চলতি পথের গপ্পো ৯
সাব্বির হোসেন
জনাব মিজানকে সাথে নিয়ে আমার স্কুল পড়ুয়া এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। পথে মিজান বলল,
: আপনার বন্ধু কি সে কালের?
: সে কালের বলতে?
: না মানে, দেখে তো অনেক বয়স্ক আর ব্যাকডেটেড মনে হয়।
: (ভুরু কুঁচকে) না। কেন?
: না এমনি আর কি। কলেজ ব্যাচ যদি ২০০৫ এর হয় তাহলে তো জুনিয়ার হবে আমার থেকে।
: কোথাও দেখে ছিলেন তাকে? আচ্ছা, আমার বাবা সেই সময়ে মেট্রিকুলেশন পাশ করেছিল। আপনার মত হায়ার সেকেন্ডারি পড়েন নাই। তাহলে কি উনি আপনার থেকে জুনিয়র? আচ্ছা মেট্রিক / ইন্টার দিয়ে কি সিনিয়র- জুনিয়র মাপে?
: না মানে ইয়ে… আরে বুঝেন না এখন তো এরকমই বাহির হইছে।
: ও!!!!
বন্ধুর বাসায় এসে, খালা কে দেখে জনাব মিজানকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি,
খালা, ইনি হচ্ছেন জনাব মিজান। ইনি কিন্তু আপনার থেকেও মুরুব্বি। ইনি সম্মান পাশ করেছেন কোন এক সুনাম ধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
: না, না, ওহ্ একি বলছেন, ছিঃ ছিঃ
: কেন? ছিঃ ছিঃ কেন! খালা তো আপনার থেকেও জুনিয়ার। যদিও তিনি রত্নগর্ভা। চার সন্তান এর জননী। তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছেন। আর একজন স্কলারশিপ নিয়ে জাপানে কর্মরত।
: না মানে এভাবে বলার কি আছে?
: জানেন মিঃ মিজান, খালা কিন্তু পড়াশুনাই করেননি।
: ইয়ে মানে, মস্ত ভুল করে ফেলেছি। আমাকে মাফ করবে দয়া করে।
: জানেন মিজান সাহেব, আমরা এরকম হাজার হাজার ভুল প্রতিনিয়ত করে থাকি। এভাবে কত শত মানুষের মনে যে আমরা দাগ ফেলেছি তা আমরা নিজেরই জানি না। এগুলোকে মানবিক ভুল বলে চিহ্নিত করা যায়। একটা ঘটনা বলি শুনুন। ক’মাস আগে আমাকে এক ধনবান সুপরিচিত মুখ অনেক জোর করে তার গ্রামে নিয়ে গেল বিশেষ এক অনুষ্ঠানে। গিয়ে দেখলাম তিনি সেখানে একটি মাদ্রাসা উদ্বোধন করবেন। গ্রামটা আমার অনেক চেনা। তাই খবরদারি করতে কষ্ট হল না। খবর নিয়ে জানতে পারলাম গ্রামে দুটো মাদ্রাসা আগে থেকেই আছে আর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাত্র একটি। শুধু তাই নয়, বিদ্যালয়টি সংস্কারকাজ অত্যন্ত জরুরি। কোন রকম ছোট ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করছে। বর্ষায় পানি ঢোকে। ভাঙ্গা দেয়াল। পলেস্তারা খুলে পড়ছে প্রতিনিয়ত। সরকারি সাহায্য সহায়তা পায় কিন্তু তা খুব সামান্য। গতবার যে অর্থ সহায়তা পেয়েছিল তা দিয়ে বিদ্যালয়ে একটা টয়েলেট স্থাপন করেছে কর্তৃপক্ষ। যাই হোক ঘটনায় ফিরি। তো অনুষ্ঠান- খাওয়াদাওয়া চলছে। এক পর্যায় আমাকে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে বলা হল। আমি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বললাম, “আপনারা ভুল করছেন। আপনাদের গ্রামে মাদ্রাসা নয় এখন একটি স্কুল বেশ জরুরি। এ গ্রামের নারীরা অনেক পিছিয়ে। আমি আমার শ্রদ্ধেয় উপস্থিত প্রতিষ্ঠাতা বড় ভাইকে আন্তরিক অনুরোধ করব তিনি যেন এই নবনির্মিত বিল্ডিংটি একটি স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ঘোষণ
করেন।” কিচ্ছুক্ষণ পর গ্রামের মানুষেরা গুনগুনিয়ে কথা বলাবলি শুরু করল। অধিকাংশই আমার প্রতি ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত। বিশেষ করে বড় ভাই সাহেব। যিনি আমাকে আদর সোহাগ করে নিয়ে গেছেন সেখানে। আর দেরি না করে তড়িঘড়ি আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বললেন- “এ তুমি কি করলে! তোমাকে আমি ভালর জন্য আনলাম। আর তুমি কিনা এভাবে…..ছিঃ”
তখন পুরো চিত্রটা তার সামনে উপস্থাপন করলাম। উনি পুরো ব্যপারটা বুঝতে পেরে আমার প্রতি বেশ খুশি হলেন। কি কিছু বুঝলেন মিঃ মিজান?
: হ্যাঁ, আসলে আমরা এত সুক্ষভাবে চিন্তা করি না। আপনি বেশ প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। হয়তো ঐ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পেছনে কোন স্বার্থান্বেষী মহলের সম্পৃক্ততা আছে যারা ঐ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করণের মাধ্যমে অর্থকড়ি নয় ছয় করে হাতানোর মতলব এঁটেছিল। আবার এও হতে পারে যে, ধর্মান্ধ কিছু মানুষের উস্কানিতে ঐ ভদ্রলোক রাজি হয়েছিল। অথবা সেই গ্রামের মানুষ এখনও আদি আর সেকেলের মানুসিকতা নিয়ে পিছিয়ে আছে। হম। অনেক কিছুই হতে পারে।
: ভাবতে হবে। ভাবতে হবে মিঃ মিজান। জীবন, সমাজ, পরিবার, ছেলেমেয়ে সন্তান, দেশ সব কিছু নিয়ে ভাবতে হবে।