ছিন্ন পাতায় ভাসাই তরী
পিয়াল হাসান
১
শরতের সকাল। বর্ষা প্রায় শেষ। তবু বৃষ্টির ছোয়া সারাক্ষন ধাবমান। তবে এখন আবহাওয়াটা স¦চ্ছ। এমনি এক সীগ্ধ সকালে শহরের এক চায়ের দোকানে ঢুকলো আবির। উদ্দেশ্য চা খাওয়া। সে চায়ের দোকানে ঢোকা মাত্রই একটি ছেলে (হোটেল বয়) এসে বলল,“কি খাইবেন স্যার?” “কি আছে?” “চা-বিস্কুট।” “বিস্কুট আর চা দাও। র-য় চা।” “র-য় চা কড়া হইব। দুধ চা দেই। মালাই দিয়া দুধ চা পাওয়ন যায় এইহানে।” “ঠিক আছে। দুধ চা-ই দাও।” “আইচ্ছা।” দোকানের ছেলেটি তাকে দুধ চা আর বিস্কুট দিয়ে যায়। তা খেয়েই আবির বের হয় দোকান হতে।
আবির আজ বের হয়েছে জড়ুরী এক কাজে। সে এ শহরে এক মেসে থাকে। তার চাকরি দরকার। আর এটিই হলো তার জড়ুরী কাজ। কয়েক দিন আগে পেপারে সে একটি চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে (সংবাদ পত্রে নিয়োগ সংক্রান্ত) দরখাস্ত করায় সেখানে তার ইন্টারভিউ হয় এবং এর রেজাল্ট পেতে আজ তার ছুটে চলা। রৌদ্রের তেজ বেড়ে যাচ্ছিল। তবুও সে ছুটতে থাকলো নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।
মনির সাহেবের মেয়ে বেলাকে পছন্দ করে আবির। তার জন্যই আজ সে চাকরি পাবার আশায় ছুটছে। বেলার সাথে তার প্রথম পরিচয় হয় কলেজ লাইফের দিনগুলোতে। সে সময় খুব নাম করা ছাত্র ছিল আবির। বেলা তখন কেবল অনার্স ৩য় বর্ষে। আবির অনার্স শেষ করে এমএ পড়ছে। তাদের পরিচয় হয় ভ্যালেন্টাইজ ডে তে ফুল দেওয়া নেওয়ার মাধ্যমে। তখন থেকেই ভাললাগা। তারপরেই প্রেম। আবির এমএ পাশ করার পর হতেই টিউশোনি করা শুরু করে এবং সে আজ বেলার জন্য চাকরি পাওয়ার আশায় ছুটছে। তাকে পৌছাতেই হবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
একদিনের ঘটনা। আবির কি যেন কাজে মেসে বাস্ত ছিল। হঠাৎ বেলা এসে বলল, “আবির আজ তোমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাব।” “মানে?” আবির জানতে চায়। “মানে, আমি আমাদের সম্পর্কের কথা বাবাকে বলেছি। তাই তিনি তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।” “তা কি ঠিক হবে ? না না, এটা হয় না।” “কেন হয় না। তুমি কি চাও না, আমাকে একান্ত আপন করে পেতে ?” “চাই, অবশ্যই চাই। কিন্তু, তুমি তো জান আমি বেকার মানুষ। সামান্য টিউশনি করে জীবন কাটাই। আর তোমার বাবা আমার এ অবস্থা শুনে যদি...” “না না, আমার বাবা এমন লোক নন। আমার তো মনে হয় কোন অসুবিধাই নেই।” “কিন্তু....” “কিন্তু টিন্তু নেই, চল তো।”
সেদিন বেলা আবিরকে তার বাবার কাছে নিয়ে গেলেও তার বাবা আবিরের সাথে কথা বলে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় নি। তার একটাই কথা, যদি আবির চাকরি পায়, তবেই তিনি ওর হাতে বেলাকে তুলে দেবেন। তার আগে নয়। এরপর থেকে ওর এ চাকরি খোঁজা শুরু। তাই আজ ও ছুটছে তার নিদিষ্ট ঠিকানায়।
২
আবির বসে আছে সেই সংবাদপত্রের অফিসে যেখানে ওকে ডাকা হয়েছে। একটু পরেই তার কাংখিত রেজাল্ট। ওর এখনও ডাক পরেনি। তবুও সে অজানা ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ। সে নার্ভাস ফিল করল। যদি চাকড়িটা না হয়। যদি সে বেলাকে হারিয়ে ফেলে তার মনের রাজ্য থেকে। কিছুক্ষন পর তার ডাক পরল। শেষ পর্যন্ত নার্ভাস ভাব নিয়েই সে প্রবেশ করল সম্পাদকের রুমে।
আবির প্রবেশ করেই দেখলো সম্পাদক সাহেব কাজগপত্র ঠিক করছেন। মনে হয় তারই। হঠাৎ, ওকে লক্ষ করে সম্পাদক চেয়ারে বসতে বলায় ও দুরু দুরু বুকে বসে পরলো। একটু পরেই সম্পাদক বলে উঠলেন, “নার্ভাস নাকি, আবির সাহেব।” “জ্বি, কিছুটা।”
সম্পাদক আর কিছু বললেন না। একটু পর রির্পোট দেখে তিনি পুরোপুরি আবিরের দিকে তাকালেন। বললেন, “আবির সাহেব। আপনার বায়োডাটা আমরা পড়েছি। আপনি তো এমএ তে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট। সামান্য টিউশনিও করেন।” “জ্বি।” “তাহলে তো আপনার এ সময় সুখেই খাকার কথা। তবে, আজ রেজাল্টের দিন একটু নার্ভাস ফিল হতেই পারে।” “স্যার, আমার চাকড়িটা দরকার। আমি এর আগেও চাকড়ির আবেদন করেছিলাম দু,তিন খানে। কিন্তু কাজ হয় নি।” “আবির সাহেব। জীবনটা কিন্তু খুবই কঠিন। আর জীবনে চাকরি পাওয়াটাও অনেক কঠিন ব্যাপার।” “তাহলে চাকরিটা কি আমি পাব না।” “হতাশায় ডুবে আসেন মনে হচ্ছে। হতাশাও কিন্তু একটা রোগ আবির সাহেব। যাই হোক, আপনি বরং চা খান। চা দিতে বলি ?” “স্যার কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে চাকরির জন্য এসেছি আর রেজাল্টটা পেলেই আমি চলে যাব চাকরি হোক আর না হোক।”
আবির যখন কথাটা বলছিল তখন সম্পাদক সাহেব ফোনের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলেন। তাই ওর কথাটা শেষ হতেই তিনি কিছু না বলে ফোনে তার এসিস্টেনকে ডাকলেন। তার এসিস্টেন এলে তিনি যা বললেন তাতে আবির কাঁদবে না হাসবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। কারন, সম্পাদক তার এসিস্টেনকে ওর জয়েনিং লেটার দিতে বলেছেন। পদ, সংবাদপত্রের একাউন্টিং। একটুপর এসিস্টেন চলে গেলে আবির ওর আবেগ লুকিয়ে রেখে শুধু বলল, “থ্যাক্স, স্যার। মেনি মেনি থ্যাক্স।” সম্পাদকও তখন হাসছেন। তিনিও এর জবাবে বললেন, “ইউ আর ওয়েলকাম। আসলে আপনাকে আমাদের ইন্টারভিউয়ের দিনই ভাল লেগেছিল। শুদু আজ বাজিয়ে দেখছিলাম আপনার চেহারা কেমন হয়। আসলে এটা না করলেও হত। যাইহোক, ভূল করলে মাফ করবেন। আর ভাল থাকবেন।” “না না, আমি কিছু মনে করি নি। ধন্যবাদ।” “আর একটা কথা, জীবনটা আসলে বড় কঠিন। এখানে টিকে থাকলে বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করতে হয়। আপনি বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করেই তো আজ চাকরিটা পেলেন। যাইহোক, ভালো থাকবেন।” “ঠিক আছে।”
শরতের সেই বিকেলে চাকরিটা পাওযার পর আবির বেড়িয়ে আসে রাস্তায়। আজ তার সব স্বপ্ন পূরন হলো যেন। হঠাৎ, বিকেলের মিষ্টি আভায় একটু পরিবর্তন হয় যেন। দেখা দেয় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টিতে ভিজে যায় আবির। আর তখনই ওর মনে পড়ে বেলার কথা। বেলাকে পাওয়ার জন্যই তো তার এ সংগ্রাম। তাই সে বৃষ্টিতে ভিজেই ছুটে যায় টেলিফোন বুথ এর দিকে…….