শুক্রবার, ১৩ Jun ২০২৫, ০৭:৩৫ অপরাহ্ন

চলে গেলেন কবি সরোজ দেব, আমাদের প্রিয় সরোজদা-আমিনুল ইসলাম

চলে গেলেন কবি সরোজ দেব, আমাদের প্রিয় সরোজদা-আমিনুল ইসলাম

অনেকদিনের প্রিয় পৃথিবী ছেড়ে আজ অজানা ভুবনের না-ফেরার দেশে চলে গেলেন কবি সরোজ দেব। আমাদের প্রিয় সরোজদা। আমি বয়সে ছোট হলেও তিনি আমাকে ‘ আমিনুল ভাই’ বলে ডাকতেন। তাঁর সেই মখমলি ডাক আমার কানে মধু ঢেলে দিতো। আমি তাঁকে শুধু নাম ধরে ডাকার জন্য দু-একবার পীড়াপীড়ি করেছিলাম কিন্তু তাঁকে মানাতে পারিনি। চাকরিতে ডাম্পিং পোস্টিং বা পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে আমাকে গাইবান্ধা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পোস্টিং দেওয়া হয়। ছোট দুটি সন্তানসহ বাসার মালপত্র নিয়ে লীনা চলে যায় মুণ্ডুমালা শশুরবাড়িতে। সেখানে সে তার বাবা (শশুর)-এর ‘‘ প্রিয় মেয়ে ” হয়ে যায়। আর রবীন্দ্রনাথের ‘‘পোস্টমাস্টার” এর মতো পরিবার-পরিজনহীন আমি গাইবান্ধা জেলা পরিষদের ডাকবাংলায় উঠি। কিন্তু সেখানে কোনো বালিকা রতন ছিল না যে ‘বালিকা রতন আর বালিকা না থেকে “ জননীর স্থান অধিকার করিয়া “ বসবে। তো সপ্তাহ শেষে বাসে চড়ে প্রথমে রাজশাহী, অতঃপর আরেকটি লোকাল বাস ধরে মুন্ডুমালা। এভাবেই ২ বছর ৬ মাস। একদিন একবার বাস থেকে নেমে দেখি, আমার সাপ্তাহিক ময়লাযুক্ত কাপড় ভরতি ব্রিফকেসটি খোয়া গেছে। ততদিনে আমার ব্যাচমেটরা অনেকেই আমাকে ডিঙিয়ে এডিসি হয়ে গেছেন । ফলে বাধ্যতামূলকভাবে একধরনের কষ্ট মনে। কিন্তু গাইবান্ধা সেই দণ্ডিত আমাকে ‘‘কবি ” বানিয়ে দেয় সেই আড়াই বছরে। আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘‘তন্ত্র থেকে দূরে” প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে। তখন আমি গাইবান্ধায়। নদীভাঙন জনিত কারণে গাইবান্ধা তখন খুবই গরিব জেলা এবং মঙ্গার আক্রমণের শিকার। কিন্তু সাহিত্যচর্চা, নাট্যচর্চা, সংগীতচর্চা ইত্যাদিতে গাইবান্ধা অনেক এগিয়ে। শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। পরিচয় হয় আবু জাফর সাবু (বর্তমানে প্রয়াত), সরোজ দেব, ইসলাম রফিক, অধ্যাপক মাজহারুল মান্নান, গোবিন্দ চন্দ্র দাস , রজতকান্তি বর্মণ, সুলতান উদ্দিন আহমেদ, শামীম মাহবুব , দেবাশীস দেবু, মামুন মিজান, পিটু রশিদ, মানিক বাহার, কিংশুক ভট্টাচার্য ইন্দ্রজিৎ সরকার, অদ্বিত্ব শাপলা এবং আরও কয়েকজনের সাথে যারা সকলেই সাহিত্য-নাটক-সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমার প্রথম বই ‘‘তন্ত্র থেকে দূরে”-এর প্রথম রিভিউয়্যার কবি-ছড়াকার-সাংবাদিক আবু জাফর সাবু ভাই বছর দুয়েক হয় মারা গেছেন।
কবি সরোজ দেব তখন কবিতা লেখার পাশাপাশি ‘শব্দ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। তাঁর আরেকটি পত্রিকাও ছিল। বয়সের চাপে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে নামটা ভুলে গেছি। সরোজ দেব বয়সে আমার সিনিয়র ছিলেন। লেখক হিসেবে ছিলেন অনেক অনেক সিনিয়র। কারণ আমি চাকরিজীবেন প্রবেশ করে লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছিলাম। সরোজ দেব ছিলেন এক নিপাট ভদ্রলোক; কথাবার্তায়– আচরণে নিরহংকার ও অনুদ্ধত। অজাতশত্রু। তাঁর কাছে