সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৩৬ অপরাহ্ন

গল্প: অপূর্ণতা-মাজহারুল মোর্শেদ

গল্প: অপূর্ণতা-মাজহারুল মোর্শেদ

শেষ প্রহরের পাখিগুলো একে একে ফিরে যাচ্ছে অন্ধকার গুহা ছেড়ে, হয়তো কিছু সময় পড়ে তাদের আনন্দমুখর কলকাকুলিতে ভরিয়ে দেবে পৃথিবীর বুক। ভুরভুর ছন্দময় ভোরের আলোয় পাঁপড়ি মেলে হাসবে হাসনাহেনা, জুঁইচামেলি। পাশের বাঁশ বাগানে বউ কথা কও, বউ কথা কও বলে সমান তালে ডেকে যাচ্ছে একটি পাখি, সুখের বিরক্তিতে ভরিয়ে তুলছে চারিপাশ। বাড়ির আঙিনায় বকুল গাছটায় তারস্বরে ডাকছে একটি বুড়ো কাক। রাতে ভালো ঘুম না হওয়ায় চোখের পাতাগুলো সীসার মতো ভারী হয়ে আছে কিছুতেই খুলতে চাচ্ছেনা। তাই শোয়ার বালিশটা কানের উপর চাপ দিয়ে আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার চেষ্টা করল ধ্রুব। হঠাৎ কতোগুলো মানুষের কোলাহল তার কানে আসে। বালিশ থেকে মাথাটা উঁচু করে শব্দের দিক নির্ণয়ের চেষ্টা করে, এমন সময় ছোট বোন নিশা দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে-

ভাইয়া? এই ভাইয়া? নদীতে নাকি একটা লাস ভেসে আসছে। কেউ চিনতে পারছে না তুই একটু যেয়ে দেখনা, চিনতে পারিস কি না?

বর্ষার নদী, ভরা যৌবনে উথাল পাথাল ঢেউ নিমিশেই সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নিষ্পাপ লাসটাকে ঘিরে আছে অনেক মানুষ। ভিড় ঠেলে ধ্রুব লাসটির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করল, এরই মধ্যে একজন বলে উঠল, কোন এক আত্মীয়ের বিয়ে বাড়িতে তাকে দেখেছে। দু’চারজন মানুষকে সরিয়ে দিয়ে ধ্রুব লাসটির একেবারে কাছে গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে, তার চিৎকারের শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়, মেঘেরা সড়ে যায়, গোটা আসমান বিশ্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যায় তার গগন বিদারি আর্তনাদে। তার দু”চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে, মাথার উপর আসমান ভেঙে পড়ে, সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যায়, চোখের কোণ থেকে গরম অশ্রæ গড়িয়ে পড়ে। সে স্পষ্ট শুনতে পায়, নীলা ফিসফিস করে বলছে- ধ্রুব, তুমি মন খারাপ করোনা এ জগতে না হয় নাইবা হলো আমাদের দেখা, এসো এখন আর কেউ বাধা দেবে না তোমায়।

মেঘের আড়ালে শেষ রাতের চাঁদ যেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়, অস্তিত্বকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টাও যখন ব্যর্থ হয়ে দিনের আলোর কাছে আত্মসমর্পণ করে, ঠিক তেমনি একখানা চাঁদমুখ পৃথিবীর সকল দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্চনা-বঞ্চনা, হতাশা-গ্লানির মাঝে সংগ্রামী চেতনায় পরাজিত লাস হয়ে পড়ে আছে।

