খলিফাতাবাদের সুন্দরি
মুস্তাফিজ রহমান
বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন। যখন থেকে সুন্দরবন সম্পর্কে জানি তখন থেকেই এই বনের প্রতি অন্য রকম আগ্রহ অনুভব করি। মনে মনে স্বপ্ন দেখি একদিন সুন্দরবন ভ্রমনে যাব। চাকরির কল্যাণে সেই সুযোগ তৈরি হল। অফিস থেকে সুন্দরবন ভ্রমনে যাবে। শোনার পর থেকে প্রহর গুনতে থাকি। অবশেষে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষন সবাই মিলে ঘুরতে গেলাম সুন্দরবন।
সন্ধায় যখন সৈয়দপুর রেল স্টেশনে সিমান্ত ট্রেনে উঠি তখনো জানতাম না আমার জন্য কত চমক অপেক্ষা করছে। বগির যেদিকে তাকাই সেদিকেই আমার পরিচিত মানুষ। ট্রেনের আস্ত দুটি বগি আমাদের জন্য ভাড়া করা হয়েছে। ট্রেনে বেশ একটা উৎসব উৎসব আমেজ। মৃদু শব্দ তুলে ট্রেন যাত্রা শুরু করলো। আনন্দ আড্ডা আর কোলাহলে আমরা চলেছি। রাতের প্রদীপের আলো জলা গ্রাম গুলো কখনো কাছে আসছে কখনো আবার দূরে হরিয়ে যাচ্ছে। সেই সৌন্দর্যে ডুবে থাকা আর হলো না। সহকর্মিদের হৈহুল্লোরে ভিতরে তাকাতে হল। থোকায় থোকায় আড্ডা চলছে। কোথাও আন্তাকসরি, কোথাও মজার কৌতুকে মেতে আছে। কেউবা কার্ড খেলায় মত্ব। ট্রেনের বগি গুলোকে তারা তুমুল আড্ডাখানা বানিয়ে রেখেছে। যে যার ইচ্ছে মত হেসে খেলে সময় পার করছি। ট্রেনের মাতাল করা দুলুনি আর আড্ডায় আমরা চলেছি। সময় খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। রাত দুপুরে দেখা মিললো লালন শাহ সেতু। ঝক ঝকাঝক শব্দ তুলে ট্রেন সেতু পার হচ্ছে পাশেই সড়ক সেতুর বর্ণিল বাতিগুলো তাদের আলোকছটায় আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। দীর্ঘ সেতু দিয়ে আমরা পদ্মা পার হলাম। দুলতে দুলতেই রাত পার করে দিলাম।
দীর্ঘ এগারো ঘন্টা পথ পারি দিয়ে আমরা খুলনা পৌছালাম। তখন ভোরের অন্ধকার কেটে সুর্য মামা উঠি উঠি করছে। প্রকৃতিও আরমোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠছে। আমরাও গা ঝারা দিয়ে নেমে পড়লাম। এ অঞ্চলে আমার মত অনেকেই প্রথম। তাই আমাদের সবার চোখ মুখে কৌতুহল। রেল স্টেশনের নামপ্লেটের সামনে ছবি তোলার লাইন লেগে গেল। কেউই সময় নষ্ট করতে চান না। ছবি তোলা শেষে আমরা রুপসায় কারিতাসের অফিসে গেলাম। শরীর জুড়ে একরাশ ক্লান্তি। সারা রাতের ক্লান্তি দুর করার জন্য ওয়াস রুমে ঢুকলাম। দেখি পানি বেজায় গড়ম। আবার নোন্তাও। যতই পানি ঢালি শরীর আরাম পায় না। কি আর করা এ অঞ্চলের আবহাওয়া গড়ম। তাই একেই মেনে নিতে হলো। নাস্তার পর নির্ধারিত আলোচনায় বসলাম। আমার তাতে মন নেই। বাইরে যাবার জন্য ছট ফট করছি। দুপুরের খাবারে দেখলাম সুস¦াদু সামুদ্রিক মাছ। খেতে ভালোই লাগলো।
আমরা বেরিয়ে পরলাম। নৌকায় রুপসা নদী পার হলাম। বাসে বাগের হাটের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম। পথ যেন ফুরাতেই চায় না। মনটা আকু পাকু করছিল ষাটগম্বুজ মসজিদ আর খানজাহান আলির মাজার দেখার জন্য। ১৫শ শতাব্দিতে সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ এর আমলে খান-আল আজম উলুগ খানজাহান আলি সুন্দরবনের কোল ঘেষা এ অঞ্চলে খলিফাতাবাদ নামে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি ষাটগম্বুজ মসজিদ সহ আরও অসংখ্য মসজিদ পুকুর খনন করেন। যা এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রতিক। ভাবতে ভাবতেই আমি ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখতে পাই। মনটা আনন্দে ভড়ে ওঠে। কিন্তু বাস না থামায় কিছুটা সংসয়ে পরি। পরে জানলাম আগে খানজাহান আলীর মাজার দেখবো তার পর ষাটগম্বুজ মসজিদ।
