনি। আমি যে এই পাড়াতে অনেকদিন থাকি সেটা বোধহয় বুঝা যায়। ছেলেগুলো নেশা করে এসেছে কিন্তু ঠিক ছিনতাইকারী বলে মনে হল না। আমি ওদের দিকে একটা বন্ধুসুলভ হাসি দিয়ে হেঁটে পাশের গলিতে চলে এলাম।
ফুটপাথে একজন বৃদ্ধ ভিখারী শুয়ে আছে ছালার বস্তা গায়ে দিয়ে। পাশে একটা নেড়ী কুকুর ঘুমাচ্ছে। সরু গলিতে আমরা তিনজন মাত্র প্রাণী। বৃদ্ধ আমাকে দেখে আবার ছালার ভেতর ঢুকে পড়ল। ভাবলাম লোকটার সাথে একটু কথা বলি, কিন্তু যথারীতি এড়িয়ে হাঁটা শুরু করলাম। পেছন থেকে বুড়া ডাক দিল।
– বাবার কাছে কি সিগ্রেট আছে?
আমি প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিলাম। সে ম্যাচ বের করে সিগারেট ধরিয়ে নিজে থেকেই কথা শুরু করল।
– সিগ্রেট খাইয়েন না বাবা। বিড়ি-সিগ্রেট, গুল-তামাক-গাঞ্জা খাইলে হায়াত কইমা যায়, অসুখ বিসুখ হয়।
– হু। তা হয়।– বাবাজীর কি মন খারাপ? বউয়ের লগে ঝগড়া হইছে? ঝগড়া কোনো খারাপ জিনিস না। মন পরিষ্কার হয়। সক্কালে দেখবেন সব ঠিক
হইয়া গেছে।
– না। সেইরকম কিছু না। আমি বিয়ে করি নাই।
– কিছু মনে কইরেন না বাবা। বুইড়া মানুষ, ফকির মানুষ সারাদিন মাইনশের গালি খাই। আপনে আমারে দামী সিগ্রেট দিছেন।
আপনারে উপরওয়ালায় দশটা সিগ্রেট দিব।
– না ঠিক আছে। আপনি ঘুমান।
– ঘুমায় ঘুমায়ই তো দিন যায় বাবাজী আর কি করুম! বাড়িত যান গা। এলাকার পোলাপাইনগুলা ভালো না।
– হু জানি। আমি যাই।
– কিছু মনে না করলে আরেকটা সিগ্রেট দিয়া যাইবেন বাবা? সক্কালে খামু।আমি বৃদ্ধকে আরেকটা সিগারেট দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। চার-পাঁচটা রাস্তা পার হয়ে রায়ের বাজার বদ্ধভূমির দিকে চলে আসলাম। বেশ কিছু বাতি জ্বলছে। অন্যরকম দেখাচ্ছে বদ্ধভূমিটি। বুঝলাম একদম সামনে যাওয়া যাবে না। পুলিশ পাহারায় আছে জায়গাটা। আমি বাসায় ফিরে আসার পথ ধরলাম। রিকশায় করে যেতে পারলে ভালো হত কিন্তু এখানে যে চার-পাঁচটা রিকশা দেখছি সেগুলোর সব কয়টার ভেতর একজন করে মেয়ে বসে আছে হুড তুলে। বুঝলাম রাত্রীকালীন এই রিকশাগুলোর প্যাসেঞ্জার আলাদা।
উদাসীন ভাব ছেড়ে আমার এক রুমের ঘরে ফিরে আসলাম রাত ২টার দিকে। গরম পানি করে গোসল করলাম, ভাত খেলাম। ফ্রিজে ছিল দুপুরের ভাত, আলুভর্তা, টমেটো ভর্তা। পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে সরিষার তেলে একটা ডিম ভেজে নিলাম। বাইরে বেশ ঘন কুয়াশা পড়ছে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি স্ট্রিট লাইটের আলোতে সবকিছু নীলচে ধূসর দেখাচ্ছে। এই বছর ঠাণ্ডাটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। আমি লেপের নীচে ঢুকে গেলাম। ঠাণ্ডার রাতে লেপের ভেতর শুয়ে ঘুমানোর মত আরামদায়ক কিছু আর হয় না। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলাম। তুলির বিয়ে বা বহুদিন পরে তার ফোন কল- কোনো কিছুই যেন মাথায় থাকল না।
“বিকালবেলা আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে ছোট্ট সাদা নৌকায় বসে আমি মাছ ধরছি। কোনো পশুর ডাকে পেছনে ফিরলাম। দেখি- জঙ্গলা ঝোপটা নড়ছে। কোনো পশু হয়ত উঁকি দিয়েছিল। সামনে তাকাতেই দেখি পুরো সমুদ্র জমে সাদা বরফ হয়ে গেছে। ছিপটা আটকে আছে বরফে। আমি নৌকা ছেড়ে উঠে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম।
রাত নেমে এসেছে। জঙ্গলের মধ্যে আমার একতলা কাঠের বাড়ির সামনে তিনজন লোক আর একজন মেয়ে কাঠের গুঁড়ি দিয়ে আগুন করেছে। তারা বসে বসে জিপসিদের মত গান করছে। আমার বাড়ির সামনে এরা কি করে? আমি ঘরে ঢুকতে গেলে ওরা চারজন স্থির চোখে আমার দিকে তাকাল। তারপর একসাথে সবাই উচ্চস্বরে হেসে বলতে থাকল- “কাওয়ার্ড, কাওয়ার্ড, কাওয়ার্ড”। আমি ঘরের দরজা খুলতেই দেখি ভেতরে একটা সাদা সাইবেরিয়ান বাঘ! আমি বের হয়ে দৌড়াতে থাকলাম।
সমুদ্রের উপর দিয়ে দৌড়াচ্ছি। এমন সময় পুরানো দিনের অ্যানালগ ফোন বেজে উঠল। ক্রিং ক্রিং ফোনের শব্দটা আসছে আমার সামনে থাকা সাদা নৌকাটি থেকে। গভীর সমুদ্রে দৌড়ে নৌকায় উঠে রিসিভার উঠালাম। ফোনের অপরপাশ থেকে তুলি বলল- “You are a coward”. রিসিভার ধরেই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা শকুন ঘুরছে ত্রিশ-চল্লিশ ফিট উপরে।”
এপর্যন্ত স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘেমে বিছানা বালিশ ভিজে গেছে। আমি ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা ছোট্ট চড়ুই পাখি বন্ধ ফ্যানের ব্লেডে বসে আছে। জানলা দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়েছে। আমি উঠে এক গ্লাস পানি খেলাম। ভয়ংকর অনুভূতি ছিল স্বপ্নটার। স্বপ্ন ভাঙ্গার পর বেশ স্বস্তি লাগছে- মনে হচ্ছে ভাজ্ঞিস বিষয়টা স্বপ্ন ছিল।
গতকাল তুলির বিয়ে হয়ে গেল। কেন সে দেড় বছর পর নিজের বিয়ের দিনই আমাকে ফোন দিল? সে কি চাইছিল আমি সিনেমাটিক কিছু করে তার সাথে দেখা করি? নাকি এখনো সে ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কের কাপুরুষকে মনে মনে কামনা করে? আমি আর ভাবতে পারছি না। মনে হল তুলি সারাজীবনের জন্য আমার মাথায় কিছু প্রশ্ন ঢেলে দিয়ে চলে গেল- যার কোনো উত্তর আমার জানা নেই।
যার কোনো উত্তর হয় না।