গৌরবের এক নাম রংপুর জিলা স্কুল : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
রানা মাসুদ
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানান প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন রংপুরের একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা। তাঁদের কেউ কেউ পেশাগত জীবনের শীর্ষ অবস্থানে, কেউ কেউ স্বকীয়তার ভুবনে উজ্জ্বল দীপশিখা হয়ে দীপ্যমান, কেউ কেউ দেশ পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এবং আছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতেও থাকবেন।
এই স্বনামধন্য ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটা হচ্ছে রংপুর জিলা স্কুল। রংপুর শহরের প্রধান রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় কাচারি বাজার পেরিয়ে একটু পশ্চিমে সন্মুখে বিশাল সুন্দর মাঠ ছাড়িয়ে একটা বিশাল ক্যাম্পাস দাঁড়িয়ে আছে ওটাই জিলা স্কুল। আমরা দেখি, আমাদের সন্তানদের দেখাই কিন্তু অনেকেই বলতে পারি না এর ইতিহাস।
ইংরেজ শাসনামল। গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকাল। তখন বাংলার জেলায় জেলায় জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৮৩২ সালের কোন এক দিন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক রংপুর পরিদর্শনে আসেন। এর আগে কোন গভর্নর জেনারেলের রংপুর আগমন ঘটেনি। বড়লাট বাহাদুরের আগমন উপলক্ষে রংপুরে তখন চলছিল এলাহী কারবার। সর্বত্র চলছিল সাজ সাজ রব। এক মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন তৎকালীন রংপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর মিঃ ন্যাথানিয়েল স্মিথ।তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য রংপুরের বিদ্বোৎসাহী জমিদারগণকে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করেন। রংপুরের প্রজাহিতৌষী, মানব দরদী ও শিক্ষানুরাগী জমিদারগণ খুব দ্রুত অনুদান সংগ্রহ করে স্থাপন করেন ‘ রঙ্গপুর জমিদারদিগের স্কুল ‘। গঠন করা হয় একটি পরিচালনা কমিটি। কুণ্ডীর বিদ্বোৎসাহী জমিদার রাজমোহন রায়চৌধুরী এই স্কুল পরিচালনা কমিটির প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৮৪৭ সালে তাঁর পরলোকগমনের পর সেক্রেটারি পদে আসেন তাঁরই ভাই কুণ্ডীর অন্যতম জমিদার কাশীচন্দ্র রায়চৌধুরী । এরপর তাঁর কনিষ্ঠ ভাই বাংলাসাহিত্যের উজ্জ্বল রত্ন কালীচন্দ্র রায়চৌধুরী স্কুল কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পরলোকগমনের পর ১৮৮০ সালে তুষভাণ্ডারের সুপ্রসিদ্ধ জমিদার রায়বাহাদুর রমণীমোহন রায়চৌধুরী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। সকলেই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। জমিদার রমণীমোহন স্কুলে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর আন্দোলন করেন।
রংপুর জিলা স্কুলের বর্তমান ক্যাম্পাসের উত্তর-পূর্ব কোনায় পূর্বে একটা কুঁড়েঘর ছিল। ১৮৩২ সালে এই কুঁড়েঘরে সৃষ্টি হয় এই অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে এক অনন্য ইতিহাস। বড়লাট বাহাদুর গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তাঁর ঐতিহাসিক সফরে এসে এখানে উদ্বোধন করেন রংপুরের জমিদারদের উদ্যোগে গঠিত ‘ রঙ্গপুর জমিদারদিগের স্কুল ‘। শুরু হয় এক আলোর দ্বীপের পথচলা। ১৮৩২ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ‘রঙ্গপুর জমিদারদিগের স্কুল’ হিসেবে পরিচিত ছিল। জিলা স্কুল প্রকৃত অর্থে শুরু হয় ১৮৬২ সাল থেকে। এই স্কুলটি ইংরেজ সরকার ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর কয়েক বছর পর্যন্ত ‘রঙ্গপুর জমিদারদিগের স্কুল’ -এর শিক্ষার্থীগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে অসমর্থ হয়। অপর এক সূত্রমতে সম্ভবত সে বছর সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহের ডামাডোলে স্কুল থেকে কোন ছাত্র এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেনি।১৮৫৭ সালে স্কুলটি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমোদন লাভ করে।১৮৬২ সালে ইংরেজ সরকার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অধিগ্রহণ করে রংপুর জিলা স্কুল নামকরণ করেন। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত এর শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। ১৮৬২ সালে একজন ইউরোপিয়ান ছিলেন প্রধান শিক্ষক। সম্ভবত তাঁর নাম ছিল ডেভিড হেয়ার। ১৮৮৩ সাল থেকে স্কুলটি প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা লাভ করে। ১৯১৫ সালে মূল ভবনের সাথে আরো চারটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়।