বাস যেখানে থামলো তার পাশেই বিশাল তোরন। তার ভিতর দিয়ে কিছুদুর এগিয়েই মাজার। মধ্যযুগীয় স্থাপত্তে নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট ইমারতের ভিতর শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন এক সময়ের পরাক্রমশালী রাজা সাধক খানজাহান আলি। মাজারের চার পাশের দেয়াল বেশ পুরু এবং সুন্দর কারুকার্য মন্ডিত। ভিতরে কবর জেয়ারতের ব্যবস্থা আছে। অনেকে সেখানে বসে দোয়া দরুদ পড়ছেন। মাজারের পাশেই রয়েছে বিশাল দিঘী। নাম ঠাকুর দিঘী। ধারনা করা হয় খানজাহান আলি কিংবদন্তির কুমির কালাপাহার আর ধলাপাহারে আরোহন করে এই দীঘিতে প্রথম এসে নামেন। যাদের বংশধররা এখনো নাকি দীঘিতে রয়েছে। মাজার থেকে হাটা পথেই ষাটগম্বুজ মসজিদ যাওয়া যায়। বিশাল প্রাচীর ঘেরা মসজিদ এলাকায় ঢুকতেই হাতের ডানে বাগের হাট যাদুঘর। সেখানে প্রবেশ করেই চোখে পরে কিংবদন্তির ধলাপাহার আর কালাপাহারের প্রতিমুর্তি। ছোট্ট ছিমছাম জাদুঘরটি খলিফাতাবাদ রাজ্যের বহু নিদর্শন সংরক্ষন করেছে। ১৫শ শতকের বিভিন্ন মাটির তৈজসপত্র, পাটালি, টালি আসবাব পত্র প্রাচীন বিনিময় মাধ্যম কড়ি মনে করিয়ে দেয় মধ্যযুগীয় বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থাকে। যাদুঘর থেকে বেরিয়ে সামনেই ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ। ধিরে ধিরে সে দিকে পা বাড়াই।
প্রায় ডের মিটার পুরু প্রাচীর ঘেরা এলাকার ভিতরে মসজিদ। পুর্ব দিকের প্রবেশ দারটি নিজেই একটা পুরাকীর্তি। সুন্দর লতাপাতার কারুকার্য মন্ডিত উচু ইমারতটি সত্যি একটা ছোটখাট ঐতিহ্য। ভতিরে প্রবেশ করার সময় মনে হচ্ছিল যেন আমি খলিফাতাবাদের রাজার সাথে সৌজণ্য সাক্ষাত করতে যাচ্ছি। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের ১১ টি দরজার সব চেয়ে বড় দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। বইয়ে পড়েছি ষাটগম্বুজ মসজিদের নাম ষাটগম্বুজ হলেও এর গম্বুজ সংখ্যা মোট ৮১টি। উপরে উঠে তো আর গনা সম্ভব নয়। তাই সেটি মেনে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। কিন্তু ভিতরের স্তম্ভ মোট ষটটিই রয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটি ইটের তৈরি বাকি গুলো পাথরের। ধারনা করা হয় পাথর গুলো আনা গয়েছিল রাজমহল থেকে। বহু বছর লেগেছে এই মসজিদ তৈরি করতে। কিন্তু কোথাও কোন শীলালিপি নেই। স্থাপত্য রীতি দেখে অনুমান করা হয় এটি ১৫শ শতকে নির্মিত। বিভিন্ন অলংকরণ আর লতাপাতার কারুকার্যে ভরা মসজিদের ভিতরটি এতো সুন্দর যে বের হতে ইচ্ছে করে না। সেখানে এখনো নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় হয়। যদিও ধারনা করা হয় খানজাহান আলি এটিকে নামাযের পাশাপাশি দরবার হল হিসেবেও ব্যবহার করতেন। মসজিদের প্রধান মিহরাবটিও লতাপাতার কারুকার্য মন্ডিত। লাল ইটের পুরু দেয়ালের ইমারতটি পাঁচ ছয়শত বছর ধরে বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ মসজিদের স্বীকৃতি ধরে রেখেছে। বর্তমানে এটি বিশ্ব ঐতিহ্য। মসজিদের চার পাশে ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল যেন আমি মধ্যযুগে পৌছে গেছি। রাজা খানজাহান আলি আমার সামনে তার মন্ত্রিদের নিয়ে রাজ্যের জটিল সমস্যা সমাধানে মত্ত।
মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ কোনে দুটি বিশাল রেইন ট্রি গাছ মসজিদের দিকে এমনভাবে হেলে আছে যেন তারা রাজার হুকুমে মসজিদ পাহারা দিচ্ছে। যদিও অত পুরোনো গাছের এতোদিন বেচে থাকবার কথা নয়। যেমন এর দক্ষিণের একটি তোরন আজ বিলুপ্ত। তবুও গাছগুলো ঐতিহ্যেরই ধারক-বাহক।
পশ্চিমের প্রাচীর ঘেঁষে রয়েছে বিশাল দিিঘ। নাম ঘোড়াদীঘি। তিনটি মৌজায় অবস্থিত দীঘিটি নিয়ে কিংবদন্তি খননের পর যখন পানি উঠছিলনা খানজাহান আলি ঘোড়ায় চড়ে এর চারদিক প্রদক্ষিণ করেন। সেই থেকে এর নাম ঘোড়াদীঘি। জানা যায়, খানজাহান আলি এ এলাকায় ৩৬০ টি মসজিদ ও দিঘী প্রতিষ্ঠা করেন। যা এখনো এ অঞ্চলের মানুষের উপকারে আসছে। মসজিদ এলাকার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে সেখান থেকে আর আসতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারনে বাধ্য হয়ে ফিরতি পথে পা বাড়াই।
মসজিদ এলাকা থেকে বের হয়ে রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। পিছনে তাকিয়ে দেখি আর একটি পুরাকীর্তি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এক গম্বুজ বিশিষ্ট শিংগাইর মসজিদ। এই ছোট মসজিদটিও তার আপন সৌন্দর্যে মহিয়ান। এর সামনে তিনটি ও দুইপাশে দুটি মোট পাঁচটি দরজা রয়েছে। ভিতরের মিহরাবটিও কারুকার্যময়। দেখেই বোঝা যায়, এটিও খান জাহান আলি নির্মাণ করেছেন।
আমাদের আরও দর্শনিয় স্থান দেখা বাকি। তাই ইচ্ছে থাকলেও কোথাও বেশি সময় ব্যায় করা সম্ভব নয়। তাই খলিফতাবাদ অর্থাৎ বাগের হাট থেকে ফিরতে হল খুলনায়। এখানে যতগুলো দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল রূপসা সেতু। আগেও অনেক সেতু দেখেছি কিন্তু এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট রয়েছে। নদীর উপরে সেতুর মূল অংশটি অনেক উচু এর নিচ দিয়ে অনায়াসেই বড় বড় লঞ্চ যাতায়ত করতে পারে। সেতুর দুই পাশে প্রায় আধা কিলো করে বর্ধিত অংশ। যার দুই পাশেই রাস্তা রয়েছে। এবং নদীর বাধে সেতুর নীচ দিয়েও রাস্তা রয়েছে। আরও আকর্ষণীয় হল নিচ থেকে উপরের সেতুতে ওঠার জন্য রয়েছে শিড়ি। যা আমি অন্য কোথাও দেখিনি। শিড়িগুলো এতো চওড়া যে দেখতে বড় শপিংমলের শিড়ির মত। রাতের রূপসা সেতু আরও সুন্দর। সেতুর উপরের বাতির আলো নদীর পানিতে আলেয়ার সৃষ্টি করে। সে এক মোহনিয় পরিবেশ। যে কারও মন রাঙিয়ে দেবে। সেতুর পাশে দাঁড়ালে মনে হয় যেন বিদেশের কোন সুন্দর পার্কে দাড়িয়ে আছি। রাতে খুলনা শহর ঘুরে দেখলাম। পুরণো শহর কিন্তু বেশ গোছালো এবং ছিমছাম। আমার বেশ ভালো লেগেছে। সারা দিনের ছুটোছুটিকে অবসর দিয়ে রেস্টুরেন্টে ফিরে আসি বিশ্রামের জন্য। কাল আরও চমক অপেক্ষা করছে।
