চলতি পথের গপ্পো ৭–সাব্বির হোসেন
গতকাল জাহেরা কাজে আসেনি। আজ আসলো। জাহেরার ডান চোখ ভয়ানক জখম। ভাল করে তাকালে অত্যাচার এর গভীরতা অনুভব যায়। জানতে চাইলাম এ অবস্থা কেমন করে হল। বলল, গতকাল তার স্বামী তাকে প্রচুর মেরেছে। কোন কারন ছাড়াই গায়ে হাত তোলে। আইনি সহায়তা নেয়ার কথা জানালাম। বলল, স্বামীকে পুলিশে নিয়া গেলে বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়া কই যাবে সে। তাই কিলচড় খেয়েই এতগুলো দিন যেভাবে কেটে আসছে বাকি জীবনটাও এভাবে কাটাবে। এই বলে, চা বানিয়ে আনতে গেল সে।
আমি পড়ার টেবিলে দৈনিক খবরের কাগজটা নিয়ে চোখ বুলোতে লাগলাম। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা, তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী অপহরণ। ঠিক তার নিচেই, ত্রাণের চাল নিতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার এক শিশু কন্যা। খবরেরকাগজটি মুড়িয়ে পাশে রেখে চোখ বন্ধ করে হেলান দিলাম চেয়ারে। মেয়ে দৌড়ে এসে কোলে বসে বলছে, বাবা টিভিটা অন করে দাও। কিচ্ছুক্ষণ কার্টুন দেখে আবার বাহিরে খেলতে গেল। ততোক্ষণে চা দিয়ে গেছে জাহেরা। চায়ে দু চুমুক দিয়ে সংবাদ দেখছি। শিরোনাম শুনে মন প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। সরকারের দেয়া ত্রাণের চাল আত্মসাৎ, হঠাৎ মৃত্যু তাই আতংকে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে থাকলো মৃত দেহ, মৃত্যুর আগে সাহায্য চেয়েও সন্তানরা কেউ এগিয়ে আসেনি, মাদক কারবারিতে বাধা দেওয়ায় যুবককে কুপিয়ে খুন, দোকানের ভেতর গলায় কাপড় পেঁচানো ও হাত-পা বাঁধা লাশ, করোনা আক্রান্ত ডাক্তারকে বের করে দিয়েছে এলাকাবাসী, এক অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার জ্বর সর্দিতে আক্রান্ত হওয়ায় করোনা সন্দেহে এলাকাবাসীর উগ্র আচরণ, ভাঙচুর! উহ, ভাবা যায়। মনে হচ্ছে আমি এক বিষাক্ত বলয়ের ভেতর আবদ্ধ। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বন্ধুবর আজম এসে হাজির। ওকে দেখে তাও মনে প্রাণ ফিরে এলো। সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল, কি খবর? একটু বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। পান্তা ইলিশ খেয়েছ তো?
খবরেরকাগজটা আজমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, চোখ বুলাও আসছি।
কিচ্ছুক্ষণ পরে আবার ঘরে এসে বসলাম। আমাকে দেখে আজম আশীষ বলে উঠল, আরিইইইইই যাহ্। অরগেন্ডি কাপড়ের সাদা পান্জাবী। রঙ্গিন কারুকাজ। বেশ লাগছে তোমাকে। তো এতক্ষণ পড়নি কেন?
: আরে মিঁয়া, তুমি বৈশাখের হাওয়া নিয়ে আসলে আর আমি তার শোভা বর্ধন না করে থাকি কেমন করে বল। আমি তো চৈত্রসংক্রান্তির গোঁ ধরে বসে ছিলাম সকাল থেকে। তোমার আসাতে আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। বুঝলে এতসব উদ্ভট আর ভয়ংকর খবর শুনে একটু ছিটকে পড়েছিলাম।
জাহেরা চা নাস্তা দিয়ে গেল। চানাচুর সাথে বাদাম বিস্কুট।
: শারমিনকে দেখছিনা। কোথায় সে?
: আছে। পেছনের বাগানে। কিছু সবজির চারা লাগিয়েছিল। সেগুলো মেয়েকে নিয়ে পরিচর্যা করছে হয়তো। ফ্রীজ থেকে ইলিশটা ভিজিয়ে দিতে বললাম জাহেরাকে। দুপুরে এক সাথেই খাবো। বোশেখ এর প্রথাটা ধরে রাখতে হবে। আমরা বাঙালদের ঐতিহ্য ভুলতে বসেছি। সমাজের কিছুসংখ্যক মানুষ সমালোচনা করতে পছন্দ করে কম বেশি। কিন্তু এর আনন্দ কারও চোখে পড়ে না। এই তো সেদিন বলল, আমরা নাকি একদিনের বাঙালি। আরও শুনলাম, জিজ্ঞেস করলে নাকি বাংলা তারিখ বলতে পারবো না। আচ্ছা তুমিই বল এ কেমন মানুসিকতার পরিচয়?
আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে দিল আজম।
কথা বলতে বলতে শারমিন এসে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। জাহেরা এসে কাপ পিরিচ তুলতে তুলতে বলল, ভাইজান আপনি ভাল আছেন?
আজম জাহেরাকে হাসিমুখে বলল, হ্যাঁ জাহেরা। আমি খুব ভাল আছি। জানো তো তোমাকে বলেছিলাম মনে হয়, জাহেরা আমার নানির নাম ছিল।
এই বলে জাহেরাকে তিনশত এক টাকা হাতে দিয়ে বলল- শুভ নববর্ষ জাহেরা।
ততোক্ষণে জাহেরার মনের দুঃখ বেদনা ভুলে গেছে। আমার মেয়ে আফরিন রঙিন শাড়ি পড়ে সেজেগুজে রেডি। ইতিমধ্যে জাহেরার দুসন্তানও এসে হাজির।
ঘন্টাখানেক বাদে টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হল। ইলিশের কোপতা, টাকি মাছের ভর্তা, সাদা ভাত, মরিচ পেঁয়াজ কুচো, মুশুর ডাল, লাল শাক ভাজি, করল্লা ভাজি। আমি, আজম, শারমিন, আমার কন্যা আফরিন আর জাহেরা ও তার দু সন্তান যগলু – ফজলু আজ এক সাথে দুপুরের বৈশাখী খাবার খাবো। শুভ হোক নববর্ষ। শুভ হোক পহেলা বৈশাখ।