রংপুর জিলা স্কুলের প্রারম্ভিক অবস্থাটা ছিল অত্যন্ত কন্টর্কিত, ছিল দুর্যোগপূর্ণ। হঠাৎ করে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্কুলগৃহ পুরোপুরি ভস্মীভূত হয় ১৮৭৫ সালের একদিন। ভীষণ সমস্যা তৈরি হয়। কার্যক্রম চালু রাখতে স্কুল স্থানান্তরের প্রয়োজন খুব জরুরি হয়ে ওঠে। শুরু হয় এক অনিশ্চিত যাত্রা। প্রথম পর্যায়ে কেরানীপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়ির বাইরের ঘরে শিক্ষকগণ ছাত্রদের পাঠদান করতে থাকেন। এরপর কোচবিহার মহারাজার একটি দ্বিতল ভবনে স্কুলটি স্থানান্তরিত করা হয় ( সেই ভবনটার ছবি কারো কাছে থাকলে দিলে খুশি হবো)।সেখান থেকে রংপুর জেলা বোর্ডের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ব্যবসায়ী মিঃ রেইনীর রেশম গুদামে কিছুদিন পরিচালনা করা হয়। এরপর বর্তমান রংপুর চিড়িয়াখানার ওখানে তখন অবস্থিত একটা বড় আটচালা বাড়িতে স্কুলটি স্থানান্তরিত করা হয়। এখানে পাঁচ বছর ছিল। এতো সমস্যার পরেও রংপুর জিলা স্কুলের শিক্ষার মান উন্নত হওয়ায় তৎকালীন শিক্ষা প্রশাসন এটিকে একটি সেকেন্ড গ্রেড কলেজে পরিণত করে। তখনকার সমগ্র রংপুর জেলায় কলেজ স্থাপনের একটি প্রথম প্রচেষ্টা। সে সময় রংপুর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু চন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য অধ্যক্ষের দায়িত্ব লাভ করেন। কলেজটি চার বছর পর্যন্ত চালু ছিল। ১৮৮০ সালে কলেজ সেকশন বন্ধ হয়ে পূর্বের অবস্থা অর্থাৎ স্কুল পর্যায়ে ফিরে যায়। অবিভক্ত বাংলার তখনকার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার অ্যাশলী ইডেন ১৮৮৩ সালে বর্তমান জিলা স্কুল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেই বছর রংপুর জিলা স্কুল বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়। এরপর শুধু এগিয়ে যাওয়া। ধাপে ধাপে উন্নতির পথে এগুতে থাকে স্কুলটি। ১৯০৪ সাল থেকে চালু হয় বিজ্ঞান বিভাগ। হিন্দু ও রাজবংশীয় ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ১৯১১ সালে নির্মিত হয় ছাত্রাবাস। ১৯১৯ সালে নির্মিত হয় মুসলিম ছাত্রাবাস।
অনিন্দ্য সুন্দর সাজানো গোছানো বিশাল ক্যাম্পাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রংপুর জিলা স্কুল। মন্থনার জমিদার যোগীন্দ্রনারায়ন রায় চৌধুরীর দানকৃত ৯ দশমিক ২৭ একর জমির উপর স্কুল। স্কুলের অতি সম্প্রতি নির্মিত মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই মনটা অসম্ভব ভালোলাগায় উদ্ভাসিত হয়। দুই পাশে গাছ ছাওয়া সুন্দর রাস্তার দুই ধারে দুটি সবুজ ঘাসের গালিচা মোড়ানো বিশাল আয়তনের খেলার মাঠ। চমৎকার মোগল ঘরানার আর্চওয়ে টাইপের নকশার প্রথম ভবন। চমৎকার একটি সাজানো বাগান। পাশে একটা বড় বট গাছ কাব্যিক দ্যোতনা ছড়িয়ে আছে। একটি জিমনেশিয়াম, একটি প্রশস্ত কমন রুম এবং আছে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। জিলা স্কুলের এই মাঠেই একসময় বিভাগীয় কাপ ছাড়াও প্রতি বছর হার্ডিঞ্জ শিল্ড এবং তাজহাট শিল্ডের ফুটবল খেলা হতো। রংপুর জিলা স্কুলের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলাতে যেমন তেমনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।
রংপুর জিলা স্কুল শুধু রংপুর নয় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন স্কুল। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন কার্যক্রমে রয়েছে এখানকার শিক্ষার্থীদের বিশাল সাফল্য ।জাতি গঠনে রয়েছে এর বিশাল অবদান। শুরু রংপুর নয় উত্তরবঙ্গের জন্য গৌরবের এক নাম রংপুর জিলা স্কুল।এই স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি কিন্তু একজন রংপুরবাসী হিসেবে এই স্কুলের জন্য আমি এক আকাশ সমান গর্ব বোধ করি ।
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা: শ্রদ্ধেয় মোতাহার হোসেন সুফী রচিত রঙ্গপুরের ইতিহাস, মোস্তফা তোফায়েল হোসেন রচিত বৃহত্তর রংপুরের ইতিহাস, মিঃ জ্ঞানেন্দ্রনাথ গুপ্ত রচিত নিবন্ধ এবং স্কুলে প্রধান শিক্ষকের রুমের দেয়ালে পাথরে খোদাই করা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।