ফেব্রুয়ারি প্রায় শেষের পথে। জয়পুরহাট সিভিল সার্জন অফিসে পোস্টিং হবার প্রায় দুমাস হয়ে গেল। ছোট্ট একটি জেলাশহর, ইন্ডিয়ার কাছে। হাটবাজার, দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট যেমন কম, তেমনি জনবসতিও পাতলা। আমি নিভৃতচারী মানুষ, জমকালো ইটপাথরের ব্যস্ত শহর আমার জন্য নয়। প্রশাসনিকভাবে এটা জেলাশহর হলেও জায়গাটাকে ঠিক শহর বলে মনে হয় না। শহরের সব সুযোগ-সুবিধা বেষ্টিত এক শান্ত, সুখী গ্রাম বললে ভালো মানায়!
প্রথম যখন পোস্টিং অর্ডার পেলাম দেশের এক প্রান্তে পড়ে থাকতে হবে ভেবে মনটা খারাপ হয়েছিলো। কিন্তু জয়পুরহাটে পা দিয়েই এখানে পোস্টিং পাবার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো। অফিস থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে একটা চারতলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের দুই রুমের একটি ইউনিট ভাড়া নিয়েছি। একা থাকি। সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিস যাই, বিকেলে ফিরি। আগে বিকেল কাটতো চেম্বারে, রোগী দেখে। জয়পুরহাটে এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যতদিন পোস্টিং থাকবে বিকেলে চেম্বার করবো না। নিজেকে সময় দেবো। নয়টা পাঁচটা অফিস করার পরে এখন আমার অনেক অবসর।
এরকম অখণ্ড অবসরে এর আগে কখনো থাকিনি। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে চোখ বুঝে একটু বিশ্রাম নেই, কোনো কোনোদিন একটু ঘুমও চলে আসে। এরপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে সন্ধ্যার কিছু আগে হাঁটতে বেরোই। আধাঘণ্টা হাঁটার পরে যখন বেলা পড়ে আসে ডিসি লেকের ঘাটে গিয়ে বসি। অন্ধকার পুরোপুরি না নামা পর্যন্ত পানির কাছে থাকি। এই জায়গাটা আমাকে নেশার মতো টানে! বেশিরভাগ সময় চুপ করে বসে থাকি, নিজেকে ভাবি। কখনো মোবাইল নোটে একটা দুটো একান্ত ভাবনা লিখি, কখনো গান শুনি। এরপর হেঁটে হেঁটে অপরাজিতা আপার চেম্বারে যাই। ডা. অপরাজিতা আমার অফিস কলিগ, এখানে এসে পরিচয়। খুব অল্প সময়ে খুব অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে উঠেছি আমরা। ওনার রোগী দেখা শেষ হলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে রাতের খাবার খাই, কখনো ঘন্টাচুক্তি রিকশা ভাড়া করে রাতের হাওয়া খেয়ে বেড়াই। এরপর যে যার বাসায়। বাসায় ফিরে কোনো একটা বই পড়তে পড়তে বা একটা কিছু লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে দীর্ঘ একটা ঘুম দিয়ে পরদিন সকাল। মোটামুটি এই আমার নিত্যকার ধীরগতির জীবন!সেদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি। সরকারি ছুটি। মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে একটা ক্রিকেট ম্যাচ দেখায় অনেক দেরীতে ঘুম ভাঙলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। প্রায় দুমাস বাড়ি যাইনি। মাকে কথা দিয়েছিলাম সকাল ১১টার ট্রেনে বাড়ি যাবো। উইকএন্ডসহ টানা তিনদিন ছুটি পাওয়া গেছে। দুদিন থেকে আসবো। সেটা আর হলো না। দুপুরের খাবার খেয়ে ডিসি লেকের ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এই একটা জায়গায় গেলে আমার মন যত খারাপই থাকুক শান্ত হয়ে যায়! বাসা থেকে বের হতেই মনটা আরো বিষাদে ছেয়ে গেলো। শীতের রোদহীন দুপুর। রাস্তাঘাটে তেমন মানুষ নেই। চারপাশ এমন থমথমে নীরব আর গুমোট যে কিছুক্ষণ হাঁটার পর মনে হলো ঘর ফিরে যাই। কিন্তু ঘরে শুয়ে শুয়ে ছাদ দেখার থেকে ঘাটের পানিতে পাতা পড়া দেখাও ভালো! ঘরে ফেরার ভাবনা মাথা থেকে বিদায় করে দিয়ে দ্রুত হাঁটা ধরলাম। পৌঁছে দেখি দুনম্বর সিঁড়ির ধাপে একজন বসে আছে। এই সিঁড়িটাতেই আমি বসি। মনে মনে খুব বিরক্ত হলাম। এইরকম ভরদুপুরে ব্যাপারটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এখানে সাধারণত কেউ বসতে আসে না। অন্তত আমি যে কয়দিন এসেছি কাউকে আসতে দেখিনি। দীর্ঘদিন এখানে নিয়মিত আসাতে ঘাটটার প্রতি আমার একটা অধিকারবোধ জন্ম নিয়েছে। লোকটাকে মনে হচ্ছে অনাহুত। একরকম রাগে গজগজ করতে দু নম্বর সিঁড়ির অন্যপাশটায় গিয়ে বেশ শব্দ করে বসলাম। শব্দ শুনে লোকটা আমার দিকে তাকালো। চোখে শুন্যদৃষ্টি। আমাকে দেখে বিরক্ত হয়েছে নাকি স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে চাহনি থেকে সেটা বুঝতে পারলাম না। এরপর চোখ নামিয়ে হাতে ধরে রাখা ডায়েরীর মধ্যে কি একটা লেখায় মনোযোগ দিলো! আমিও লেকের পানির দিকে দৃষ্টি রাখলাম। আমার পাশে যে কেউ বসে আছে ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই পারছি না। বিরক্তি বেড়েই চলছে। আড়চোখে একবার লোকটার দিকে তাকালাম। গৌড়বর্ণ, মুখভর্তি যত্ন করে কাটা চাপদাড়ি, মাথার চুল সামনের দিকে কিছুটা পাতলা। যদিও বসে আছে বোঝা যাচ্ছে বেশ লম্বাই হবে। আকাশি রংয়ের একটা সোয়েটার পড়ে আছে, হাতঘড়ি, প্যান্ট আর জুতা কালো। অবিকল একজোড়া জুতা গত ডিসেম্বরে আমার ছোটভাইকে কিনে দিয়েছি তাই অনুমান করছি জুতাজোড়া বাটা থেকে কেনা! বয়স ত্রিশ হতে পারে, পঁয়ত্রিশও হতে পারে। আড়চোখে সাইড থেকে তাকিয়ে দাঁড়ি ভেদ করে সেটা ঠাওর করা সম্ভব নয়। পেশা কী হবে কে জানে! লোকটার দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবছি হঠাৎ সে ডায়েরী থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। সেও মনে হয় লজ্জা পেয়েছে। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। আগের থেকে দ্রুত লিখবার চেষ্টা করছে। একটা অস্বস্থিতে পড়ে গেলাম। বসে থাকতেও কেমন লাগছে, উঠে যে চলে যাবো সেটাও সমীচীন মনে হচ্ছে না। একটু পর সে বাঁচিয়ে দিলো এমন পরিস্থিতি থেকে। লেখা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো, ধীরগতিতে হাঁটা ধরলো অফিসার্স কোয়ার্টারের দিকে। বুঝলাম আমার মতো তারও হয়তো চাকরীসূত্রে এখানে থাকা! সে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকলাম পথের দিকে। আর কিছুক্ষণ বসে থেকে আমিও বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আজ আর বাইরে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
পরদিন শুক্রবার, শনিবার অফিস বন্ধ। দুদিনই একই সময়ে ডিসি লেকে গিয়েছি। দুদিনই লোকটা আমার আগে ঘাটে এসেছে, একই জায়গায় বসে লিখেছে। এই দুইদিন আর আমার দিকে একবারও তাকায়নি সে। আমিও আমার মতো বসে বসে লেকের পানিতে পাতা পড়া দেখেছি, পানপোকাদের চলাচল দেখেছি, গান শুনেছি। যদিও লোকটার সাথে একটা কথাও হয়নি তবুও এই আরেকজন রক্তমাংসের মানুষ একইভাবে নীরবতা ভাগাভাগি করে উপভোগ করছে ভেবে ভালো লাগছে। সন্ধ্যা নামলেই সে চলে যায়। এরপর আমারও আর ঘাটে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমিও ঘরে ফিরি।