ধ্রুবকে একদিন জড়িয়ে ধরে, বুকে মাথা রেখে নীলা অনেক্ষণ কেঁদেছিল নীলা। নয়নে আটকে থাকা কষ্টের লোনাজল বিস্মৃতির পথের সব ধুলো বালি সরিয়ে তার গাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে। মনে মনে ধ্রুব বলে নীলা, তুমি কাঁদো, আরো কাঁদো। হৃদয়ের গহীনে লুকানো জমাট বাঁধা কষ্টগুলো তোমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তোমার চারপাশের ঐশ^র্য, চাকচিক্যময় বর্ণালী জগৎ, অহংকার করার মতো অনাগত ভব্িযষ্যত তোমার ভেতরে ভেতরে পঁচা কাঠের অভ্যন্তরে উঁই পোকার মতো ক্ষয় করে ক্রমাগত তোমাকে দুর্বল করে চলেছে, তুমি কাঁদো, কাঁদতে কাঁদতে সব কষ্টের জলগুলো নিশে^ষ করে দাও। এক পলক দেখার অনাদিকাল প্রতীক্ষা, বিস্মৃতির বেড়াজাল সরিয়ে মায়াবী মুখের প্রাণোচ্ছল হাসি, ক্ষমাহীন উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বুকের মধ্যে তোমাকে পাওয়া, বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ তৃপ্তি সুধায় হৃদয় পরিপূর্ণতা পেয়েছে আজ।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভরা পূর্ণিমার অম্লান জোছনাকে স্বাক্ষী রেখে কতো নির্ঘুম রাত যে পার করেছ তার হিসেব আমি তোমাকে দিতে পারব না জানি, তবে জীবন ডায়রির খোলা পাতায় যে দুঃখ কষ্ট ,জ্বালা-যন্ত্রণা, নিগৃহিত নিপিড়িত সময়ের কালো দাগ, ব্যর্থতার চরম গ্লানি, হতাশার কৌশলগত পরিক্রমায় ডুবে থেকে দিনে দিনে যে নিজেকে নিশ্বেষ করে দিয়েছ তা আমি বেশ উপলব্ধি করতে পাচ্ছি।

ভালোবাসার প্রতি তোমার যে শ্রদ্ধাবোধ এ আমার চির চেনা, সময়ের পালাবদলে তোমার কষ্টার্জিত অতীত, দম বন্ধকরা আবেগ অনুভুতি, ক্ষয়ে যাওয়া আত্মার অতৃপ্ত বাসনা নীরবে নিভৃতে কেঁদে কেঁদে যে মধ্যরাতের বাতাশ ভারি করে তা কেবল তোমারই নিজেস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিয়ে। সেদিন কাঙ্খিত সম্বোধনে আমার কাঙ্গাল মন বড় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যেন বিবর্ণ এক ধুসড় রাতে প্রিয়ার নীল চোখে কেবলি খুঁজি রবির ঝলমলে আলোয় রাঙা প্রভাত। কোন এক সময়ে অসাধ্য সাধনের দৃঢ় প্রত্যয়ে আমার হৃদয় গহব্বরে ভালোবাসা ভীষণ বিদ্রহী হয়ে ওঠে, নাম নাজানা ফাগুনের আর্বিভাব হয়, শিহরে ওঠে ধমনীর রক্ত কণিকা গুলো। কারণে অকারণে তোলপার করে ওঠে, জলডাকাতের মতো ভীষণ উৎপাত শুরু করে বুকের ভিতর।

এক বকভরা প্রতীক্ষার নরকীয় প্রহরের অবসানে নিবিষ্ট ধ্যানে অনেক্ষণ বিভোর থাািক। মরুসাহারার খরা বুকে উত্তপ্ত মন একটু প্রশান্তির ক্যানভ্যাসে স্বস্থির রংতুলির আঁচড়ে ভবিষ্যত জীবনের রঙিন ছবি আঁকে। সাঁঝের মায়া কাটিয়ে নিসিদ্ধ রাতের একাকিত্ব ঘুচিয়ে যখন সাবলিলতায় ফিরে আসে অস্থির মন তখন ভীষণ চঞ্চল হয়ে ওঠে, শূন্য হৃদয়ের উর্বর জমিনে বিলাসী স্বপ্নের দু”ফোটা বৃষ্টি পড়ে। তাই স্বপ্ন বিলাসী মন ক্ষণিকের জন্য হলেও সেই জমিনে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনে।

জীবনের অগোছালো উঠোনে হঠাৎ এসে থমকে দাঁড়ায় চলমান বিবেক, নিজের বুকের উপর থেকে নীলাকে সরিয়ে নিয়ে ধ্রুব বলে-

একটু অপেক্ষা কর নীলা? দেখবে একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমার ভয় তো কেবল সেখানেই ধ্রুব? যেখানে অপেক্ষমান রাতের নীরবতা গুমড়ে কাাঁদে, আশার থলিতে লাল সালু কাপড়ে মোড়ানো থাকে জীবনের চাওয়া পাওয়া। পাহাড় সমান উঁচু নিচু পথ, চলতে গিয়ে পিচলে পড়ে দুমড়ে মুচড়ে যায় শরীরের অবয়ব। আমার ভাগ্যহত জীবনে একি নিয়তির নির্মমতা! জন্মের পাপে মাতৃ বিয়োগ, মমতার চাদরে মোড়ানো ভালোবাসার পরিবর্তে পেয়েছি রুক্ষতা, শাসনের ডাÐাবেড়ি। আমার আর এ নরকে বাঁচতে ইচ্ছে করে না ধ্রুব?