কেউ পর ছিল না। দুনিয়ার সবাই ছিল আপন। যারা তাঁর পরিচিত হয়ে সাহিত্যচর্চা করেছেন, তারা সবাই ছিলেন তাঁর ‘‘বৃহত্তর পরিবার” এর লোক। একই ফরমুলায় খুব অল্পদিনের মধ্যে সরোজদার আপন হয়ে উঠি আমি। ‘শব্দ’ পত্রিকায় আমার কবিতা থাকতেই হবে। আমি জেলা পরিষদের ডাকবাংলায় বিবাহিত ব্যাচেলর। পৌরসভায় তেমন কোনো কাজ ছিল না। অফুরন্ত অবসর। সরোজ দেব এবং আরও কয়েকজনের উসকানিতে আমি নিজের টাকায় ২০০২ সালে প্রথম কবিতাগ্রন্থ বের করি: ‘তন্ত্র থেকে দূরে’। প্রকাশক: শ্রাবণ, আজিজ সুপার মার্কেট , শাহবাগ , ঢাকা। গাইবান্ধার আরেক গুণী মানুষ কবি সিরাজুদ্দৌলাহ বাহার বইটি প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এভাবেই গাইবান্ধা আমাকে কবি-প্রাবন্ধিক বানিয়ে দেয়। আমার এখন বইয়ের সংখ্যা ৩১। আজ পেছনে ফিরে দেখলে মনে হয়, সেই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাকে গাইবান্ধায় ‘‘পানিশমেন্ট পোস্টিং” না দিলে আমলাতন্ত্রের মূলধারায় বেশি বেশি সক্রিয় থেকে আমিও হয়তো ‘‘ক্যারিয়ারিস্ট” হয়ে উঠতাম এবং ‘‘সচিব’’ হিসেবে অবসরে যেতাম। আমার সচিব হওয়া হয়নি। কিন্তু একজন ক্ষুদে লেখক হয়েছি। আমার ৩১টি বইয়ের ফ্ল্যাপে কোনোটাতেই ‘‘পেশাগত পরিচয় ” উল্লেখ নাই। হয়তো কোনো গোপন অভিমান কাজ করেছে অবচেতনে। তবে এটাও সত্য যে সরকারি চাকরি আমাকে সরকারি টাকায় গাইবান্ধাসহ সারা বাংলাদেশ দেখিয়েছে। তাই সরকারি চাকরির ঋণ অস্বীকার করে অকৃতজ্ঞদের তালিকায় নিজের নাম লেখাতে চাই না।
গাইবান্ধা থেকে বদলী হয়ে যাওয়ার পর আরও ২০ বছর চাকরি করেছি। মূলত ঢাকায়। সরোজদা ঢাকা এলেই আমার মতিঝিলস্থ সরকারি ফ্ল্যাটে আসতেন। লীনাকে নিজের ছোটবোনের মতো দেখতেন। লীনাও তাঁকে সরোজদা বলে জানতো এবং শ্রদ্ধা করতো। সরোজদার মাথাভরতি কাব্যিক চুল দেখে আমি মনে মনে ঈর্ষান্বিত বোধ করতাম সবসময়। লীনাকে অনেকবার বলেছি, সরোজদার মতো মাথাভরতি শৈল্পিক চুল থাকলে আমিও মাথাভরতি চুল- মুখভরতি দাড়ি রেখে দিতাম। আমাদের মতো লেখকদের মধ্যে সরোজদার জনপ্রিয়তাও ছিল ঈর্ষণীয়।
কিন্তু শেষের কয়েকবছর সরোজদার সাথে তেমন যোগাযোগ ছিল না। কেন অমনটি ঘটেছিল? দুর্ঘটনায় আমার পা ভেঙে যাওয়া, কোভিড-১৯ অতিমারিতে আক্রান্ত হওয়া এবং নিজের চাকরি নিয়ে অপ্রকাশিত অসন্তোষ্টি ইত্যাদি আমার নিজেকেও অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুটিয়ে থাকতে বাধ্য করেছিল বলে এখন মনে হয় আমার। আবার পরবর্তীতে সরোজদাকে ঘিরে রেখেছিল সাহিত্যজগতের দুয়েকজন মানুষ যারা সরোজদা এবং আমার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল বলে আমার বেশ কয়েকবারই সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু আমি অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও তুচ্ছ যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে অভ্যস্ত বলে আমার সেই সন্দেহের কথা সরোজদাকে বলতে চাইনি। হানাহানির জয়ের চেয়ে নিভৃত পরাজয়ের কোলাহলমুক্ত দিনরাত আমাকে শান্তি দেয় বেশি। সরোজ দেবও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নাম লেখাননি কোনোদিন।