রবিবার অফিস করে বাসায় ফিরতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলো। ড্রেস বদলিয়ে ফ্রেশ হয়ে কোনো মতে একটা কলা আর ছোট একটা পাউরুটির অর্ধেক পেটে চালান করে দ্রুত লেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। এসময় লোকটা আর ঘাটে থাকে না। আজ নিশ্চয়ই আর দেখা হবে না ভাবতেই মন খারাপ হয়ে এলো। ঘাটে কাছে যখন পৌঁছালাম আকাশে তখন চাঁদ উঠেছে। লোকটা বসে আছে এখনও। আমি ধীরপায়ে দুনম্বর সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। জোরে জোরে শব্দ করে জীবনানন্দের কবিতা পড়ছে সে। চাঁদের আলো লেকের পানিতে ঠিকরে পড়ে পানিকে আয়না বানিয়ে ফেলেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে অবিকল আরেকটি চাঁদ। মৃদুমন্দ বাতাসে লেকের পানি হালকা দুলছে, সেই পানিতে নেচে চলেছে গাছেদের ছায়া এবং চাঁদের প্রতিবিম্ব। এমন আদিম, অকৃত্রিম জোৎস্নার আলোতে লোকটাকে মনে হচ্ছে রূপকথা থেকে উঠে আসা কোনো আদিম পুরুষ। মোহগ্রস্তের মতো সন্তপর্নে তার দিকে এগোলাম। দুনম্বর ধাপটায় তার কাছাকাছি বসলাম। সে পড়ছে:
“চাঁদ জেগে আছে আজও অপলক,- মেঘের পালকে ঢালিছে আলো! সে যে জানে কত পাথারের কথা,- কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি! কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জ্যোৎস্না, শুক্লাতিথি!”
আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে যেন এই লোকটা, লেকটা, আমি আর কবিতাটা ছাড়া আর কিছু নেই। কবিতাটা শেষ হলে লোকটা বলে উঠলো- “আজকে দেরীতে এলেন যে!” কিছুটা সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম -“আজকে অফিস ছিলো।”
সে বললো -“আচ্ছা”। তারপর আবার খানিক নীরবতা। একটু পর সে বেশ ধরা গলায় বললো- “আমি পেশায় একজন ডাক্তার, বিয়ে থা করিনি। সুযোগ পেলেই নতুন জায়গায় ঘুরতে যাই। এইদিকে কখনো আসা হয়নি। তাই তিনদিনের লম্বা ছুটির সাথে দুদিন অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে আমার এক বন্ধুর কোয়ার্টারে এসে উঠেছি। এখানে এসে এই ঘাটের মায়ায় পড়ে গেছি বলে বিশেষ কোথাও যাওয়া হয়নি। পরশু জয়পুরহাট থেকে চলে যাবো।”
হঠাৎ চলে যাওয়ার কথা শুনে বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসতে চাইলো। মনে হলো লোকটাকে বলি থেকে গেলে হয়না? গলা দিয়ে কথা বেরোতে চাইলো না, খুব কষ্টে বললাম- “আচ্ছা।”অনেকক্ষণ আবার কোনো কথা নেই। সময় গড়াচ্ছে। যেন কারোরই ওঠার তাড়া নেই। কোনো এক নাম না জানা রাতের পাখির উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে সম্বিত ফিরে পেলাম। মোবাইলের সময় দেখে নিলাম। রাত ১০.৪০। বাড়ি ফিরতে হবে। লেকের পানিতে চাঁদটাকে একবার দেখে নিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললাম- “যাই”। সে আমার দিকে তাকালো। জোৎস্নার আলোতে স্পষ্ট পড়তে পারছি তার চোখের ভাষা। আমি আমার ডান হাতটা সিঁড়ির উপর রাখলাম। সে দুহাত দিয়ে আমার হাতটাকে মুঠোয় পুরে নিলো। আবার কোনো কথা নেই। নীরবতার মধ্যেই যেন সব বলা হয়ে গেলো! আমার চেতনা অবশ হয়ে আসছে। এই মানুষটাকে আমি ভালোবাসি। এখন আমার মরনেও সুখ!
বাহুতে বড় ভাবির কনুইয়ের গুতা খেয়ে ভাবনা ছুটে গেলো। দুবছর আগে ঘাটপাড়ে দেখা হওয়া মানুষটির সাথে আজ আমার বিয়ে। সে আমার পাশে বসে আছে। আমাদের মুখে আজও কোনো কথা নেই। যেন আমরা লেকের পাড়ে ঘাটের দুনম্বর সিঁড়িতে বসে আছি।