ভোর পাঁচটায় বাসে উঠে বসি। রূপসা সেতু পার হবার সময় সুর্যের মিষ্টি রোদ গায়ে পড়ে। আকাশ বর্নিল সাজে সজ্জিত। প্রকৃতি যেন সেজেগুজে আমদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা চলেছি মংলার দিকে। এখানে উত্তরাঞ্চলের মত সমতল ভুমির দেখা পাওয়া দুরহ। রাস্তার দুপাশে যতদুর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। সেখানে কোথাও ঘেড় দিয়ে কোথাও বাঁধ দিয়ে মাছ চাষে ব্যস্ত চাষীদের পেশিবহুর শরীরে রোদ চিকচিক করছে। বেশির ভাগেই বাংলার হোয়াইট গোল্ড চিংড়ি। এটি মনে হয় বাংলার সবচেয়ে বড় মৎস্য উৎপাদন কেন্দ্র। যা দেশের চাহিদা পূরণ করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছে। রাস্তার দুই ধারে বাহারি গাছপালা। গাছগুলো পুরো রাস্তাতেই যেন প্রাকৃতিক ছামিয়ানা তৈরি করে রেখেছে। রাস্তায় যেতে যেতে বসুন্ধরা, যমুনা, ওমেরার বিশাল বিশাল গ্যস ডিপো চোখে পড়লো।
মংলায় পৌছে নাস্তা সারি। নদীর ওপারে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে লঞ্চ এম এল আখতার যে আমাদের সুন্দরবন দেখাবে। আমদের আর তর সৈছিল না। নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে লঞ্চে উঠলাম। ভেপুঁ তুলে লঞ্চ যাত্র শুরু করলো। কিছুদুর গিয়ে নামলো পশুর নদীতে। খরোস্রোতা নদীর পানি ঘোলা। দু’ধারে থরে থরে সাজানো অসংখ্য ছোট বড় লঞ্চ। যা বন্দরের মালামাল সর্বরাহে ব্যবহার হয়। লঞ্চ চলছে। দূরে সুন্দরবন দেখা যাচ্ছে। আমার আগে ধারনা ছিল সুন্দরবন মনে হয় এক দিনেই দেখে শেষ করা যাবে। আমরা আজই সমুদ্র পর্যন্ত দেখে শেষ করতে পারবো। কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিলো। বিশাল সুন্দরবনের অনেক অংশ এখনো মানুষের কাছে রহস্যাবৃত।
সূর্য আমাদের মাথার উপরে গনগন করছে কারো সে দিকে খেয়াল নেই। আমরা প্রায় সবাই লঞ্চ এর সাদে উঠে পড়েছি। ধিরে ধিরে আমরা সুন্দরবনের কাছে চলে আসলাম। তখন প্রবল বেগে জোয়ারের পানি সুন্দরবনে হুহু করে ঢুকছিলো। বনের গাছের গোড়া গুলো শিকড় সহ তলিয়ে যাচ্ছে পানিতে। মনে হচ্ছে যেন বন্যায় তলিয়ে যাবে। গোল পাতা গেওরা কেওরার গাছগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে তাদের নিজস্ব ভূবনে। গোল পাতা কিন্তু মোটেও গোল নয়। নারিকেল গাছের পাতার মত লম্বা। আমাদের লঞ্চটি বনের খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের সতর্ক চোখ বনের ভিতরে রয়েল বেঙল টাইগার, চিত্রা হরিণ আর কুমির খুঁজছিলো। কুমির নাকি নদীর পারে গা শুকায়। কিন্তু তাদের কারোই দেখা পাওয়া যাচ্ছেনা। তবে বনের গাছপালা আমাদের ভালোই আনন্দ দিচ্ছে। আকাশে অসংখ্য পাখির উড়াউড়ি। যদিও লঞ্চ এর শব্দে তাদের কলকাকলি আমাদের কানে আসছে না। কে যেন চিৎকার করলো ডলফিন বলে। আমরা সেদিকে তাকানোর আগেই মহাসয় পানিতে ডুব দিয়েছে। এবার বনের পাশাপাশি নদীর দিকেও শতর্ক নজর রাখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কালো ডলফিন উপরে লাফ দিয়ে পানিতে পড়লো। আবার সবার চিৎকার। এবার প্রায় সবাই ডলফিন দেখেছি। আমরা যত এগিয়ে যাচ্ছি বন ততই গভির হচ্ছে। বেশি দুর ভিতরে দেখা যায় না। আমরা গোলপাতা কেওড়া গেওড়ার সৌন্দর্য দেখছি আর এগিয়ে যাচ্ছি। স্বপ্ন আমাদের টাইগার দেখা তাই দৃষ্টি সরাচ্ছি না পাছে বাঘ এসে আমাদের দেখা না দিয়েই চলে যায়। সুন্দরবনের মধু খুবই বিখ্যাত। আমরা সেই বাওয়ালিদেরও খুঁজছিলাম। পেলে একটু সুন্দরি গাছের মধু চেখে দেখতাম। তাদেরও দেখা মিললো না। কিছুদুর পর পর সরু নালা বনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। নালাগুলোর অনধিকার প্রবেশ যেন প্রাণীদের বিচরনে বিশাল বাধার সৃষ্টি করেছে। সুন্দরবন দর্শনেই নদীর উপর বিশাল বিশাল জাহাজ চোখে পড়লো। এগুলো এতো বিশাল যে আমাদের লঞ্চটিকে মনে হচ্ছিল বিশাল দশতলা বিল্ডিংয়ের পাশে একটা ছোট টিন সেড বাসা। লম্বায় তিন চারশ মিটারতো হবেই। জানলাম গভীর সমুদ্রে এর চেয়ে তিন চার গুন বড় জাহাজ রয়েছে। এই লঞ্চটি মুলোতো সেই জাহাজের যাত্রি আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার হয়।
সময় কত হল সেদিকে কারো খেয়াল নেই। সবাই বনের সৌন্দর্য উপভোগে ব্যাস্ত। আমাদের লঞ্চটি একটি চিকন নালা ধরে চলতে লাগলো। নালাটি এতো চিকন যে হাত বাড়ালেই গোল পাতা ছোঁয়া যায়। পাশেই দেখলাম একটি চিত্রা হরিণ পানি খাচ্ছে। পিছনে গোল পাতার ফাকে দাড়িয়ে আরও কয়েকটি। আমরা হরিন দেখার আনন্দে প্রায় সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠলাম। ফলে হরিন দিলো ছুট। আমি ক্যামেরা তাক করার ব্যস্ততায় ভালো করে দেখতেই পেলাম না। পরে দেখলাম ক্যমেরাতেও ছবি তুলতে পারিনি। আবসোস্ আর দেখে কে। যেন হাত ফসকে মহামূল্যবান সম্পদ জলে পরে গেল।
লঞ্চ থামলো হাড়বাড়িয়া ইকোটুরিজম কেন্দ্রে। এই স্থানটি রয়েলবেঙ্গল টাইগার আর চিত্রা হরিনের বিচরণ ক্ষেত্র। লঞ্চ থেকে নেমে যখন সুন্দরবনে পা রাখলাম নিজেকে বেশ গর্বিত লাগলো। মনের আনন্দ এমন যেন পৃথিবী জয় করে ফেলেছি। দৌড়ে বনের ভিতরে প্রবেশ করতে যাবো এমন সময় পিছন থেকে ডাক পড়লো। বলা হল এটা খুব ভয়াবহ স্থান। একলা গেলে যেকোন সময় বাঘের অক্রমনের শিকার হতে পারি। তাই আমাদেরকে গান ম্যান দেয়া হল। আর কোন রকম শব্দ করতে নিষেধ করে দয়ো হল। আমরা হাইকিংয়ের নিয়মে সারিবদ্ধভাবে বনে প্রবেশ করলাম। সামনে একজন আর পিছনে একজন গানম্যান। আমি সবার সামনে। মাঝে মাঝে গানম্যানকেও ছেড়ে যাচ্ছি। খাল পারাপারে একটা ঝুলন্ত সেতু দেখলাম সেটি কাপ্তাই লেকের ঝুলন্ত সেতুর কথা কনে করিয়ে দিল। সেতু পার হয়েই অবাক বিশ্বয়ে তাকিয়ে রইলাম। ম্যনগ্রোভ বা শ্বাষমুল, যার জন্য সুন্দরবন পৃথিবী বিক্ষাত। মিনিয়েচার মন্দিরের মত দাড়িয়ে আছে থরে থরে শ্বাষমুল। এটি না দেখলে সুন্দরবন দেখা অসম্পুর্ণ থেকে যেত। আর দেখলাম শ্বাষমুলের ভিতরে সুন্দর সুন্দর লাল কাকড়া। আমি এর আগে এরকম কাকড়া দেখিনি। এতো সুন্দর যে ধরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু উপায় নেই। এরা এতোটা চালাক যে ধরতে গেলেই ফুরুৎ করে গর্তে ঢুকে পড়ে। অনেকটা লুকোচুরি স্বভাবের। আর একটু সামনে গিয়ে দেখলাম বিশাল দীঘি। দীঘির মাঝখানে সুন্দর গোল ঘর। এখানে নাকি বাঘ আর হরিণ পানি খেতে আসে। আর একটু সামনে এগিয়ে কাঠের পাতাটনের তেরি উচু রাস্তা। প্রায় পাঁচ ফুট উচু রাস্তা পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা হয়েছে। আমরা পতাটনের উপর দিয়ে হাটতে শুরু করলাম। আমাদের বলা হয়েছিলো শব্দ না করতে। কিন্তু এতোগুলো মানুষের পায়ের শব্দে আর নিরবতা রক্ষা হল না। আমাদের দুই পাশে সুন্দরি গাছের সারি। যেন কেউ নিপুন হাতে সারিবদ্ধভাবে গাছগুলো রোপন করেছে। চোখ ধাধানো তাদের সৌন্দর্য। কিছ কছিু সুন্দরি এতোটাই বৃদ্ধ যে তাকে আর সুন্দরি বলে ডাকার উপায় নেই। অবশ্য তরুনী সুন্দরীগুলো দেখতে ছিপছিপে তন্বি সুন্দরিই বটে। নিচে কাদা পানিতে হরিণের তাজা পায়ের ছাঁপ দেখা গেল। গানম্যান বললেন আধাঘন্টা আগেই তাদের একটি শিাল দল এখানে ছিল। যেহেতু আমরা নিরবতা রক্ষা করতে পারিনি তাই আমাদের হরিণ দেখার চেষ্ট বৃথা গেল। কারন হরিণ নিজের পায়ের শব্দ শুনলেও দৌড় দেয়। ধীরে ধীরে বন আরও গভীর হলো। আমাদের তখন গা ছম ছমে অবস্থা এই বুঝি ওৎ পেতে থাকা বাঘ আক্রমন করে বসে। এক স্থানে দেখলাম একটা ঝোপের ধারে একটু গোছালো। মনে হল এটা কোন প্রাণীর বাসা। গানম্যান বললেন এখানে কিছুদিন আগে একটা বাঘ বাচ্চা প্রসব করেছে। আমাদের ভয় আরও বেড়ে গেল। যতদুর জানি বাচ্চাওয়ালা বাঘিনীরা বেশি হিংস্র হয়। না জানি সে আশপাশে কোথাও ওৎ পেতে আছে কিনা। আমরা দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলাম। বন যত গভীর হচ্ছে নানান পাখির কলকাকলি ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাথার উপর দিয়ে গাঙচিলের মত কিছু একটাকে উড়ে যেতে দেখলাম।
হাড়বাড়িয়ায় গহীন বনের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে সামনে পেলাম পর্যবেক্ষন টাওয়ার। শরীর টানছিল না। তবুও মনের জোরে উপরে উঠলাম। প্রায় চার তলা উপর থেকে সুন্দরবনকে মনে হল যেন বিশাল সবুজ গালিচা বিছিয়ে কোন দুর দেশের রাজকুমারের অপেক্ষা করছে।। যত দুর চোখ যায় সবুজের ছড়াছড়ি। আর নানা জাতের পাখির কলকাকলিতো রয়েছেই। সেখানেই সবুজের সমারহে খানিক বিশ্রাম নিলাম। বন এতোটাই ঘনো যে কোথাও মাটি দেখা যায় না। সুন্দরির মগডালে পাখিদের গুনজন শুনতে শুনতে নিচে নেমে এলাম। ঘুরতে ঘুরতে পুর্বের জায়গায় ফিরে এলাম। গোল পাতা যদিও গোল নয় কিন্তু এর ফল গোল। ঠিক বিচি কলার মত। তবে আকারে ছোট। ফলটি নাকি বেশ সুস্বাদু। বন কর্মকর্তার অফিসের সামনে ছোট সুন্দরি গাছ দেখলাম। হালকা সবুজ ছোট কাঠাল পাতার মত দেখতে পাতা গুলো। প্রথমে কাঠাল গাছ ভেবে ভুল করলাম।। সত্যি সুন্দরের আভিযাত্য রয়েছে এ গাছে। শ্বাসমুল, সুন্দরী, লাল কাকড়ার সৌন্দর্যে এতোটাই বুদ ছিলাম যে আর কিছু ভাবতে পারিনি। এদিকে লঞ্চ ছাড়বে ছাড়বে ভাব। কার যেন ডাকে দৌড়ে গিয়ে লঞ্চে উঠলাম। হড়বাড়িয়াকে বিদায় জানিয়ে বনের ভিতর দিয়ে আমাদের লঞ্চ পশুর নদীতে এসে নামলো।
নদীতে লঞ্চ এগিয়ে চলছে। বন থেকে সুন্দরিরা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আরও কিছুক্ষন থাকতে মন টানছিল। ডেক থেকে সুন্দরীদের হাতছানি ভালো দেখা যায়। তাই ডেকে উঠে বসলাম। সুন্দরবনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ঠিক যেন মাতাল প্রেমিক। লঞ্চের শব্দ একটু বাড়লো। সেই শব্দে সম্ভিত ফিরে পেলাম। লঞ্চ কিভাবে চলে কখনো দেখা হয় নি। তাই সারেং মাস্টারের ঘরে গেলাম। গল্পে গল্পে ভাব জমিয়ে নিলাম। চালানো খুব একটা কঠিন মনে হল না। তাকে বলে হুইল ধরলাম। কিছুক্ষন চালালাম। সে এক অন্য অনুভুতি। মনে হল যেন আমরা বহুদূরে বানিজ্যে যাচ্ছি আর তার কান্ডারি আমি। আমার উপরেই সবার বাঁচা মরা। এবার নিচে গেলাম। দেখি চিংড়ি মাছ রান্না হচ্ছে। পেট মোচর দিয়ে উঠলো। বুঝলাম ভালোই ক্ষুধা লেগেছে। রান্নার স্বাদ ভেষে এসে ক্ষুধা আরও দ্বিগুন করে দিল। লঞ্চেই খাবারের ব্যাবস্তা হল।
বন থেকে বেশ দুরত্ব বজায় রেখে লঞ্চ থামলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই বনের ধারে গাছের ডালে বানরের দেখা মিললো। সে নেচে নেচে আমাদের আনন্দ দিচ্ছে আর প্রাণ পণে চেষ্টা করছে আমাদের কাছে আসার। কিন্তু পানির জন্য আসতে পাড়ছে না। পানিতে হেলে থাকা গাছের ডাল ধরে যতদুর আসা যায় সে তার সর্বোচ্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। পানিতেও নামার চেষ্টা করলো। পরে দেখি আরও এক পাল বানর এসে জড়ো হয়েছে। তারা যার যার ইচ্ছেমত অবস্থান নিল। ধীরে ধীরে তাদের দলটি বড় হতে লাগলো। লঞ্চের লোকজন বানরের বাদরামি সম্পর্কে আগে থেকেই জানে। তাই তারা নদীতেই আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছিল। বনের ভিতরে হলে খাওয়া সম্ভব ছিল না। এটা তাদের রাজ্য। এখানে তারা প্রাণীকে কেন গ্রাহ্য করবে। খাওয়া শেষে যে যার মত বাদরামি শুরু করলো। কেউ হাতের ইশারায় কেউ শিষ দিয়ে তাদের ডাকতে লাগলো। বেশ জমে উঠলো বানরে আর মানুষে আড্ডাবাজি। বলা যায় বাদরামি। কেউ কেউ খাবার ছুড়ে দিল। সেই খাবার নিয়ে শুরু হল শক্তির লড়াই। প্রথমে একটি ছোট বানর সেটি পেলেও বড় বানরের আগমন টের পেয়ে সে খাবার রেখেই জান নিয়ে পালালো। বুঝলাম এদের এখানেও মানুষের মত ক্ষমতার লড়াই ভালোই চলে। বানরের সাথে বাদরামির ফাকেই আমাদের লঞ্চ যাত্রা শুরু করলো।
এবার এসে দাড়ালো করমজল ইকোটুরিজম কেন্দ্রে। এটি মুলতো সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার। আমরা এখানে নেমেই বাদরের পাল্লায় পড়লাম। এবার তাদের ভাব টা এমন ছিল যেন তারা ঘটা করে বানরের রাজ্যে স্বাগতম জানালো। মানুষের এতো কাছে এসেছে যেন হাত বাড়ালেই হ্যান্ডসেক করবে। কেউ কেউ আবার গার্ড অব অনার দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের একজন তাদের খাবার দিলে সেখানেই খাওয়া শুরু করলো। যেন বানরে মানুষে সহাবস্থান। এটি মুলত চিত্রা হরিণ আর কুমিরের প্রজণন কেন্দ্র। এখানে সুন্দরবনের একটি স্বচিত্র মানচিত্র রয়েছে। পাশে রাখা হয়েছে রয়েল বেঙল টাইগারের আস্ত কংকাল, চামড়া আর হরিনের মাথার খুলি। যেন বাঘটি কিছুক্ষন আগেই হরিণটিকে বধ করেছে। হাড়বাড়িয়ার মত এখানেও বন দেখার জন্য কাঠের পাটাতনের উচু রাস্তা রয়েছে। আমরা সে পথে কিছুদুর এগিয়ে বিশাল হরিণের পাল দেখলাম। তবে উন্মুক্ত নয় প্রাচীরে আটকানো। মুলোত প্রজণনের জন্য এদেরকে এখানে কিছুদিন রাখা হয়। বাচ্চা বড় হলে তাদের আবার বনে ছেড়ে দেয়া হয়। এখানে হরিণ দেখা আর চিড়িয়াখানায় হরিণ দেখার মধ্যে পার্থক্য করতে পারলাম না। তবুও দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নিলাম। হরিণের গায়ে হাত দিয়ে ছবি তুললাম। আগেতো হরিণের ছবিই তুলতে পারিনি। এখানে এটি বোনাস। হরিণ দেখে একটু এগিয়ে বিশাল পুকুর। সেখানে গোল গোল চোখ তুলে শুয়ে আছে বিশার কুমির। দেখে বেশ ভদ্রই মনে হল। কেন যে এদের হিংস্র বলে অপবাদ দেয়। তার সামনেই ছোট বড় অনেকগুলো সেড। এর ভিতরে কিলবিল করছে কুমির ছানা। দেখতে আমাদের এলাকার গুই সাপের মত। ছোট বেলায় যার লেজে দড়ি লাগিয়ে এলাকায় ঘড়িয়েছি। বেশ দশ বারটি সেডে কুমির ছানার অলস বিচরণ। একে অন্যের পিঠে উঠে মজা করছে। এ কুমির গুলোও রাখা হয়েছে বড় করে সুন্দরবনের নদীতে উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য। সুন্দরবন দিন দিন তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বন্য প্রাণীর দল। সেই সব প্রণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার এই প্রচেষ্টা সত্যি প্রশংসনিয়।
এখানে একটি ডলফিনের ছবির গ্যলারি রয়েছে। তথ্য বহুল এই মিনি গ্যালারি থেকে জানা যায় শুশুক, ইরাবতি তথা মিঠা পানির ডলফিন সম্পর্কে। মানুষের বন্ধু এ প্রাণীটি দিন দিন হাড়িয়ে যাচ্ছে। এক সময় দেশের সব নদীতেই এদের দেখা মিলত। মানুষের অজ্ঞতা আর অবহেলায় এরা আজ প্রায় বিলুপ্ত। জলবায়ুর পরিবর্তন, উজানে বাঁধের ফলে নদীতে লবনাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে ফলে সুন্দরবন এলাকায় এদের আর আগের মত চোখে পড়ে না। এখানে ইরাবতির কংকাল রয়েছে। এ প্রানিটির বিলুপ্তির খবর শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমাদের রয়েল বেঙল টাইগারও বিলুপ্তির পথে। করমজলের বিলবোর্ড এর পরিসংখ্যান বলছে ৬০১৭ বর্গকিলোমিটারের সুন্দরবনে মাত্র ১০৬ টি বাঘ রয়েছে। বহু প্রজাতির প্রাণী এখন বিলুপ্ত। এসব খবরে বাঙালী হিসেবে যে কারও মন খারাপ হবে। ছবি গ্যালাড়ি থেকে বের হয়ে উঠলাম পর্যবেক্ষন টাওয়ারে। টাওয়ার থেকে একসাথে হরিণ, কুমির, বানর, নদী, বন সব দেখা যায়। সে এক আশ্চর্য সুন্দর পরিবেশ। বনের কিছু অংশ ঘুরলাম। এখানেও গোল পাতা ঝোপের নিচে বাঘের বাসার মত কিছু একটা চেখে পড়ল। পশ্চিম আকাশে সূর্য পাটে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে তাই ইচ্ছে থাকলেও আর থাকা গেল না। বনে থাকার নিয়ম নেই। সুন্দরবনের পাখ পাখালির মধুর কলকাকলির ছন্দে দুলতে দুলতে আমরা রওয়ানা হলাম। লঞ্চ এগিয়ে চলেছে পিছনে সুন্দরবন তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের বিদায় জানিয়ে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। আমাদের আনন্দ যাত্রা শেষ হতে চলেছে। মনে হল এর পর যদি আসি কম পক্ষে এক মাসের জন্য আসবো। এতো বিশাল সুন্দরবনের এক চিমটি দেখে মনে অতৃপ্তি রয়ে গেল।
আমি ডেকে বসে সুন্দরিদের শেষ দর্শনে ব্যস্ত পাশ থেকে কোরাস গান ভেসে এলো ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি……….’। আমিও সেই কোরাস গানে সুর মেলালাম।।
লঞ্চ মংলায় আমাদের নামিয়ে দিল। সেখান থেকে খুলনা এসে ট্রেনে চেপে বসলাম। মধ্য যুগের সুন্দরবনের কোল ঘেষা খলিফাতাবাদের রাজার ষাটগম্বুজ মসজিদ আর বাংলার ফুসফুস সুন্দরবন জয়ের আনন্দ আমাদের তনুমনে। ঝক ঝকাঝক ট্রেন চলতে শুরু করলো। আমরা আবারো থোকায় থোকায় আড্ডায় মেতে উঠলাম। গভীর রাতে কে কখন কিভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। চোখ খুলে দেখি আমরা সৈয়দপুরে পৌঁছে গেছি। আমার সবুজে শ্যমলে ভরা ধান ক্ষেত সকালের মিষ্টি রোদে তাদের গায়ের শিশির শুকাচ্ছে আর আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মনে মনে আওড়ালাম হায় খলিফাতাবাদের সুন্দরী সুন্দরবন এক দিন এসো আমাদের এই উত্তর বাংলায়। দেখে যেও সমতলের সৌন্দর্য।