সরোজদা নানাবিধ কারণে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল তো বটেই, মাঝেমাঝে অনটনগ্রস্তও থাকতেন বলে দূর থেকেই জানতাম। কবি-সম্পাদক সরোজ দেবের কাছে অনেকেই সাহিত্যক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি ও পথ পেয়েছেন। কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কয়জন তাঁকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করেছেন, আমার জানার সুযোগ হয়নি। এটাও ঠিক যে, তিনি আত্ম-মর্যাদাশীল মানুষ ছিলেন। সরোজদার কাছে আমারও অনেক ঋণ আছে। সেই ঋণ চিরতরে চির-অপরিশোধিত ও চির-অপরিশোধ্য থেকেই গেল।
আমি মাঝেমাঝে ভেবেছি,– বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনকারী সরোজ দেব যদি নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানোর উপমায় সাহিত্যচর্চায় বিশেষত লিটল ম্যাগাাজিন সম্পাদনায় ডুবে না যেতেন, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে সফল হতেন এবং সংসারজীবনেও আর পাঁজচন সংসারী লোকের মতো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারী হতেন। অনেকদিন ধরেই অর্থনীতিচালিত পৃথিবী– পণ্যশাসিত সংস্কৃতি। ফলে সরোজ দেব-দের কেউই ‘বুদ্ধিমান’ বলেনি, কোনোদিনও বলবে না। কিন্তু এধরনের ‘অ-বুদ্ধিমান ‘সরোজ দেব’-রাই যুদ্ধ-হানাহানি-ক্ষমতালিপ্সা-লুণ্ঠনের বিপরীতে পৃথিবীকে সুস্থতায় সুবজ রাখতে চেষ্টা করে এসেছে ছন্দে ও তালে, সুরে ও সুষমায়। এ-যুগে লেখকমাত্রই গরিব নয়। কিন্তু তারপরও আর্থিকভাবে অসচ্ছল লেখকদের সংখ্যই বেশি। সরোজ দেবরা অসচ্ছল দিন আর অসচ্ছল রাতের হাত দিয়ে পৃথিবীকে করে তোলে দোয়েল কোয়েল শ্যামার গানে মুখরিত জীববৈচিত্র্যময় সবুজের উঠোন আর লুটেরারা সেখানে বানায় বিবেকহীন ভোগবাদিতার বিলাসী বাগানবাড়ি।
আমি অনেকদিন আগে ‘অ-বুদ্ধিমান’ সরোজ দেবকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটির নাম ‘ লক্ষ্মীর রাজ্যে সরস্বতীর মালী’। কবিতাটির কথা সরোজদাকে কোনোদিন বলিনি। কেন বলিনি? কোনো অজানা দ্বিধা ছিল। অবশেষে ২০২৪ সালে প্রকাশিত আমার ‘পরদেশী মেঘ’ কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্ত সরোজদাকে গতবছরও তা জানাইনি আমি। সেই কবিতাটি আজ এখানে দিয়ে সরোজদার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
“চৈত্রশেষে বৈশাখী উৎসব; সে-উৎসবে ক্যালকুলেটর
হাতে মুক্তবাজার দিন, অর্থনীতির গন্ধ মেখে বিশ্বায়িত
রাত, আর চেকলিস্ট হাতে মিডিয়া প্রযোজিত হাওয়া।
আর পুরাতন মালীর বাগানে নদী-গাঁও-বিলবাসী পাখি,
বর্ষবরণে কোয়েলার গান, সাতসাইলী খঞ্জনার নাচ;
একতারায় সুর বেঁধে আসমানি বাউল পিঁউকাঁহা পাপিয়া;
গঞ্জিকার স্বাদ নিয়ে শাখা যমুনায় মুখ ঘঁষে স্থানীয় সাঁঝ;
সেই ফাঁকে দুয়েকটি বিউটিপার্লার পাখি পালক উদাম করে
ঠোঁটে নেয় রাজভৃত্যের ছিটিয়ে দেওয়া চাররঙা দানা।
ওসবের কোনোকিছু নয়, রাতদিন মালীর দুচোখে
উথলায় শুধু রোদের ছায়ার মতোন সুখ। আহা সুখ!
অথচ মালীর ঘরে শূন্য দিন, রিক্ত রাত, বঞ্চনার পিরানহা
ছিঁড়ে খায় অস্থি কাঠামো। অঙ্কপটু সাজুমুদি বলে:
দ্যাখো, দ্যাখো–নিজঘরে আগুন আর বোকা মালী
দুবেলা জল ঢালে পুরোনো ওই শ্যাওড়া গাছের গোড়ায়!”
[ লক্ষ্মীর রাজ্যে সরস্বতীর মালী’, পরদেশী মেঘ ]

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge