ঘুম ভেঙ্গে দেখি রাত ৩টা বাজে।
স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গল। এরপর সারারাত আর ঘুম হল না। শুয়ে, বসে, হেঁটে, বই পড়ে কিছুতেই কাজ হল না। আমি এক কাপ চা বানিয়ে ডায়েরি লিখতে বসলাম। শুরু করলাম স্বপ্নের দৃশ্য দিয়ে।নভেম্বর ২, ২০২৩। শ্রীমঙ্গল, সিলেট।
আমি সবুজ শিশিরে ভেজা লনে ঘুমিয়ে ছিলাম। একটা মৌমাছি এসে আমার কানের কাছে বসল। তাকিয়ে দেখি চারদিক বিভিন্ন ফুলের চারাছেয়ে রয়েছে। সেগুলো দ্রুত বড় গাছ হয়ে গেল। তারপর আরো বড় হতে থাকল এবং জায়গাটা গভীর অন্ধকার জঙ্গলে পরিণত হল। আওয়াজ পেলাম বিভিন্ন পাখি আর বনের পশুদের। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সেসময় গাছের আড়াল থেকে একজন অপূর্ব সুন্দরী পরী আমারপাশে এসে শুলো। ধবধবে সাদা পোষাক পরা পরী আমাকে বলল,‘অনীল আমি তোমাকে নিতে এসেছি। তুমি যাবে আমাদের দেশে?’২
খুবই সাধারণ, শিশুদের রূপকথার গল্পের মত স্বপ্ন কিন্তু আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। আমি কুসংস্কারগ্রস্ত লোক নই।বিস্ময় বোধ বা আবেগ বয়সের সাথে সাথে ফিকে হয়ে গেছে। বায়ান্ন বছরের অভিজ্ঞ মন সহজে বিচলিত হয় না। সবচেয়ে বড় কথা চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কিছু হয়নি। তবুও মনটা অস্থির হয়ে থাকল। স্বপ্নে যেই দৃশ্যগুলো দেখেছি তার সাথে অনুভূতির পার্থক্য অনেক। যুক্তি দিয়ে এর বিশ্লেষণ সম্ভব না।আমি দীর্ঘ দশ বছর বাংলাদেশের নামকরা একটা ব্যাটারি ফ্যাক্টরিতে কেমিস্ট হিসেবে কাজ করেছি। আমার কাজ ছিল ব্যাটারি তৈরির প্রযুক্তিগতপ্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে মান নিশ্চিত করা। খুব বেশি কিছু করতে হত না, তাছাড়া কাজের ওপর আমার ভালোদখল ছিল। ছোটবেলায় লেখাপড়ায় ভালো থাকায় বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলাম। ক্যামিকাল ইঞ্জিনিয়ার। সেই শিক্ষা দিয়েই ক্যারিয়ার গড়ি। তখন জানতাম না যে আসলে আমি কাজ করছি অত্যন্ত বাজে একটা পরিবেশের পক্ষ হয়ে। ব্যাটারি তৈরির অন্যতম উপাদান কার্বন। ধনী রাষ্ট্রগুলো সাধারণতব্যাটারি ফ্যাক্টরিগুলো বসায় তৃতীয় বিশ্বের দেশে।ব্যাটারি তৈরি প্রক্রিয়া পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে যামানুষের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। চর্মরোগ, চোখের অসুখ, হার্টের ব্লক থেকে শুরু করে লাং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়। উন্নত বিশ্ব চায় না তাদের দেশের লোকদের এই রোগগুলো হোক। একই কারণে সিমেন্ট, তামাক ও লেদারের ফ্যাক্টরিও তৃতীয় বিশ্বে বেশি। এছাড়া দরিদ্র দেশে শ্রমের দামও কম।পুঁজিবাদের এই সাইকেল সাংঘাতিক ধূর্ত ও অমানবিক। যাই হোক পঞ্চাশ না পার হতেই স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে সরে আসি ব্যাটারি কারখানা থেকে। ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে সামনের বছর পাঁচেক অনায়াসে চলে যাবে। আমি একা মানুষ আর সাধারণ মধ্যবিত্তের তুলনায় আমার লোভ ওউচ্চাকাঙ্খা কম।
স্বপ্নের মত হাস্যকর ব্যাপার আমাকে বিচলিত করছে! কেন করছে? আমার হজমশক্তি ভালো, ঘুম হয় ভালো, কোনো নেশায় আমি আসক্ত না, মানসিক ভারসাম্য আছে, ব্লাড প্রেশার নরমাল-তবুও প্রায়ই স্বপ্ন দেখে ভয় পাচ্ছি। আগে স্বপ্নে দুঃস্বপ্নের অনুভূতি হলে, স্বপ্ন ভাঙ্গলে স্বস্তি লাগত। মনে হত বিষয়টা সত্যি না, স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এখন বিষয়গুলো অন্যভাবে প্রভাবিত করছে। স্বপ্নের মত একটা ঠুনকো বিষয়ের জন্য কেন ঘুম হবে না? সহজ স্বাভাবিক স্বপ্ন অথচ এর অনুভূতি কেন এত ভয়ংকর ও তীক্ষ্ণ হবে? আমার কি কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করা দরকার?
এই পর্যন্ত লিখে আমি একটা সিগারেট ধরালাম। এখন রাত ৪টাবাজে। টরোন্টতে নায়েলাকে কল দেয়ার জন্য ভালো সময়। সেখানে এখন বিকাল হবে। আমার একমাত্র মেয়ে নায়েলা কানাডায় নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছে হিউম্যান সাইকোলজি বিষয়ে। আমার স্ত্রী দশ বছর আগে গত হয়েছে বহুদিন ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে। সে কথা এখন থাক।
-কেমন আছিস আম্মু?
-এই তো বাবা, ভালো আছি। এত রাতে? তুমি ঘুমাও না?
-ঘুম ভেঙ্গে গেল। তুই কি করছিস?
-ক্লাস শেষ হল। কফি খেতে এসেছি। লাইব্রেরি থেকে কয়েকটা বই নিয়ে ডর্মে ফিরব। বরফ পড়ছে খুব।
-খুব বেশি ঠাণ্ডা?
-হু। মাইনাস ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আরো ঠাণ্ডা পড়বে রাতে। নভেম্বর মাসে এখানে এই টেম্পারেচারই নরমাল।
-আচ্ছা।
-বাবা, কি ব্যাপার বলো তো? তোমার কি কোনো প্রবলেম হচ্ছে?
-নাহ। সেরকম কিছু না।
-কি হয়েছে ক্লিয়ারলি বলো তো।
-তুই ডর্মেটরিতে ফের, আমি তোর টাইম রাতে কল দিব নে।
-রাতে না, তুমি এখনই বলো।
আমি নায়েলাকে আজকের স্বপ্নের দৃশ্য ও অনভূতিগুলো বললাম। এরকম যে মাঝে মধ্যেই হচ্ছে সেটাও নিজের মত ব্যাখ্যা করলাম। সে মন দিয়ে শুনল। নায়েলার এই দিকটা খুব ভালো। সে খুব মন দিয়ে কথা শুনে। মাঝাখানে ইন্টারাপ্ট করে না। আমার কথাশেষে সে কথা শুরু করল। কিছুক্ষণ স্বপ্ন নিয়ে কিছু প্রচলিততথ্যগুলোজানাল- স্বপ্ন মাত্র কয়েক সেকন্ডের হয়, স্বপ্নে কোনো রং ও গন্ধ থাকে না, স্বপ্নের সবকিছু মানুষের অভিজ্ঞতারভেতরে… তারপর সে কন্যার দৃষ্টিকোণ থেকে আমাকে গাইড করার চেষ্টা করল।
-বাবা তুমি একজন নার্স বা একজন লোক রাখো বাসায়। আইসোলেশন আসলে একটা বয়স পরে খুব ইনফ্লুয়েন্স করে।
-আম্মু তুই তো জানিস আমি লেখালেখি নিয়ে থাকি, তাই নিঃসঙ্গ টাইমটা এনজয় করি। তাছাড়া একটা মেয়ে সকালে এসে রান্নাবান্না করে, ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। আইসোলেশনটা আমার ভালো থাকার জন্যই জরুরি।
-হু বুঝতে পারি… কিন্তু বয়সটা তো একটা ব্যাপার। তোমার যদি হঠাৎ কোনো প্রবলেম হয় তখন আমি কি করব বলো?
-এত বুড়া আমি এখনো হয়নি রে। বয়স যদি সত্তর হত তাহলে একজন নার্স হলেও রেখে দিতাম। তোর মা মারা যাওয়ার পর…
-মায়ের কথা এখন থাক। মন খারাপ হয়ে যায় বাবা।
-হু থাক।
-বাবা আমার এক বন্ধু আছে সাইক্রেটিস্ট। ওর সাথে আমি কন্টাক্ট করে তোমাকে একজন এক্সপেরিয়েন্সড সাইকোলজিস্টের নাম্বারজোগাড় দেই। তুমি তার সাথে দেখা করে তোমার মনের কথাগুলো বলবে। এটা আমার রিকোয়েস্ট।
-তোর রিকোয়েস্ট হলে তো রাখতেই হবে। দিস। নাম্বার দিস। আমি দেখা করব। তাড়াহুড়ার কিছু নেই।
-ঠিক আছে। বাবা আমি বের হলাম। লাইব্রেরি হয়ে রুমে ফিরতে হবে। আমি পরে কল দিব। তুমি একটু রেস্ট নাও।
-সারাদিন তো রেস্টেই থাকি। যাই হোক, যা তুই। পরে কথা হবে। খোদা হাফেজ।
-খোদা হাফেজ বাবা।৩
স্বপ্নের মত এরকম তুচ্ছ বিষয় নিয়ে লিখছি কেন? গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে আমার সম্পর্ক কম বলে? আমার দেশে কত মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যায়, কত মানুষ সন্তান হারানোর বেদনা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কত মানুষ টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারে না, কত মেয়েকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়- এইরকম হাজারো সমস্যা আমরা রাস্তাঘাটে দেখি, খবরের কাগজে পড়ি। সেখানে আমি কি স্বপ্ন দেখলাম, ঘুমাতে পারলাম কিনা-এসব নিয়ে ভাবার কোনো মানে আছে! হয়ত আছে কারণ আমার আত্মার ভেতরই তো আমি লুকিয়ে আছি। নিজের আত্মার কাছে সকল প্রাণীই আত্মকেন্দ্রিক। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভেঙ্গে দেখি বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। নভেম্বর মাসের ভর দুপুরের আকাশ ধূসর করে মেঘ গর্জে উঠছে। জানলা দিয়ে বৃষ্টির পানির ঝাপটা আসছে। আমি বিছানা থেকে উঠে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আকাশে মেঘের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম স্বপ্নের সেই পরীটাকে! সে আমাকে বলল, ‘অনীল আমি তোমাকে নিতে এসেছি। তুমি যাবে আমাদের দেশে?’