ধ্রুব নীলার মুখ চেপে ধরে বলে, ছিঃ অমন কথা মুখে বলতে নেই নীলা? আমি বলেছিতো একটু অপেক্ষা কর, আর কয়েকটা মাস। তারপর সকল জ¦ালা যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে আমাদের মিলন হবে কোন এক সুখের মোহনায়। হৃদয়ের আলিঙ্গনে পরম তৃপ্তির উষ্ণতায় আপ্লুত চোখ ভালোবাসার নিবিড় স্পর্শে কেবল নতুনত্ব খুঁজে পাবে। আধারের গায়ে রঙিন আলো মেখে আমরা সেদিন নবজীবনের স্বাদ খুঁজে বেড়াব । হৃদয়ের গোপন গলিতে লুকিয়ে রাখা প্রেম বিকশিত হবে তোমার শালিক জোড়া চোখে, হাজার বছর ধরে চলবে আমাদের এ পথচলা,তবুও কখনো হবে না শেষ।

ধ্রূব আমার মনের ভেতর কেন জানি এক অজানা আতঙ্কের সুর বার বার বেজে উঠছে, হয়তো এটাই আমাদের শেষ দেখা। আর কোনদিন দেখা হবে না। কথাগুলো বলার সময় থরথর করে তার ঠোঁট কাঁপছে, শরীরের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে গেছে। সে আর দাড়িয়ে থাকতে পাচ্ছে না ধপাস করে বিছানার উপর বসে পড়ল।

প্রকৃতির পালাবদলে দিন যায় রাত আসে, মাস যায় বছর আসে কিন্তু পরিবর্তন আসেনা অমোঘ নিয়োমের, অনাগত ভবিষ্যতের। অদম্য ইচ্ছে গুলোকে মাটি চাঁপা দিয়ে পুতে ফেলে সবার মনোরঞ্জনে নিজেকে আত্মহুতি দেয়। হৃদয়ের কোণে লালিত স্বপ্ন গুলোকে গুছিয়ে নেয়ার তিব্র বাসনা প্রতিকুলতার সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত, আপোষহীন দুর্বার তেজ দীপ্ত অস্থির চিত্ত কেবলি বারবার হারিয়ে যায় কালবৈশাখী ঝড়ে, ভেঙে যায় আকাশে উড়ানোর ডানা স্থিমিত হয়ে পড়ে মনের জোর বোবা কান্নায় থেমে যায় চঞ্চলতা, অদম্য সাহস বুকের শক্তি। নীলা গভীর রাতে বহু কষ্ট করে ধ্রুবকে একটা চিঠি লিখে-

প্রিয় ধ্রুব,

কোথায় আছ কেমন আছ জানিনা, অনেকটা স্বার্থপরের মতো তোমাকে ভুলে শুধু নিজেকে নিয়েই আমি বেশ আছি। সংসারের আঁচলে নিজেকে জড়িয়ে আমার সমস্ত ঐর্শ্বযকে উজার করে দিয়েছি সবার জন্য বিনিময়ে পেয়েছি শুধু ত্যাগের আনন্দ। এখানে পরিশ্রম করার অধিকার টুকুই আমার চরম প্রাপ্তি। মাথায় কয়েকগোছা চুল ছাড়া শরীরে অবশিষ্ট কিছুই নেই। গায়ের সোনা রঙ কালো হয়ে ঝরা পাতার মতো শুকিয়ে গেছে। সংসার জলধির বিশাল ঢেউয়ের বিপরীতে সাতার কাঁটতে কাঁটতে আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আর পাচ্ছিনা নিজেকে সামলে রাখতে। নিজের মানুষটা যে কিনা আমার সজ্জা সঙ্গী তাকে চাওয়াটাও যেন অরঙ্ঘণীয় পাপ। গভীর রাতে মাতাল হয়ে সে বাড়ি ফেরে শরীরের গন্ধে পাশে থাকা যায় না। চুলোয় যাক জীবন-যৌবন, সর্বনাশা শরীর। কি হবে বেঁচে থেকে বলো? শুধু কষ্টকে ধার করে জীবনের তাকে সাজিয়ে রাখা। তাই আমি স্থির করেছি এ জনমে তোমায় পাওয়া নাই বা হোল পরজনমে এ অধিকার টুকু পাওয়ার প্রত্যাশায় তোমাকে ছেড়ে গেলাম। ভালো থেকো ।

ইতি

তোমার নীলা।

শেয়ার করুন ..

Comments are closed.




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge